চরাচর-ভাষার অস্তিত্ব সংকট by মযহারুল ইসলাম বাবলা
বাংলাদেশের সব প্রান্তজুড়ে দেশব্যাপী আমরা অনায়াসে মাত্র একটি ভাষায় সবাই সবার সঙ্গে কথা বলে থাকি। দ্বিতীয় বা বিকল্প ভাষার প্রয়োজন হয় না। তবে দেশের সব অঞ্চলের নিজস্ব আঞ্চলিক কথ্য ভাষা আছে। যার একটির সঙ্গে অপরটির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষাও। একমাত্র বাংলা ভাষা আঞ্চলিক সব ভাষার সীমা ডিঙিয়ে সবার কাছেই যেমন বোধগম্য, তেমনি বলার ক্ষেত্রেও সবাই বলে থাকি। বাংলা ভাষা বলতে ও
বুঝতে অক্ষম তেমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের নিকট-প্রতিবেশী ভারতে যা অসম্ভব। বিশাল ভারতের স্বীকৃত ভাষা প্রায় সাতাশটি। হিন্দি বলয়ের প্রদেশ ব্যতীত প্রায় প্রদেশের নিজস্ব প্রাদেশিক ভাষা আছে। রাষ্ট্রীয় হিন্দি ভাষা অনেক প্রদেশের প্রাদেশিক ভাষাকে পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারেনি। দক্ষিণের চার রাজ্য কেরালা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ঘুরে সেখানে রাষ্ট্রীয় হিন্দি ভাষার তেমন প্রচলন দেখিনি। ওই চার প্রদেশের মালায়ালম, কন্নড়, তেলেগু এবং তামিল ভাষার বিকল্প ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিন্দি নয়, ইংরেজি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন দুই শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের ঘেরাটোপের নানা দৃষ্টান্ত এখনো বিদ্যমান। ভাষার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি আইন-কানুন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, শাসক শ্রেণীর শাসন-শোষণ_প্রায় সবই। রাষ্ট্রীয় হিন্দি ভাষাকে দক্ষিণের মানুষরা বলতে গেলে একরকম প্রত্যাখ্যানই করেছে। দক্ষিণে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির তেমন ঠাঁই নেই। সেখানকার সমৃদ্ধ স্বীকৃত প্রাদেশিক ভাষার ওপরই তারা নির্ভরশীল। প্রধান বিকল্প ভাষা ইংরেজি, যা প্রবলভাবে সেখানকার সবার মুখে মুখে ফেরে। ভারতের স্বীকৃত প্রাদেশিক ভাষার পাশাপাশি অস্বীকৃত প্রচুর কথ্য-আঞ্চলিক ভাষা আছে। যার সংখ্যা নিরূপণ অসম্ভব। প্রতিটি প্রদেশেই আছে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা। বর্তমানে প্রযুক্তির কারণে গ্রাম এবং শহরের দূরত্ব কমে আসায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারেও ভাটির টান পড়েছে। নানাবিধ কারণে আমাদের আঞ্চলিক ভাষা হুমকির মুখে। ভাষার দখলদারিত্বের পেছনে অর্থনৈতিক বিষয়টির যুক্ততাকেও অস্বীকার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে এটাও অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতি প্রকাশের মাধ্যম ভাষা। সংস্কৃতিগত পরিবর্তনে প্রকাশের পরিবর্তন ঘটে বলেই ভাষা ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অথচ আঞ্চলিক ভাষার নানা উপাদানে মাতৃভাষা সমৃদ্ধ হওয়ার পথটি আমরা ক্রমশ হারিয়ে চলেছি। যার ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। একমাত্র ভাষার জন্য জীবন দেওয়া জাতি বিশ্বে বিরল। আমরা আমাদের মাতৃভাষা রক্ষায় লড়াই-সংগ্রাম করেছি। যে বাংলা ভাষা রক্ষায় আমাদের ত্যাগ ও আত্মদান, সেই ভাষাও কিন্তু নানা সংগত কারণে হুমকিমুক্ত নয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে অজস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে। স্বাধীন দেশে বাংলা ভাষা যতটা হুমকির মুখে, পরাধীন দেশেও কিন্তু অতটা হুমকির মুখে ছিল না।
প্রতিটি ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন দর্শন ও সংস্কৃতি। ভাষার বিলুপ্তিতে জ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব অনিবার্য। একমাত্র ভাষা ব্যতীত আত্মপ্রকাশের অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। বিশ্বের বেশির ভাগ ভাষার লিখিত রূপ নেই বলেই এসব ভাষা মানুষের মুখে মুখেই বেঁচে থাকে। এর ব্যবহার বন্ধ হওয়া মানেই নিশ্চিত বিলুপ্তি। এসব ভাষার সঙ্গে বিলুপ্তি অনিবার্য সামাজিক ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি-সম্পদ।
মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রতিটি ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন দর্শন ও সংস্কৃতি। ভাষার বিলুপ্তিতে জ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব অনিবার্য। একমাত্র ভাষা ব্যতীত আত্মপ্রকাশের অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। বিশ্বের বেশির ভাগ ভাষার লিখিত রূপ নেই বলেই এসব ভাষা মানুষের মুখে মুখেই বেঁচে থাকে। এর ব্যবহার বন্ধ হওয়া মানেই নিশ্চিত বিলুপ্তি। এসব ভাষার সঙ্গে বিলুপ্তি অনিবার্য সামাজিক ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি-সম্পদ।
মযহারুল ইসলাম বাবলা
No comments