এই নগরীর দিনরাত্রিঃ শীতের প্রকোপে দিশেহারা by রেজোয়ান সিদ্দিকী
দেশজুড়ে শীত জেঁকে বসেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ ঢাকার চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকায় সর্বনিম্ন ১০হ্ন থেকে ১২হ্ন সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলেও উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা আরও কম। সেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেশি। শীতকে প্রতিহত করার মতো গরম কাপড় তাদের নেই। তেমনি আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের পর্যাপ্ত উপকরণেরও অভাব।
ফলে তারা শীতের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হচ্ছে। প্রচণ্ড শীতে ডজন ডজন মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। নগরীর অবস্থা ততটা বেশামাল নয়। মানুষ সাধ্যমত শীতবস্ত্র পরে ঠাণ্ডা ঠেকানোর কোশেশ করছে এবং একটুখানি উত্তাপের আশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের প্রতীক্ষা করছে। গ্রীষ্মে যে সূর্যের তাপ এড়ানোর জন্য নাগরিক মানুষ একটুখানি ছায়া একটুখানি মেঘের আশা করেছে। এখন আর তাদের ছায়া কিংবা মেঘ চাই না, সূর্যের খরতাপ চাই।
আবার পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ্বে যখন এই তীব্র শীত বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাংশে তখন খরতাপ। বাংলাদেশের গড়পড়তা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলেও অস্ট্রেলিয়ার গড় তাপমাত্রা হলো ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখানে তীব্র গরমে নাগরিকরা নাকাল হচ্ছে। আমরা সূর্যের প্রার্থনা করছি, তারা সূর্যের খরতাপ থেকে মুক্তি চায়। সম্ভবত এটাই নিয়ম। দেশভেদে, কালভেদে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিনিয়তই বদলে যেতে থাকে।
আমরা সবকিছু আমাদের অনুকূলে পেতে চাই। কখনোই বুঝতে চাই না যে, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম আছে। সে নিয়ম ঘুরতে ঘুরতে কখনও মানুষের অনুকূল হয়, কখনও প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে যায়। জগত্ সংসারের এটাই নিয়ম।
শীত নিবারণে নগরবাসীর প্রাণান্ত প্রয়াস আছে। কিন্তু ছিন্নমূল যারা, পথের পাশে পলিথিনের ঘের যাদের আশ্রয়, সংসার তাদের অবস্থাও সঙ্গীন। ছিন্ন কাঁথায় শীত নিবারণের প্রয়াস। তারা ছোট ছোট শিশুদের এই কনকনে শীতের মধ্যেও সামান্য বস্ত্রে ভিক্ষার জন্য রাস্তায় নামিয়ে দেয়। কোনো কোনো শিশু পালকের ভাঙা ডাস্টার হাতে গাড়ির ধুলো ঝাড়ার চেষ্টা করে। চালকরা কাচ খুলে তাদের তাড়ায়। কেউ কেউ দুই-এক টাকার নোট বা মুদ্রা ছুড়ে দেয়। আবার কেউ কেউ মধ্যরাতে শীতার্ত মানুষের সেবায় তাদের গায়ে কম্বল বিছিয়ে দেয়। এদের জীবনে শীত-গ্রীষ্মের ভেদ অতি সামান্যই। গ্রীষ্ম বা বর্ষায় প্রচণ্ড খরতাপে কিংবা অঝোর বৃষ্টিতে যেমন তারা পথের পাশে জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকে, শীতেও তেমনি কাঁপতে কাঁপতে ভিক্ষার হাত বাড়ায়।
পৃথিবীর এমন কোনো শহর নেই যেখানে এ রকম বিপন্ন মানুষ নেই। সব শহরেই গৃহহীন মানুষ আছে। তারা শীতের ভেতরে পার্কের বেঞ্চে কিংবা বাসস্টেশনে হোল্ডঅলের ভেতরে ঘুমায়। সকালে হোল্ডঅল গুছিয়ে সেটা পিঠে নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু করে। নগরীর যারা পত্তন ঘটিয়েছিলেন তারা এমন চিত্রের কথা সম্ভবত কল্পনাও করেননি। সভ্যতার বিকাশে প্রাথমিক যুগে নগরীর গোড়াপত্তন। আগেই এই দেয়াল দিয়ে নগরীর সীমারেখা নির্ধারিত হয়। তারপর ঠিক হতো কারা ওই নগরীর কোথায় থাকে। কাদের কী কাজ হবে। সেখানে উদ্বাস্তু মানুষের আনাগোনার কোনো সুযোগ ছিল না।
