সময়চিত্র-১২ মার্চ ঘিরে আশঙ্কা by আসিফ নজরুল
৭ মার্চ বাংলাদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে তৈরি থাকার তাগিদ এবং আত্মবিশ্বাস প্রদান করেছিল। দিনটি এবার আওয়ামী লীগ উদ্যাপন করেছে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে। এর পেছনে বাড়তি একটি উদ্দেশ্য ছিল,
১২ মার্চের বিরোধী দলগুলোর ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির আগেই নিজেদের জনসমর্থন ও শক্তিমত্তা প্রদর্শন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীসহ দলের অন্যান্য নেতার বক্তব্যে তা-ই লক্ষ করা গেছে। দলটির গত কয়েকটি কর্মসূচির তুলনায় এদিন জনসমাগম অনেক বেশি ছিল। দলের সভানেত্রী সম্ভবত এতে উৎফুল্ল হয়েছেন এবং বিরোধী দলের নেত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আজ দেখুন জনতার ঢল!’
এমনিতে বড় দুটো দলের পক্ষে রাজপথে জনতার ঢল নামানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারে থাকলে জনসভায় আসার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনামা পাঠানো যায়, বিরোধী দলে থাকলে সরকারের ব্যর্থতা পুঁজি করে জনগণকে কাছে টানা যায়। সরকারের বড় সমাবেশ ঠেকানোর ক্ষমতা থাকে না বিরোধী দলের, কিন্তু সরকার পারে বিরোধী দলের জন্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে। ১২ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কি তা-ই করবে? ১২ মার্চ কি জনতার সমর্থন দেখানোর সুযোগ দেওয়া হবে বিএনপিকে? এর দুই দিন পর সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররাও। মানুষের আশঙ্কা: রাজপথে পাল্টাপাল্টি এসব শক্তির মহড়া কোথায় নিয়ে যাবে দেশকে? কী প্রমাণ করতে চাইছে বড় দুটো দল, বিশাল বিশাল জনসমাবেশ করে কী বার্তা দিতে চাচ্ছে তারা দেশের মানুষকে?
১২ মার্চ কর্মসূচি সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি এবং তার মিত্ররা। দলটির সাম্প্রতিক রোডমার্চগুলোতে অভাবনীয় জনসমাগম, স্থানীয় পরিষদসহ বিভিন্ন নির্বাচনে সাফল্য এবং নতুন মহাসচিবের উজ্জ্বল উপস্থিতি দলটির কর্মীদের মধ্যে নতুন আশাবাদ ও প্রত্যয় সৃষ্টি করেছে। ১২ মার্চ ঢাকা চলো কর্মসূচি তাই স্মরণকালের অন্যতম বৃহত্তম জনসমাগমে পরিণত হতে পারে। শুধু বিএনপির সমর্থকেরাই নয়, অর্থনীতি ও বিদেশনীতিতে সরকারের ব্যর্থতা ও সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ মানুষও বিএনপির ১২ মার্চ কর্মসূচির দিকে তাকিয়ে থাকবে বলে মনে হচ্ছে। এদের একটি বড় অংশ হয়রানি ও নির্যাতনের আশঙ্কা না থাকলে এদিন ঢাকা চলো কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারে এবং সেটি হলে তা এই সরকারের প্রতি জনগণের বৃহত্তর অংশের অনাস্থার একটি বড় প্রতিফলন হয়ে উঠতে পারে।
স্পষ্টতই সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সম্ভাবনা রোখার চেষ্টায় নেমে পড়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে থেকে আসা লোকদের না থাকতে দেওয়ার জন্য হোটেল মালিকদের ও ১২ মার্চে বিএনপির সমর্থকদের পরিবহন-সুবিধা না দেওয়ার জন্য বাসমালিকদের শাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১২ মার্চ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর হুমকি দিয়েছেন, আইন প্রতিমন্ত্রী জনসভার জন্য আসা লোকদের ধাওয়া দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, জনসভার খরচ অনুসন্ধানের জন্য দুদককেও মাঠে নামানো হতে পারে, সিলেটের ঘটনার মাধ্যমে এই হুমকিও হয়তো রয়ে গেছে। বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এসব হুমকিতে দোদুল্যমান মানুষকে মাঠে নামানোর দৃঢ় সাংগঠনিক শক্তি দেখানো। সেটি করা গেলে ১২ মার্চে জনতার আরও অনেক বড় ঢল দেখানো সম্ভব।
মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চাচ্ছে বিএনপি, সেটি অর্জন করা শেষ পর্যন্ত আদৌ সম্ভব হবে কি?
২.
বিএনপির বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, ১২ মার্চ কর্মসূচির আসল লক্ষ্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করা। ঠিক একই কাজ আওয়ামী লীগ সফলতার সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছিল ১৯৯৬ সালের আন্দোলনের মাধ্যমে। প্রায় দেড় যুগ পর আজকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তুলনামূলক সক্ষমতা সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার একটি বড় প্রমাণ সংবিধান সংশোধনী কমিটির আলোচনায় এই সরকারব্যবস্থার পক্ষে বিভিন্ন মহলের বক্তব্য। পত্রিকাগুলোর পাঠক জরিপেও ব্যতিক্রমহীনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনগণ মতামত দিয়েছে।
বিএনপি ১২ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আবারও করবে। দ্রব্যমূল্য, শেয়ারবাজার, সরকারের ভারতনীতি, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও তারা কথা বলবে, এটি ধারণা করা যায়। বিএনপির সভায় প্রচুর আশ্বাস থাকবে, যতটুকু আশ্বাস পূরণের ক্ষমতা হয়তো তাদের নেই। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের প্রচুর অভিযোগও থাকবে, যার সবকিছু হয়তো সত্যি নয়। কিন্তু আমার ধারণা, এ ধরনের কোনো অভিযোগ বা আশ্বাস সরকারকে বিচলিত করবে না। সরকারের উৎকণ্ঠা থাকবে কেবল দুটো বিষয়ে। এক. ঢাকা চলো কর্মসূচিতে আসা মানুষ সাম্প্রতিক আরব বসন্তের ঘটনাগুলোর মতো অব্যাহতভাবে অবস্থান করে সরকারের পতনের আন্দোলন শুরু করে কি না? দুই. কোনো নাশকতার কারণে লগি-বৈঠা পরিস্থিতি এবং পরবর্তী সময়ে এক-এগারোর মতো কোনো সুযোগ তৈরি হয় কি না? এই দুই আশঙ্কার কোনো একটি সত্যি হলে নির্ধারিত মেয়াদের আগে সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হতে পারে এবং বিএনপি বা অন্য কোনো মহল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এসব আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। মানুষ যদি অব্যাহতভাবে রাস্তায় অবস্থান শুরু করে, তাহলে তা জনদুর্ভোগের কারণ হবে, নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত হবে। এতে নাশকতা বা সরকারের সমর্থকদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়বে। যদি সত্যি নাশকতা বা সংঘর্ষ হয়, সরকার তখন কঠোর দমননীতিতে নামতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে নাশকতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।
সরকারের আশঙ্কা বা হুঁশিয়ারি পুরোপুরি অমূলক নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী এবং জঙ্গি দমনের কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ক্রোধ থাকতে পারে। ঢাকা চলো কর্মসূচিতে লাখ লাখ লোকের সমাগম হলে সেখানে বা সেখান থেকে নাশকতা তাই হতে পারে। গোড়াতেই গণ-আন্দোলন বা অব্যাহত অবস্থানের সম্ভাবনা নস্যাৎ করার লক্ষ্যে নাশকতা হতে পারে, এমনকি সরকারের কোনো কোনো মহল থেকে। সরকার নাশকতা করে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়ে দেবে, এ আশঙ্কাও বিরোধী দল প্রকাশ করেছে এরই মধ্যে।
