সরল গরল-পঞ্চদশ সংশোধনী আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য by মিজানুর রহমান খান
পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জযোগ্য। কারণ, এর মাধ্যমে শুধু সংসদের সার্বভৌমত্ব নয়, সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ-ক্ষমতাও প্রকারান্তরে সীমিত করা হয়েছে। আড়াই বছর ধরে আমাদের যেসব কথা শুনে কান ঝালাপালা হয়েছে তা হলো, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের অযোগ্য।
সামরিক শাসকেরা মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করেছেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তা উদ্ধার করেছেন। কিন্তু বাস্তবে জনগণকে আবারও বিরাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর সংবিধান তৈরির ইতিহাসে যা হয়তো কেউ কখনো কল্পনা করেনি, সামরিক শাসকেরাও করেননি, বর্তমান সংসদ ঠিক সেই কাণ্ড করেছে। তারা পাইকারি হারে সংবিধানের ৫০টির বেশি অনুচ্ছেদকে চিরকালের জন্য ‘সংশোধনের অযোগ্য’ ঘোষণা করেছে। এ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে দুনিয়ার সংবিধানবিষয়ক পণ্ডিতেরা হয়তো হাসাহাসির সুযোগ পাবেন।
মৌলিক কাঠামো ভারতীয় বিচারকদের বহুল ব্যবহূত একটি ডকট্রিন। তবে কোন বিষয়গুলো মৌলিক কাঠামো, সে বিষয়ে তাঁরা কখনো একমত হতে পারেননি। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট অষ্টম সংশোধনীতে তা প্রথম অনুসরণ করেন; কিন্তু তাঁরাও যথারীতি একমত হতে পারেননি। এটা সম্ভবত একমত হওয়ার বিষয়ও নয়। অষ্টম সংশোধনীতে মৌলিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি দ্বাদশ সংশোধনীতে পাল্টে সংসদীয় পদ্ধতি হয়ে যায়। বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী সংবিধানের ২১ অনন্য বৈশিষ্ট্যের তালিকা তৈরি করেন। নির্দিষ্ট না করে তিনি তাঁর রায়ে বলেছিলেন, এর মধ্যে ‘কতিপয়’ সংশোধনের অযোগ্য। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আটটি মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করেছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে তা গুরুত্বহীন। আর বিচারপতি এ টি এম আফজাল তো এর পুরোপুরি বিরোধী।
৫০-এর চিরযৌবন প্রাপ্তি: পঞ্চম সংশোধনীতে জিয়াউর রহমান তাঁর পছন্দের মাত্র চারটি অনুচ্ছেদ রক্ষা করতে গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ গণভোট বাতিল করে। কিন্তু জিয়ার কৌশলটা ঠিকই নেয়। প্রথমবারের মতো সংবিধানের প্রায় ৫০টি অনুচ্ছেদকে তারা চিরকালের জন্য ‘সংশোধনের অযোগ্য’ করেছে। তবে জিয়া ও এরশাদ যা করেননি, আওয়ামী লীগ তা-ই করল। বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মকে তারা অনন্তকালের জন্য সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
সংবিধানের নতুন ৭খ অনুচ্ছেদ বলেছে, সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য। ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ১১টি আছে], দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ১৮টি আছে], নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ২৩টি আছে] এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।’ কেন এই বিধান? এর সঙ্গে কি তাহলে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কোনো সম্পর্ক আছে? এর উত্তর হলো, না। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বাগাড়ম্বর রাজনীতির সম্পর্ক আছে। বিসমিল্লাহ, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম, জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির পিতার প্রতিকৃতি, সাতই মার্চের ভাষণ—এ ধরনের যা আছে, তার সবটাই ‘সংশোধনের অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিধানের জন্য হয়তো রক্ষাকবচের দরকার ছিল।