প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ নিয়ে কিছু কথা by ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ৫ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর পৌনে এক ঘণ্টার ভাষণে তিন বছরে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর ভাষণে সরকারের সাফল্যগাথাই বেশি ছিল, দেশ যে বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে তাঁর সরকার কী ভূমিকা নিতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি, গ্যাস সংকটের বিষয়টি যে তাঁর বক্তব্যে উঠে
আসবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। আমি তাতে অবাক হইনি। এটি মূলত একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। দিকনির্দেশনামূলক কোনো বক্তব্য আমি খুঁজে পাইনি তাঁর ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকার পরিচালনায় তিনি বিরোধী দলের কোনো সহযোগিতা পাননি। তিনি মিথ্যা বলেননি। তিনি সহযোগিতা পাননি এটা সত্য, কিন্তু বিরোধী দল কোনো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করেনি এটাও সত্য। আমরা বারবার বলে আসছি, বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতি চর্চা ও গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। গত তিন বছরে এই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বেশ কিছু ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। এ ব্যবধান দূর করা না গেলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে তা থেকেই যাবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এ দূরত্ব কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা দেননি। তিনি বিরোধী দলকে জনগণের স্বার্থে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটা আরো ভালো হতো যদি তিনি জাতীয় ইস্যু নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে একটা সংলাপের আহ্বান জানাতেন। কিন্তু সেই আহ্বান তিনি জানাননি। গেল তিন বছরে বেশ কিছু জাতীয় ইস্যু তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটা জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। বিশেষ করে টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তার পানিবণ্টন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার ইত্যাদি প্রশ্নে একটা ঐকমত্য প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। একটা ভালো দিক হচ্ছে রাষ্ট্রপতির আহ্বানে বিএনপি সাড়া দিয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে কতটুকু কী অর্জিত হবে, আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিরোধী দলের প্রস্তাব যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে জটিলতা থেকেই যাবে। রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ে না হোক সিনিয়র পর্যায়ে ইস্যুভিত্তিক আলোচনা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এ রকম একটি ইঙ্গিত দিতে পারতেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই সাধারণ মানুষই ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সরকারের কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। অতীতে বাণিজ্যমন্ত্রীর অতিকথনে মানুষ ছিল বিরক্ত। সেই বাণিজ্যমন্ত্রী এখন নেই বটে, কিন্তু বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রীর কোনো কর্মকাণ্ডও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো নয়। বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার যখন ক্ষমতা নেয়, তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.০৬ শতাংশ, আর মূল্যস্ফীতির হার এখন ১১.৫৮ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামত প্রয়োজন। সরকারের ভর্তুকি নিয়েও সমস্যা রয়েছে। ক্ষমতা নেওয়ার সময় ভর্তুকি ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। রপ্তানি খাতে কিছুটা ধীরগতি লক্ষণীয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩.৫৫ শতাংশ কম রপ্তানি হয়েছে। আর নভেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ১৭ শতাংশ কম এসেছে রপ্তানি আয়। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে গেল বছরের শেষের দিন থেকে। ভর্তুকির চাপ কমাতেও বিদেশি সাহায্য সময়মতো ছাড় না পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত অক্টোবর পর্যন্ত তা ২২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে মনে হয় না। ২০১০-১১ অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭ শতাংশ। চলতি বছর জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হবে বলে মনে হয় না (কালের কণ্ঠ, ৬ জানুয়ারি)। ডলারের সঙ্গে টাকার মান কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। ইউরোপে মন্দা বিরাজ করায় রপ্তানি অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে প্রায় সাড়ে তিন হাজার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থনীতির এই পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামত প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এ ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামত চাইতে পারতেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়েছেন। চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করা হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি সহজেই করা যায় তা হচ্ছে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো আমলাদের দক্ষতা প্রমাণ করে না। বিশ্বব্যাপী যেখানে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সচিবদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অনেক সচিবের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বয়সের কারণে এবং দলীয় বিবেচনায় অনেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়েছেন, কিন্তু তাঁরা অনেকেই অদক্ষ। এসব অদক্ষ আমলা নিয়ে সরকার তার লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জন করবে, সে প্রশ্নই থেকে যায়। গত ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচটি সচিব পদ সৃষ্টির কথা ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের খুশি করলেও (যাঁরা এখন সচিব হতে পারবেন) সামগ্রিকভাবে জনসাধারণের কাছে পুলিশ বাহিনীর জন্য আস্থার জায়গাটা কি তৈরি হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা বলেননি। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো মহাজোট সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা বেশি আসার কথা বলে না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহাজোট সরকারের তিন বছরে সারা দেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৯ হাজার ১০৪টি, অপহরণ হয়েছে ৪০৪টি, গুপ্তহত্যা হয়েছে ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৬০০, চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামিকে দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসকদলের সাত হাজার ১০০ নেতা-কর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে (যুগান্তর, ২ জানুয়ারি ২০১২)। এ চিত্র পুলিশ বাহিনীর সফলতা প্রমাণ করে না। তবুও প্রধানমন্ত্রী পুলিশের জন্য পাঁচটি সচিব পদ সৃষ্টি করেছেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে সরকারের খরচ আরো বাড়বে। বিশ্বমন্দার এই যুগে এই ব্যয়বৃদ্ধি কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা এখনই কার্যকর করার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তার অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পত্রপত্রিকায় যখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্য ও মাস্তানির সংবাদ প্রকাশ হয়, তখন কী প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে ম্লান করে দেয় না? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের মতো দেশজুড়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড (টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, শ্লীলতাহানি) মহাজোট সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতে তাঁর সরকারের সাফল্যের কথা বলছেন বটে, কিন্তু সংবাদপত্রই বলে দেয় অনিয়ম-নিয়োগ বাণিজ্যে অনেক সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে (সমকাল, ৫ জানুয়ারি, ২০১২)। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সফলতার কোনো বর্ণনা দেননি। মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। এতে তুলনামূলক বিচারে ভারতের অর্জন বেশি, বাংলাদেশের অর্জন কম। অতিমাত্রায় ভারতনির্ভরতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মানসিকতার চরিত্রকে নষ্ট করেছে। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে দুজন উপদেষ্টার 'বিতর্কিত ভূমিকা' কার্যত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকাকে খর্ব করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফরে ব্যস্ত সময় কাটালেও দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সম্মানই তিনি বয়ে আনতে পারেননি। কখনো-সখনো তাঁর শিশুসুলভ আচরণ (ফটো তোলা, অটোগ্রাফ নেওয়া), পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থানকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশ যখন টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারতের উদ্যোগকে প্রতিবাদ করতে পারে না, যখন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারতকে রাজি করাতে পারে না, তখন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির দৈন্যদশাই ফুটে ওঠে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর চীন ও মিয়ানমার সফরের পরও দেশ দুটোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। অথচ পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ দুটো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে ও র্যাবের ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা ভাটা লক্ষ করা যায়। হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফরে এলেও বাংলাদেশ সফর করা থেকে বিরত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে পররাষ্ট্রনীতির কোনো দিকনির্দেশনা নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পদ্মা সেতুর কথা উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বিশ্বব্যাংক অর্থ বিনিয়োগ করবে_এমন কোনো কথা প্রধানমন্ত্রী বলেননি। কিন্তু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট করেছে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে অনেক অদক্ষ মন্ত্রী সরকারের কর্মকাণ্ডে কোনো গতি আনতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ভাষণের একাধিক জায়গায় তিনি বিরোধী দলনেত্রীকে সমালোচনা করেছেন। এর পরও প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। শুধু আহ্বান জানালেই চলবে না, তাঁকে আন্তরিক হতে হবে। বিরোধী দল কর্তৃক উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণ করতে হবে। কুমিল্লা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। ইভিএমের ব্যবহার সফল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি তার আপত্তি তুলে নিতে পারে। নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা আজ শুধু বিএনপিই বলছে না, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম থেকে শুরু করে সরকার সমর্থিত দু-একটি দলও এ দাবি করছে। এটা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। বিরোধী দল যাতে সংসদে আসে, সে ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। আমরা চাই না ২০১২ সালের রাজনীতি সংঘাতময় হোক। আমরা চাই একটি সমঝোতা। চাই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ একটি ক্ষেত্র তৈরি করুক। সরকারি দল আরো আন্তরিক হোক, তাহলেই রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। না হলে থার্ড ফোর্সের যে সম্ভাবনার কথা কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ৬ জানুয়ারি), তার উত্থান আমরা রোধ করতে পারব না।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়েছেন। চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করা হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি সহজেই করা যায় তা হচ্ছে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো আমলাদের দক্ষতা প্রমাণ করে না। বিশ্বব্যাপী যেখানে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সচিবদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অনেক সচিবের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বয়সের কারণে এবং দলীয় বিবেচনায় অনেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়েছেন, কিন্তু তাঁরা অনেকেই অদক্ষ। এসব অদক্ষ আমলা নিয়ে সরকার তার লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জন করবে, সে প্রশ্নই থেকে যায়। গত ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচটি সচিব পদ সৃষ্টির কথা ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের খুশি করলেও (যাঁরা এখন সচিব হতে পারবেন) সামগ্রিকভাবে জনসাধারণের কাছে পুলিশ বাহিনীর জন্য আস্থার জায়গাটা কি তৈরি হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা বলেননি। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো মহাজোট সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা বেশি আসার কথা বলে না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহাজোট সরকারের তিন বছরে সারা দেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৯ হাজার ১০৪টি, অপহরণ হয়েছে ৪০৪টি, গুপ্তহত্যা হয়েছে ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৬০০, চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামিকে দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসকদলের সাত হাজার ১০০ নেতা-কর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে (যুগান্তর, ২ জানুয়ারি ২০১২)। এ চিত্র পুলিশ বাহিনীর সফলতা প্রমাণ করে না। তবুও প্রধানমন্ত্রী পুলিশের জন্য পাঁচটি সচিব পদ সৃষ্টি করেছেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে সরকারের খরচ আরো বাড়বে। বিশ্বমন্দার এই যুগে এই ব্যয়বৃদ্ধি কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা এখনই কার্যকর করার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তার অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পত্রপত্রিকায় যখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্য ও মাস্তানির সংবাদ প্রকাশ হয়, তখন কী প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে ম্লান করে দেয় না? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের মতো দেশজুড়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড (টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, শ্লীলতাহানি) মহাজোট সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতে তাঁর সরকারের সাফল্যের কথা বলছেন বটে, কিন্তু সংবাদপত্রই বলে দেয় অনিয়ম-নিয়োগ বাণিজ্যে অনেক সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে (সমকাল, ৫ জানুয়ারি, ২০১২)। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সফলতার কোনো বর্ণনা দেননি। মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। এতে তুলনামূলক বিচারে ভারতের অর্জন বেশি, বাংলাদেশের অর্জন কম। অতিমাত্রায় ভারতনির্ভরতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মানসিকতার চরিত্রকে নষ্ট করেছে। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে দুজন উপদেষ্টার 'বিতর্কিত ভূমিকা' কার্যত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকাকে খর্ব করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফরে ব্যস্ত সময় কাটালেও দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সম্মানই তিনি বয়ে আনতে পারেননি। কখনো-সখনো তাঁর শিশুসুলভ আচরণ (ফটো তোলা, অটোগ্রাফ নেওয়া), পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থানকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশ যখন টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারতের উদ্যোগকে প্রতিবাদ করতে পারে না, যখন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারতকে রাজি করাতে পারে না, তখন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির দৈন্যদশাই ফুটে ওঠে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর চীন ও মিয়ানমার সফরের পরও দেশ দুটোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। অথচ পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ দুটো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে ও র্যাবের ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা ভাটা লক্ষ করা যায়। হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফরে এলেও বাংলাদেশ সফর করা থেকে বিরত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে পররাষ্ট্রনীতির কোনো দিকনির্দেশনা নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পদ্মা সেতুর কথা উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বিশ্বব্যাংক অর্থ বিনিয়োগ করবে_এমন কোনো কথা প্রধানমন্ত্রী বলেননি। কিন্তু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট করেছে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে অনেক অদক্ষ মন্ত্রী সরকারের কর্মকাণ্ডে কোনো গতি আনতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ভাষণের একাধিক জায়গায় তিনি বিরোধী দলনেত্রীকে সমালোচনা করেছেন। এর পরও প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। শুধু আহ্বান জানালেই চলবে না, তাঁকে আন্তরিক হতে হবে। বিরোধী দল কর্তৃক উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণ করতে হবে। কুমিল্লা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। ইভিএমের ব্যবহার সফল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি তার আপত্তি তুলে নিতে পারে। নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা আজ শুধু বিএনপিই বলছে না, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম থেকে শুরু করে সরকার সমর্থিত দু-একটি দলও এ দাবি করছে। এটা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। বিরোধী দল যাতে সংসদে আসে, সে ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। আমরা চাই না ২০১২ সালের রাজনীতি সংঘাতময় হোক। আমরা চাই একটি সমঝোতা। চাই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ একটি ক্ষেত্র তৈরি করুক। সরকারি দল আরো আন্তরিক হোক, তাহলেই রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। না হলে থার্ড ফোর্সের যে সম্ভাবনার কথা কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ৬ জানুয়ারি), তার উত্থান আমরা রোধ করতে পারব না।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments