শেকড়ের ডাক-তিস্তা ও ট্রানজিট : আমাদেরও কি মমতা হতে হবে! by ফরহাদ মাহমুদ
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত মাসেও প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির বিপক্ষে তাঁর অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বরং তিনি অভিযোগ করেছেন, ফারাক্কা বাঁধের স্লুইস গেটগুলো ঠিকমতো কাজ না করায় সেগুলো দিয়ে বাংলাদেশে চুক্তির চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পানি চলে আসছে।
অবশ্য কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছেন, তাঁর এ অভিযোগ সত্য নয়; অর্থাৎ বাংলাদেশে বেশি পানি যাচ্ছে না। অর্ধ শতাব্দী আগের যে প্রমত্তা পদ্মা, যেটি দিয়ে কলকাতা থেকে স্টিমারে করে আসা যেত গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত, সেই নদী আজ মৃতপ্রায়। শীতের সময় হেঁটেও পার হওয়া যায়। তাতেও কি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন ভরে না। তিনি কি চান, নদীনির্ভর বাংলাদেশের নদীগুলোর সবই মরে যাক! মরুকরণ ও বন্যায় শেষ হয়ে যাক এ দেশের প্রকৃতি ও চাষাবাদ! অভিন্ন নদীগুলোতে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে এই দেশ আর এই দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ মৃত্যুর দুয়ারে অপেক্ষা করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি বাংলাদেশের এই মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে চান?
শুধু তিস্তা বা পদ্মা নয়, ভারতের সঙ্গে থাকা আমাদের ৫৪টি অভিন্ন নদীর অবস্থাও কমবেশি একই রকম। ফেনী নদীতেও পানিপ্রবাহ ব্যাহত করা হয়েছে বাঁধ দিয়ে। বহু নদী থেকেই উজানে পানি প্রত্যাহার করে সেচ প্রকল্প বানানো হয়েছে। বরাক নদের উজানে টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। ভারত তাদের এ কৌশল থেকে সহসা সরে যাবে কিংবা ভাটির দেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। অদূর ভবিষ্যতে তারা হয়তো এ রকম অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়ন করবে, যেগুলো বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। ইতিমধ্যে ২২টি নদী সম্পূর্ণভাবে মরে গেছে, শতাধিক নদী মৃত্যুর মুখোমুখি। আর এই নদীগুলোর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে মারা যাচ্ছে বাংলাদেশও। কিন্তু তিস্তা ও পদ্মার পানিপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে যে ক্ষতি বাংলাদেশের হয়েছে, তা আর কখনো পূরণ করা যাবে না। ভারত যদি এখনো প্রতিবেশীর প্রতি এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ না করে, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশের সর্বনাশের চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাব। ইতিমধ্যেই পশ্চিম ও পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। গত বছরও যেসব গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উঠানো গেছে, এ বছর বোরো মৌসুমের শুরুতে সেই নলকূপগুলোর অনেক কটিতেই পানি উঠছে না। এ তো গেল ক্ষয়ক্ষতির একটি দিক। অন্যদিকে নদীতে যথেষ্ট পানিপ্রবাহ না থাকায় পলি জমে নদীগুলো দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষায় যখন উজান থেকে ঢল নামে, তখন নদীগুলো সেই পানি ধারণ করতে পারে না। শুরু হয় বন্যা। তখনো মাঠের পর মাঠ পানির নিচে চলে যায়। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়।
ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলছি, তাদের ট্রানজিট দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, অথচ তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ভারত এখনো আমাদের সঙ্গে এক ধরনের নাটকই করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির বিপক্ষে তাঁর অনড় অবস্থানই তুলে ধরছেন। এখন ফারাক্কা নিয়েও টানাহেঁচড়া শুরু করেছেন। স্বাধীনতাপরবর্তী চার দশক ধরে আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভারতের সঙ্গে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথাই বলেছি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বরং দিনে দিনে ক্ষতির পরিমাণই কেবল বেড়েছে। এই অবস্থায় আমাদের অন্য কিছু ভাবা দরকার। কারণ এই দেশটি আমাদের। আর এই দেশটির বাঁচা-মরার সঙ্গে আমাদের তথা দেশের মানুষের বাঁচা-মরাও এক সূত্রে গাঁথা। তাই দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কথাও জরুরি ভিত্তিতে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। আমাদের প্রিয় দেশটির ওপর নেমে আসা এই ভয়াবহ বিপর্যয় মোকাবিলার চেষ্টা করতে হবে। মরুকরণ প্রক্রিয়া ঠেকাতে হবে, অন্যদিকে বন্যার হাত থেকে মানুষ ও ফসল রক্ষা করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আমরা সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে পারিনি, আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হয়েছে। অভিন্ন নদীগুলোর ক্ষেত্রেও কিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন আছে। ভাটির দেশের ক্ষতি করে উজানের কোনো দেশ অভিন্ন নদী থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। অথচ ভারত তাই করে যাচ্ছে। তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের এই বরখেলাপ নিয়ে কেন আমরা আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছি না? কেন আমরা তাদের দয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি? ভারতে রাজ্য সরকারের অনুমতি ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে কিছু করতে পারে না। আর আমরা তো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অনেক মুখঝামটা সহ্য করেছি। আর কত সয়ে যাব? এখন এই সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন হবে শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নয়ন।
আমরা অবশ্যই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। কিন্তু তা এই দেশের ক্ষতি করে নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে তাঁর স্বার্থকে আগলে ধরে বসে আছেন, তেমনি আমাদেরও কি নিজের স্বার্থ আদায়ে তাঁর মতোই মরিয়া হতে হবে! কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা যেভাবে কথা বলে চলেছেন, সেভাবেই যদি কাজ করা হয়_তাহলে আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হবে কিভাবে? আমাদের বাগে নিতে ভারতের হাতে অনেক অস্ত্র রয়েছে, কিন্তু ট্রানজিট ছাড়া আমাদের হাতে বলতে গেলে আর কোনো অস্ত্রই নেই। অথচ পানি ছাড়াই আংশিক ট্রানজিট সুবিধা কার্যত ভারতকে দেওয়া হয়ে গেছে। বাকিটা দেওয়ার জন্যও সেই উপদেষ্টাসহ অনেকেই অতি উৎসাহী হয়ে আছেন। এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমরা কি কিছু করতে পারব? দেশের স্বার্থে বর্তমান সরকারকে এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসতে হবে। তা না হলে এ যাবৎকালে তাদের যত অর্জন আছে, কেবল পানির কারণে সবই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত গত বুধবার ঢাকা পেঁৗছে বলেছেন, তিনি দুই প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাবেন। আমরাও তাই চাই। কিন্তু সেটি কেবল নিয়ে নয়, দিয়েও দেখাতে হবে। ভাটির দেশের মানুষ হিসেবে অভিন্ন নদীতে পানির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ পাওয়া আমাদের অধিকার। ভারত সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে, যা তারা নিতে পারে না। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান ছাড়া কোনো নেতার কোনো স্বপ্নই বাস্তবায়িত হবে না।
লেখক : সাংবাদিক
No comments