রাহুল ও কংগ্রেস ব্যর্থ হলো কেন? by প্রতাপ ভানু মেহতা

উত্তর প্রদেশের নির্বাচন ছিল প্রচণ্ড ভাবাবেগপূর্ণ, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। একই সঙ্গে শান্তিপূর্ণ, ভদ্রজনোচিত ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে এসব নির্বাচনকে পুরনো বোতলে নতুন মদ মনে হতে পারে। তীব্র স্থানীয় দরকষাকষি, জাতপাত ও সম্প্রদায়গত সমীকরণ, দুর্নীতি বা অপরাধগ্রস্তদের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দেখে এ ধারণা হওয়াটা


অস্বাভাবিক নয়। তবে এর অভ্যন্তরে যে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে, তাকে অস্বীকার করা যাবে না। ভোটাররা পার্থক্য নির্ণয়ে চমৎকার সামর্থ্য প্রদর্শন করছে। এখানে কৌশলটা হলো, সর্বাগ্রে স্থিতিশীল সরকার গঠনের উপযোগী দলের সন্ধান করা। এসব নির্বাচনের ফলাফল যে ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে নির্দেশ করছে তাতে সবসময় 'ক্ষমতাসীদের মাথাভাঙা বিরোধিতা' অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে পারফরম্যান্সই মুখ্য।
এ নির্বাচন রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেসের জন্য বিরাট পরীক্ষা ছিল। কিন্তু তিনি এবং তার দল এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের চারটি অগ্রগণ্য ভুল হলো অহমিকা, সাম্প্রদায়িকতা, কপটতা ও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করা। তদুপরি জাতীয় আন্ডারকারেন্টও স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কংগ্রেসকে ভোট দিলে তার আত্মঅহংকার ও কেন্দ্রে স্বআরোপিত নীতি-অক্ষমতাকে পুরস্কৃত করা হবে, এমন একটা সেন্টিমেন্ট সেখানে ছিল। আন্না হাজারের আন্দোলন গৌণ অবস্থানে চলে যাওয়ার পরও দুর্নীতির গন্ধ কিন্তু কংগ্রেসের বিশ্বযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দলটি অমার্জিতভাবে ১৯৭০ স্টাইলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে টেনে এনেছে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের নৈরাশ্যবাদিতাকেই প্রকট করেছে। রাহুল রাজীব গান্ধীর মতোই তল্পিবাহকদের স্ট্র্যাটেজিস্ট বানিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্টরা সংখ্যালঘু রক্ষক সেজেছেন, দলের যেসব কর্মকর্তা সুশাসনের গুরুত্ব বুঝতে অক্ষম তাদের মাথায় তুলেছেন। অথচ পাঞ্জাব কংগ্রেসের তরুণ শক্তির জন্য একটি সত্যিকারের মহাপরীক্ষার স্থান হতে পারত। তারুণ্যের গতিময়তা এখানে সঞ্চারিত করার চেষ্টা নেওয়া যেত। এই রাজ্যটিতে এবার কংগ্রেসের পরাজয় নাও হতে পারত। অথচ তরুণদের দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসার গোটা পরিকল্পনাটিই মুখ থুবড়ে পড়ল। এখন এই বিপর্যয় থেকে পার্টি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে সেটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। রাহুলের কৌশল ছিল এবারকার নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে তার নিজের ও সরকারের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা। কিন্তু এখন এ নিয়ে পুনঃচিন্তার প্রশ্ন এসে গেছে।
একদা মায়াবতী উত্তর প্রদেশে চমৎকার এক সামাজিক জোট গড়ে তুলেছিলেন। নির্বাচনে তার দল পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাজ্যে বিপুল শক্তির অধিকারী হিসেবে থাকবেন। তবে তিনি যাদের ক্ষমতায়ন করেছেন তাদেরও দুঃশাসন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে তার মাত্রা তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখানে সমাজবাদী পার্টি ক্ষমতাসীন-বিরোধী জনগণের মনোভাবের ফায়দা তুলেছে। তবে দলটির নির্বাচনী প্রচারণা ছিল অত্যাধুনিক ও সুবিবেচনাপ্রসূত। সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত তারুণ্যপূর্ণ আধুনিকতাবাদী অবয়ব তুলে ধরার মাধ্যমে রাহুল গান্ধীর পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছেন। তরুণ ভোটারদের কাছে আগের মোলায়ম সিং যাদব সরকারের দুঃশাসনের স্মৃতি নেই। অখিলেশ যাদব এসব ভোটারের কাছে উদ্দীপনামূলক কথা বলেছেন।
এসব নির্বাচনের প্রভাব কার ওপর কতটা পড়বে সেটা নির্ভর করবে কে কীভাবে এ থেকে শিক্ষা নেয় তার ওপর। তবে দুটি জাতীয় দলেরই এ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করতে হবে। বলা হয়ে থাকে যে, জাতীয় দলগুলো আঞ্চলিক এজেন্ডাকে রাস্তা করে দিচ্ছে। কিন্তু সত্যটা এর ঠিক বিপরীত। জাতীয় দলগুলোর প্রকৃত জাতীয় এজেন্ডা না থাকার কারণেই তারা আঞ্চলিক এজেন্ডাকে পথ করে দিচ্ছে। এভাবেই আঞ্চলিক দলগুলো মানুষের স্বপ্ন-সারথি হয়ে উঠেছে। বিজেপির যদিও এসব নির্বাচন থেকে তেমন প্রত্যাশা ছিল না, কিন্তু তাদেরও উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। উত্তর প্রদেশে তুলে ধরার মতো তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেতা নেই, নতুন ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে পারার মতো জাতীয় নেতাও দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় রাজনীতির জন্য এর নিহিতার্থ অপরিমেয়। কংগ্রেস বিরোধিতা নতুন জীবন পেতে পারে। সব দলই কংগ্রেস দেশ শাসন করতে পারে না সেটা প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃত্ব সংকটে ভুগছে। সরকারের নৈতিক ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির অবস্থাও তার শেষ হয়ে গেছে। তবে গণতন্ত্র ডেভিলদেরও দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়। আর এটা করতে গিয়ে এদের সে ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, আত্মঅহমিকা থেকে মুক্ত করে।

প্রতাপ ভানু মেহতা :দিলি্লর সেন্টার ফর পলিসি রিসার্সের প্রেসিডেন্ট
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.