অপরিণত মানুষের জন্য তত্ত্বাবধায়ক প্রয়োজন
শেক্সপিয়ারের নাটকে সংলাপের ভাষা : 'টু বি অর নট টু বি'_হবে কি হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মানসিক দোলাচল এখন যে পর্যায়ে, তার সঠিক বর্ণনা উদ্ধৃত এ সংলাপের ভাষা এবং এর নিহিতার্থ থেকে পাওয়া যাবে। প্রসঙ্গটি নিয়ে যা-ই বলা হোক না, তা বুঝতে বাঙালি চরিত্র ও মানসিকতার অন্তরাল জেনে-বুঝে নিতে হবে। আবেগপ্রবণ ও হুজুগে বাঙালি কখনো তাদের স্মৃতিশক্তির জন্য কীর্তিত হয়নি। অবশ্য বাঙালির মধ্যে যে দু-চারজন স্মৃতিধর মানুষ নেই, তা নয়। সুতরাং হ্রস্বস্মৃতির বাঙালি অতিসহজেই অতীত ভুলে যায়।
অবশ্য অতীতের কিছু মোক্ষম উপাদান যে স্মরণে সদাই বরণ করা থাকে, তার প্রমাণ আমাদের দুটো প্রধান দলের রাজনীতি। আমরা অতীত ততটুকুই ব্যবহার করি যতটুকু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে লাগে। কিন্তু অতীত যখন সামগ্রিক স্বার্থে লাগে তখন যেন আমরা অতীত বিচ্যুত হই। অর্থাৎ স্বার্থচিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের ভাবনাচিন্তা তাৎক্ষণিকতা প্রসূত। আমাদের এমন মানসিকতার জন্য জাতীয় জীবনে কেমন সংকট হতে পারে, তার বড় একটি দৃষ্টান্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা-সংক্রান্ত প্রধান দুটো দলের পরস্পরবিরোধী অনড় অবস্থান। ফলে আমাদের যে অবস্থা তার বর্ণনা আছে আফ্রিকার নেতা জোমো কেনিয়াত্তার উক্তিতে : 'যখন দুই হাতি লড়াই করে তখন পদপিষ্ট হয় ঘাস।' দুই নেত্রীর লড়াইয়ে আমাদের অবস্থাও ঘাসের মতো।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সাতকাহনের বয়ান দিতে গিয়ে আরো একটি প্রাককথন আছে। কূটনীতি ও রাজনীতিতে একটি প্রবচন পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রচলিত আছে : একজন ব্যক্তি আরোহীর আসন থেকে চালকের আসনে স্থানান্তরিত হলে পথের দৃশ্য বদলে যায়। রাজনীতিতে বিরোধী দল থেকে সরকারে গেলে রাজনৈতিক ইস্যুগুলো সম্পর্কে মত ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। যেমন বিরোধী অবস্থানে একটি দলের জন্য হরতাল একটি যুতসই রাজনৈতিক হাতিয়ার। আবার একই দল ক্ষমতায় থাকলে হরতাল হয়ে যায় সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের এখনকার রাজনীতিতে যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান, তার পটভূমি বুঝতে হলে উপযুক্ত দুটো পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিতে হবে। এটাও বুঝে নিতে হবে যে, এমন দ্বান্দ্বিক অবস্থান দুটো দলের পক্ষে চূড়ান্ত নয়। তাদের অবস্থান নির্ভর করে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর_ক্ষমতায়, না ক্ষমতার বাইরে।
জানা আছে, নব্বইয়ের আন্দোলন-পরবর্তী পর্যায়ে প্রণীত চার জোটের রূপরেখায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্দেশিত হয়েছিল, পরপর তিন মেয়াদে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে। এমন সিদ্ধান্ত সার্বিক পরিস্থিতি-উদ্ভূত ছিল। আর সিদ্ধান্তটির দুটো দিক লক্ষণীয়। এক. রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি ঐকমত্যভিত্তিক রাজনৈতিক অনাস্থা। দুই. ব্যবস্থাটি নির্দিষ্ট মেয়াদে সাময়িক হিসেবে নির্ধারিত ছিল। নিহিতার্থের বিচারে এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাজনীতিবিদরা জনস্বার্থে নিজেদের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন। বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের একটি অরাজনৈতিক-প্রশাসনিক সমাধান হিসেবে সে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রশংসিত ও অভিনন্দিত হয়েছিল। বোঝা গিয়েছিল, নির্বাচনের মতো জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়টির ব্যবস্থাপনায় রাজনীতিবিদরা যে অপরিণত এবং যোগ্য নন, তা তাঁরা নিজেরাই উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা করে তাঁরা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন।
অবশ্য সিদ্ধান্তটি যে সম্পূর্ণ ঐকমত্যভিত্তিক ছিল, তা বলা যায় না; কারণ পরবর্তী পর্যায়ে খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৌল চরিত্র নিয়ে যৌক্তিক ও বাস্তবানুগ সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'একমাত্র শিশু ও উন্মাদ ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না।' অবশ্য পরে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা মানে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিগত স্বকীয় নিরপেক্ষতা নয়, বরং দায়িত্ব পালনে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের নিরপেক্ষতা। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ যাবৎ কর্মকাণ্ডে কতটুকু নিরপেক্ষ ছিল, তা বিবেচ্য এবং প্রশ্নসাপেক্ষ।
যা-ই হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নবিদ্ধ এবং যার কারণ দুটো প্রধান দলের এ ইস্যুতে দ্বান্দ্বিক অবস্থান। কিন্তু ইস্যুটিকে অরাজনৈতিক ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আলোচনা-বিতর্কের ধরন ভিন্ন হতো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর কেন থাকা উচিত নয়, তার একাধিক যুক্তি আছে। এক. ব্যবস্থাটি অরাজনৈতিক ও অসাংবিধানিক। অরাজনৈতিক হওয়ার কারণে ব্যবস্থাটি রাজনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সাময়িক সমাধান হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও ব্যবস্থাটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য অশনিসংকেত। শুরু থেকেই ব্যবস্থাটি অসাংবিধানিক। দুই. শেষোক্ত যুক্তিতে আদালতের রায়ে ব্যবস্থাটি বাতিল হয়েছে। আদালতের রায়ের সঙ্গে আরো দুই মেয়াদে ব্যবস্থাটি চালু রাখার যে প্রসঙ্গ আছে, তা মন্তব্য, রায় নয়। সুতরাং ব্যবস্থাটি চালু থাকলে তা আদালত অবমাননার শামিল হয়ে যায়। তিন. সংবিধান অনুযায়ী একমাত্র নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনার প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিকে পাশ কাটিয়ে তাকে স্বাধীন হতে না দিয়ে বা তাকে রাজনৈতিক সরকারের আজ্ঞাবহ রেখে এত দিন সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এত সব যুক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু রাখতে হয় তবে প্রশ্ন : আর কত দিনে? উত্তর পাওয়া মুশকিল। আরো প্রশ্ন : আমাদের মাননীয় রাজনীতিবিদরা আর কত দিন অপরিণত থাকবেন? কারণ অপরিণত মানুষের জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা অভিভাবক প্রয়োজন হয়। ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে, অপরিণত বা অপ্রাপ্তবয়স্ক শাসকের জন্য তত্ত্বাবধায়ককে ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। কাজেই সম্পূরক প্রশ্নটি হলো, সংবিধান লঙ্ঘন করে এমন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাজনীতিবিদ ও তাঁদের রাজনীতি আর কত দিন অপরিণত থাকবেন বা থাকবে?
তবে চূড়ান্ত বক্তব্য হলো, যেকোনো বিতর্ক বা দ্বান্দ্বিক অবস্থানের ইতি ঘটা উচিত সংলাপের মধ্য দিয়ে, ছায়া মুষ্টিযুদ্ধের (শ্যাডো বঙ্ংি) মধ্য দিয়ে নয়। কারণ তা হয়ে যায় শুরুতে উল্লেখ করা হাতির লড়াইয়ের মতো। আমরা হাতির লড়াই চাই না; চাই সংবিধান মেনে রীতিসিদ্ধ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক সংকটের রাজনৈতিক সমাধান। সুতরাং রাজনৈতিক নেতৃত্বের (সরকার বা বিরোধী) দায়িত্ব এখানে মুখ্য ও অগ্রগণ্য। আমরা হতাশ হতে চাই না। আমরা গিরিশচন্দ্র সেনের সঙ্গে সহমত হতে চাই_
No comments