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংসদে বিল পাসের আগমুহূর্তে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ‘কেশবানন্দ ভারতী মামলা’র দোহাই দেন। ১৯৭৩ সালের এই মামলাতেই ভারত প্রথম ‘ডকট্রিন অব বেসিক স্ট্রাকচার’ প্রয়োগ করে। আইনমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ইন্দিরা গান্ধী আদালতের রিভিউ-ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। কিন্তু এই মামলায় সেই সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হয়। কথা সত্য। কিন্তু আইনমন্ত্রী ও তাঁর সরকার এখন যে কাণ্ড করলেন, তা ইন্দিরাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম, অর্থাৎ গাছের ও তলার দুটোই চাই। তাই ওই দুটোকে একসঙ্গে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো করা হয়েছে। প্রকারান্তরে আইনমন্ত্রী নিজেই কৌশলে আদালতের রিভিউ-ক্ষমতা হরণে ব্রতী হলেন। কেশাবানন্দ মামলার রায়মতেই তাই নতুন সংশোধনী বাতিলযোগ্য কি না, তা যাচাইযোগ্য মনে করি।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে ওই কেশবানন্দে দেওয়া ভারতের প্রধান বিচারপতি এস এম সিক্রি বর্ণিত পাঁচটি মৌলিক কাঠামোর উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রজাতন্ত্রী ও গণতন্ত্রী সরকার, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণ এবং সংবিধানের ফেডারেল চরিত্র। এই মামলার বিচারকসংখ্যা যে ১৩, বিল পাসের দিন আইনমন্ত্রী সেটাও শুনিয়েছেন। কিন্তু তিনি আংশিক বলেছেন। পুরো গল্প হলো, মৌলিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে ওই ১৩ জন রায় প্রদানে একমত হননি। তাঁরা বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন (৯: ৪)। এমনকি মৌলিক কাঠামোর তালিকা তৈরিতেও তাঁরা একমত হতে পারেননি। বিচারপতি শিলাত ও গ্রোভার ওই পাঁচটি ছাড়াও জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতা, মৌলিক অধিকারভাগে বর্ণিত ব্যক্তির মর্যাদা, কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগের ম্যান্ডেটকে ‘সাংবিধানিক কাঠামোর মূল উপাদান’ হিসেবে বর্ণনা করেন। অন্যদিকে বিচারপতি ওয়াই বি চন্দ্রচুঁড় (পরে প্রধান বিচারপতি) শুধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক কাঠামো বলেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি লেখেন, রাষ্ট্রের একটি বেসিক পিলার হচ্ছে, The State shall have no religion of its own (রাষ্ট্রের নিজের কোনো ধর্ম থাকবে না)। সরকার হয়তো জনগণকে বোকাই ভাবে, না হলে আইনমন্ত্রী একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম আখ্যা দিয়ে কোন মুখে সংসদে দাঁড়িয়ে কেশবানন্দ মামলা ও তাঁর ১৩ বিচারকের ঐতিহাসিক রায়টির কথা মুখে আনেন?
সবচেয়ে লক্ষণীয়, বিচারপতি খায়রুল হকও তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন যে, These cannot be catalogued but can only be illustrated। অর্থাৎ মৌলিক কাঠামোর তালিকা করা চলে না। এটা শুধু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অথচ আইনমন্ত্রী এর দোহাই দিয়ে জাতিকে ৫০+ মৌলিক কাঠামোর একটি দীর্ঘতম তালিকা উপহার দিয়েছেন। এটা শতাব্দীর রসিকতা।
সংবিধান বলেছে, ৫০টি অনুচ্ছেদে ‘সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।’ ‘অন্য কোন পন্থায়’ বলে কি তাঁরা আদালতকেও বাঁধেননি? উপরন্তু তাঁরা ওই ৫০টির বাইরেও অনির্দিষ্টসংখ্যক ‘সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো’ আবিষ্কার করেছেন। এমনকি ৭খ অনুচ্ছেদটিকেও মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করে এটিও সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, সংবিধানের অর্ধশতাধিক অনুচ্ছেদ চির অযোগ্য ঘোষণার চেয়ে জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত গণভোট প্রথা ছিল অধিকতর গ্রহণযোগ্য। জিয়াকে গালি দিতে দিতে তাঁর বহু কিছু নতুন করে ধারণ করেছে পঞ্চদশ সংশোধনী। তাই সামরিক ফরমানের গন্ধ মুছতে গণভোট মুছে দেওয়ার নীতি কপটতা। আওয়ামী লীগ হাস্যকরভাবে ভবিষ্যতের দুয়ারে তালা মেরেছে কিংবা ঘড়ির কাঁটা বন্ধ করেছে।
বিল পাসের সকালে বিশেষ কমিটির দুজন সদস্যকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তাঁরা দ্রুত একমত হন যে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হতে পারে না। তাঁরা দুজনেই জানেন যে সংবিধানেই লেখা আছে, মূলনীতিগুলো আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়।
রাষ্ট্রদ্রোহ ও দণ্ডবিধি: এবার আসুন দেখি, অবৈধ ক্ষমতা বন্ধে কী করা হয়েছে। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদকে ঘাড়ে রেখে ভবিষ্যতের এরশাদ মার্কা ব্যক্তিদের বিচারে ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’ নিশ্চিত করেছে সরকার। কিন্তু তাতেও গোঁজামিল। সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে কার্যত ‘নতুন অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে আপিল বিভাগের নির্দেশনা ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। পাকিস্তান, আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর সংবিধান দেখে ৭ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ ওই সব দেশ এমন অপরাধকে ‘হাইট্রিজন’ বা ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেছে। রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান। সেখানে আমাদের দণ্ডবিধির ১২৪ক আছে। পাকিস্তান তাই হাইট্রিজনকে সেডিশনের চেয়ে গুরুতর অপরাধ সংজ্ঞায়িত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অবশ্য এই বিধান বুটের তলায় রেখে ভুট্টোকে ফাঁসি দিতে জিয়াউল হককে বেগ পেতে হয়নি।
সংসদে পেশ করা বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে ৭ক অনুচ্ছেদে ‘সংসদের আইন দ্বারা’ কথাটি ছিল। কিন্তু বিলে তা তুলে ‘প্রচলিত আইনে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ক্ষমতা জবরদখল ‘নতুন অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হলো না। এখন এক দেশে একই নামের অপরাধের দুই রকম সংজ্ঞা ও দুই ধরনের শাস্তি বহাল হলো। দণ্ডবিধির রাষ্ট্রদ্রোহ আর সংবিধানের রাষ্ট্রদ্রোহ এখন যে এক নয়, এটাও একটা কৌতুকপ্রদ ঘটনা।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ড. আনিসুজ্জামানের আইন শব্দকোষে বলা আছে, ‘সেডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহ হলো সাধারণ মানুষকে দাঙ্গা, হাঙ্গামা বা গণ-অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করিতে পারে এরূপ কথা বলা বা লেখা। দণ্ডবিধি ১২৪(ক) ধারা অনুসারে, যে ব্যক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকারকে, যেকোনো প্রণালীতে রাষ্ট্রপতি বা সরকারের যেকোনো আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার জন্য বা প্রয়োগ করা হইতে বিরত করিবার জন্য প্রলুব্ধ বা বাধ্য করিবার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতিকে বা সরকারকে আক্রমণ করেন বা অবৈধভাবে বাধা প্রদান করেন কিংবা অবৈধভাবে বাধাদানের উদ্যোগ করেন, অথবা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগের ভান করিয়া ভয়াভিভূত করিবার উদ্যোগ করেন, সে ব্যক্তি ৭ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
এখন সংবিধানের নতুন ৭ক অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ ধরন ও সংজ্ঞা দণ্ডবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। একই দেশে দুই রকম ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ আইন ও বিচার চলতে পারে কি? সর্বোচ্চ শাস্তির অর্থ নিয়েও দুই রকম মত পাওয়া গেছে। বিল পাসের পরপরই প্রশ্নের জবাবে বিশেষ কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বলেন, ‘সর্বোচ্চ দণ্ডের অর্থ হলো মৃত্যুদণ্ড।’ কিন্তু বিশেষ কমিটির অপর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বললেন, ‘এটা দণ্ডবিধির আওতায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা বুঝতে হবে।’ এই ব্যাখ্যা সঠিক হলে অবৈধ ক্ষমতা দখলের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মাত্র সাত বছর। আর যদি মৃত্যুদণ্ড বোঝায়, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াবে—এই রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার হবে কোন আইনের আওতায়। সংশয় এখানেই শেষ নয়।
