নির্বাচনের পথ কাঁটায় ভরা by আহমেদ দীপু
আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বর্তমান সংসদই বহাল থাকবে। মন্ত্রীরাও থাকবেন নিজ নিজ পদে। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা যে যাঁর পদে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। বর্তমান সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নতুন নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিয়ে সংসদেও বসতে পারবেন না।
বর্তমান সংসদের মেয়াদ পূর্ণ করে দশম সংসদের জন্য নির্বাচিতরা শপথ নেওয়ার পরই কেবল নবম জাতীয় সংসদের অবসান ঘটবে।
বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এ বিধান যুক্ত করেছে। একই সংশোধনীতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে এ বিধান অনুযায়ী নির্বাচন হলে দশম জাতীয় সংসদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকারি পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে সরকারি প্রভাব কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে। অন্যদিকে বিরোধী দলের যেসব প্রার্থী নির্বাচন করবেন, তাঁরা সরকারি প্রভাব কাজে লাগানোর সুযোগ তো পাবেনই না, উল্টো তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করার আশঙ্কাও রয়েছে বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ ছাড়া আইনগত জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ সংসদ ভেঙে না দিয়ে নির্বাচন হলে বর্তমান সংসদ সদস্য বহাল থাকা অবস্থায় আরো একজন সংসদ সদস্য কিভাবে নির্বাচিত হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সংসদ সদস্যের পদ রাষ্ট্রের লাভজনক পদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আরপিও অনুযায়ী লাভজনক পদে বহাল থেকে কেউ সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ সদস্যরা নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবারও বহালের দাবিতে আন্দোলন করছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকেই মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচন করার বিষয়ে যে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছে এটা বিরোধী দলগুলো কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছে না। কাজেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো এ সংশোধনী বাতিল করে যেকোনো নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নেমেছে বলে জানা গেছে।
বর্তমান সংবিধানের ১২৩ নম্বর অনুচ্ছেদের দফা-৩ উপদফা 'ক'-তে বলা হয়েছে, 'মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে;' সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপদফা 'খ'-তে বলা হয়েছে, 'মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে' সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
১২৩ অনুচ্ছেদের দফা-৩-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, 'তবে শর্ত থাকে যে এই দফার (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপদফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।' সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা ছিল, 'মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।' ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এ বিধানের কারণে মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য কারো নিজ নিজ পদে থেকে নির্বাচন করার সুযোগ ছিল না। সংসদ ভেঙে যাওয়ার কারণে কেউ সংসদ সদস্যই থাকতে পারতেন না, কাজেই পদে থেকে নির্বাচন করার সুযোগও ছিল না। নির্বাচনের সময় যাতে কোনো প্রার্থী নিজের পক্ষে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্য কোনো সরকারি প্রভাব কাজে লাগাতে না পারেন, এ জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু উচ্চ আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার সুযোগে বর্তমান সরকার সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটুকুও বাতিল করে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩-এর ৩ উপ অনুচ্ছেদের দফা 'ক'-তে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ পদে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তবে বর্তমান সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত দশম সংসদের জন্য নির্বাচিতরা সংসদে বসতে পারবেন না। তিনি আরো বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় দেশে কোনো সরকার থাকে না। এটা হতে পারে না। সরকার ছাড়া দেশ চলতে পারে না। এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কি না- এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই। সংসদীয় গণতন্ত্র যেসব দেশে আছে তাদের অনেক দেশে এভাবেই নির্বাচন হচ্ছে।
বিরোধী দল তো বিষয়টি মেনে নিচ্ছে না, তাহলে নির্বাচন কিভাবে হবে- এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দল কী চায়, সেটা সংসদে এসে বলতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, এখানে এসে তাদের সব কথা বলতে হবে।
