আমাদের রাজঘুঘু by আ ন ম আমিনুর রহমান

ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ গ্রামের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর, বন-জঙ্গল, জলা-বিল রীতিমতো চষে বেড়াতাম। পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা তখন থেকেই। গ্রামে তখন জানা-অজানা রংবেরঙের কত পাখি দেখেছি। এদের অনেকগুলোই এখন আর চোখে পড়ে না।

গ্রামের মাঠ-ঘাট ও ঝোপ-জঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির ঘুঘু দেখতাম। এর মধ্যে বড় আকারের এক প্রজাতির ঘুঘু চোখে পড়ত। বর্তমানে আমাদের গ্রামাঞ্চল নগরায়ণের পথে। গত ১০-১৫ বছরে যতবার গ্রামে গেছি, এই ঘুঘুটি খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। গাজীপুরে এত দিন ধরে আছি, কিন্তু এখানেও কোনো দিন চোখে পড়েনি। সত্যি বলতে কি, গত দুই দশকে যেভাবে গ্রামীণ বন-জঙ্গল ধ্বংস হয়েছে, তাতে এ দেশের বেশির ভাগ গ্রামের চৌহদ্দি থেকে এরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন আর তাই ভরদুপুরে গ্রামে এদের মায়াভরা কুককুউ-কুককুউ-কুককুউ-কুক ডাক শোনা যায় না।
কিছুদিন আগে পঞ্চগড়ে গিয়ে মনটা ভরে গেল। পঞ্চগড় সদর, বোদা, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া থানার বিভিন্ন স্থানে বেশ সংখ্যায় এদের দেখলাম। সেখানে এখনো গ্রামীণ পরিবেশটা বিরাজ করছে বলেই হয়তো এরা ভালো আছে। এরা হলো ইউরেশীয় কণ্ঠি ঘুঘু (Eurasian Collared Dove)। আমাদের গ্রামে ‘রাজঘুঘু’ নামে পরিচিত। পঞ্চগড়ে বলে ‘নোদাঘুঘু’। বৈজ্ঞানিক নাম Streptopelia decocto। রাজঘুঘুর দুটো জানা উপপ্রজাতির মধ্যে এ দেশে Streptopelia decocto decocto উপপ্রজাতিটিই দেখা যায়।
প্রথম দর্শনে রাজঘুঘু দেখতে কিছুটা স্ত্রী ‘লালঘুঘু’র মতো। তবে রংটা আরও হালকা এবং আকারে বেশ বড়। লম্বা ৩২ সেন্টিমিটার, ওজন ১৩৫ গ্রাম। দেহের ওপরের অংশ বালু-বাদামি ও নিচের অংশ হালকা গোলাপি-ধূসর। ঘাড়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটা কলার থাকে। পেট ও তলপেট ছাই-ধূসর। ডানার পেছনের পালক কালচে ও নিচটা সাদা। লেজের তলার আচ্ছাদক পালক গাঢ় ধূসর। কালচে লেজের শেষ অংশে সাদা পট্টি। ঠোঁট বাদামি-কালো। পা ও আঙুল গাঢ় গোলাপি। নখ কালো। পুরুষ ও স্ত্রী দেখতে একই রকম। বাচ্চাগুলোর পালকে হলদে আভা থাকে। ঘাড়ে কোনো কলার নেই।
খোলা মাঠ, গ্রাম বা আশপাশে বড় গাছ আছে এমন কৃষিজমি, শুষ্ক পাতাঝরা বনের প্রান্ত ও লবণাক্ত (Mangrove) বনে এদের দেখা যায়। সাধারণত একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। চষা জমি, ঘেসো মাঠ বা বনের প্রান্তে হেঁটে হেঁটে আগাছার বীচি ও শস্যদানা খায়। তেঁতুলিয়ার রওশনপুরে কাজী অ্যান্ড কাজী চা-বাগানের ডেইরি ফার্মের পাশের চষা জমিতে তিলা ও লালঘুঘুর দলের সঙ্গে সাতটি রাজঘুঘু চরতে দেখেছি।
ফেব্রুয়ারি থেকে মে প্রজননকাল হলেও সারা বছরই এরা প্রজনন করতে পারে। প্রধানত ছোট আকারের গাছ ও ঝোপঝাড়ে কাঠিকুঠি দিয়ে অন্যান্য ঘুঘুর মতোই বাসা বানায়। স্ত্রী রাজঘুঘু তাতে দু-তিনটি সাদা ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে মাত্র তেরো দিনে।
দেখতে বেশ সুন্দর হওয়ায় এরা পোষা পাখির ব্যবসায়ীদের নজরে পড়েছে। এমনিতেই বর্তমানে এদের সংখ্যা বেশ কমে গেছে। যৎসামান্য যা-ই আছে, তা-ও আবার ঘুঘু শিকারিদের কবলে পড়ে বিভিন্ন পোষা পাখির দোকানে, বিশেষ করে ঢাকার কাঁটাবনে, চলে আসে। কাজেই রাজঘুঘু রক্ষা করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.