পাকিস্তানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদটির অবিকল হলো ৭ক অনুচ্ছেদের প্রথম দফা। এরপর আর কোনো কথা থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই ৭ক-তে দ্বিতীয় দফা কেন যুক্ত করা হলো। এতে বলা আছে, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে।’ এ ধরনের বিধান অন্যত্র নেই। নাগরিকের আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে টানাটানির কারণ এমনও হতে পারে, সংবিধানে যা নতুন ঢোকানো হয়েছে এর নিন্দুকদের ভয় দেখানোর জন্য। বিশেষ কমিটির সদস্যরা এর আগে আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর কথা আমাদের শুনিয়েছিলেন। কিন্তু নকল করার সময় পাকিস্তানকে অনুসরণ করেন। অথচ আর্জেন্টিনার সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদটি অধিকতর সুরক্ষিত। এর কথা হলো, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা সংবিধান স্থগিত করলেও তা কার্যকর হবে না; সংবিধান বহাল থাকবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহতভাবে টিকে থাকবে। তাঁদের অবৈধ কর্ম চিরকালের জন্য বাতিল বলে গণ্য হবে। তাঁরা কখনোই কোনো পাবলিক অফিস ভোগ করতে পারবেন না, চিরকালের জন্য ক্ষমার অযোগ্য থাকবেন। ৩৬(৪) অনুচ্ছেদ এ-ও বলেছে, জবরদখলকারী শক্তির বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার অধিকার থাকবে।
আমরা দেখলাম, বড় বড় কথা বলে আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে একটা অস্পষ্ট ও গোঁজামিলের বিধান জুড়ে দিল। তবে আপাতত আমাদের বড় আগ্রহের বিষয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর নামে মৌলিক কাঠামো হরণ-প্রক্রিয়ার বৈধতার প্রশ্নটি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্করণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুমীমাংসিত মৌলিক কাঠামো এবারও সংবিধানে সৃষ্টি করা হলো না। আইনমন্ত্রী নিশ্চয় জানেন, ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’কেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আমরা তার স্বীকৃতি পেলাম না। পরোক্ষভাবে সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ-ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াসটি অবশ্য রাষ্ট্রধর্মসংক্রান্ত রিটের শুনানিতে যাচাইযোগ্য। ড. কামাল হোসেনকে সবটা খুলে বললাম। তিনি অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জুলাইয়ে আদালতে যাবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে তাঁর একটি প্রশ্ন দিয়েই আজকের লেখাটি শেষ করি।
ড. কামাল হোসেনের প্রশ্নটি এ রকম: ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেবে না। ২ক অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। একসঙ্গে এই দুটি বিষয় কী করে মৌলিক কাঠামো হতে পারে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
পৃথিবীর সংবিধান তৈরির ইতিহাসে যা হয়তো কেউ কখনো কল্পনা করেনি, সামরিক শাসকেরাও করেননি, বর্তমান সংসদ ঠিক সেই কাণ্ড করেছে। তারা পাইকারি হারে সংবিধানের ৫০টির বেশি অনুচ্ছেদকে চিরকালের জন্য ‘সংশোধনের অযোগ্য’ ঘোষণা করেছে। এ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে দুনিয়ার সংবিধানবিষয়ক পণ্ডিতেরা হয়তো হাসাহাসির সুযোগ পাবেন।
মৌলিক কাঠামো ভারতীয় বিচারকদের বহুল ব্যবহূত একটি ডকট্রিন। তবে কোন বিষয়গুলো মৌলিক কাঠামো, সে বিষয়ে তাঁরা কখনো একমত হতে পারেননি। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট অষ্টম সংশোধনীতে তা প্রথম অনুসরণ করেন; কিন্তু তাঁরাও যথারীতি একমত হতে পারেননি। এটা সম্ভবত একমত হওয়ার বিষয়ও নয়। অষ্টম সংশোধনীতে মৌলিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি দ্বাদশ সংশোধনীতে পাল্টে সংসদীয় পদ্ধতি হয়ে যায়। বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী সংবিধানের ২১ অনন্য বৈশিষ্ট্যের তালিকা তৈরি করেন। নির্দিষ্ট না করে তিনি তাঁর রায়ে বলেছিলেন, এর মধ্যে ‘কতিপয়’ সংশোধনের অযোগ্য। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আটটি মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করেছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে তা গুরুত্বহীন। আর বিচারপতি এ টি এম আফজাল তো এর পুরোপুরি বিরোধী।
