অল্প কথায়-ষাট বছরে দাউদ হায়দার by হাসান ফেরদৌস
এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ৬০ বছরে পা দিল কবি দাউদ হায়দার। গত ৩২ বছরের মতো এবারও বিদেশের মাটিতেই তাকে জন্মদিন কাটাতে হলো। দাউদ আর আমি একই স্কুলের ছাত্র, থাকতামও একই পাড়ায়। সেই প্রায়-ফিকে বয়স থেকেই জানতাম দাউদ কবিতা লেখে, যা লেখে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না।
আমরা জানতাম, ওর সব ভাই-ই কবি, ফলে ধরেই নিয়েছিলাম বড় কোনো ভাইয়ের কবিতা টুকলিফাই করে ও বাহাদুরি দেখায়। একবার ‘সব পাখি ঘরে ফেরে সন্ধ্যায়, আমি তবু প্রতীক্ষায়’ বা এ জাতীয় একটি কবিতা স্কুলে ঘরভর্তি ছাত্রদের পড়ে শুনিয়েছিল। তখন বুঝিনি কিসের প্রতীক্ষা। এখনো বুঝি না, তবে এটুকু জানি, ঘরে ফেরার জন্য দাউদের যে ব্যাকুলতা, তাতে কোনো খাদ নেই।
খুব অল্প বয়স থেকেই দাউদ সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। কলেজে পড়ার সময় ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ এই নামের একটি কবিতা লিখে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। ইংরেজি অনুবাদে সে কবিতা দেশের বাইরে ছাপা হয়েছিল, কী যেন একটা পুরস্কারও পেয়েছিল। মনে আছে, গাঁটের টাকা খরচ করে আমরা কয়েকজন মিলে ঢাকায় মিলনায়তন ভাড়া করে ওর সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলাম। অথচ যে লেখাটির জন্য ও আমাদের কাছে ‘হিরো’ হয়ে উঠেছিল, তা কিন্তু কবিতা নয়, একটি গল্প, সাপ্তাহিক চিত্রালীতে ছাপা হয়েছিল। গল্পের নামধাম মনে নেই, শুধু মনে আছে বেশ রগরগে প্রেমের গল্প। আমাদের স্কুলের লাগোয়া এক দোতলা বাসার একটি মেয়েকে নিয়ে লেখা। যাবতীয় বিবরণ, মায় মেয়েটির নাম পর্যন্ত টায় টায় মিলে গিয়েছিল। মেয়েটির প্রতি দাউদের গোপন প্রণয়ের কথা আমরা জানতাম, মেয়েটি সম্ভবত জানত না। গল্পটি ছাপা হয়েছিল শুক্রবার। সেদিন কোনো অঘটন ঘটেনি। পরদিন শুনি দাউদকে হন্যে হয়ে খুঁজছে মেয়েটির ডাকাবুকো এক ভাই। ওর ঠ্যাং না ভাঙা পর্যন্ত রেহাই নেই। এরপর এক সপ্তাহ দাউদের পাত্তা নেই। সম্ভবত পাবনায় ওদের গ্রামের বাড়িতে পালিয়েছিল। পরে শুনেছি, মেয়েটির সেই ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল।
প্রেম করতে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙার উপক্রম দাউদের সেই প্রথম নয়। স্কুলে পড়তে পড়তেই এক সহপাঠীর ছোট বোনের কাছে প্রণয় নিবেদন করে বসে ও। সহপাঠী হলে কী হবে, রীতিমতো ডাঁকসাইটে গুন্ডা সে ভাইটি। এখন আর মনে নেই, সেবার কয় সপ্তাহের জন্য পাবনা পালিয়েছিল দাউদ, তবে পালিয়েছিল নির্ঘাত। শুনেছি উনিশ শ বাহাত্তরে জোড়া খুন করে ছেলেটি জার্মানি পালিয়ে যায়। দাউদ যে এখন জার্মানিতে, সে খবর তার জানা আছে কি না সে ব্যাপারে আমি অবশ্য নিশ্চিত নই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা সময়েই দাউদ দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পায়। সে পাতাতেই ‘কালো সূর্যের কালো বন্যা...’ ইত্যাদি নামের একটি কবিতা লিখে দেশজুড়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে বসে। খুবই বাজে কবিতা, এমন কবিতার জন্য যে দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, সেখানে লোকজন হয় মস্ত কাব্যপ্রেমী, নয়তো তাদের মাথায় একটি বা দুটি স্ক্রুর কমতি রয়েছে। আমি তখন বিদেশে। হঠাৎ শুনি দাউদ জেলে। সেখান থেকে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে শুনেছিলাম ওই কবিতাটির ছুঁতো ধরে জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা ইঁদুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই উচ্চশিক্ষার্থে তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে দাউদ দেশছাড়া। এদিকে সেসব নেংটি ইঁদুর বেড়ে ধেঁড়ে ইঁদুর হয়েছে, তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটেছে। দাউদের আর ঘরে ফেরা হয়নি।
প্রায় এক যুগ পর, ১৯৮২ সালে কলকাতায় দাউদের সঙ্গে দেখা। সে শহরে দাউদ তখন রাজপুত্র। এক সপ্তাহ ওর সঙ্গে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়িয়েছি দুজন। তখন মনে হয়েছে, এই শহরে ওর অপরিচিত এমন মানুষ একজনও নেই। ‘নন্দন’-এ গেছি নাটক দেখতে। টিকিট নেই। দাউদ ম্যানেজারের উদ্দেশে ছোট এক টুকরো চিরকুট পাঠাতে না পাঠাতেই তিনজন লোক এসে আমাদের একদম প্রথম সারিতে বসিয়ে দিল। সেক্রেটারিয়েটে গেছি। গেট পাসের কোনো বালাই নেই, দাউদ হন হন করে টেনে নিয়ে গেল সোজা পশ্চিম বাংলা সরকারের হোম সেক্রেটারির ঘরে। অফিস ভর্তি লোক। আমি ঢাকা থেকে ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে এসেছিলাম, তার দুই প্যাকেট হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, আপনার জন্য ঢাকা থেকে এনেছে। ক্যালকাটা ক্লাবে খোলা মাঠে মল্লিকা সারাভাইয়ের নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে, ‘বাই ইনভাইটেশন অনলি’। দাউদ মল্লিকাকে কী লিখে পাঠাল, কে জানে, ভিআইপির রোতে জায়গা মিলে গেল। শুধু তা-ই নয়, বিরতিতে মল্লিকার সঙ্গে সাক্ষাতের নির্দেশ পর্যন্ত এসে হাজির। বছর দুয়েক আগে নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে মল্লিকাকে আমি সে কথা মনে করে দিয়েছিলাম। মহিলা ভারি মজা পেয়েছিলেন।
ঢাকায় ফিরে দাউদের জন্য একটি সুতির পাঞ্জাবি একজনের হাতে পাঠিয়ে ছিলাম। আপ্লুত দাউদ চিঠি লিখে জানিয়েছিল, ‘তোমার পাঠানো পাঞ্জাবি পরে মনে হচ্ছে পুরো বাংলাদেশকে ধারণ করে আছি।’
আশির দশকের শেষ সময় থেকে দাউদ বার্লিনে। বাংলাদেশ থেকে যত দূরে ওকে যেতে হয়েছে, বাংলাদেশ তাকে তত বেশি আঁকড়ে ধরেছে। দেশে না ফিরলেও সে ফেরার স্বপ্ন দেখা থামায়নি। তার কবিতার প্রধান সুর, এখনো, নির্বাসন যন্ত্রণা। তিন দশকের বেশি সময় দেশের বাইরে, পূর্ব-পশ্চিমের হেন দেশ নেই, যা সে চষে বেড়ায়নি। কলকাতা বা বার্লিন, প্যারিস বা কোপেনহেগেন, কবিতার খাতা নিয়ে তন্ন তন্ন করে ঘুরেছে। অথচ সে খাতায় যখন কবিতার শব্দ বসিয়েছে, ঘুরেফিরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ফেলে আসা স্বদেশ। যখনই গভীর, গোপন যন্ত্রণার কথা বলেছে, বলেছে স্বপ্ন ও ভালোবাসার কথা, তখন কেবলই শোনা গেছে ‘বাংলাদেশের’ নাম।
‘হে জীবন, তোমাকে সুখের মুখ দেখাবো বলে
সেই কবে থেকে প্রতীক্ষমাণ—
এক যুগ কেটে গেল, কলকাতায়
এখনো আশায় বসে আছি
যদি কেউ ফেরায় সস্নেহে, পিতৃদেশে।’
সামরিক শাসক এরশাদের আমলে দাউদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হয়, সে পাসপোর্ট আর সে ফেরত পায়নি। সামরিক সরকার আমলে তার দেশে ফেরা হবে না, এ কথা দাউদ ধরেই নিয়েছিল, কিন্তু নব্বইয়ের গোড়ায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ও এই ভেবে আশায় বুক বেঁধেছিল, এবার বুঝি নিয়ম বদলাবে। নতুন প্রতিটি সরকারের কাছেই দেশে ফেরার আবেদন জানিয়েছে। নিজের দেশ, শুধু পর্যটকের মতো দিন কয়েকের জন্য সেখানে এসে ঘুরে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সরকার, কোনো তরফ থেকেই কোনো সাড়া মেলেনি। ১/১১-এর পট-পরিবর্তনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে, তার কাছেও আবেদন করেছিল। পরিচিত আমলা, নামজাদা বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে অনুরোধ-উপরোধ করা হয়েছিল, তদবিরেরও কোনো কমতি ছিল না। কোনো কাজ হয়নি। সবার যুক্তি, দাউদকে ফিরতে দিলে জামায়াত-শিবিরকে উসকে দেওয়া হবে। কী আশ্চর্য, বাংলাদেশি নাগরিক, নিজের দেশে ফিরবে। অথচ তাঁকে আসতে দেওয়া হবে না মৌলবাদীদের রাজনৈতিক পাঁয়তারার কারণে? একাত্তরের রাজাকারেরা যখন খুশি আসছে-যাচ্ছে, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছে। অথচ ৩৫ বছর আগে, প্রায় কৈশোরে লেখা এক কবিতার জন্য দেশে ফিরতে পারবে না কবি?
৫ মার্চ ২০১২, নিউইয়র্ক
খুব অল্প বয়স থেকেই দাউদ সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। কলেজে পড়ার সময় ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ এই নামের একটি কবিতা লিখে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। ইংরেজি অনুবাদে সে কবিতা দেশের বাইরে ছাপা হয়েছিল, কী যেন একটা পুরস্কারও পেয়েছিল। মনে আছে, গাঁটের টাকা খরচ করে আমরা কয়েকজন মিলে ঢাকায় মিলনায়তন ভাড়া করে ওর সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলাম। অথচ যে লেখাটির জন্য ও আমাদের কাছে ‘হিরো’ হয়ে উঠেছিল, তা কিন্তু কবিতা নয়, একটি গল্প, সাপ্তাহিক চিত্রালীতে ছাপা হয়েছিল। গল্পের নামধাম মনে নেই, শুধু মনে আছে বেশ রগরগে প্রেমের গল্প। আমাদের স্কুলের লাগোয়া এক দোতলা বাসার একটি মেয়েকে নিয়ে লেখা। যাবতীয় বিবরণ, মায় মেয়েটির নাম পর্যন্ত টায় টায় মিলে গিয়েছিল। মেয়েটির প্রতি দাউদের গোপন প্রণয়ের কথা আমরা জানতাম, মেয়েটি সম্ভবত জানত না। গল্পটি ছাপা হয়েছিল শুক্রবার। সেদিন কোনো অঘটন ঘটেনি। পরদিন শুনি দাউদকে হন্যে হয়ে খুঁজছে মেয়েটির ডাকাবুকো এক ভাই। ওর ঠ্যাং না ভাঙা পর্যন্ত রেহাই নেই। এরপর এক সপ্তাহ দাউদের পাত্তা নেই। সম্ভবত পাবনায় ওদের গ্রামের বাড়িতে পালিয়েছিল। পরে শুনেছি, মেয়েটির সেই ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল।
