মিজানুর রহমানের পাগলাঘণ্টি by ফারুক ওয়াসিফ
পুলিশ ও র্যাব মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় মানুষের লাশ পড়ে থাকছে। এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি।’ —মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, (প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর)।‘পুরুষের ভালোবাসা, গৃহস্থের মুরগি পোষা’ বলে একখান প্রবাদ চালু আছে গ্রামদেশে। বাংলাদেশে মানবাধিকার ব্যাপারটা আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অবস্থা খানিকটা তেমনই। গৃহস্থের মুরগি ভালোবাসায় দোষ নেই। কিন্তু মানবাধিকারের প্রতি সরকারি নজর মাংসের জন্য মুরগি ভালোবাসার মতো হয়ে গেলে বিপদ। দেশে-বিদেশে ভাবমূর্তিবাড়াতে সরকারের একটা মানবাধিকার কমিশন চাই, কিন্তু কমিশনের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়তার ভয়। কিন্তু কমিশন তা হয়েথাকতে চাইবে কেন?
বহু সাধ্যসাধনার পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হলো। নতুন শিশু জন্মাল ঠিকই, কিন্তু দাঁড়াতে দেওয়া হলো না। সেই আমলেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশুমারভাবে বেড়ে গেল। মানবাধিকার কমিশন দর্শক হয়ে রইল। সব দিকে তখন দুদকের জয়জয়কার। অথচ দুর্নীতিও দমল না।
রাজনীতি ও সরকার বদলায়, সঙ্গে বদলায় সরকারি প্রয়োজন। মঞ্চে এখন নতুন নায়ক, নতুন সংলাপ। জনসমক্ষে হাজির হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তার সজ্জন চেয়ারম্যান। নিউটন বলেছেন, প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে। মানুষ অপদার্থ নয়, তাহলে মনুষ্য জগতে মানবাধিকার লঙ্ঘন যত বাড়ছে, মানবাধিকার কমিশনের প্রতিকার-ক্রিয়া তত বাড়ছে না কেন?
এ বিষয়ে পুরোনো গল্পটাই দেখি খেটে যাচ্ছে: স্বর্গে একটা ন্যায়ের ঘণ্টা আছে, পৃথিবীতে কেউ অন্যায় করলেই সেটা বেজে ওঠে। ছোট পাপে ছোট বাজনা, বড় পাপে বড় বাজনা। বড় অন্যায় তো আর সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঘটে না, তাই ঘণ্টাটাও থেমে থেমেই বাজে; স্বর্গবাসীর টনকও অনড়ই থাকে। কিন্তু একদিন সুশীল ঘণ্টাটি পাগলপারা হয়ে গেল। পাগলাঘণ্টির আওয়াজে স্বর্গ তো স্বর্গ, নরকবাসীরও আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় হয়! জানা গেল ব্যাপার গুরুতর, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখানে-সেখানে ঠেঙানি খাচ্ছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন ‘উন্মোচন’ নামের এক ব্লগে প্রতিবাদ করেছেন বলে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে এক রাত এক দিন। পল্টন থেকে সাদা পোশাকের লোকেরা এক যুবককে মুখে টেপ মেরে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ হেফাজতে মার খেয়ে মরে যাচ্ছেন বিরোধী দলের নেতা। করিৎকর্মারা করে যাচ্ছেন, থামছেন না, ঘণ্টারও তাই থামাথামি নেই।