নাশকতা করার পরিকল্পনা যদি থাকে কোনো মহলের, তাহলে তার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কারও জন্য ভালো হবে না। প্রায় সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে বড় দুটো দল ও তাদের সমর্থকেরা যদি সংঘর্ষে মেতে ওঠেন, তাহলে আবারও এক-এগারোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমার ধারণা, এ ধরনের বিপদ সম্পর্কে দুটো দলই সচেতন রয়েছে। বিএনপি এর আগের কর্মসূচিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করেছে, সরকারও তেমন কোনো বাধা দেয়নি এসব কর্মসূচিতে। আমরা মনে করি, একই মনোভাব ১২ মার্চ কর্মসূচিতেও বহাল রাখা উচিত। রাজধানী শহরে লাখ লাখ লোকের সমাবেশে কোনো উসকানি দেওয়া হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা একপর্যায়ে সম্ভব না-ও হতে পারে। এটি মনে রেখে, বিশেষ করে সরকারের কোনো প্রকার উসকানি দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত, বিরোধী দলের এ ধরনের পরিকল্পনা থাকলে সরকারের আগেই তা নস্যাৎ করা উচিত। তবে এই অজুহাতে সরকার যড়যন্ত্রমূলকভাবে দমননীতি চালালে কিংবা শেষ মুহূর্তে ১২ মার্চ কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে চাইলে সেটিই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য বড় উসকানি হয়ে উঠবে।
৩.
১২ মার্চ কর্মসূচির পর কী? বিএনপি কি এই দিনের জনসমাবেশের শক্তি ও উদ্যমকে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তর করার ক্ষমতা রাখে? আগামী মে মাসে এইচএসসি পরীক্ষা এবং প্রায় একই সময়ের বর্ষাকাল আন্দোলন অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বিরোধী দলগুলোর জন্য। বাংলাদেশের ইতিহাসও বলে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের সেরা ও অনুকূল সময় হচ্ছে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। বিএনপি বা তার মিত্রদের কেউ যদি হঠকারী পথে যেতে চায়, তাহলে সম্ভব হলে আগামী এক মাসেই সরকার পতনের পরিস্থিতি সৃষ্টির চিন্তা থাকবে তাদের। এ পথ খুবই বিপজ্জনক, ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো বিবেকবান মানুষের কাম্য হবে বরং শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাই যেন অব্যাহত রাখে বিএনপি। তার সঙ্গে সঙ্গে আগামী নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে যৌক্তিক বিকল্প উত্থাপন করে সংসদ ও সংসদের বাইরে আলোচনার জন্য আন্তরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে দলটিকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না যে কেবল শুভবুদ্ধিপ্রসূত হয়ে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করতে রাজি হবে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা ক্ষমতা হারানোর পর জেল, জুলুম ও নির্যাতনের আশঙ্কা করে থাকেন। নিজ আমলে বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে সেই সুযোগও তাঁরা অনেকাংশে তৈরি করে দিয়ে যান। ক্ষমতা হারানোর বিভীষিকাময় পরিণতির আশঙ্কা থেকেই মূলত সরকারগুলো যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জিতে আসতে চায়। এভাবে নির্বাচনে জিতে আসা দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস তা-ই বলে। বিএনপি যদি তাই আলোচনার দ্বার খোলা রাখার পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নমনীয় করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে, তাহলে তাকে তাই অযৌক্তিক বলা যাবে না। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ তা-ই করেছে। তবে ২০০১ সালে বিএনপি কর্তৃক সাজানো নির্বাচন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ রাজপথে কিছু হঠকারিতা করেছিল বলে অনির্বাচিত সরকার আসার পথ সুগম হয়েছিল, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এর মূল্য দিতে হয়েছে। বিএনপির তাই উচিত হবে, শুধু নিজেদের হঠকারিতা পরিহার করা নয়, জোটসঙ্গী উগ্রবাদী কোনো গোষ্ঠীর স্যাবোটাজের চিন্তা থাকলে তার দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা। না হলে বাংলাদেশকে ঘিরে কিছু আন্তর্জাতিক মহল যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, অরাজক অবস্থায় সম্ভবত তাদের চিন্তা থাকবে নিজেদের স্বার্থানুগ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো নয়।
আমরা চাই, ১২ ও ১৪ মার্চে দুই প্রধান দলের সর্বোচ্চ সংযম, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। ২০১২ সালের মার্চ হোক সমাধান শুরু খোঁজার মাস, সমস্যা শুরুর নয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এমনিতে বড় দুটো দলের পক্ষে রাজপথে জনতার ঢল নামানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারে থাকলে জনসভায় আসার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনামা পাঠানো যায়, বিরোধী দলে থাকলে সরকারের ব্যর্থতা পুঁজি করে জনগণকে কাছে টানা যায়। সরকারের বড় সমাবেশ ঠেকানোর ক্ষমতা থাকে না বিরোধী দলের, কিন্তু সরকার পারে বিরোধী দলের জন্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে। ১২ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কি তা-ই করবে? ১২ মার্চ কি জনতার সমর্থন দেখানোর সুযোগ দেওয়া হবে বিএনপিকে? এর দুই দিন পর সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররাও। মানুষের আশঙ্কা: রাজপথে পাল্টাপাল্টি এসব শক্তির মহড়া কোথায় নিয়ে যাবে দেশকে? কী প্রমাণ করতে চাইছে বড় দুটো দল, বিশাল বিশাল জনসমাবেশ করে কী বার্তা দিতে চাচ্ছে তারা দেশের মানুষকে?
১২ মার্চ কর্মসূচি সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি এবং তার মিত্ররা। দলটির সাম্প্রতিক রোডমার্চগুলোতে অভাবনীয় জনসমাগম, স্থানীয় পরিষদসহ বিভিন্ন নির্বাচনে সাফল্য এবং নতুন মহাসচিবের উজ্জ্বল উপস্থিতি দলটির কর্মীদের মধ্যে নতুন আশাবাদ ও প্রত্যয় সৃষ্টি করেছে। ১২ মার্চ ঢাকা চলো কর্মসূচি তাই স্মরণকালের অন্যতম বৃহত্তম জনসমাগমে পরিণত হতে পারে। শুধু বিএনপির সমর্থকেরাই নয়, অর্থনীতি ও বিদেশনীতিতে সরকারের ব্যর্থতা ও সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ মানুষও বিএনপির ১২ মার্চ কর্মসূচির দিকে তাকিয়ে থাকবে বলে মনে হচ্ছে। এদের একটি বড় অংশ হয়রানি ও নির্যাতনের আশঙ্কা না থাকলে এদিন ঢাকা চলো কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারে এবং সেটি হলে তা এই সরকারের প্রতি জনগণের বৃহত্তর অংশের অনাস্থার একটি বড় প্রতিফলন হয়ে উঠতে পারে।
স্পষ্টতই সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সম্ভাবনা রোখার চেষ্টায় নেমে পড়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে থেকে আসা লোকদের না থাকতে দেওয়ার জন্য হোটেল মালিকদের ও ১২ মার্চে বিএনপির সমর্থকদের পরিবহন-সুবিধা না দেওয়ার জন্য বাসমালিকদের শাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১২ মার্চ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর হুমকি দিয়েছেন, আইন প্রতিমন্ত্রী জনসভার জন্য আসা লোকদের ধাওয়া দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, জনসভার খরচ অনুসন্ধানের জন্য দুদককেও মাঠে নামানো হতে পারে, সিলেটের ঘটনার মাধ্যমে এই হুমকিও হয়তো রয়ে গেছে। বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এসব হুমকিতে দোদুল্যমান মানুষকে মাঠে নামানোর দৃঢ় সাংগঠনিক শক্তি দেখানো। সেটি করা গেলে ১২ মার্চে জনতার আরও অনেক বড় ঢল দেখানো সম্ভব।
মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চাচ্ছে বিএনপি, সেটি অর্জন করা শেষ পর্যন্ত আদৌ সম্ভব হবে কি?
২.
বিএনপির বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, ১২ মার্চ কর্মসূচির আসল লক্ষ্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করা। ঠিক একই কাজ আওয়ামী লীগ সফলতার সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছিল ১৯৯৬ সালের আন্দোলনের মাধ্যমে। প্রায় দেড় যুগ পর আজকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তুলনামূলক সক্ষমতা সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার একটি বড় প্রমাণ সংবিধান সংশোধনী কমিটির আলোচনায় এই সরকারব্যবস্থার পক্ষে বিভিন্ন মহলের বক্তব্য। পত্রিকাগুলোর পাঠক জরিপেও ব্যতিক্রমহীনভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনগণ মতামত দিয়েছে।
বিএনপি ১২ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আবারও করবে। দ্রব্যমূল্য, শেয়ারবাজার, সরকারের ভারতনীতি, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও তারা কথা বলবে, এটি ধারণা করা যায়। বিএনপির সভায় প্রচুর আশ্বাস থাকবে, যতটুকু আশ্বাস পূরণের ক্ষমতা হয়তো তাদের নেই। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের প্রচুর অভিযোগও থাকবে, যার সবকিছু হয়তো সত্যি নয়। কিন্তু আমার ধারণা, এ ধরনের কোনো অভিযোগ বা আশ্বাস সরকারকে বিচলিত করবে না। সরকারের উৎকণ্ঠা থাকবে কেবল দুটো বিষয়ে। এক. ঢাকা চলো কর্মসূচিতে আসা মানুষ সাম্প্রতিক আরব বসন্তের ঘটনাগুলোর মতো অব্যাহতভাবে অবস্থান করে সরকারের পতনের আন্দোলন শুরু করে কি না? দুই. কোনো নাশকতার কারণে লগি-বৈঠা পরিস্থিতি এবং পরবর্তী সময়ে এক-এগারোর মতো কোনো সুযোগ তৈরি হয় কি না? এই দুই আশঙ্কার কোনো একটি সত্যি হলে নির্ধারিত মেয়াদের আগে সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হতে পারে এবং বিএনপি বা অন্য কোনো মহল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এসব আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। মানুষ যদি অব্যাহতভাবে রাস্তায় অবস্থান শুরু করে, তাহলে তা জনদুর্ভোগের কারণ হবে, নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত হবে। এতে নাশকতা বা সরকারের সমর্থকদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়বে। যদি সত্যি নাশকতা বা সংঘর্ষ হয়, সরকার তখন কঠোর দমননীতিতে নামতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে নাশকতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।
সরকারের আশঙ্কা বা হুঁশিয়ারি পুরোপুরি অমূলক নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী এবং জঙ্গি দমনের কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ক্রোধ থাকতে পারে। ঢাকা চলো কর্মসূচিতে লাখ লাখ লোকের সমাগম হলে সেখানে বা সেখান থেকে নাশকতা তাই হতে পারে। গোড়াতেই গণ-আন্দোলন বা অব্যাহত অবস্থানের সম্ভাবনা নস্যাৎ করার লক্ষ্যে নাশকতা হতে পারে, এমনকি সরকারের কোনো কোনো মহল থেকে। সরকার নাশকতা করে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়ে দেবে, এ আশঙ্কাও বিরোধী দল প্রকাশ করেছে এরই মধ্যে।
নাশকতা করার পরিকল্পনা যদি থাকে কোনো মহলের, তাহলে তার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কারও জন্য ভালো হবে না। প্রায় সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে বড় দুটো দল ও তাদের সমর্থকেরা যদি সংঘর্ষে মেতে ওঠেন, তাহলে আবারও এক-এগারোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমার ধারণা, এ ধরনের বিপদ সম্পর্কে দুটো দলই সচেতন রয়েছে। বিএনপি এর আগের কর্মসূচিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করেছে, সরকারও তেমন কোনো বাধা দেয়নি এসব কর্মসূচিতে। আমরা মনে করি, একই মনোভাব ১২ মার্চ কর্মসূচিতেও বহাল রাখা উচিত। রাজধানী শহরে লাখ লাখ লোকের সমাবেশে কোনো উসকানি দেওয়া হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা একপর্যায়ে সম্ভব না-ও হতে পারে। এটি মনে রেখে, বিশেষ করে সরকারের কোনো প্রকার উসকানি দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত, বিরোধী দলের এ ধরনের পরিকল্পনা থাকলে সরকারের আগেই তা নস্যাৎ করা উচিত। তবে এই অজুহাতে সরকার যড়যন্ত্রমূলকভাবে দমননীতি চালালে কিংবা শেষ মুহূর্তে ১২ মার্চ কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে চাইলে সেটিই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য বড় উসকানি হয়ে উঠবে।
৩.
১২ মার্চ কর্মসূচির পর কী? বিএনপি কি এই দিনের জনসমাবেশের শক্তি ও উদ্যমকে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তর করার ক্ষমতা রাখে? আগামী মে মাসে এইচএসসি পরীক্ষা এবং প্রায় একই সময়ের বর্ষাকাল আন্দোলন অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বিরোধী দলগুলোর জন্য। বাংলাদেশের ইতিহাসও বলে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের সেরা ও অনুকূল সময় হচ্ছে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। বিএনপি বা তার মিত্রদের কেউ যদি হঠকারী পথে যেতে চায়, তাহলে সম্ভব হলে আগামী এক মাসেই সরকার পতনের পরিস্থিতি সৃষ্টির চিন্তা থাকবে তাদের। এ পথ খুবই বিপজ্জনক, ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো বিবেকবান মানুষের কাম্য হবে বরং শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাই যেন অব্যাহত রাখে বিএনপি। তার সঙ্গে সঙ্গে আগামী নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে যৌক্তিক বিকল্প উত্থাপন করে সংসদ ও সংসদের বাইরে আলোচনার জন্য আন্তরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে দলটিকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না যে কেবল শুভবুদ্ধিপ্রসূত হয়ে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করতে রাজি হবে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা ক্ষমতা হারানোর পর জেল, জুলুম ও নির্যাতনের আশঙ্কা করে থাকেন। নিজ আমলে বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে সেই সুযোগও তাঁরা অনেকাংশে তৈরি করে দিয়ে যান। ক্ষমতা হারানোর বিভীষিকাময় পরিণতির আশঙ্কা থেকেই মূলত সরকারগুলো যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জিতে আসতে চায়। এভাবে নির্বাচনে জিতে আসা দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস তা-ই বলে। বিএনপি যদি তাই আলোচনার দ্বার খোলা রাখার পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নমনীয় করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে, তাহলে তাকে তাই অযৌক্তিক বলা যাবে না। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ তা-ই করেছে। তবে ২০০১ সালে বিএনপি কর্তৃক সাজানো নির্বাচন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ রাজপথে কিছু হঠকারিতা করেছিল বলে অনির্বাচিত সরকার আসার পথ সুগম হয়েছিল, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এর মূল্য দিতে হয়েছে। বিএনপির তাই উচিত হবে, শুধু নিজেদের হঠকারিতা পরিহার করা নয়, জোটসঙ্গী উগ্রবাদী কোনো গোষ্ঠীর স্যাবোটাজের চিন্তা থাকলে তার দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা। না হলে বাংলাদেশকে ঘিরে কিছু আন্তর্জাতিক মহল যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, অরাজক অবস্থায় সম্ভবত তাদের চিন্তা থাকবে নিজেদের স্বার্থানুগ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো নয়।
আমরা চাই, ১২ ও ১৪ মার্চে দুই প্রধান দলের সর্বোচ্চ সংযম, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। ২০১২ সালের মার্চ হোক সমাধান শুরু খোঁজার মাস, সমস্যা শুরুর নয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments