ঋণ খেলাপে পিছিয়ে নেই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা
সম্প্রতি ২৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির চূড়ান্ত তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে। প্রথমবারের মতো প্রণীত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ ১০ খেলাপির এসব তালিকায় নাম রয়েছে অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকদের, যাঁদের অনেকেই সমাজে সুপরিচিত। এসব পরিচালক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৭৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করছেন না। শুধু একবার নয়, অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েকবার ঋণ নিয়েছেন। ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও এসব পরিচালকের অনেকে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ফের ঋণ নিয়েছেন। কয়েকজন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদেও দিব্যি 'দায়িত্ব পালন' করে যাচ্ছেন।
দেশের এই ২৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া মোট ঋণের ৬.১৯ শতাংশই (এক হাজার ১৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা) খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এর ৩.৯৯ শতাংশই অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকেরও বেশি টাকা পকেটে পুরেছেন সমাজের বিশিষ্ট শ্রেণীতে পরা ওই পরিচালকরা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠানো খেলাপি ঋণের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. এইচ বি এম ইকবাল, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. এম এ হান্নান ফিরোজ ও তাঁর স্ত্রী ফাতিনাজ ফিরোজ, একুশে টেলিভিশনের স্বত্বাধিকারী আবদুস সালাম, প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক ক্যাপ্টেন ইমাম আনোয়ার হোসেন ও মিসেস ফেরদৌসি ইসলামসহ আরো অনেকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৭ সালে সৌদি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল ইনভেস্টমেন্ট কম্পানি থেকে চার কোটি ১০ লাখ টাকা ঋণ নেয় বেঙ্গল টাইগার সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে এ ঋণের মেয়াদ নবায়ন করা হয় এবং একসময় ঋণের পরিমাণ সুদে-আসলে ছয় কোটি ৬৮ লাখ টাকা ছাড়িয়ে সম্পূর্ণ খেলাপি হয়। বেঙ্গল টাইগারের পরিচালক হিসেবে এ ঋণের গ্রহীতারা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. ইকবাল, প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক ক্যাপ্টেন ইমাম আনোয়ার হোসেন ও মিসেস ফেরদৌসি ইসলামসহ ছয়জন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো শীর্ষ ১০ খেলাপির তালিকায় এই ছয়জন পরিচালকের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় তাদের বেঙ্গল টাইগার সিমেন্টের অবস্থান চতুর্থ।
২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আইডিএলসি থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ নেয় ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে এর সাত কোটি পাঁচ লাখ টাকাই খেলাপি হয়। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ১০ খেলাপির মধ্যে ওয়েস্টমন্টের অবস্থান নবম। ওয়েস্টমন্ট এরপর ২০০৬ সালের ৩১ অক্টোবর ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট থেকে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ নেয়। এই ঋণ পরবর্তী সময়ে সুদ-আসলে পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ টাকা হয় এবং খেলাপি হয়। ফারইস্টের শীর্ষ ১০ খেলাপির তালিকায় ওয়েস্টমন্টের অবস্থান সপ্তম। ওয়েস্টমন্টের ঋণ গায়েব করে দেওয়ার কার্যকলাপ এখানেই শেষ নয়। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই আইআইডিএফসি থেকেও ওয়েস্টমন্ট ৫৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়। আইআইডিএফসির শীর্ষ ১০ খেলাপির তালিকায় ওয়েস্টমন্টের অবস্থান চতুর্থ। এসব খেলাপি প্রতিষ্ঠানের একমাত্র বাংলাদেশি পরিচালক হিসেবে তালিকায় নাম এসেছে তাজুল ইসলাম ফারুকের এবং তাঁর সঙ্গে রয়েছে আরো তিনজন বিদেশি পরিচালকের নাম। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স থেকে ২৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নেয়। ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে ঋণটি খেলাপি ঘোষিত হয়। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের পাঠানো শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির তালিকায় স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান প্রথম। ২০০৫ সালে ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকেও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দুই কোটি সাত লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয় এবং পরে ওই ঋণটিও খেলাপি হয়। ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্সের পাঠানো শীর্ষ ১০ খেলাপির তালিকায় স্ট্যামফোর্ডের অবস্থান তৃতীয়। উভয় প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির তালিকায় পরিচালক হিসেবে নাম রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ড. এম এ হান্নান ফিরোজ, মিসেস ফাতিনাজ ফিরোজসহ সাতজনের।
একুশে টেলিভিশন ১৯৯৯ সালের ৯ ডিসেম্বর আইপিডিসি থেকে সাড়ে ছয় কোটি টাকা, ১৯৯৯ সালের ১৯ অক্টোবর দেড় কোটি টাকা, ২০০৮ সালের ২১ মে চার কোটি টাকাসহ মোট ১২ কোটি টাকা ঋণ নেয়। পরবর্তী সময়ে এসব ঋণের ছয় কোটি ৩৪ লাখ টাকা খেলাপি হয়। প্রতিষ্ঠানটি আইপিডিসির শীর্ষ ১০ খেলাপির তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। একুশে টেলিভিশন ২০০৪ সালে আইডিএলসি থেকে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ টাকা ঋণ নেয়। পরিশোধ না করায় পরবর্তী সময়ে তা সুদে-আসলে ছয় কোটি ৮১ লাখ টাকা হয়ে খেলাপি হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির তালিকায় নাম উঠেছে একুশের পরিচালক আবদুস সালাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুল হক বীর-উত্তমসহ ১০ জনের।
খেলাপির শীর্ষ ১০-এ স্থান পাওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের অনেকেই বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক। ব্যাংক কম্পানি আইনের ২৭ ক.ক (৩) ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতার অনুকূলে ব্যাংক-কম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনোরূপ ঋণ সুবিধা প্রদান করতে পারবে না।' অন্য এক ধারায় বলা হয়েছে, ঋণখেলাপি ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না। খেলাপির তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কিভাবে ব্যাংকের পরিচালক ও বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাচ্ছেন_ এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় তাঁদের খেলাপি বলা যাচ্ছে না। ব্যাংকের কোনো পরিচালক ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে আদালতের স্থগিতাদেশ থাকলে ব্যাংক-কম্পানি আইন অনুযায়ী তাঁকে পরিচালক থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় না।
শীর্ষ ১০-এর তালিকা থেকে আরো দেখা গেছে, এসব ঋণ আদায়ে দায়ের করা মামলার অনেকটাই প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'এর আগে খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের কাছ থেকে করণীয় জানতে চেয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, এ জন্য পৃথক আদালত গঠন করা যেতে পারে। ব্যাংকিং বোঝে এবং আর্থিক আইন সম্পর্কে যাঁদের ভালো ধারণা রয়েছে, এমন ব্যক্তিদেরই আমরা বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করার সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হলেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে প্রভাবশালী খেলাপিদের মামলা যুগ যুগ ধরে চললেও এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করণীয় কিছু থাকছে না।'
শীর্ষ ১০ খেলাপি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় জোরদার করার পরামর্শ দেব। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মামলা করেই হোক অথবা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই হোক, তাদের কাছ থেকে আদায় বাড়াতে হবে।'
No comments