গল্পটার এ পর্যন্তই আমরা জানতাম। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। বাংলাদেশে ক্রসফায়ার, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, নিরপরাধের পায়ে গুলি-কোপ, অপহরণ-গুম ইত্যাদির জন্য ঘুম হারামকারী পাগলাঘণ্টি থেকে বাঁচতে স্বর্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটা বুদ্ধি বের করলেন। তিনি পৃথিবীবিষয়ক মন্ত্রীকে বললেন, জিনিসটাকে বাংলাদেশে চালান করে দিন, ওদের ঠ্যালা ওরাই সামলাক। স্বর্গের সঙ্গে যেহেতু পশ্চিমা দুনিয়ার যোগাযোগ বেশি, তাই তারাই ঘণ্টাটাকে বাংলাদেশের রাজধানীর কোথাও ঝুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পেল।
স্বর্গীয় জিনিস। রাখাও বিপদ, ফেলাও বিপদ। অবশেষে জাতিসংঘের ইউএনডিপি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপাচাপি ও আর্থিক সহযোগিতায় ঘণ্টাটার একটা ঠিকানা হলো। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। হলো বটে, কিন্তু এর দেহটিকে রাখা হলো দুর্বল। তবে অর্থবল-লোকবল-আইনি বলের ঘাটতি রইলেও এর হূদয়বলের কোনো কমতি নেই। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানকে ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্ব দেওয়ার পর সংস্থাটি হূদয়বলে বলীয়ান হলো, তিনি হলেন এর চেয়ারম্যান। এখন স্বর্গবাসীর তন্দ্রা নিরাপদ হলেও বঙ্গবাসীর ঘুম হারাম। সরকার চিরকালই ঘুমকাতুরে, কোনো ঘণ্টিতেই তারা জাগে না। তবে সাধারণ মানুষ ঘণ্টাটির বাজনা শুনে উঠে বসে। ঘণ্টাবাদকের হূদয় আলোড়িত হলে তাদের মনও দুলে ওঠে। তাই তাঁর মতো আমরাও বলি ‘এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি’।
র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন ও তার পরিবারের ভরসাস্থল ছিলেন মিজানুর রহমান। লিমনকে জড়িয়ে তাঁকে কাঁদতে দেখে আমরাও চোখ ভেজালাম, মন ভেজালাম। পুলিশের হাতে নির্যাতিত ঢাবির ছাত্র কাদেরের পাশেও তিনি। তিনিই আমাদের মনে করিয়ে দেন, গরাদের বাইরে থাকা মুক্ত-অর্ধমুক্ত মানুষের সমান মানবাধিকার গরাদের ভেতরে থাকা মানুষেরও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন কারাগারের ফটকের কড়া নাড়া শুরু করলেন তিনি। কিন্তু অদৃশ্য ক্ষমতার ইশারায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, একটু হিসাব করেই চলতে হবে। একজন জেলারই পারলেন সাংবিধানিক পদাধিকারীকে পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিতে, আইনের গতি দিশা হারাল।
গত এক সপ্তাহের প্রধান কথা এটাই: পুলিশের বুট, ছাত্রলীগের জুতা আর আমাদের কপাল। জবির ছাত্রদের ওপর নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অনলাইন ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম সংহতি সমাবেশ ডেকেছিল জাদুঘরের সামনে। সমাবেশ শুরুই হতে পারল না, রণসাজে সজ্জিত পুলিশ ইতস্তত হাঁটা-বসা ৩১ জনকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করল, যাদের আবার ১৮ জনই পুলিশের ভাষ্যমতে ‘নির্দোষ পথচারী’!
এ রকম অবস্থাতেই মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বললেন, ‘দুর্ভাগ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, আবার রাষ্ট্রের কাছেই এর প্রতিকার চাইতে হয়।’ (প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর)। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর অনেকে বলেছিলেন, এটা একটা কাগুজে বাঘ। কিন্তু আইনও তো কাগজে লেখা কিছু কথাই! সরকার, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকেরা মানলে সেই কাগজেরও বাঘের মতো দাঁত গজায়, না মানলে তা রোমটাও নড়াতে পারে না। যে দেশে মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের শ্রদ্ধা থাকে, সে দেশে মানবাধিকারের অভিভাবক কেবল ‘কাগুজে’ বাঘ হয়ে থাকার কথা নয়। আদিকালের নিধিরাম সরদার নিশ্চয়ই কোনো বিবেকবান মানুষ ছিলেন, ঢাল-তলোয়ার না থাকলেও নিশ্চয় তাঁর প্রতিবাদের সৎসাহস ছিল। সেই থেকে কমজোরি কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠায় আগুয়ান ব্যক্তিকে নিধিরাম সরদার বলার চল শুরু। দিন শেষে দেখা গেল, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এক ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সরদার। এ-ও বোঝা গেল, তিনি এখনো ‘বীর’ নন, তিনি যাত্রাপালার ‘বিবেক’, যিনি দুঃখীর দুঃখে কাঁদেন বটে, কিন্তু প্রতিকার তাঁর সাধ্যের বাইরে। কিন্তু তাঁর এই কান্নারও প্রয়োজন আছে, একটি আইনি প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মানবিকতা প্রদর্শন রাষ্ট্রের ক্ষয়মান মানবিকতারই কান্না হয়ে বাজে। মানুষ যখন কষ্টে উহ্ বলে ওঠে, তখন সমবেদনার ‘আহ্’ বলার মানবিক সান্ত্বনাও দরকার।
মানবাধিকার কমিশনই যখন মানবাধিকারের ‘অক্ষমতায়’ কাঁদে, তখন যশোরের সেই বুড়ির গল্পটা মনে পড়ে। প্রান্তরের মধ্যে বুড়ির ঘর। তিন কুলে বুড়ির কেউ নেই। একা থাকে, একা খায়, একাই ঘুমায়। জমিখেকোরা তক্কে তক্কে থাকে। বুড়ি মরলে কি আর জমি মরবে? ঘর ধসবে? বুড়ির ওয়ারিশান নেই, জোর যার, জমি হবে তার। বুড়ি ভয়ে ঘুমায় না। রাতে বাড়ির আশপাশে টর্চ জ্বলতে দেখে। ঘরের চালে ঢিল পড়ে। তবু বুড়ি ঘর ছাড়ে না। সে বরং কুপির সলতেটা আরও চাগিয়ে উঠে বসে। আত্মরক্ষার একটা বুদ্ধিও বের করে। রাত হলে খেয়েদেয়ে কাঁসার একটা কলস আর বাঁশের ডালঘুটনিটা নিয়ে বসে। তারপর সারা রাত দুলে দুলে সারা জীবনের জানা সব গীত গায় আর তালে তালে কাঁসার কলসটা পেটায়। পড়শিদের বলা আছে, ‘ডাকাত এলে গীত থামবে, আমি মরলে বাজনা থামবে। তোমরা বুঝে নিয়ো, তোমরা সাড়া দিয়ো।’ বুড়ি গায় আর ডঙ্কা বাজায়। লোকে ঘুমের মধ্যেও কান পাতে: আওয়াজ আসছে, বুড়ি বাজাচ্ছে। বুড়ি অতন্দ্র।
মানবাধিকার কমিশন ও তার চেয়ারম্যান জেগে থাকুন, ঘণ্টা বাজতে থাকুক। সরকার না হোক, মানুষের ঘুম ভাঙবেই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
বহু সাধ্যসাধনার পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হলো। নতুন শিশু জন্মাল ঠিকই, কিন্তু দাঁড়াতে দেওয়া হলো না। সেই আমলেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশুমারভাবে বেড়ে গেল। মানবাধিকার কমিশন দর্শক হয়ে রইল। সব দিকে তখন দুদকের জয়জয়কার। অথচ দুর্নীতিও দমল না।
রাজনীতি ও সরকার বদলায়, সঙ্গে বদলায় সরকারি প্রয়োজন। মঞ্চে এখন নতুন নায়ক, নতুন সংলাপ। জনসমক্ষে হাজির হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তার সজ্জন চেয়ারম্যান। নিউটন বলেছেন, প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে। মানুষ অপদার্থ নয়, তাহলে মনুষ্য জগতে মানবাধিকার লঙ্ঘন যত বাড়ছে, মানবাধিকার কমিশনের প্রতিকার-ক্রিয়া তত বাড়ছে না কেন?
