ইরানে সম্ভাব্য হামলা-ইসরায়েলের পথে যেসব বাধা by মাহফুজার রহমান
বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক চাপ ও আলোচনা বারবার ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর আগাম হামলার কথা জোরালো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাত্রা আরও কঠোর করার জন্য চাপ দিয়েছে।
ফলে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামর্থ্য যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি পাশ্চাত্যে তেল রপ্তানি অনেকখানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, কূটনৈতিক সমাধানের পথ এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু এ বছরের কোনো একসময় ইসরায়েল ইরানে হামলা করে বসতে পারে— এ মর্মে গুঞ্জন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
শত্রু দেশের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের আগাম হামলা চালানোর একাধিক নজির আছে। ইরানে হামলার আশঙ্কার পেছনে ভিত্তি জুগিয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কথাবার্তাও। সর্বশেষ গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের হাতে যাতে পরমাণু অস্ত্র না আসে, তা ঠেকাতে ইসরায়েল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইসরায়েলপন্থী প্রভাবশালী সংগঠন আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (এইপ্যাক) সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি আমার দেশের মানুষকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে থাকতে দিতে পারি না।’
এ অবস্থায় ইসরায়েল সত্যিই ইরানে হামলা করবে কি না আর তার সামরিক সক্ষমতাই বা কতটুকু—এ নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েল নানাভাবে তার সামরিক শক্তি বাড়িয়ে এসেছে। বিশেষ করে বিমানবাহিনীর। ইসরায়েলি এয়ারফোর্স (আইএএফ) ১২৫টি অত্যাধুনিক এফ-১৫ আই ও এফ-১৬ আই যুদ্ধবিমান কিনেছে। অপেক্ষাকৃত দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম ট্যাংক তৈরি করেছে তারা। কিনেছে বাংকার ধ্বংস করতে সক্ষম বিশেষায়িত অস্ত্র। চালকবিহীন বিমানের আধুনিকায়ন করেছে ইসরায়েল। সব মিলিয়ে দেশটির সাম্প্রতিক অস্ত্র ক্রয় ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য দূরপাল্লার অভিযান চালানোর সক্ষমতা বাড়ানো।
ইসরায়েল ১৯৮১ সালের জুনে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের কাছে ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে যুদ্ধবিমানের হামলা চালায়। তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার একটি স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় দেশটি। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, সেটি ছিল একটি নির্মাণাধীন পারমাণবিক স্থাপনা।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইরানে সম্ভাব্য হামলা ইরাক বা সিরিয়ার মতো হবে না। কারণ, ওই দুটি দেশে হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল একটিমাত্র। এসব স্থাপনা ভূগর্ভস্থও ছিল না। ইরানে হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। যেমন দূরত্ব, একাধিক স্থাপনা, পাল্টা হামলার আশঙ্কা ইত্যাদি। এসব কারণে ইরানে হামলা অনেক কঠিন হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
ইসরায়েল থেকে ইরানে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুগুলোর গড় দূরত্ব দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার। বিমান হামলা চালানোর জন্য ইরানের আকাশসীমায় পৌঁছানো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হামলা চালানোর পর ফিরে আসা।
তিনটি পথ ব্যবহার করে ইরানে হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল। একটি হলো দেশটির উত্তরাঞ্চল থেকে। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান উত্তর দিক থেকে উড়ে পূর্ব দিকে ঘুরে তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত দিয়ে এবং এরপর তুরস্ক ও ইরাক সীমান্ত দিয়ে উড়ে গিয়ে হামলা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দেশের মধ্যাঞ্চল দিয়ে (যার সম্ভাবনা বেশি) ইরাকের ওপর দিয়ে গিয়ে হামলা চালাতে পারে। ইরাক থেকে মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ায় দেশটির নিজের আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণের তেমন সামর্থ্য নেই। তাদের এই দুর্বলতা কাজে লাগাতে পারে ইসরায়েল। তৃতীয়ত, দক্ষিণ দিক দিয়ে সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে ইরানে হামলা চালানো সম্ভব। তবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ থাকলেও ইসরায়েলকে সৌদি আরব সেই অনুমতি দেবে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে।
যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই তা হচ্ছে, এ রকম দূরপাল্লার যাত্রায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে পথে নতুন করে জ্বালানি নিতেই হবে।
লন্ডনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) ডগলাস ব্যারি বলেন, ‘আকাশে জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে বিমানে জ্বালানি ভরার বিষয়টি হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, শুধু হামলা করাই শেষ কথা নয়। হামলা চালানোর পর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে ফিরেও আসতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি দরকার। ইসরায়েল থেকে একবার জ্বালানি নিয়ে ইরানে হামলা চালিয়ে আবার ফিরে আসা ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের জন্য কঠিন হবে।
ইসরায়েলের জ্বালানির আধার-সংবলিত আট থেকে ১০টি বাণিজ্যিক বোয়িং ৭০৭ বিমান আছে। তবে এসব বিমান অভিযানের ক্ষেত্রে সেভাবে কাজে লাগবে না বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
ডগলাস ব্যারি বলেন, ইসরায়েল এখন ভাবছে, কোথায় হামলা করলে ইরানের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। তারা বুঝতে চায়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল স্থাপনা কোথায়। কোন স্থাপনায় সামরিক উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চলছে, তা চিহ্নিত করতে চায় ইসরায়েল।
ইসরায়েলের বিবেচনায় হামলার তালিকায় প্রথম দিকেই থাকার কথা তেহরানের দক্ষিণের নাতাঞ্জ এবং পবিত্র বলে পরিচিত কুম শহরের ‘ফোর্দো’ পরমাণু স্থাপনা। এ ছাড়া আরাকে একটি চুল্লি নির্মাণাধীন। ইস্পাহান নগরেও রয়েছে পারমাণবিক স্থাপনা। তাই হামলার তালিকায় এসব শহরও থাকতে পারে।
তবে ইসরায়েলের জন্য নাতাঞ্জ ও ফোর্দোতে হামলা চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করা কঠিন হতে পারে। কারণ, নাতাঞ্জের স্থাপনা ভূগর্ভস্থ। আর ফোর্দোর স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে পর্বতময় এলাকায়।
ডগলাস ব্যারির মতে, এসব এলাকায় হামলা চালানোর জন্য ভালো গোয়েন্দা তথ্য প্রয়োজন। লক্ষ্যস্থলের অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্যসংগ্রহ করতে হবে। জানতে হবে স্থাপনার নকশা ও গঠন-সম্পর্কিত তথ্য। তবে তিনি এ-ও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন থেকেই ইরানের এসব স্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় হামলার জন্য বিশেষ ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজন। তবে ভূগর্ভস্থ স্থাপনার বিষয়টি শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নেই। এ কারণে অস্ত্র নির্মাতারা তা ধ্বংস করার মতো শক্তিশালী অস্ত্র নির্মাণে সব সময়ই সচেষ্ট। আর ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের এ বিষয়ে ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে।
ইসরায়েলের হাতে ভূগর্ভস্থ স্থানে হামলার জন্য রয়েছে ‘জিবিইউ-২৮’। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এটা পেয়েছে তারা। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এটা প্রথম ব্যবহার করে। দুই হাজার ২৬৮ কেজি ওজনের এ অস্ত্রটি লেজার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এখন এটা আরও আধুনিক করা হয়েছে।
তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইএইচএস জেনসের এয়ার লঞ্চড ওয়েপনস বিভাগের সম্পাদক রবার্ট হিউসন বলেন, জিবিইউ-২৮-এর সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নির্ভর করবে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যস্থির করার তথ্য পাওয়ার ওপর। আদর্শ কোণ থেকে ছোড়া যায় না বলে পর্বত বা গুহায় এর কার্যকারিতা কম। শুধু এফ-১৫ আই থেকে এ বোমা নিক্ষেপ করা যায়। আর বিমানটি একবারে মাত্র একটি বোমা বহনে সক্ষম। সাফল্যের জন্য তুলনামূলকভাবে কাছ থেকে আঘাত করার শর্তটিও একটি সমস্যা। নাতাঞ্জ ও ফোর্দোর ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংসে এগুলো কতটা কার্যকর হবে, তা বলা যে কারও পক্ষেই কঠিন। তার পরও বলতে হয়, বিদ্যমান অন্য যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে এটি বেশি কার্যকর।
ডগলাস ব্যারি অবশ্য বলছেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে প্রচুর বিদ্যুৎ লাগে। তাই ইসরায়েল ইরানের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে হামলা চালিয়েও তা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এতক্ষণ ইসরায়েলের যেসব অস্ত্র নিয়ে আলোচনা হলো তার কথা মোটামুটি সবার জানা। এগুলো প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা পেয়েছে। কিন্তু সমর প্রযুক্তিতে বেশ অগ্রসর ইসরায়েল নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়েও কোনো গোপন অস্ত্র তৈরি করে থাকতে পারে। ইরানের ওপর হামলায় তা ব্যবহার করা হতে পারে। ইসরায়েল দূরপাল্লার হেরন বা এইতান চালকবিহীন বিমান ব্যবহার করে হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসলীলা পর্যবেক্ষণও করতে পারে।
অন্যদিকে হামলা হলে ইরানও বসে থাকবে না। তারাও বাঁচার চেষ্টা করবে। রুশ প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও যথেষ্ট দক্ষ। ইসরায়েলি পাইলটদের তা ভালোই জানা।
ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া এসএ-৫। এ ছাড়া টর-এম-১/এসএ-১৫ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। রাশিয়া তার সবচেয়ে শক্তিশালী দূরপাল্লার এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও নানা কারণে তা সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। তবে ইরান অন্য সূত্রে কয়েকটি এস-৩০০ পাওয়ার দাবি করেছে।
ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভবত সেকেলে হয়ে গেছে। কিন্তু তা এখনো বড় হুমকি।
ইসরায়েলের ছোট আকারের কিছু ডুবোজাহাজ আছে, যা ইরানের ওপর হামলায় ব্যবহূত হতে পারে। লন্ডনের আইআইএসএসের বিশেষজ্ঞ ডগলাস ব্যারি বলেন, ইসরায়েলের কাছে জার্মানির তৈরি ডলফিন ডুবোজাহাজ আছে, যা থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা সম্ভব। ইরানের এসএ-৫ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসে কার্যকর হতে পারে ওই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
ইরানের বিমানবাহিনীর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৪ টোমাহক ও রাশিয়ার তৈরি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান। ইরানের দিক থেকে পাল্টা হামলার আশঙ্কা ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলতে পারে। তার পরও বেশির ভাগ বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েল ইরানে হামলা চালিয়ে দেশটির পরমাণু কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি করতে পারবে।
তবে বিশেষজ্ঞ ডগলাস ব্যারির মতে, হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েল হয়তো তার শক্তির খুব কমই ব্যবহার করতে পারবে। তিনি বলেন, ইসরায়েল হামলা চালাতে সফল হলেও তা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে হয়তো শুধু বিলম্বিত করতে পারবে। আইএইচএস জেনসের বিশ্লেষক রবার্ট হিউসনও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন। হিউসন বলেন, ইরান অবশ্যই হামলা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। ইসরায়েল হামলা চালিয়ে হয়তো ইরানের কিছু ক্ষতি করতে পারবে। কিন্তু পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংস বা বিলম্বিত করতে সক্ষম নাও হতে পারে। ইরানে হামলা হলে যুদ্ধ বিশ্বব্যাপীও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হয়তো এসব বিবেচনা থেকেই কয়েক দিন আগে মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব জেনারেল স্টাফ চেয়ারম্যান মার্টিন ডেম্পসি বলেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলা সুবিবেচনার কাজ হবে না। এই হামলা বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। সর্বোপরি ইসরায়েলকে কিছু হিসাব-নিকাশ করতে হবে।
এর পরও কি ইসরায়েল ইরানে হামলার সাহস পাবে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই।
তথ্য সূত্র : বিবিসি।
শত্রু দেশের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের আগাম হামলা চালানোর একাধিক নজির আছে। ইরানে হামলার আশঙ্কার পেছনে ভিত্তি জুগিয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কথাবার্তাও। সর্বশেষ গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের হাতে যাতে পরমাণু অস্ত্র না আসে, তা ঠেকাতে ইসরায়েল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইসরায়েলপন্থী প্রভাবশালী সংগঠন আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (এইপ্যাক) সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি আমার দেশের মানুষকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে থাকতে দিতে পারি না।’
এ অবস্থায় ইসরায়েল সত্যিই ইরানে হামলা করবে কি না আর তার সামরিক সক্ষমতাই বা কতটুকু—এ নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েল নানাভাবে তার সামরিক শক্তি বাড়িয়ে এসেছে। বিশেষ করে বিমানবাহিনীর। ইসরায়েলি এয়ারফোর্স (আইএএফ) ১২৫টি অত্যাধুনিক এফ-১৫ আই ও এফ-১৬ আই যুদ্ধবিমান কিনেছে। অপেক্ষাকৃত দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম ট্যাংক তৈরি করেছে তারা। কিনেছে বাংকার ধ্বংস করতে সক্ষম বিশেষায়িত অস্ত্র। চালকবিহীন বিমানের আধুনিকায়ন করেছে ইসরায়েল। সব মিলিয়ে দেশটির সাম্প্রতিক অস্ত্র ক্রয় ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য দূরপাল্লার অভিযান চালানোর সক্ষমতা বাড়ানো।
ইসরায়েল ১৯৮১ সালের জুনে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের কাছে ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে যুদ্ধবিমানের হামলা চালায়। তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার একটি স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় দেশটি। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, সেটি ছিল একটি নির্মাণাধীন পারমাণবিক স্থাপনা।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইরানে সম্ভাব্য হামলা ইরাক বা সিরিয়ার মতো হবে না। কারণ, ওই দুটি দেশে হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল একটিমাত্র। এসব স্থাপনা ভূগর্ভস্থও ছিল না। ইরানে হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। যেমন দূরত্ব, একাধিক স্থাপনা, পাল্টা হামলার আশঙ্কা ইত্যাদি। এসব কারণে ইরানে হামলা অনেক কঠিন হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
ইসরায়েল থেকে ইরানে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুগুলোর গড় দূরত্ব দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার। বিমান হামলা চালানোর জন্য ইরানের আকাশসীমায় পৌঁছানো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হামলা চালানোর পর ফিরে আসা।
তিনটি পথ ব্যবহার করে ইরানে হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল। একটি হলো দেশটির উত্তরাঞ্চল থেকে। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান উত্তর দিক থেকে উড়ে পূর্ব দিকে ঘুরে তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত দিয়ে এবং এরপর তুরস্ক ও ইরাক সীমান্ত দিয়ে উড়ে গিয়ে হামলা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দেশের মধ্যাঞ্চল দিয়ে (যার সম্ভাবনা বেশি) ইরাকের ওপর দিয়ে গিয়ে হামলা চালাতে পারে। ইরাক থেকে মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ায় দেশটির নিজের আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণের তেমন সামর্থ্য নেই। তাদের এই দুর্বলতা কাজে লাগাতে পারে ইসরায়েল। তৃতীয়ত, দক্ষিণ দিক দিয়ে সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে ইরানে হামলা চালানো সম্ভব। তবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ থাকলেও ইসরায়েলকে সৌদি আরব সেই অনুমতি দেবে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে।
যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই তা হচ্ছে, এ রকম দূরপাল্লার যাত্রায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে পথে নতুন করে জ্বালানি নিতেই হবে।
লন্ডনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) ডগলাস ব্যারি বলেন, ‘আকাশে জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে বিমানে জ্বালানি ভরার বিষয়টি হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, শুধু হামলা করাই শেষ কথা নয়। হামলা চালানোর পর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে ফিরেও আসতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি দরকার। ইসরায়েল থেকে একবার জ্বালানি নিয়ে ইরানে হামলা চালিয়ে আবার ফিরে আসা ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের জন্য কঠিন হবে।
ইসরায়েলের জ্বালানির আধার-সংবলিত আট থেকে ১০টি বাণিজ্যিক বোয়িং ৭০৭ বিমান আছে। তবে এসব বিমান অভিযানের ক্ষেত্রে সেভাবে কাজে লাগবে না বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
ডগলাস ব্যারি বলেন, ইসরায়েল এখন ভাবছে, কোথায় হামলা করলে ইরানের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। তারা বুঝতে চায়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল স্থাপনা কোথায়। কোন স্থাপনায় সামরিক উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চলছে, তা চিহ্নিত করতে চায় ইসরায়েল।
ইসরায়েলের বিবেচনায় হামলার তালিকায় প্রথম দিকেই থাকার কথা তেহরানের দক্ষিণের নাতাঞ্জ এবং পবিত্র বলে পরিচিত কুম শহরের ‘ফোর্দো’ পরমাণু স্থাপনা। এ ছাড়া আরাকে একটি চুল্লি নির্মাণাধীন। ইস্পাহান নগরেও রয়েছে পারমাণবিক স্থাপনা। তাই হামলার তালিকায় এসব শহরও থাকতে পারে।
তবে ইসরায়েলের জন্য নাতাঞ্জ ও ফোর্দোতে হামলা চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করা কঠিন হতে পারে। কারণ, নাতাঞ্জের স্থাপনা ভূগর্ভস্থ। আর ফোর্দোর স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে পর্বতময় এলাকায়।
ডগলাস ব্যারির মতে, এসব এলাকায় হামলা চালানোর জন্য ভালো গোয়েন্দা তথ্য প্রয়োজন। লক্ষ্যস্থলের অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্যসংগ্রহ করতে হবে। জানতে হবে স্থাপনার নকশা ও গঠন-সম্পর্কিত তথ্য। তবে তিনি এ-ও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন থেকেই ইরানের এসব স্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় হামলার জন্য বিশেষ ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজন। তবে ভূগর্ভস্থ স্থাপনার বিষয়টি শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নেই। এ কারণে অস্ত্র নির্মাতারা তা ধ্বংস করার মতো শক্তিশালী অস্ত্র নির্মাণে সব সময়ই সচেষ্ট। আর ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের এ বিষয়ে ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে।
ইসরায়েলের হাতে ভূগর্ভস্থ স্থানে হামলার জন্য রয়েছে ‘জিবিইউ-২৮’। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এটা পেয়েছে তারা। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এটা প্রথম ব্যবহার করে। দুই হাজার ২৬৮ কেজি ওজনের এ অস্ত্রটি লেজার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এখন এটা আরও আধুনিক করা হয়েছে।
তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইএইচএস জেনসের এয়ার লঞ্চড ওয়েপনস বিভাগের সম্পাদক রবার্ট হিউসন বলেন, জিবিইউ-২৮-এর সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নির্ভর করবে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যস্থির করার তথ্য পাওয়ার ওপর। আদর্শ কোণ থেকে ছোড়া যায় না বলে পর্বত বা গুহায় এর কার্যকারিতা কম। শুধু এফ-১৫ আই থেকে এ বোমা নিক্ষেপ করা যায়। আর বিমানটি একবারে মাত্র একটি বোমা বহনে সক্ষম। সাফল্যের জন্য তুলনামূলকভাবে কাছ থেকে আঘাত করার শর্তটিও একটি সমস্যা। নাতাঞ্জ ও ফোর্দোর ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ধ্বংসে এগুলো কতটা কার্যকর হবে, তা বলা যে কারও পক্ষেই কঠিন। তার পরও বলতে হয়, বিদ্যমান অন্য যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে এটি বেশি কার্যকর।
ডগলাস ব্যারি অবশ্য বলছেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে প্রচুর বিদ্যুৎ লাগে। তাই ইসরায়েল ইরানের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে হামলা চালিয়েও তা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এতক্ষণ ইসরায়েলের যেসব অস্ত্র নিয়ে আলোচনা হলো তার কথা মোটামুটি সবার জানা। এগুলো প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা পেয়েছে। কিন্তু সমর প্রযুক্তিতে বেশ অগ্রসর ইসরায়েল নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়েও কোনো গোপন অস্ত্র তৈরি করে থাকতে পারে। ইরানের ওপর হামলায় তা ব্যবহার করা হতে পারে। ইসরায়েল দূরপাল্লার হেরন বা এইতান চালকবিহীন বিমান ব্যবহার করে হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসলীলা পর্যবেক্ষণও করতে পারে।
অন্যদিকে হামলা হলে ইরানও বসে থাকবে না। তারাও বাঁচার চেষ্টা করবে। রুশ প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও যথেষ্ট দক্ষ। ইসরায়েলি পাইলটদের তা ভালোই জানা।
ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া এসএ-৫। এ ছাড়া টর-এম-১/এসএ-১৫ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। রাশিয়া তার সবচেয়ে শক্তিশালী দূরপাল্লার এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও নানা কারণে তা সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। তবে ইরান অন্য সূত্রে কয়েকটি এস-৩০০ পাওয়ার দাবি করেছে।
ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভবত সেকেলে হয়ে গেছে। কিন্তু তা এখনো বড় হুমকি।
ইসরায়েলের ছোট আকারের কিছু ডুবোজাহাজ আছে, যা ইরানের ওপর হামলায় ব্যবহূত হতে পারে। লন্ডনের আইআইএসএসের বিশেষজ্ঞ ডগলাস ব্যারি বলেন, ইসরায়েলের কাছে জার্মানির তৈরি ডলফিন ডুবোজাহাজ আছে, যা থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা সম্ভব। ইরানের এসএ-৫ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসে কার্যকর হতে পারে ওই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
ইরানের বিমানবাহিনীর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৪ টোমাহক ও রাশিয়ার তৈরি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান। ইরানের দিক থেকে পাল্টা হামলার আশঙ্কা ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলতে পারে। তার পরও বেশির ভাগ বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েল ইরানে হামলা চালিয়ে দেশটির পরমাণু কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি করতে পারবে।
তবে বিশেষজ্ঞ ডগলাস ব্যারির মতে, হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েল হয়তো তার শক্তির খুব কমই ব্যবহার করতে পারবে। তিনি বলেন, ইসরায়েল হামলা চালাতে সফল হলেও তা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে হয়তো শুধু বিলম্বিত করতে পারবে। আইএইচএস জেনসের বিশ্লেষক রবার্ট হিউসনও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন। হিউসন বলেন, ইরান অবশ্যই হামলা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। ইসরায়েল হামলা চালিয়ে হয়তো ইরানের কিছু ক্ষতি করতে পারবে। কিন্তু পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংস বা বিলম্বিত করতে সক্ষম নাও হতে পারে। ইরানে হামলা হলে যুদ্ধ বিশ্বব্যাপীও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হয়তো এসব বিবেচনা থেকেই কয়েক দিন আগে মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব জেনারেল স্টাফ চেয়ারম্যান মার্টিন ডেম্পসি বলেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলা সুবিবেচনার কাজ হবে না। এই হামলা বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। সর্বোপরি ইসরায়েলকে কিছু হিসাব-নিকাশ করতে হবে।
এর পরও কি ইসরায়েল ইরানে হামলার সাহস পাবে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই।
তথ্য সূত্র : বিবিসি।
No comments