কিন্তু নগরকে এরকম নিয়মের নিগড়ে বেশিদিন আবদ্ধ রাখা যায়নি। এখন আর দেওয়াল ঘেরা নগরীর কল্পনাও কেউ করে না। আপন নিয়মেই নগর বিস্তৃত হতে থাকে, যার খুশি নগরে আসেন, যার খুশি রয়ে যান। কেউ কেউ ফিরে যান উেসর কাছে। ফলে এই নগরীতে ভাগ্যান্বেষী উদ্বাস্তু মানুষ বেড়েছে। শীত-গ্রীষ্মে তাদের দায়িত্ব কেউ বহন করতে চায় না। কিন্তু আমরা কখনও ভেবে দেখি না যে এরাও আদম সন্তান; এদের প্রতিও আমাদের সম্পন্ন নাগরিকদের দায়িত্ব আছে। আমাদের মধ্যে যাদের সাধ্য আছে, তারা যদি মনে করি এমন প্রচণ্ড শীতে অন্তত একজন করে মানুষকে শীত নিবারণে সাহায্য করব তাহলে বোধকরি ছিন্নমূল মানুষের কষ্ট খানিকটা দূর হতো। কিন্তু নাগরিকের এতটা ভাববার অবকাশ কোথায়।
একটি কাকের মৃত্যু
হিসাব না করেও বলা যায় নাগরিক পাখিদের মধ্যে কাকের সংখ্যায়ই সবচেয়ে বেশি। এ নগরে যে অন্য কোনো পাখি একেবারেই দেখা যায় না এমন কথা বলব না। এখানে চড়াই আছে, দোয়েল আছে, কখনও কখনও ঘুঘুর ডাকও শোনা যায়। কখনও হঠাত্ আমগাছে উড়ে আসে দুই-একটি ইষ্টিকুটুম, কাঠ ঠোকড়ার ডাকও শোনা যায়। গাছপালা যেখানে এখনও অবশিষ্ট আছে সেখানে রাতে শোনা যায় হুতুম পেঁচার কর্কশ ধ্বনি। তবুও নগরীতে কাকই বেশি। কাক বেশি থাকার কারণও আছে, তাহলো আমরা যেখানে-সেখানে উচ্ছিষ্ট ফেলে কাকের খাবারের সংস্থান রাখি। আমরা বন উজাড় করেছি। কাকের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করেছি। কিন্তু নগরীর পথে পথে আবর্জনা ফেলে কাকের জন্য যথেষ্ট খাবারের বন্দোবস্ত রেখেছি। কাকের অনেক উপকারের কাহিনী আমরা পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। একটি কাক একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চেয়ে কম আবর্জনা সাফ করে না। কাক যদি নিজে নিজেই নিজ কাঁধে এমন দায়িত্ব তুলে না নিত তাহলে এ নগরী বাসযোগ্য থাকত কি না সন্দেহ আছে। কিন্তু মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে কোনো কাক নেই। কাকদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশ নিষিদ্ধ করার আগে তারা বনায়ন করে কাকের জন্য নতুন বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এতটাই নিশ্চিদ্র যে সেখানে রাস্তাঘাটে কাকদের খাবার পড়ে থাকে না। ফলে কাক যে আসবে, খাবে কী। সে কারণে কাকেরা কুয়ালালামপুর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু আমাদের তো কাক না হলে চলে না। কেননা আমরা এখনও অতটা সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি। নগর পালকরাও নগরীর পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে পারেনি। কাক টুকটাক মাছ-টাছ চুরি করে। পোষা পাখিকে জ্বালায়, তা সত্ত্বেও আমরা কী সহ্য করি। কাকের জন্য বড় মমতা। আমার বাসার কাছে নানা ধরনের গাছপালা। সুতরাং এখানে অসংখ্য কাকের বাস। কখনও কখনও কোনো কোনো গাছে এত কাক এসে বসে যে, সে গাছের পাতাও দেখা যায় না। শুধু কাক আর কাক। তাদের সম্মিলিত ধ্বনিতে চমকিত হতেই হয়। একদিন দেখি কাঁঠাল গাছের ডালে একটি প্রবীণ কাক বড় বেশি কষ্টে উড়ে এসে বসে। হাঁটতে গেলে একটি পাখা ছড়িয়ে যায়। যেন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। তারপর ঝাঁক বেঁধে তাকে আর উড়ে যেতে দেখি না। গাছের ডাল থেকে ডালে কিংবা মাটিতে ঘাসের ভেতরে সে তার খাদ্যের সন্ধান করে। খাদ্যের অন্বেষণে বহুদূর যেতে পারে না। কী হয়েছিল এই কাকের। খাদ্যের জন্য সেকি প্রতিপক্ষের সঙ্গে কঠোর লড়াইয়ে আহত হয়েছে? নাকি সামান্য বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়েছিল? বলতে পারি না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সে চুপটি করে বসে আছে গাছের ডালে। এক. বাঁ দিকে পাখাটা সামান্য বিস্তৃত। দুই. একটা পোকামাকড় ধরার চেষ্টা। কষ্টে এ ডাল থেকে ও ডালে। ঠাণ্ডায় মনে হয় জমেই যাচ্ছে সে। আমি ভেবেছিলাম অন্য কোনো কাক তার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে আনবে। সে নমুনা দেখতে পাইনি। ভাত ছিটিয়ে দিলে সে নামার আগেই হঠাত্ কোথা থেকে ডজন ডজন কাক এসে নিমিশেই সে খাবার ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধ ক্লান্ত কাক নিচে নেমে দুই-একটি ভাতের সন্ধান করছে, তারপর ফিরে গেছে আবারও গাছের ডালে।
সোমবার ভোরে দেখি শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কাকটি। মনে হলো কাঁপছে সে। মনে হলো যেন ঠিকমত বসে থাকতে পারছে না। তারপর এক সময় ডাল থেকে ধুপ করে পড়ে গেল নিচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোথা থেকে এক ঝাঁক কাক উড়ে এসে কাকা রবে শোর তুলল। অনেক কাকই কাকটিকে ঘিরে কিছুক্ষণ শোরগোল করে হঠাত্ এক সময় সবাই উড়ে গেল যার যার জীবিকার ধান্ধায়। কাক সমাজের এটাই নিয়ম। খুব বেশিক্ষণ কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। ফলে একটি স্বজাতির মৃত্যু তাদের খুব বেশি সাড়া দিতে পারে না। আমরা নাগরিক মানুষও কি কাকের এই নিয়তির খুব বেশি বাইরে থাকি।
স্বাগত নববর্ষ
খ্রিস্টীয় সাল গণনায় গত শুক্রবার নববর্ষ শুরু হয়ে গেছে। এই নববর্ষ উদযাপন নিয়ে প্রতি বছর এক দারুণ উত্কণ্ঠার মধ্যে পড়ে সরকার। তরুণরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। রাজপথে বেসামাল হয়। দল বেঁধে হল্লা করে জানান দিতে চায় যে, নতুন বছর শুরু হয়ে গেল। এই জানান দেয়ার ভেতরে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি বিগত প্রায় এক দশক ধরে নববর্ষ উদযাপনের নামে উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়েছে। তারুণ্য সব সময় শৃঙ্খলা মানে না। নিয়ম থাকলে তা ভাঙার চেষ্টা করে। ফলে পৃথিবীর দেশে দেশে নববর্ষ নিয়ে কম কাণ্ড ঘটেনি। কিন্তু এবার ২০১০ সালের আগমনী মুহূর্তে সেই বাঁধভাঙা উচ্ছৃঙ্খল কোথায়ও দেখা যায়নি। এর জন্য পুলিশকে সাবাস দিতে হয় বৈকি। খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মধ্যরাতে সাংবাদিকরা, টিভি ক্যামেরা ম্যানরা রাত ১১টার মধ্যেই বিভিন্ন স্পটে মোতায়েন হয়ে যায়। যদি কিছু ঘটে, যদি কিছু পাওয়া যায়। এবার সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে গেছে। পুলিশ সন্ধ্যার পরপরই সারা শহরে কড়া অবস্থান নিয়েছে। সব পানশালা বন্ধ করে দিয়েছে। এলাকায় এলাকায় মাইকিং করে সতর্ক করে, তার ওপর প্রচণ্ড শীত। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণেই ছিল সব কিছু। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিছুসংখ্যক ছাত্র (ছাত্রী নয়) সমবেত হয়ে উল্লাস করার চেষ্টা করেছে। ওটুকুই। নগরীতে যদি এ ধারা অব্যাহত রাখা যায় তাহলে সব নাগরিক তাকে স্বাগত জানাবে।
ফুটনোট
আমার এক প্রবাসী বন্ধু আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘অমন সুন্দর বাড়িটি ভাড়া দিয়ে এমন এক আদিম বাড়িতে উঠলেন কেন?’ আমি বললাম, ‘বেশকিছু ঋণ আছি, সেটা শোধ করার জন্য।’ আর তাকে বললাম, ‘রাতে কিছুটা স্ট্যাপল ফুড খাওয়া ভালো। তিনি বললেন, ‘আপনি তো দেখি আস্ত একটা মিসকিন, গরিব।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘কেন’। তিনি বললেন, ‘দুই কারণে। এক. আপনি ভাতের চিন্তা করছেন। ভাতের চিন্তা করে গরিবেরা। আপনি ঋণ শোধের চিন্তা করছেন। ঋণ শোধ করে এবং ঋণ শোধের চিন্তা করে গরিবেরা। পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করার জন্য পাগল হয়ে যান। আর বড়লোকেরা ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েও তা শোধ করার চিন্তা করে না।’ আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আপনি একটু মুটিয়ে গেছেন। চার-পাঁচ কেজি ওজন কমান।’ তিনি বললেন, ‘ও কিছু না। বয়সে ফ্যাট।’ আমি বললাম, ‘আমার বয়স তো আপনার চাইতে বেশি। আমার তো কোনো বয়সের ফ্যাট নেই।’ তিনি বললেন, ‘গরিব রিকশাওয়ালারাও ফ্যাট থাকে না, আমি চেতনায়ও গরিব। এরকম মিসকিনের সঙ্গে পয়সা খরচ করে কথা বলার যথেষ্ট সময় আমার নেই।’ বলেই তিনি সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করলেন।
লেখক : ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
No comments