এ বিষয়ে পুরোনো গল্পটাই দেখি খেটে যাচ্ছে: স্বর্গে একটা ন্যায়ের ঘণ্টা আছে, পৃথিবীতে কেউ অন্যায় করলেই সেটা বেজে ওঠে। ছোট পাপে ছোট বাজনা, বড় পাপে বড় বাজনা। বড় অন্যায় তো আর সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঘটে না, তাই ঘণ্টাটাও থেমে থেমেই বাজে; স্বর্গবাসীর টনকও অনড়ই থাকে। কিন্তু একদিন সুশীল ঘণ্টাটি পাগলপারা হয়ে গেল। পাগলাঘণ্টির আওয়াজে স্বর্গ তো স্বর্গ, নরকবাসীরও আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় হয়! জানা গেল ব্যাপার গুরুতর, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখানে-সেখানে ঠেঙানি খাচ্ছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন ‘উন্মোচন’ নামের এক ব্লগে প্রতিবাদ করেছেন বলে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে এক রাত এক দিন। পল্টন থেকে সাদা পোশাকের লোকেরা এক যুবককে মুখে টেপ মেরে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ হেফাজতে মার খেয়ে মরে যাচ্ছেন বিরোধী দলের নেতা। করিৎকর্মারা করে যাচ্ছেন, থামছেন না, ঘণ্টারও তাই থামাথামি নেই।
গল্পটার এ পর্যন্তই আমরা জানতাম। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। বাংলাদেশে ক্রসফায়ার, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, নিরপরাধের পায়ে গুলি-কোপ, অপহরণ-গুম ইত্যাদির জন্য ঘুম হারামকারী পাগলাঘণ্টি থেকে বাঁচতে স্বর্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটা বুদ্ধি বের করলেন। তিনি পৃথিবীবিষয়ক মন্ত্রীকে বললেন, জিনিসটাকে বাংলাদেশে চালান করে দিন, ওদের ঠ্যালা ওরাই সামলাক। স্বর্গের সঙ্গে যেহেতু পশ্চিমা দুনিয়ার যোগাযোগ বেশি, তাই তারাই ঘণ্টাটাকে বাংলাদেশের রাজধানীর কোথাও ঝুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পেল।
স্বর্গীয় জিনিস। রাখাও বিপদ, ফেলাও বিপদ। অবশেষে জাতিসংঘের ইউএনডিপি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপাচাপি ও আর্থিক সহযোগিতায় ঘণ্টাটার একটা ঠিকানা হলো। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। হলো বটে, কিন্তু এর দেহটিকে রাখা হলো দুর্বল। তবে অর্থবল-লোকবল-আইনি বলের ঘাটতি রইলেও এর হূদয়বলের কোনো কমতি নেই। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানকে ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্ব দেওয়ার পর সংস্থাটি হূদয়বলে বলীয়ান হলো, তিনি হলেন এর চেয়ারম্যান। এখন স্বর্গবাসীর তন্দ্রা নিরাপদ হলেও বঙ্গবাসীর ঘুম হারাম। সরকার চিরকালই ঘুমকাতুরে, কোনো ঘণ্টিতেই তারা জাগে না। তবে সাধারণ মানুষ ঘণ্টাটির বাজনা শুনে উঠে বসে। ঘণ্টাবাদকের হূদয় আলোড়িত হলে তাদের মনও দুলে ওঠে। তাই তাঁর মতো আমরাও বলি ‘এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি’।
র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন ও তার পরিবারের ভরসাস্থল ছিলেন মিজানুর রহমান। লিমনকে জড়িয়ে তাঁকে কাঁদতে দেখে আমরাও চোখ ভেজালাম, মন ভেজালাম। পুলিশের হাতে নির্যাতিত ঢাবির ছাত্র কাদেরের পাশেও তিনি। তিনিই আমাদের মনে করিয়ে দেন, গরাদের বাইরে থাকা মুক্ত-অর্ধমুক্ত মানুষের সমান মানবাধিকার গরাদের ভেতরে থাকা মানুষেরও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন কারাগারের ফটকের কড়া নাড়া শুরু করলেন তিনি। কিন্তু অদৃশ্য ক্ষমতার ইশারায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, একটু হিসাব করেই চলতে হবে। একজন জেলারই পারলেন সাংবিধানিক পদাধিকারীকে পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিতে, আইনের গতি দিশা হারাল।
গত এক সপ্তাহের প্রধান কথা এটাই: পুলিশের বুট, ছাত্রলীগের জুতা আর আমাদের কপাল। জবির ছাত্রদের ওপর নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অনলাইন ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম সংহতি সমাবেশ ডেকেছিল জাদুঘরের সামনে। সমাবেশ শুরুই হতে পারল না, রণসাজে সজ্জিত পুলিশ ইতস্তত হাঁটা-বসা ৩১ জনকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করল, যাদের আবার ১৮ জনই পুলিশের ভাষ্যমতে ‘নির্দোষ পথচারী’!
এ রকম অবস্থাতেই মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বললেন, ‘দুর্ভাগ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, আবার রাষ্ট্রের কাছেই এর প্রতিকার চাইতে হয়।’ (প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর)। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর অনেকে বলেছিলেন, এটা একটা কাগুজে বাঘ। কিন্তু আইনও তো কাগজে লেখা কিছু কথাই! সরকার, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকেরা মানলে সেই কাগজেরও বাঘের মতো দাঁত গজায়, না মানলে তা রোমটাও নড়াতে পারে না। যে দেশে মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের শ্রদ্ধা থাকে, সে দেশে মানবাধিকারের অভিভাবক কেবল ‘কাগুজে’ বাঘ হয়ে থাকার কথা নয়। আদিকালের নিধিরাম সরদার নিশ্চয়ই কোনো বিবেকবান মানুষ ছিলেন, ঢাল-তলোয়ার না থাকলেও নিশ্চয় তাঁর প্রতিবাদের সৎসাহস ছিল। সেই থেকে কমজোরি কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠায় আগুয়ান ব্যক্তিকে নিধিরাম সরদার বলার চল শুরু। দিন শেষে দেখা গেল, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এক ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সরদার। এ-ও বোঝা গেল, তিনি এখনো ‘বীর’ নন, তিনি যাত্রাপালার ‘বিবেক’, যিনি দুঃখীর দুঃখে কাঁদেন বটে, কিন্তু প্রতিকার তাঁর সাধ্যের বাইরে। কিন্তু তাঁর এই কান্নারও প্রয়োজন আছে, একটি আইনি প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মানবিকতা প্রদর্শন রাষ্ট্রের ক্ষয়মান মানবিকতারই কান্না হয়ে বাজে। মানুষ যখন কষ্টে উহ্ বলে ওঠে, তখন সমবেদনার ‘আহ্’ বলার মানবিক সান্ত্বনাও দরকার।
মানবাধিকার কমিশনই যখন মানবাধিকারের ‘অক্ষমতায়’ কাঁদে, তখন যশোরের সেই বুড়ির গল্পটা মনে পড়ে। প্রান্তরের মধ্যে বুড়ির ঘর। তিন কুলে বুড়ির কেউ নেই। একা থাকে, একা খায়, একাই ঘুমায়। জমিখেকোরা তক্কে তক্কে থাকে। বুড়ি মরলে কি আর জমি মরবে? ঘর ধসবে? বুড়ির ওয়ারিশান নেই, জোর যার, জমি হবে তার। বুড়ি ভয়ে ঘুমায় না। রাতে বাড়ির আশপাশে টর্চ জ্বলতে দেখে। ঘরের চালে ঢিল পড়ে। তবু বুড়ি ঘর ছাড়ে না। সে বরং কুপির সলতেটা আরও চাগিয়ে উঠে বসে। আত্মরক্ষার একটা বুদ্ধিও বের করে। রাত হলে খেয়েদেয়ে কাঁসার একটা কলস আর বাঁশের ডালঘুটনিটা নিয়ে বসে। তারপর সারা রাত দুলে দুলে সারা জীবনের জানা সব গীত গায় আর তালে তালে কাঁসার কলসটা পেটায়। পড়শিদের বলা আছে, ‘ডাকাত এলে গীত থামবে, আমি মরলে বাজনা থামবে। তোমরা বুঝে নিয়ো, তোমরা সাড়া দিয়ো।’ বুড়ি গায় আর ডঙ্কা বাজায়। লোকে ঘুমের মধ্যেও কান পাতে: আওয়াজ আসছে, বুড়ি বাজাচ্ছে। বুড়ি অতন্দ্র।
মানবাধিকার কমিশন ও তার চেয়ারম্যান জেগে থাকুন, ঘণ্টা বাজতে থাকুক। সরকার না হোক, মানুষের ঘুম ভাঙবেই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments