প্রাথমিক বাছাইয়ে বিবেচিত ১৬টি ব্যাংক। আছে রাজনৈতিক চাপ-আসছে নতুন ব্যাংক by মনজুর আহমেদ
নতুন ব্যাংকের জন্য ৩৭টি আবেদনের মধ্যে ১৬টি প্রাথমিক বাছাইয়ে বিবেচিত হয়েছে। এর প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে সরকারি বা শরিক দলের রাজনীতিকেরা যুক্ত। এই ১৬ ব্যাংকের তালিকা ও উদ্যোক্তাদের নাম ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
গত মঙ্গলবার তালিকাটি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানের কাছে পৌঁছায়। বুধবার পৌঁছায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এসব সূত্র থেকে প্রস্তাবিত ১৬টি ব্যাংকের তালিকা পাওয়া গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, আবেদনের মধ্য থেকে নয়টি বেসরকারি ব্যাংক দেওয়া হতে পারে। তবে আরেকটি সূত্র জানায়, সাতটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে। এমনকি বাছাইয়ে টেকেনি, এমন আবেদনও ঠিকঠাক করে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠাতে বলা হতে পারে।
এদিকে প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়াতেই কয়েকটি ব্যাংকের যথাযথ কাগজপত্র ছিল না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, খুবই ছোটখাটো বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাবিত ব্যাংকের প্রয়োজনীয় কাগজ আনা হয়। জানা যায়, প্রস্তাবিত ব্যাংকের মূলধন হিসেবে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা কর বিভাগের ১০বি বিবরণ অনুসারে যে সম্পদ দেখিয়েছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সম্পদের মূল্যমান পুনর্নির্ধারণ করে আনতে বলা হয়েছিল।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যে তালিকার কথা শুনলাম, তাতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এর পরও আমি বলব, হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক দিলে সেই ব্যাংকগুলো যদি উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড করে, সেবার মান বাড়ায়, তাহলে সেটা ঠিক আছে। না হলে যে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হবে, তা লাভজনক কিছু বয়ে আনবে না।’ তিনি বলেন, বর্তমানে যে ব্যাংকগুলো আছে, সেগুলোর তারল্য পরিস্থিতিসহ নানা সমস্যা রয়েছে, এটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
১৬ ব্যাংক ও উদ্যোক্তা: প্রাথমিক বাছাইয়ে বিবেচিত নতুন ব্যাংকের তালিকায় আছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’। যদিও এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে জনৈক শহীদুল আলমের। একসময় এরশাদের অর্থকড়ি সংরক্ষণ করতেন গোলাম মসি, যিনি জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনিও ব্যাংকটির একজন উদ্যোক্তা।
আরও আছে ঢাকার সরকারদলীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপসের ‘মধুমতি ব্যাংক’। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে জনৈক হুমায়ুন কবীরের। এনামুল হক চৌধুরীর প্রস্তাবিত ব্যাংকের নাম ‘চার্টার্ড ব্যাংক’। এই ব্যাংকের উদ্যোক্তার তালিকায় নাম রয়েছে সদ্য প্রয়াত সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর।
সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমান ও নসরুল হামিদের প্রস্তাবিত ব্যাংক হচ্ছে ‘মেঘনা ব্যাংক’। চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে আশিকুর রহমানের।
তালিকায় আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ‘ফার্মারস ব্যাংক’। তিনি ব্যাংকটির প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান। ‘কটক বাংলা ব্যাংক’-এর উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছে ভারতের বিখ্যাত কটক মহিন্দ্রা ব্যাংক, যাদের শেয়ার থাকবে ৬০ শতাংশ। এই ব্যাংকে আছে আবদুল মাতলুব আহমাদের নিটল গ্রুপ, প্রাণ এগ্রো বিজনেস ও প্রাণের প্রধান নির্বাহী আমজাদ খান চৌধুরীসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
‘পিপলস ইসলামী ব্যাংক’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তালিকায় আছে আমেরিকা-প্রবাসী আবুল কাসেমের নাম। এর সঙ্গে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের ভাই ইফতেখার আহমেদের (টিপু) ইফাদ অটোস, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। এঁদেরই আরেকটি ব্যাংকের প্রস্তাব রয়েছে, যার নাম ‘ফেডারেল ব্যাংক’। ‘সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে এস এম আমজাদ হোসেনের। উদ্যোক্তাদের মধ্যে আছেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক নেতা অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী।
‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর প্রস্তাবক হলেন দেশের প্রথম অর্থসচিব মতিউল ইসলাম। উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের ১৫টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানি রয়েছে।
আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজমের প্রস্তাবিত ‘দ্য পিপলস ব্যাংক’। এই ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য উদ্যোক্তা হচ্ছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আলী খোকন ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের স্ত্রী সৈয়দ আরজুমান বানু।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলামের প্রস্তাবিত ব্যাংকের নাম ‘ফেডারেল ব্যাংক’। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সরকারদলীয় সাংসদ শাহরিয়ার আলম ও সরকারের শীর্ষপর্যায়ে ঘনিষ্ঠ হাবিবি মিল্লাত। এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের প্রস্তাবিত ব্যাংক হচ্ছে ‘মিডল্যান্ড ব্যাংক’।
হোসনে আরা বেগমের টিএমএসএস প্রস্তাবিত ব্যাংকের নাম ‘ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক’। এই ব্যাংকের সঙ্গে রয়েছে ওবায়দুল করীমের ওরিয়ন ফার্মা, যার প্রতিনিধি ফেরদৌস জামান, বেলহাসা একম জেভির প্রতিনিধি সমরেশ বণিক ও বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের প্রতিনিধি হচ্ছেন ওবায়দুল করীমের ছেলে সালমান ওবায়দুল করীম।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ‘সেলফ এমপ্লয়মেন্ট ব্যাংক’ নামে আবেদন করেছিলেন। সঙ্গে আছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ওহেদুল হক, অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ ভূঁইয়া, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ কয়েকজন শিক্ষাবিদ।
এ ছাড়া আছে ‘কোরিয়া-বাংলা ব্যাংক লি.’। এর প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, মাল্টিপ্ল্যান লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই ব্যাংকের সঙ্গে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, দেশের অর্থনীতি বিবেচনা করলে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক। অতিরিক্ত ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তার পরও দু-তিনটি ব্যাংক দিলে তা সহনীয় হবে। এর বেশি ঠিক হবে না।
প্রক্রিয়া শুরু যেভাবে: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই অর্থমন্ত্রী গত ২৯ জুন বাজেট পাসের দিন জাতীয় সংসদে নতুন ব্যাংকের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করার কথা ঘোষণা দেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম থেকেই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক মত দিয়ে আসছিল। অর্থমন্ত্রী পরে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি নয়। আবার বলেন, তবে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে।
দেশের সীমিত বাজারে অধিকসংখ্যক ব্যাংক থাকায় অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিপূর্বে সরকারকে সতর্ক করেছিল। অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার কারণে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুসারে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা শুধুই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
সরকারের ইচ্ছা পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গত ২৭ সেপ্টেম্বর নতুন ব্যাংকের দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। সেই অনুসারে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৭টি আবেদন জমা পড়ে। দ্রুত নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সরকারের দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আরও বাছাই বাকি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ১৫ মার্চের সভায় নতুন ব্যাংকের প্রস্তাব হাজির করা হতে পারে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক বাছাইয়ের পর আবেদনগুলো আরও দুটি কমিটি মূল্যায়ন করবে। এর একটি ডেপুটি গভর্নর-১ আবুল কাসেমের নেতৃত্বে মূল্যায়ন কমিটি, অপরটি কারিগরি ওয়ার্কিং গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের চারজন মহাব্যবস্থাপক শেষের কমিটিতে রয়েছেন। এই কমিটিগুলোতে স্বতন্ত্রভাবে প্রস্তাবিত ব্যাংকের বিষয়ে সদস্যরা তাঁদের মতামত দেবেন। অবশ্য একটি সূত্র জানায়, এই কমিটিতে একজন মহাব্যবস্থাপক দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