৫০-এর চিরযৌবন প্রাপ্তি: পঞ্চম সংশোধনীতে জিয়াউর রহমান তাঁর পছন্দের মাত্র চারটি অনুচ্ছেদ রক্ষা করতে গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ গণভোট বাতিল করে। কিন্তু জিয়ার কৌশলটা ঠিকই নেয়। প্রথমবারের মতো সংবিধানের প্রায় ৫০টি অনুচ্ছেদকে তারা চিরকালের জন্য ‘সংশোধনের অযোগ্য’ করেছে। তবে জিয়া ও এরশাদ যা করেননি, আওয়ামী লীগ তা-ই করল। বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মকে তারা অনন্তকালের জন্য সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
সংবিধানের নতুন ৭খ অনুচ্ছেদ বলেছে, সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য। ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ১১টি আছে], দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ১৮টি আছে], নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ [এখানে ২৩টি আছে] এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।’ কেন এই বিধান? এর সঙ্গে কি তাহলে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কোনো সম্পর্ক আছে? এর উত্তর হলো, না। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বাগাড়ম্বর রাজনীতির সম্পর্ক আছে। বিসমিল্লাহ, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম, জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির পিতার প্রতিকৃতি, সাতই মার্চের ভাষণ—এ ধরনের যা আছে, তার সবটাই ‘সংশোধনের অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিধানের জন্য হয়তো রক্ষাকবচের দরকার ছিল।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংসদে বিল পাসের আগমুহূর্তে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ‘কেশবানন্দ ভারতী মামলা’র দোহাই দেন। ১৯৭৩ সালের এই মামলাতেই ভারত প্রথম ‘ডকট্রিন অব বেসিক স্ট্রাকচার’ প্রয়োগ করে। আইনমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ইন্দিরা গান্ধী আদালতের রিভিউ-ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। কিন্তু এই মামলায় সেই সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হয়। কথা সত্য। কিন্তু আইনমন্ত্রী ও তাঁর সরকার এখন যে কাণ্ড করলেন, তা ইন্দিরাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম, অর্থাৎ গাছের ও তলার দুটোই চাই। তাই ওই দুটোকে একসঙ্গে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো করা হয়েছে। প্রকারান্তরে আইনমন্ত্রী নিজেই কৌশলে আদালতের রিভিউ-ক্ষমতা হরণে ব্রতী হলেন। কেশাবানন্দ মামলার রায়মতেই তাই নতুন সংশোধনী বাতিলযোগ্য কি না, তা যাচাইযোগ্য মনে করি।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে ওই কেশবানন্দে দেওয়া ভারতের প্রধান বিচারপতি এস এম সিক্রি বর্ণিত পাঁচটি মৌলিক কাঠামোর উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রজাতন্ত্রী ও গণতন্ত্রী সরকার, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণ এবং সংবিধানের ফেডারেল চরিত্র। এই মামলার বিচারকসংখ্যা যে ১৩, বিল পাসের দিন আইনমন্ত্রী সেটাও শুনিয়েছেন। কিন্তু তিনি আংশিক বলেছেন। পুরো গল্প হলো, মৌলিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে ওই ১৩ জন রায় প্রদানে একমত হননি। তাঁরা বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন (৯: ৪)। এমনকি মৌলিক কাঠামোর তালিকা তৈরিতেও তাঁরা একমত হতে পারেননি। বিচারপতি শিলাত ও গ্রোভার ওই পাঁচটি ছাড়াও জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতা, মৌলিক অধিকারভাগে বর্ণিত ব্যক্তির মর্যাদা, কল্যাণরাষ্ট্র গঠনে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগের ম্যান্ডেটকে ‘সাংবিধানিক কাঠামোর মূল উপাদান’ হিসেবে বর্ণনা করেন। অন্যদিকে বিচারপতি ওয়াই বি চন্দ্রচুঁড় (পরে প্রধান বিচারপতি) শুধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক কাঠামো বলেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি লেখেন, রাষ্ট্রের একটি বেসিক পিলার হচ্ছে, The State shall have no religion of its own (রাষ্ট্রের নিজের কোনো ধর্ম থাকবে না)। সরকার হয়তো জনগণকে বোকাই ভাবে, না হলে আইনমন্ত্রী একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম আখ্যা দিয়ে কোন মুখে সংসদে দাঁড়িয়ে কেশবানন্দ মামলা ও তাঁর ১৩ বিচারকের ঐতিহাসিক রায়টির কথা মুখে আনেন?
