ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান। গম আত্মসাৎ মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। এখন তিনি সিলেটে সহকারী উপ-কর কমিশনার। আর তাঁর বদলে জেল খাটছেন অন্যজ-সবই সম্ভব!

ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালে গম আত্মসাৎ করেছিলেন তিনি। এরপর পলাতক। এক যুগ পলাতক থাকার সময় সরকারি চাকরি হয় তাঁর। চাকরি পাওয়ার পরের বছর গম আত্মসাৎ মামলার রায় হয়। রায়ে তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। সাজা পাওয়ার পরও তিনি চাকরি করছেন। আর টাকার বিনিময়ে তাঁর বদলে জেল খাটছেন অন্য এক ব্যক্তি।


অভিনব প্রতারণাকারী এই ব্যক্তির নাম আবদুর রহমান। তিনি সহকারী উপ-কর কমিশনার, এখন সিলেটে কর্মরত। তাঁর পক্ষে হাজিরা দিতে গিয়ে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যিনি সাজা ভোগ করছেন, তিনি সিলেটের লোক, নাম আবদুর রউফ (৫৫)। আর সাজাপ্রাপ্ত আবদুর রহমানের বাড়ি নীলফামারীতে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) শামীমা আখতার গতকাল সোমবার রংপুর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে এক আবেদনে জানান, সাজাপ্রাপ্ত ওই আসামি প্রকৃত আবদুর রহমান নন, তিনি আসলে আবদুর রউফ। তিনি আবদুর রহমান সেজে গত ২৯ জানুয়ারি রংপুরের আদালতে আপিলের জন্য হাজির হলে বিচারক তাঁকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন।
দুদক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, সাজাপ্রাপ্ত আবদুর রহমান সিলেটে কর্মরত আছেন। আত্মসমর্পণকারী ব্যক্তি রহমান নন। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুদকের পিপি শামীমা আখতার পুলিশ সুপার বরাবর আবেদন করেন।
পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি আইন অনুযায়ী বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারে নয়। তার পরও প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) দিয়ে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সরেজমিনে তদন্ত করে জানা গেছে, নীলফামারীর সাজাপ্রাপ্ত আবদুর রহমানের নামে সিলেটের আবদুর রউফ নামের এক ব্যক্তি জেলে রয়েছেন।
রংপুর দুদকের উপপরিচালক জহুরুল হুদা এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, সাজাপ্রাপ্ত রহমান সহকারী উপ-কর কমিশনার পদে বহাল তবিয়তে আছেন। বিষয়টি জানিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে রংপুরের জ্যেষ্ঠ জজ আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করা হয়েছে।
রংপুরের কারাধ্যক্ষ জাভেদ মেহেদী বলেন, এখানে যিনি এসেছেন, তিনি আদালতের মাধ্যমেই এসেছেন। তবে বিষয়টি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে।
যা ঘটেছিল: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবদুর রহমান ১৯৮৯ সালে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময় তিনি কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় নদী খনন ও মৎস্য চাষ প্রকল্পের প্রকল্প চেয়ারম্যান ছিলেন। এ কাজের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪০ মেট্রিক টন গম। এর মধ্যে ১১৫ মেট্রিক টন গমের কোনো কাজ করা হয়নি। এই গম তিনি আত্মসাৎ করেন। রংপুর জেলা দুদকের তৎকালীন কর্মকর্তা আবদুস সোবহান ’৯৩ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে ডিমলা থানায় মামলা করেন (নম্বর ০৩)। মামলাটি তদন্ত শেষে বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য রংপুরের বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হয়। ২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর মামলার রায় হয়। রায়ে পলাতক অবস্থায় তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ছয় লাখ ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। আবদুর রহমান দীর্ঘদিন পলাতক থাকায় গত বছরের ১৭ অক্টোবর রংপুরের বিশেষ আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এদিকে রায় হওয়ার আগের বছর ২০০৩ সালের শেষ দিকে আবদুর রহমান মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে ভুয়া সনদ দেখিয়ে সরকারি চাকরি নেন। তিনি এখন সিলেট সার্কেল-১ কর কার্যালয়ে সহকারী উপ-কর কমিশনার হিসেবে কর্মরত।
৫০ হাজার টাকায় রফা: সিলেটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আবদুর রহমান সিলেটের আবদুর রউফকে (৫৫) রংপুরের আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য রাজি করান। এ জন্য আবদুর রউফের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকায় সমঝোতা হয়।
কারাবন্দী আবদুর রউফের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এইমাত্র জানলাম, আমার স্বামী রংপুরের জেলে আছেন। গত ২৭ জানুয়ারি আমার স্বামী ঠিকাদারি কাজের কথা বলে রংপুরে যান। পরদিন ফোনে বলেন, “আমাদের বাড়ির পাশের ইসকান্দর আলী কিছু টাকা দেবে, তা নিয়ে রেখে দিয়ো।” এর পরদিন থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।’
রউফের একমাত্র ছেলে আজিম আহমদ বলেন, ‘বাবাকে আমরা খুঁজছি। তাঁর মোবাইল ফোনটিও বন্ধ।’
এ ঘটনায় মধ্যস্থতাকারী রউফের প্রতিবেশী ইসকান্দর বলেন, ‘আবদুর রহমান ভালো মানুষ। ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মধ্যস্থতা করেছি। এই টাকার মধ্যে ৪০ হাজার টাকা রউফের স্ত্রীকে দেই। বাকি ১০ হাজার টাকা আমি রেখে দিয়েছি।’
রহমান উধাও!: আবদুর রহমান গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত সিলেটে অফিস করেছেন। এরপর অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে তাঁর গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার পশ্চিম খড়িবাড়ী গ্রামে গেলে তাঁর স্ত্রী কোনো কথা না বলে দরজা বন্ধ করে দেন।
ওই মামলার খালাস পাওয়া আসামি বর্তমানে ডিমলা উপজেলার চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমিও ওই মামলার আসামি ছিলাম। বেকসুর খালাস পাই। কিন্তু গয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির প্রকল্প চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের তিন বছর জেল হয়। তখন থেকে তিনি পলাতক।

No comments

Powered by Blogger.