প্রেম করতে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙার উপক্রম দাউদের সেই প্রথম নয়। স্কুলে পড়তে পড়তেই এক সহপাঠীর ছোট বোনের কাছে প্রণয় নিবেদন করে বসে ও। সহপাঠী হলে কী হবে, রীতিমতো ডাঁকসাইটে গুন্ডা সে ভাইটি। এখন আর মনে নেই, সেবার কয় সপ্তাহের জন্য পাবনা পালিয়েছিল দাউদ, তবে পালিয়েছিল নির্ঘাত। শুনেছি উনিশ শ বাহাত্তরে জোড়া খুন করে ছেলেটি জার্মানি পালিয়ে যায়। দাউদ যে এখন জার্মানিতে, সে খবর তার জানা আছে কি না সে ব্যাপারে আমি অবশ্য নিশ্চিত নই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা সময়েই দাউদ দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পায়। সে পাতাতেই ‘কালো সূর্যের কালো বন্যা...’ ইত্যাদি নামের একটি কবিতা লিখে দেশজুড়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে বসে। খুবই বাজে কবিতা, এমন কবিতার জন্য যে দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, সেখানে লোকজন হয় মস্ত কাব্যপ্রেমী, নয়তো তাদের মাথায় একটি বা দুটি স্ক্রুর কমতি রয়েছে। আমি তখন বিদেশে। হঠাৎ শুনি দাউদ জেলে। সেখান থেকে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে শুনেছিলাম ওই কবিতাটির ছুঁতো ধরে জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা ইঁদুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই উচ্চশিক্ষার্থে তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে দাউদ দেশছাড়া। এদিকে সেসব নেংটি ইঁদুর বেড়ে ধেঁড়ে ইঁদুর হয়েছে, তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটেছে। দাউদের আর ঘরে ফেরা হয়নি।
প্রায় এক যুগ পর, ১৯৮২ সালে কলকাতায় দাউদের সঙ্গে দেখা। সে শহরে দাউদ তখন রাজপুত্র। এক সপ্তাহ ওর সঙ্গে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়িয়েছি দুজন। তখন মনে হয়েছে, এই শহরে ওর অপরিচিত এমন মানুষ একজনও নেই। ‘নন্দন’-এ গেছি নাটক দেখতে। টিকিট নেই। দাউদ ম্যানেজারের উদ্দেশে ছোট এক টুকরো চিরকুট পাঠাতে না পাঠাতেই তিনজন লোক এসে আমাদের একদম প্রথম সারিতে বসিয়ে দিল। সেক্রেটারিয়েটে গেছি। গেট পাসের কোনো বালাই নেই, দাউদ হন হন করে টেনে নিয়ে গেল সোজা পশ্চিম বাংলা সরকারের হোম সেক্রেটারির ঘরে। অফিস ভর্তি লোক। আমি ঢাকা থেকে ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে এসেছিলাম, তার দুই প্যাকেট হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, আপনার জন্য ঢাকা থেকে এনেছে। ক্যালকাটা ক্লাবে খোলা মাঠে মল্লিকা সারাভাইয়ের নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে, ‘বাই ইনভাইটেশন অনলি’। দাউদ মল্লিকাকে কী লিখে পাঠাল, কে জানে, ভিআইপির রোতে জায়গা মিলে গেল। শুধু তা-ই নয়, বিরতিতে মল্লিকার সঙ্গে সাক্ষাতের নির্দেশ পর্যন্ত এসে হাজির। বছর দুয়েক আগে নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে মল্লিকাকে আমি সে কথা মনে করে দিয়েছিলাম। মহিলা ভারি মজা পেয়েছিলেন।
ঢাকায় ফিরে দাউদের জন্য একটি সুতির পাঞ্জাবি একজনের হাতে পাঠিয়ে ছিলাম। আপ্লুত দাউদ চিঠি লিখে জানিয়েছিল, ‘তোমার পাঠানো পাঞ্জাবি পরে মনে হচ্ছে পুরো বাংলাদেশকে ধারণ করে আছি।’
আশির দশকের শেষ সময় থেকে দাউদ বার্লিনে। বাংলাদেশ থেকে যত দূরে ওকে যেতে হয়েছে, বাংলাদেশ তাকে তত বেশি আঁকড়ে ধরেছে। দেশে না ফিরলেও সে ফেরার স্বপ্ন দেখা থামায়নি। তার কবিতার প্রধান সুর, এখনো, নির্বাসন যন্ত্রণা। তিন দশকের বেশি সময় দেশের বাইরে, পূর্ব-পশ্চিমের হেন দেশ নেই, যা সে চষে বেড়ায়নি। কলকাতা বা বার্লিন, প্যারিস বা কোপেনহেগেন, কবিতার খাতা নিয়ে তন্ন তন্ন করে ঘুরেছে। অথচ সে খাতায় যখন কবিতার শব্দ বসিয়েছে, ঘুরেফিরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ফেলে আসা স্বদেশ। যখনই গভীর, গোপন যন্ত্রণার কথা বলেছে, বলেছে স্বপ্ন ও ভালোবাসার কথা, তখন কেবলই শোনা গেছে ‘বাংলাদেশের’ নাম।
‘হে জীবন, তোমাকে সুখের মুখ দেখাবো বলে
সেই কবে থেকে প্রতীক্ষমাণ—
এক যুগ কেটে গেল, কলকাতায়
এখনো আশায় বসে আছি
যদি কেউ ফেরায় সস্নেহে, পিতৃদেশে।’
সামরিক শাসক এরশাদের আমলে দাউদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হয়, সে পাসপোর্ট আর সে ফেরত পায়নি। সামরিক সরকার আমলে তার দেশে ফেরা হবে না, এ কথা দাউদ ধরেই নিয়েছিল, কিন্তু নব্বইয়ের গোড়ায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ও এই ভেবে আশায় বুক বেঁধেছিল, এবার বুঝি নিয়ম বদলাবে। নতুন প্রতিটি সরকারের কাছেই দেশে ফেরার আবেদন জানিয়েছে। নিজের দেশ, শুধু পর্যটকের মতো দিন কয়েকের জন্য সেখানে এসে ঘুরে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সরকার, কোনো তরফ থেকেই কোনো সাড়া মেলেনি। ১/১১-এর পট-পরিবর্তনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে, তার কাছেও আবেদন করেছিল। পরিচিত আমলা, নামজাদা বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে অনুরোধ-উপরোধ করা হয়েছিল, তদবিরেরও কোনো কমতি ছিল না। কোনো কাজ হয়নি। সবার যুক্তি, দাউদকে ফিরতে দিলে জামায়াত-শিবিরকে উসকে দেওয়া হবে। কী আশ্চর্য, বাংলাদেশি নাগরিক, নিজের দেশে ফিরবে। অথচ তাঁকে আসতে দেওয়া হবে না মৌলবাদীদের রাজনৈতিক পাঁয়তারার কারণে? একাত্তরের রাজাকারেরা যখন খুশি আসছে-যাচ্ছে, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছে। অথচ ৩৫ বছর আগে, প্রায় কৈশোরে লেখা এক কবিতার জন্য দেশে ফিরতে পারবে না কবি?
৫ মার্চ ২০১২, নিউইয়র্ক
No comments