সবচেয়ে লক্ষণীয়, বিচারপতি খায়রুল হকও তাঁর রায়ে উল্লেখ করেন যে, These cannot be catalogued but can only be illustrated। অর্থাৎ মৌলিক কাঠামোর তালিকা করা চলে না। এটা শুধু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অথচ আইনমন্ত্রী এর দোহাই দিয়ে জাতিকে ৫০+ মৌলিক কাঠামোর একটি দীর্ঘতম তালিকা উপহার দিয়েছেন। এটা শতাব্দীর রসিকতা।
সংবিধান বলেছে, ৫০টি অনুচ্ছেদে ‘সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।’ ‘অন্য কোন পন্থায়’ বলে কি তাঁরা আদালতকেও বাঁধেননি? উপরন্তু তাঁরা ওই ৫০টির বাইরেও অনির্দিষ্টসংখ্যক ‘সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো’ আবিষ্কার করেছেন। এমনকি ৭খ অনুচ্ছেদটিকেও মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করে এটিও সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, সংবিধানের অর্ধশতাধিক অনুচ্ছেদ চির অযোগ্য ঘোষণার চেয়ে জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত গণভোট প্রথা ছিল অধিকতর গ্রহণযোগ্য। জিয়াকে গালি দিতে দিতে তাঁর বহু কিছু নতুন করে ধারণ করেছে পঞ্চদশ সংশোধনী। তাই সামরিক ফরমানের গন্ধ মুছতে গণভোট মুছে দেওয়ার নীতি কপটতা। আওয়ামী লীগ হাস্যকরভাবে ভবিষ্যতের দুয়ারে তালা মেরেছে কিংবা ঘড়ির কাঁটা বন্ধ করেছে।
বিল পাসের সকালে বিশেষ কমিটির দুজন সদস্যকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তাঁরা দ্রুত একমত হন যে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হতে পারে না। তাঁরা দুজনেই জানেন যে সংবিধানেই লেখা আছে, মূলনীতিগুলো আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়।
রাষ্ট্রদ্রোহ ও দণ্ডবিধি: এবার আসুন দেখি, অবৈধ ক্ষমতা বন্ধে কী করা হয়েছে। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদকে ঘাড়ে রেখে ভবিষ্যতের এরশাদ মার্কা ব্যক্তিদের বিচারে ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’ নিশ্চিত করেছে সরকার। কিন্তু তাতেও গোঁজামিল। সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে কার্যত ‘নতুন অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে আপিল বিভাগের নির্দেশনা ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। পাকিস্তান, আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর সংবিধান দেখে ৭ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ ওই সব দেশ এমন অপরাধকে ‘হাইট্রিজন’ বা ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেছে। রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান। সেখানে আমাদের দণ্ডবিধির ১২৪ক আছে। পাকিস্তান তাই হাইট্রিজনকে সেডিশনের চেয়ে গুরুতর অপরাধ সংজ্ঞায়িত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অবশ্য এই বিধান বুটের তলায় রেখে ভুট্টোকে ফাঁসি দিতে জিয়াউল হককে বেগ পেতে হয়নি।
সংসদে পেশ করা বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে ৭ক অনুচ্ছেদে ‘সংসদের আইন দ্বারা’ কথাটি ছিল। কিন্তু বিলে তা তুলে ‘প্রচলিত আইনে’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ক্ষমতা জবরদখল ‘নতুন অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হলো না। এখন এক দেশে একই নামের অপরাধের দুই রকম সংজ্ঞা ও দুই ধরনের শাস্তি বহাল হলো। দণ্ডবিধির রাষ্ট্রদ্রোহ আর সংবিধানের রাষ্ট্রদ্রোহ এখন যে এক নয়, এটাও একটা কৌতুকপ্রদ ঘটনা।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ড. আনিসুজ্জামানের আইন শব্দকোষে বলা আছে, ‘সেডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহ হলো সাধারণ মানুষকে দাঙ্গা, হাঙ্গামা বা গণ-অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করিতে পারে এরূপ কথা বলা বা লেখা। দণ্ডবিধি ১২৪(ক) ধারা অনুসারে, যে ব্যক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকারকে, যেকোনো প্রণালীতে রাষ্ট্রপতি বা সরকারের যেকোনো আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার জন্য বা প্রয়োগ করা হইতে বিরত করিবার জন্য প্রলুব্ধ বা বাধ্য করিবার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতিকে বা সরকারকে আক্রমণ করেন বা অবৈধভাবে বাধা প্রদান করেন কিংবা অবৈধভাবে বাধাদানের উদ্যোগ করেন, অথবা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগের ভান করিয়া ভয়াভিভূত করিবার উদ্যোগ করেন, সে ব্যক্তি ৭ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
এখন সংবিধানের নতুন ৭ক অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ ধরন ও সংজ্ঞা দণ্ডবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। একই দেশে দুই রকম ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ আইন ও বিচার চলতে পারে কি? সর্বোচ্চ শাস্তির অর্থ নিয়েও দুই রকম মত পাওয়া গেছে। বিল পাসের পরপরই প্রশ্নের জবাবে বিশেষ কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বলেন, ‘সর্বোচ্চ দণ্ডের অর্থ হলো মৃত্যুদণ্ড।’ কিন্তু বিশেষ কমিটির অপর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বললেন, ‘এটা দণ্ডবিধির আওতায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা বুঝতে হবে।’ এই ব্যাখ্যা সঠিক হলে অবৈধ ক্ষমতা দখলের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মাত্র সাত বছর। আর যদি মৃত্যুদণ্ড বোঝায়, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াবে—এই রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার হবে কোন আইনের আওতায়। সংশয় এখানেই শেষ নয়।
পাকিস্তানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদটির অবিকল হলো ৭ক অনুচ্ছেদের প্রথম দফা। এরপর আর কোনো কথা থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই ৭ক-তে দ্বিতীয় দফা কেন যুক্ত করা হলো। এতে বলা আছে, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে।’ এ ধরনের বিধান অন্যত্র নেই। নাগরিকের আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে টানাটানির কারণ এমনও হতে পারে, সংবিধানে যা নতুন ঢোকানো হয়েছে এর নিন্দুকদের ভয় দেখানোর জন্য। বিশেষ কমিটির সদস্যরা এর আগে আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর কথা আমাদের শুনিয়েছিলেন। কিন্তু নকল করার সময় পাকিস্তানকে অনুসরণ করেন। অথচ আর্জেন্টিনার সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদটি অধিকতর সুরক্ষিত। এর কথা হলো, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা সংবিধান স্থগিত করলেও তা কার্যকর হবে না; সংবিধান বহাল থাকবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহতভাবে টিকে থাকবে। তাঁদের অবৈধ কর্ম চিরকালের জন্য বাতিল বলে গণ্য হবে। তাঁরা কখনোই কোনো পাবলিক অফিস ভোগ করতে পারবেন না, চিরকালের জন্য ক্ষমার অযোগ্য থাকবেন। ৩৬(৪) অনুচ্ছেদ এ-ও বলেছে, জবরদখলকারী শক্তির বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার অধিকার থাকবে।
আমরা দেখলাম, বড় বড় কথা বলে আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে একটা অস্পষ্ট ও গোঁজামিলের বিধান জুড়ে দিল। তবে আপাতত আমাদের বড় আগ্রহের বিষয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর নামে মৌলিক কাঠামো হরণ-প্রক্রিয়ার বৈধতার প্রশ্নটি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্করণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুমীমাংসিত মৌলিক কাঠামো এবারও সংবিধানে সৃষ্টি করা হলো না। আইনমন্ত্রী নিশ্চয় জানেন, ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’কেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আমরা তার স্বীকৃতি পেলাম না। পরোক্ষভাবে সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ-ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াসটি অবশ্য রাষ্ট্রধর্মসংক্রান্ত রিটের শুনানিতে যাচাইযোগ্য। ড. কামাল হোসেনকে সবটা খুলে বললাম। তিনি অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জুলাইয়ে আদালতে যাবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে তাঁর একটি প্রশ্ন দিয়েই আজকের লেখাটি শেষ করি।
ড. কামাল হোসেনের প্রশ্নটি এ রকম: ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেবে না। ২ক অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। একসঙ্গে এই দুটি বিষয় কী করে মৌলিক কাঠামো হতে পারে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments