সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের অকল্পনীয় ঔদ্ধত্যঃ সরকারকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে
গত বছর থেকে সরকার পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করেছে। এ ব্যবস্থার মোদ্দা কথা হচ্ছে এখন থেকে বিভিন্ন স্কুলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে ছাত্ররা পঞ্চম শ্রেণী থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে পারবে না।
সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে একক সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠেয় এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা নিজ নিজ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হবে। প্রাইমারি স্কুলের ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ ছাত্ররা অন্য হাইস্কুলে ভর্তি হবে। এভাবে একই মানের পরীক্ষা দিয়ে ছাত্ররা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ব শেষ করে হাইস্কুলে প্রমোশন পাবে। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ। নতুন এ ব্যবস্থা জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। এর অর্থ হলো, এ ব্যবস্থা মেনে চলা প্রতিটি স্কুলের জন্য বাধ্যতামূলক।
২০০৯ সালে চালু হওয়া এই নতুন ব্যবস্থাটি সফল হয়েছে বলে অনেকে বাহবা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পুরনো ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল এ ব্যবস্থাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। ৭ জানুয়ারি আমার দেশ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ২২ ছাত্র প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগে পাস করা সত্ত্বেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের ষষ্ঠ শ্রেণীতে প্রমোশন দেয়নি; বাধ্য করেছে আবার পঞ্চম শ্রেণীতে থেকে যেতে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সরকারি নীতির বিপরীতে অবস্থান নিয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রদের একটা মডেল টেস্ট নিয়েছিল। এ পরীক্ষায় ওই ছাত্ররা তেমন একটা ভালো ফল করেনি। এখন স্কুল কর্তৃপক্ষ এটাকে বার্ষিক পরীক্ষা দাবি করে বলতে চাইছে, এটাই আসল পরীক্ষা। সরকারিভাবে অনুষ্ঠিত সমাপনী পরীক্ষার ফল তাদের কাছে বিবেচ্য নয়। সেন্ট গ্রেগরি স্কুল নাকি বিশেষ ধরনের স্কুল। তাই এ স্কুল বিশেষ ব্যবস্থাতেই চলবে।
যে ২২ ছাত্র স্কুল কর্তৃপক্ষের এহেন হঠকারিতা ও ঔদ্ধত্যের শিকার হয়েছে, তাদের অভিভাবকরা স্বাভাবিক কারণেই হতাশ এবং উদ্বিগ্ন। বাড়াবাড়ি করলে স্কুল কর্তৃপক্ষ ওই ছাত্রদের টিসি দেয়ার ভয় দেখানোয় তারা আরও মুষড়ে পড়েছেন। বলাবাহুল্য, এটা শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক চালু করা নতুন ব্যবস্থার প্রতি বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে। এবছর যদি অন্যান্য ‘নামি-দামি’ স্কুলও সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার গোটা ব্যবস্থাই অর্থহীন হয়ে যাবে।
সেন্ট গ্রেগরি একটি ঐতিহ্যবাহী মিশনারি স্কুল। একসময় খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলগুলো এদেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সমাজের পিছিয়েপড়া অংশের অনেক গরিব অথচ মেধাবী সন্তান এসব স্কুলের পরিচর্যায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তেমন নজিরের অভাব নেই। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলও একটা ভালো স্কুল হিসেবে সমাজে পরিচিত। মিশনারি স্কুলগুলো যীশুখ্রিস্টের প্রদর্শিত আলোকিত পথের যাত্রী হয়ে প্রেম, ভালোবাসা ও মানবাধিকারের আদর্শ সমুন্নত রাখার সাধনায় নিবেদিত—এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে রয়েছে। কিন্তু সেন্ট গ্রেগরি স্কুল রাষ্ট্রের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২২ কোমলমতি ছাত্রের সঙ্গে যে আচরণ করল, তা অবশ্যই যীশুর মমত্ববোধের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটা বস্তুত রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার সামিল।
আমরা আমার দেশ-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বার বার বলে আসছি যে, বিগত সেনাসমর্থিত জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের সার্বভৌমত্বের ভিতকে নড়বড়ে করে ফেলেছে। গণবিরোধী অবস্থান নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে যে, কথায় ও আচরণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে, বাংলাদেশের আইন, কনভেনশন ও প্রথাকে অবজ্ঞা করতে কেউ আর ইতস্তত করছে না। চক্ষুলজ্জার আবরণটুকুও যেন সরে গেছে। আমরা আশা করেছিলাম, জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আপদ বিদায় হওয়ার পর পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাস্তবে উন্নতির পরিবর্তে বরং পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বর্তমান সরকার তাদের এক বছরের ‘সাফল্য’র আনন্দে বিভোর। এদিকে খোদ রাজধানী ঢাকার একটা মিশনারি স্কুল যে তাদের শিক্ষা সংস্কারের শিকড় উপড়ে ফেলতে চাইছে, সেদিকে কারও খেয়াল নেই। আমরা এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এমন পদক্ষেপ দাবি করি যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অহমিকায় অন্ধ হয়ে এভাবে আইনকে পদদলিত করার ঔদ্ধত্য না দেখায়।
No comments