সংবিধান ও নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা পদে থেকে নির্বাচন করলে সবার জন্য নির্বাচনী মাঠ সমান হবে না। এ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কাজ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, কোনো সংসদ সদস্য বর্তমান পদে থেকে নির্বাচন করলে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনের তাঁর পক্ষে কাজ করার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী নিজের এলাকায় যখন যাবেন প্রশাসনকে তাঁর প্রটোকল দিতেই হবে। নির্বাচনের সময় এটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বিদ্যমান সংসদ ভেঙে না দিয়ে নতুন করে সংসদ নির্বাচন করার নজির খুব বেশি দেশে নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব ড. আকবর আলি খান এ বিষয়ে বলেন, 'আমি মনে করি, এসব বিষয়ে এমন সমাধান হওয়া উচিত যা বিরোধী দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তা না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবেই।'
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এভাবে নির্বাচন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এর ফলে সব প্রার্থীর জন্য নির্বাচনী মাঠ সমান করা যাবে না। আইনগত সমস্যাও আছে। তিনি আরো বলেন, 'পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিলে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা যেমন চলবে তেমনি বিরোধী পক্ষও ছেড়ে দেবে না। ফলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সংবিধান অনুযায়ী একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন মাত্র সংসদ সদস্য থাকবেন। বর্তমান সংসদের কোনো সদস্য নিজ পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হলে দ্বিতীয় কেউ জয়লাভ করবেন। সেই ক্ষেত্রে একটি আসনে দুজন সংসদ সদস্য হবেন। এ সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে?'
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ এ পদ্ধতিতে কখনো সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করার অর্থ হলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা। কারণ সংসদ ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ সদস্যের কোনো দায়িত্ব নেই। সেই ক্ষেত্রে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে সরকারের প্রশাসন। বর্তমান বিধান অনুযায়ী যে নির্বাচন হবে তা অবশ্যই প্রভাবিত করবে সরকার। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্যই বর্তমান সরকার সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিধান রেখেছে। তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের মানুষ তো দূরের কথা আন্তর্জাতিক মহলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই এ বিধান করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের এ স্বপ্ন কখনো পূরণ হওয়ার নয়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে আবার সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী বলেন, 'এ বিষয়ে যেকোনো প্রশ্নের মীমাংসা সংসদেই হতে পারে। আমাদের দিক থেকে এখনো এ নিয়ে কথা বলার সময় হয়নি।'
বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এ বিধান যুক্ত করেছে। একই সংশোধনীতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে এ বিধান অনুযায়ী নির্বাচন হলে দশম জাতীয় সংসদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকারি পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে সরকারি প্রভাব কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে। অন্যদিকে বিরোধী দলের যেসব প্রার্থী নির্বাচন করবেন, তাঁরা সরকারি প্রভাব কাজে লাগানোর সুযোগ তো পাবেনই না, উল্টো তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করার আশঙ্কাও রয়েছে বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ ছাড়া আইনগত জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ সংসদ ভেঙে না দিয়ে নির্বাচন হলে বর্তমান সংসদ সদস্য বহাল থাকা অবস্থায় আরো একজন সংসদ সদস্য কিভাবে নির্বাচিত হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সংসদ সদস্যের পদ রাষ্ট্রের লাভজনক পদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আরপিও অনুযায়ী লাভজনক পদে বহাল থেকে কেউ সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ সদস্যরা নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবারও বহালের দাবিতে আন্দোলন করছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকেই মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচন করার বিষয়ে যে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছে এটা বিরোধী দলগুলো কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছে না। কাজেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো এ সংশোধনী বাতিল করে যেকোনো নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নেমেছে বলে জানা গেছে।
বর্তমান সংবিধানের ১২৩ নম্বর অনুচ্ছেদের দফা-৩ উপদফা 'ক'-তে বলা হয়েছে, 'মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে;' সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপদফা 'খ'-তে বলা হয়েছে, 'মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে' সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
১২৩ অনুচ্ছেদের দফা-৩-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, 'তবে শর্ত থাকে যে এই দফার (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপদফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।' সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা ছিল, 'মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।' ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এ বিধানের কারণে মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য কারো নিজ নিজ পদে থেকে নির্বাচন করার সুযোগ ছিল না। সংসদ ভেঙে যাওয়ার কারণে কেউ সংসদ সদস্যই থাকতে পারতেন না, কাজেই পদে থেকে নির্বাচন করার সুযোগও ছিল না। নির্বাচনের সময় যাতে কোনো প্রার্থী নিজের পক্ষে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্য কোনো সরকারি প্রভাব কাজে লাগাতে না পারেন, এ জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু উচ্চ আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার সুযোগে বর্তমান সরকার সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটুকুও বাতিল করে দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩-এর ৩ উপ অনুচ্ছেদের দফা 'ক'-তে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ পদে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তবে বর্তমান সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত দশম সংসদের জন্য নির্বাচিতরা সংসদে বসতে পারবেন না। তিনি আরো বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় দেশে কোনো সরকার থাকে না। এটা হতে পারে না। সরকার ছাড়া দেশ চলতে পারে না। এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কি না- এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই। সংসদীয় গণতন্ত্র যেসব দেশে আছে তাদের অনেক দেশে এভাবেই নির্বাচন হচ্ছে।
বিরোধী দল তো বিষয়টি মেনে নিচ্ছে না, তাহলে নির্বাচন কিভাবে হবে- এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দল কী চায়, সেটা সংসদে এসে বলতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, এখানে এসে তাদের সব কথা বলতে হবে।
সংবিধান ও নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা পদে থেকে নির্বাচন করলে সবার জন্য নির্বাচনী মাঠ সমান হবে না। এ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কাজ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, কোনো সংসদ সদস্য বর্তমান পদে থেকে নির্বাচন করলে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনের তাঁর পক্ষে কাজ করার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী নিজের এলাকায় যখন যাবেন প্রশাসনকে তাঁর প্রটোকল দিতেই হবে। নির্বাচনের সময় এটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বিদ্যমান সংসদ ভেঙে না দিয়ে নতুন করে সংসদ নির্বাচন করার নজির খুব বেশি দেশে নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব ড. আকবর আলি খান এ বিষয়ে বলেন, 'আমি মনে করি, এসব বিষয়ে এমন সমাধান হওয়া উচিত যা বিরোধী দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তা না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবেই।'
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এভাবে নির্বাচন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এর ফলে সব প্রার্থীর জন্য নির্বাচনী মাঠ সমান করা যাবে না। আইনগত সমস্যাও আছে। তিনি আরো বলেন, 'পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিলে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা যেমন চলবে তেমনি বিরোধী পক্ষও ছেড়ে দেবে না। ফলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সংবিধান অনুযায়ী একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন মাত্র সংসদ সদস্য থাকবেন। বর্তমান সংসদের কোনো সদস্য নিজ পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হলে দ্বিতীয় কেউ জয়লাভ করবেন। সেই ক্ষেত্রে একটি আসনে দুজন সংসদ সদস্য হবেন। এ সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে?'
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ এ পদ্ধতিতে কখনো সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করার অর্থ হলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা। কারণ সংসদ ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ সদস্যের কোনো দায়িত্ব নেই। সেই ক্ষেত্রে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে সরকারের প্রশাসন। বর্তমান বিধান অনুযায়ী যে নির্বাচন হবে তা অবশ্যই প্রভাবিত করবে সরকার। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্যই বর্তমান সরকার সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিধান রেখেছে। তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের মানুষ তো দূরের কথা আন্তর্জাতিক মহলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই এ বিধান করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের এ স্বপ্ন কখনো পূরণ হওয়ার নয়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে আবার সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী বলেন, 'এ বিষয়ে যেকোনো প্রশ্নের মীমাংসা সংসদেই হতে পারে। আমাদের দিক থেকে এখনো এ নিয়ে কথা বলার সময় হয়নি।'
No comments