তরুণেরাই পারে সব সম্ভব করতে by ডেম জেন গুডঅল
প্রাণী সংরক্ষণবিদ ও গবেষক ডেম জেন গুডঅল। তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি জমান এবং অদ্যাবধি প্রাণী অধিকার রক্ষায় কাজ করে চলেছেন। >>দিগন্তজোড়া সবুজ ঘাস, মাটির সোঁদা গন্ধ আর পশুপাখি—এসবের মধ্যেই আমি খুঁজে পাই জীবনীশক্তি। আমার যখন বয়স সবে চার কি পাঁচ, তখন থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে আমার এমন নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। লন্ডন শহর ছেড়ে তখন প্রথমবারের মতো গ্রামে গিয়েছিলাম আমি। গ্রাম দেখে তো আমার পাগল হওয়ার অবস্থা। চারদিকে খোলা প্রান্তর, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত সবুজ মাঠ।
গ্রামে গিয়েই আমি প্রথম দেখেছিলাম হাঁস, মুরগি, ছাগলছানা, গরু—এসব; একেবারে কাছ থেকে। আমি সারা দিন এসব ‘জীবন্ত খেলনা’ নিয়ে মেতে থাকতাম। এদের সঙ্গে মিশতে মিশতেই যেন আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, এগুলো আসলে খেলনা নয়। এগুলো আমাদেরই মতো। এদেরও আছে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অনুভূতি। আমার কাছে তখন মনে হলো, আসলে মানুষ আর এদের মধ্যে একটাই পার্থক্য, আর তা হলো এগুলো আমাদের মতো কথা বলতে পারে না। পশুপাখির জন্য আমার ভালোবাসার শুরুটা হয়তো সেখান থেকেই।
পশুপাখির প্রতি আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। তখন আমি আমার দাদাবাড়িতে গিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলাম। দাদাবাড়ির প্রতিটি ঘরের বুকসেলফে ছিল থরে থরে বই সাজানো। আমি যে ঘরটায় থাকতাম, সেখানেও একটা বইয়ের সেলফ ছিল। রোজ সকালে আমি ঘুম থেকে উঠেই হারিয়ে যেতাম বইয়ের রাজ্যে। এ সময় আমি পশুপাখির ওপর লেখা অজস্র বই পড়েছি। সেই যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠল, তা এখনো আছে। আমরা যে সে সময় খুব একটা সচ্ছল ছিলাম, তা কিন্তু নয়। আমার বাবার একটা মোটরসাইকেল কেনা দরকার ছিল, তা আমরা কিনতে পারিনি। আমার নিজের একটা বাইসাইকেল দরকার ছিল স্কুলে যাওয়ার জন্য, তা কেনার পয়সাও আমাদের ছিল না। কিন্তু বই পড়তে ভালোবাসতাম খুব। সে কারণেই আমাদের বই কেনা থেমে থাকেনি কখনো। আমি সব সময় পুরোনো বই কিনতাম। কারণ তাহলে একটা নতুন বইয়ের দামে তিনটা পুরোনো বই পাওয়া যেত। এর পরও সব বই তো আর কিনতে পারতাম না! যা-ই হোক, বই পড়ার এই অভ্যাসটা কখনো মরে যায়নি আমার। যখনই সময় পেতাম, বিনা মূল্যে বই পড়ার জন্য লাইব্রেরিতে ছুটতাম। আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে হারিয়ে যেতাম সব ভ্রমণকাহিনি পড়ে। সে সময়ই নিজে নিজে সংকল্প করে ফেলেছিলাম, রহস্যময় আফ্রিকায় যাব, পশুপাখি নিয়ে কাজ করব, ওদের কাছ থেকে দেখে ওদের চিনব, ভালোবাসব।
যা হওয়ার তা-ই হলো। আমার এসব ইচ্ছার কথা যে-ই শুনত, সে-ই হাসত। তারা শুধু আমার ব্যাপারেই হাসত। আমার কোনো ছেলেবন্ধু এসব কথা বললে সবাই খুব উৎ সাহ দিত। কিন্তু আমি মেয়ে, সে জন্যই বোধ হয় সবাই আমার কথা নিয়ে তামাশা করত। আমাকে নিয়ে হাসত সবাই। সেদিন আমি হাসিনি একটুও। আমি হেসেছিলাম অনেক দিন পর, যেদিন আমি রহস্যময় আফ্রিকার গহিন অরণ্যে পা রেখেছিলাম। একটা অল্পবয়সী মেয়ে শ্বাপদসংকুল আফ্রিকার বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পারে—এটা দেখে যখন সেই মানুষগুলো বোকা বনে গিয়েছিল, তখন আমি হেসেছিলাম ওদের অবাক হয়ে ঝুলে পড়া চোয়াল দেখে। কিন্তু আমি নিজেও জানতাম, কাজটা কত কঠিন।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বনেজঙ্গলে কাটানো খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। ২৬ বছরের একটা মেয়ের জন্য তো নয়ই। আমাকে অনেক বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আদিবাসীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজ করেছি। ওদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার চেষ্টা করতাম সব সময়।
আফ্রিকায় শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা করেই আমার জীবনের একটা বড় অংশ পার করেছি। খুব ছোটবেলায় আমার একটা পুতুল ছিল শিম্পাঞ্জির। আমি জানি না এ জন্যই আমার শিম্পাঞ্জিদের ব্যাপারে এত বেশি আগ্রহ কি না! আমিই সর্বপ্রথম সভ্য দুনিয়ার মানুষকে জানাই, শিম্পাঞ্জিরাও আমাদের মতো সামাজিক জীবন যাপন করে। ওদেরও রয়েছে আমাদের মতো অনুভূতিশক্তি। মানুষের মতোই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করে পাথর থেকে, গাছের ডাল থেকে। আবার অসুখ করলে ঔষধি গাছের বাকল, পাতা, শিকড় দিয়ে ওষুধ বানায় নিজেদের জন্য!
আমার গবেষণালব্ধ এসব কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়নি প্রথমে। অনেকে এমন কথাও বলেছে, একটা মেয়ের পক্ষে এত কিছু গবেষণা করে বের করা সম্ভব নয় মোটেও। কিন্তু আমার গবেষণার যাবতীয় কাগজপত্র, শিম্পাঞ্জিদের দুর্লভ সব ছবি কথা বলেছে আমার হয়ে, আমার গবেষণার হয়ে। এর ফলে সবাই জেনেছে যে শিম্পাঞ্জিরাও মানুষের মতো সামাজিক জীবন যাপন করে।
আমি আজও পশুপাখি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। তবে শুধু শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে নয়, এখন আমি কাজ করছি পৃথিবীর সব পশুপাখি নিয়ে। আমি সারা পৃথিবীর তরুণদের মধ্যে এই বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছি, পশুপাখিরও অধিকার আছে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার। তাদের সম্পর্কে জানতে হবে, ব্যাপক গবেষণা করতে হবে, তাদের ভালোবাসতে হবে। কোনো প্রজাতিই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না। আর এটা সম্ভব করতে পারে শুধু তরুণেরাই।
সূত্র: একাডেমি অব অ্যাচিভমেন্ট। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
No comments