এনআরবি ব্যাংক: এ ছাড়া ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদের কাছে এনআরবি ব্যাংকের যে তিনটি আবেদন জমা আছে, সেই তিনটি ব্যাংকেরও লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে। যুক্তরাজ্য-প্রবাসীদের মধ্য থেকে মূল উদ্যোক্তা হিসেবে ইকবাল আহমেদ একটি ব্যাংকের আবেদন করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী ফরাসত আলী ও নিজাম চৌধুরী মূল উদ্যোক্তা হিসেবে আরও দুটি ব্যাংকের প্রস্তাব করেছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, আবেদনের মধ্য থেকে নয়টি বেসরকারি ব্যাংক দেওয়া হতে পারে। তবে আরেকটি সূত্র জানায়, সাতটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে। এমনকি বাছাইয়ে টেকেনি, এমন আবেদনও ঠিকঠাক করে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠাতে বলা হতে পারে।
এদিকে প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়াতেই কয়েকটি ব্যাংকের যথাযথ কাগজপত্র ছিল না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, খুবই ছোটখাটো বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাবিত ব্যাংকের প্রয়োজনীয় কাগজ আনা হয়। জানা যায়, প্রস্তাবিত ব্যাংকের মূলধন হিসেবে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা কর বিভাগের ১০বি বিবরণ অনুসারে যে সম্পদ দেখিয়েছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সম্পদের মূল্যমান পুনর্নির্ধারণ করে আনতে বলা হয়েছিল।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যে তালিকার কথা শুনলাম, তাতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এর পরও আমি বলব, হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক দিলে সেই ব্যাংকগুলো যদি উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড করে, সেবার মান বাড়ায়, তাহলে সেটা ঠিক আছে। না হলে যে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হবে, তা লাভজনক কিছু বয়ে আনবে না।’ তিনি বলেন, বর্তমানে যে ব্যাংকগুলো আছে, সেগুলোর তারল্য পরিস্থিতিসহ নানা সমস্যা রয়েছে, এটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
১৬ ব্যাংক ও উদ্যোক্তা: প্রাথমিক বাছাইয়ে বিবেচিত নতুন ব্যাংকের তালিকায় আছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’। যদিও এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে জনৈক শহীদুল আলমের। একসময় এরশাদের অর্থকড়ি সংরক্ষণ করতেন গোলাম মসি, যিনি জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনিও ব্যাংকটির একজন উদ্যোক্তা।
আরও আছে ঢাকার সরকারদলীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপসের ‘মধুমতি ব্যাংক’। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে জনৈক হুমায়ুন কবীরের। এনামুল হক চৌধুরীর প্রস্তাবিত ব্যাংকের নাম ‘চার্টার্ড ব্যাংক’। এই ব্যাংকের উদ্যোক্তার তালিকায় নাম রয়েছে সদ্য প্রয়াত সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর।
সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমান ও নসরুল হামিদের প্রস্তাবিত ব্যাংক হচ্ছে ‘মেঘনা ব্যাংক’। চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে আশিকুর রহমানের।
তালিকায় আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ‘ফার্মারস ব্যাংক’। তিনি ব্যাংকটির প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান। ‘কটক বাংলা ব্যাংক’-এর উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছে ভারতের বিখ্যাত কটক মহিন্দ্রা ব্যাংক, যাদের শেয়ার থাকবে ৬০ শতাংশ। এই ব্যাংকে আছে আবদুল মাতলুব আহমাদের নিটল গ্রুপ, প্রাণ এগ্রো বিজনেস ও প্রাণের প্রধান নির্বাহী আমজাদ খান চৌধুরীসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
‘পিপলস ইসলামী ব্যাংক’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তালিকায় আছে আমেরিকা-প্রবাসী আবুল কাসেমের নাম। এর সঙ্গে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের ভাই ইফতেখার আহমেদের (টিপু) ইফাদ অটোস, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। এঁদেরই আরেকটি ব্যাংকের প্রস্তাব রয়েছে, যার নাম ‘ফেডারেল ব্যাংক’। ‘সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে এস এম আমজাদ হোসেনের। উদ্যোক্তাদের মধ্যে আছেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক নেতা অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী।
‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর প্রস্তাবক হলেন দেশের প্রথম অর্থসচিব মতিউল ইসলাম। উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের ১৫টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানি রয়েছে।
আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজমের প্রস্তাবিত ‘দ্য পিপলস ব্যাংক’। এই ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য উদ্যোক্তা হচ্ছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আলী খোকন ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের স্ত্রী সৈয়দ আরজুমান বানু।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলামের প্রস্তাবিত ব্যাংকের নাম ‘ফেডারেল ব্যাংক’। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সরকারদলীয় সাংসদ শাহরিয়ার আলম ও সরকারের শীর্ষপর্যায়ে ঘনিষ্ঠ হাবিবি মিল্লাত। এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের প্রস্তাবিত ব্যাংক হচ্ছে ‘মিডল্যান্ড ব্যাংক’।
হোসনে আরা বেগমের টিএমএসএস প্রস্তাবিত ব্যাংকের নাম ‘ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক’। এই ব্যাংকের সঙ্গে রয়েছে ওবায়দুল করীমের ওরিয়ন ফার্মা, যার প্রতিনিধি ফেরদৌস জামান, বেলহাসা একম জেভির প্রতিনিধি সমরেশ বণিক ও বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের প্রতিনিধি হচ্ছেন ওবায়দুল করীমের ছেলে সালমান ওবায়দুল করীম।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ‘সেলফ এমপ্লয়মেন্ট ব্যাংক’ নামে আবেদন করেছিলেন। সঙ্গে আছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ওহেদুল হক, অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ ভূঁইয়া, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ কয়েকজন শিক্ষাবিদ।
এ ছাড়া আছে ‘কোরিয়া-বাংলা ব্যাংক লি.’। এর প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, মাল্টিপ্ল্যান লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই ব্যাংকের সঙ্গে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, দেশের অর্থনীতি বিবেচনা করলে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক। অতিরিক্ত ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তার পরও দু-তিনটি ব্যাংক দিলে তা সহনীয় হবে। এর বেশি ঠিক হবে না।
প্রক্রিয়া শুরু যেভাবে: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই অর্থমন্ত্রী গত ২৯ জুন বাজেট পাসের দিন জাতীয় সংসদে নতুন ব্যাংকের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করার কথা ঘোষণা দেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম থেকেই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক মত দিয়ে আসছিল। অর্থমন্ত্রী পরে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি নয়। আবার বলেন, তবে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে।
দেশের সীমিত বাজারে অধিকসংখ্যক ব্যাংক থাকায় অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিপূর্বে সরকারকে সতর্ক করেছিল। অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার কারণে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুসারে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা শুধুই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
সরকারের ইচ্ছা পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গত ২৭ সেপ্টেম্বর নতুন ব্যাংকের দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। সেই অনুসারে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৭টি আবেদন জমা পড়ে। দ্রুত নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সরকারের দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আরও বাছাই বাকি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ১৫ মার্চের সভায় নতুন ব্যাংকের প্রস্তাব হাজির করা হতে পারে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক বাছাইয়ের পর আবেদনগুলো আরও দুটি কমিটি মূল্যায়ন করবে। এর একটি ডেপুটি গভর্নর-১ আবুল কাসেমের নেতৃত্বে মূল্যায়ন কমিটি, অপরটি কারিগরি ওয়ার্কিং গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের চারজন মহাব্যবস্থাপক শেষের কমিটিতে রয়েছেন। এই কমিটিগুলোতে স্বতন্ত্রভাবে প্রস্তাবিত ব্যাংকের বিষয়ে সদস্যরা তাঁদের মতামত দেবেন। অবশ্য একটি সূত্র জানায়, এই কমিটিতে একজন মহাব্যবস্থাপক দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
এনআরবি ব্যাংক: এ ছাড়া ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদের কাছে এনআরবি ব্যাংকের যে তিনটি আবেদন জমা আছে, সেই তিনটি ব্যাংকেরও লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে। যুক্তরাজ্য-প্রবাসীদের মধ্য থেকে মূল উদ্যোক্তা হিসেবে ইকবাল আহমেদ একটি ব্যাংকের আবেদন করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী ফরাসত আলী ও নিজাম চৌধুরী মূল উদ্যোক্তা হিসেবে আরও দুটি ব্যাংকের প্রস্তাব করেছেন।
No comments