কোনটি তার মনের কথা by জাকির হোসেন
মহাজোট গঠন এবং বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পতিত সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার রাজনৈতিক অবস্থান ও মনোভাব বিষয়ে বিরামহীনভাবে স্ববিরোধী কথাবার্তা বলে চলেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রেডিক্টটেবল’ হিসেবে খ্যাত এরশাদ অন্তত তার এ অবস্থানটি বেশ শক্তভাবেই ধরে রেখেছেন। ‘আমি মহাজোটে আছি, মহাজোটেই থাকব এবং আগামী নির্বাচন মহাজোটবদ্ধ হয়েই করব’ ‘জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেবে, কোনো জোটে যাবে না’, ‘সরকারের কাছে আমার চাওয়া পাওয়া কিছু নেই’, এবং ‘বুকে বড় জালা নিয়ে মহাজোটে আছি’—এগুলো সাম্প্রতিক সময়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কণ্ঠনিঃসৃত অমর বাণী।
এ কথাগুলো তিনি গত প্রায় তিন বছরে কতবার যে বলেছেন এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। কিন্তু কেন তিনি এমন পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন, এরশাদের মনের কথা আসলে কোনটি—এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে পারেননি দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। অনেকেই তার বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করেননি। আবার কেউ বলেছেন, পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যিনি এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারেন। এমনকি এরশাদ নিজেও নিজের সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এরশাদের নীতি-নৈতিকতা বলে কিছুই নেই। তিনি চরম সুবিধাবাদী, অনির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসঘাতক একজন ব্যক্তি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আদালত এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তার শাস্তির ভার সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। ফলে বর্তমান সরকার চাইলেই এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে শাস্তি দিতে পারবে তেমনি ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও পারবে। তাই এরশাদ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে শাস্তি এড়াতে চাইলে বর্তমান সময়ে যেমন ক্ষমতাসীনদের বশ হয়ে থাকতে হবে তেমনি আগামীতে যারা ক্ষমতাসীন হবে তাদের সঙ্গেও আপস মীমাংসার পথ খোলা রাখতে হবে। জীবনের শেষ সময় এরশাদ আর জেলে যেতে চান না। তাই জেলের ভয়ে ভীত এরশাদ নিজেকে রক্ষায় স্ববিরোধী নানারকম কথাবার্তা বলছেন। সর্বোপরি এরশাদের নীতি-নৈতিকতা বলে কিছুই নেই। তিনি চরম সুবিধাবাদী, অনির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসঘাতক একজন ব্যক্তি। এ ধরনের ব্যক্তিরা এমনই হয়ে থাকে। এদিকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থান জানতে গতকাল সন্ধ্যায় তার সেলফোন এবং ল্যান্ডফোনে যোগাযোগ করা হলে পাওয়া যায়নি।
তবে এরশাদ সম্পর্কে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট হায়দার আকবর খান রনো বলেন, এরশাদ তার সুবিধামতো নানারকম কথা বলেন। তিনি আজ যে কথা বলেন, পরের দিন বলেন ঠিক তার উল্টোটি। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যিনি এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারেন। এমনকি এরশাদ নিজেও নিজের সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি আরও বলেন, এরশাদের নীতি-নৈতিকতা বলে কিছুই নেই। তিনি চরম সুবিধাবাদী, অনির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসঘাতক একজন ব্যক্তি।
এদিকে গত শনিবার রাজশাহীতে তৃণমূল সম্মেলনে নওহাটা কলেজ মাঠে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি আর টেনিস বল হবে না বা ফুটবল হবে না। যাতে দু’দল আমাদের নিয়ে খেলা করবে। এবার জাতীয় পার্টির নিজেই খেলোয়াড় হবে। জাতীয় পার্টি এবার এককভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে, কোনো জোটে যাবে না। কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। আবার এর একদিন পর গত রোববার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত্কালে বলেন, তিনি মহাজোটেই আছেন। গতকালও এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেন, তিনি এককভাবে নির্বাচন করবেন।
অন্যদিকে এরশাদ যে জেল এবং ফাঁসির ভয়ে চরম ভীত—বিষয়টি তিনি একাধিকবার প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলে তাকে যে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে না এবং এতে যে তিনি ভীষণ খুশি, এ অভিমতও ব্যক্ত করেছেন। গত বছর ২২ আগস্ট ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে আয়োজিত দলের যৌথ সভায় এরশাদ বলেন, ফাঁসির ভয়ে আমি ভীত নই। যদি আমাকে ফাঁসির মঞ্চে যেতেই হয় সম্মানের সঙ্গে যাব। অনেক দিন তো বাঁচলাম। জীবনে ছয় বছর জেল খেটেছি। তখন তো মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। এখন ফাঁসি হলে হবে। আপনারা এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। একই সঙ্গে তিনি বলেন, দলের অনেক নেতাকর্মী আমাকে প্রশ্ন করেন, মহাজোট করে আমি কী পেলাম? আমি তাদের বলি, দেয়ার মালিক তো আল্লাহ। তবে একটা কথা বলতে পারি, মহাজোটে যোগ দিয়ে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। এখন প্রতিদিন মামলার হাজিরা দিতে কোর্টে যেতে হয় না।
আবার ২৪ জুলাই ২০০৯ তারিখে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে এরশাদ বলেন, ওয়ান ইলেভেন না হলে আমাকে জেলে যেতে হতো। আমি জেলে গেলে জাতীয় পার্টিও জেলে চলে যেত। কিন্তু আমাকে জেলে যেতে হয়নি। এখন আমি মুক্ত বিহঙ্গ। তাই এ জন্য আপনারা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করুন।
শুধু বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয়, বিগত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের জোট রাজনীতির সমীকরণের বিষয়ে এরশাদ নানামুখী কৌশল নেয়। ওই বছর ২৭ জুলাই রাতে এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসভবনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। নানা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরদিন এরশাদ চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং ১৪ দলের শরিক বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে নানারকম কথা বলেন। তিনি শেখ হাসিনাকে দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তার ওপর নূর হোসেনের খুনের দায় চাপান। একইসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নীতি-আদর্শের কঠোর সমালোচনা করেন। আর বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ এবং তত্কালীন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের ভুয়সী প্রশংসা করেন। তবে বছরের শেষদিকে জোট করা নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নানামুখী চাপে একদিন সন্ধ্যায় আত্মগোপন করেন এরশাদ। প্রায় দু’দিন পর আত্মগোপন থেকে তিনি সরাসরি হাজির হন পল্টনে ১৪ দলের মহাসমাবেশে। সেখানে তিনি মহাজোট গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বর্তমানে তার দল জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক এবং তারা সহোদর ভাই জিএম কাদের বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রী।
এদিকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণার পর ২০০৬ সালের ১৬ আগস্ট সকালে রাজধানীর হোটেল সুন্দরবনে বৃহত্তর রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে নূর হোসেন হত্যাকাণ্ড বিষয়ে এরশাদ বলেন, আমি নূর হোসেনকে হত্যা করিনি। নূর হোসেন লাশের রাজনীতির শিকার হয়েছে। সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা একটি লাশ চেয়েছিলেন। সেই লাশের রাজনীতির শিকার হয়ে নূর হোসেন মৃত্যুবরণ করেছিল। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে শুধু নূর হোসেনের গায়ে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। এর কী উদ্দেশ্য ছিল, সেটা আজ কারও অজানা নয়। সেটা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এদিন তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সৃষ্ট রক্ষীবাহিনী জাসদের একজন কিংবা দু’জন নয়—৩০ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করেছিল। সেই জাসদ আজ আওয়ামী লীগের আঁচলের নিচে চলে গেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে তাদের পক্ষে বড় বড় কথা বলছে। এর চেয়ে লজ্জার কথা আর কী হতে পারে। তিনি বলেন, জেল থেকে আমি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিয়েছিলাম। এর বিনিময়ে তারা আমার দল ভেঙেছে, আমাকে জেলে দিয়েছে। তাই তাদের সঙ্গে জোট করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
২০০৬ সালের ৩১ জুলাই সকালে হোটেল সুন্দরবনে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চাঁদপুর জেলা জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনা বলেন আমি চোর। আমি চোর কিংবা দুর্নীতিবাজ নই। আমি যদি চোর হতাম, তাহলে আমার রাজপ্রাসাদ থাকত। আমি তো নিজের নামে বঙ্গভবন লিখে নেইনি। মিগ কিনে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করিনি। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে মিগ কেনার মাধ্যমে। যে মিগ এখন আকাশে ওড়ে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আমাকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে জেলে নেয়ার কথা বলেছিলেন। সে কথা আমি ভুলে যাইনি। তারা যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করে, আমরা তা করি না। শেখ হাসিনার উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, তিনি আমাকে খুনি বলেছেন। আমি খুনি বা হত্যাকারী নই। আমার হাতে কোনো রক্তের দাগ নেই। আমার বিবেক পরিষ্কার।
৩০ জুলাই (২০০৬) সকালে হোটেল সুন্দরবনে বৃহত্তর সিলেট জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এরশাদ জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে বলেন, আমরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এটা আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে আছে। তাই এ আদর্শের বাইরে অন্য কারও সঙ্গে জোট করা আমাদের জন্য কঠিন। এ আদর্শের ভিত্তিতে আমরা যদি জোটবদ্ধ হই—তবে এতে কারও মাথাব্যথা হওয়ার কারণ নেই। তিনি বলেন, তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর কয়েকটি পত্রিকা আমাকে নিয়ে এমন সমালোচনায় মেতে উঠেছে যে, যেন আমি তার সঙ্গে বৈঠক করে মহা অন্যায় করে ফেলেছি। আমি ১৪ দলে যোগ না দেয়ায় মনে হচ্ছে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে কোনো ভুল করিনি। দল এবং দলের স্বার্থ বিবেচনা করেই আমি তার সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি বলেন, চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের পর অনেকেই আমাকে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হিসেবে অভিহিত করছেন; কিন্তু তাদের জানা উচিত আমি একজন সৈনিক—আমরা কখনও আনপ্রেডিক্টেবল থাকি না। আমরা সিদ্ধান্ত নেই এবং তা বাস্তবায়ন করি।
অন্যদিকে এদিন দৈনিক আমার দেশকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাত্কারে তারেক রহমান সম্পর্কে এরশাদ বলেন, রাজনীতিতে তারেক নবাগত হলেও রাজনীতিক হিসেবে তাকে আমার অত্যন্ত পরিপকস্ফ বলে মনে হয়েছে। খুব মেপে কথা বলেন। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো অপ্রাসঙ্গিকতা নেই, কারও প্রতি কটূক্তি করেন না। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি স্থান করে নিতে পারবেন। রাজনীতিতে তার একটি সম্ভাবনা আছে। পৃথিবী এখন বদলে গেছে। এখন মানুষ তরুণ নেতৃত্ব চাচ্ছে। আমি মনে করি উনি যদি নিজেকে তৈরি করতে পারেন, তাহলে তিনিই ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবেন।
এতকিছুর পরও ওই বছর ৬ নভেম্বর ভোল পাল্টান এরশাদ। এদিন দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা শেষে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে চারদলে যোগ দেয়া নিয়ে আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আজ আমার সেই ভুল ভেঙেছে। তাই আর চারদলে যাচ্ছি না। আপাতত এককভাবে নির্বাচন করার কথা ভাবছি। এরপর জোট করা নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং নিজ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নানামুখী চাপে ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে নিখোঁজ হন এরশাদ। এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা জানান, অসুস্থতার কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; কিন্তু কোনো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন—তা কেউ বলতে পারেননি। স্ত্রী রওশন তার খোঁজে সিকদার মেডিকেলে যান কিন্তু পাননি। এ সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হেলালের বাড়িতে। প্রায় দু’দিন পর ১৮ ডিসেম্বর তার খোঁজ মেলে। আত্মগোপন থেকে তিনি সরাসরি হাজির হন পল্টনে ১৪ দলের মহাসমাবেশে। সেখানে বক্তৃতায় তিনি বলেন, এতদিন আমি ছিলাম শৃঙ্খলিত—এবার এ সমাবেশে সেই শৃঙ্খল ভেঙে ফেললাম। সমাবেশে জনগণের কাছে তিনি ক্ষমা চান তার কৃতকর্মের জন্য। বলেন, তিনি একজন সৈনিক। তাই মৃত্যুকে ভয় পান না তিনি। সমাবেশে যোগ দিয়ে তিনি মহাজোট গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আদালত এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তার শাস্তির ভার সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। ফলে বর্তমান সরকার চাইলেই এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে শাস্তি দিতে পারবে তেমনি ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও পারবে। তাই এরশাদ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে শাস্তি এড়াতে চাইলে বর্তমান সময়ে যেমন ক্ষমতাসীনদের বশ হয়ে থাকতে হবে তেমনি আগামীতে যারা ক্ষমতাসীন হবে তাদের সঙ্গেও আপস মীমাংসার পথ খোলা রাখতে হবে। জীবনের শেষ সময় এরশাদ আর জেলে যেতে চান না। তাই জেলের ভয়ে ভীত এরশাদ নিজেকে রক্ষায় স্ববিরোধী নানারকম কথাবার্তা বলছেন। সর্বোপরি এরশাদের নীতি-নৈতিকতা বলে কিছুই নেই। তিনি চরম সুবিধাবাদী, অনির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসঘাতক একজন ব্যক্তি। এ ধরনের ব্যক্তিরা এমনই হয়ে থাকে। এদিকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থান জানতে গতকাল সন্ধ্যায় তার সেলফোন এবং ল্যান্ডফোনে যোগাযোগ করা হলে পাওয়া যায়নি।
তবে এরশাদ সম্পর্কে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট হায়দার আকবর খান রনো বলেন, এরশাদ তার সুবিধামতো নানারকম কথা বলেন। তিনি আজ যে কথা বলেন, পরের দিন বলেন ঠিক তার উল্টোটি। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যিনি এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারেন। এমনকি এরশাদ নিজেও নিজের সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি আরও বলেন, এরশাদের নীতি-নৈতিকতা বলে কিছুই নেই। তিনি চরম সুবিধাবাদী, অনির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসঘাতক একজন ব্যক্তি।
এদিকে গত শনিবার রাজশাহীতে তৃণমূল সম্মেলনে নওহাটা কলেজ মাঠে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি আর টেনিস বল হবে না বা ফুটবল হবে না। যাতে দু’দল আমাদের নিয়ে খেলা করবে। এবার জাতীয় পার্টির নিজেই খেলোয়াড় হবে। জাতীয় পার্টি এবার এককভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে, কোনো জোটে যাবে না। কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। আবার এর একদিন পর গত রোববার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত্কালে বলেন, তিনি মহাজোটেই আছেন। গতকালও এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেন, তিনি এককভাবে নির্বাচন করবেন।
অন্যদিকে এরশাদ যে জেল এবং ফাঁসির ভয়ে চরম ভীত—বিষয়টি তিনি একাধিকবার প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলে তাকে যে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে না এবং এতে যে তিনি ভীষণ খুশি, এ অভিমতও ব্যক্ত করেছেন। গত বছর ২২ আগস্ট ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে আয়োজিত দলের যৌথ সভায় এরশাদ বলেন, ফাঁসির ভয়ে আমি ভীত নই। যদি আমাকে ফাঁসির মঞ্চে যেতেই হয় সম্মানের সঙ্গে যাব। অনেক দিন তো বাঁচলাম। জীবনে ছয় বছর জেল খেটেছি। তখন তো মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। এখন ফাঁসি হলে হবে। আপনারা এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। একই সঙ্গে তিনি বলেন, দলের অনেক নেতাকর্মী আমাকে প্রশ্ন করেন, মহাজোট করে আমি কী পেলাম? আমি তাদের বলি, দেয়ার মালিক তো আল্লাহ। তবে একটা কথা বলতে পারি, মহাজোটে যোগ দিয়ে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। এখন প্রতিদিন মামলার হাজিরা দিতে কোর্টে যেতে হয় না।
আবার ২৪ জুলাই ২০০৯ তারিখে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে এরশাদ বলেন, ওয়ান ইলেভেন না হলে আমাকে জেলে যেতে হতো। আমি জেলে গেলে জাতীয় পার্টিও জেলে চলে যেত। কিন্তু আমাকে জেলে যেতে হয়নি। এখন আমি মুক্ত বিহঙ্গ। তাই এ জন্য আপনারা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করুন।
শুধু বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয়, বিগত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের জোট রাজনীতির সমীকরণের বিষয়ে এরশাদ নানামুখী কৌশল নেয়। ওই বছর ২৭ জুলাই রাতে এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসভবনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। নানা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরদিন এরশাদ চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং ১৪ দলের শরিক বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে নানারকম কথা বলেন। তিনি শেখ হাসিনাকে দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তার ওপর নূর হোসেনের খুনের দায় চাপান। একইসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নীতি-আদর্শের কঠোর সমালোচনা করেন। আর বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ এবং তত্কালীন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের ভুয়সী প্রশংসা করেন। তবে বছরের শেষদিকে জোট করা নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নানামুখী চাপে একদিন সন্ধ্যায় আত্মগোপন করেন এরশাদ। প্রায় দু’দিন পর আত্মগোপন থেকে তিনি সরাসরি হাজির হন পল্টনে ১৪ দলের মহাসমাবেশে। সেখানে তিনি মহাজোট গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বর্তমানে তার দল জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক এবং তারা সহোদর ভাই জিএম কাদের বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রী।
এদিকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণার পর ২০০৬ সালের ১৬ আগস্ট সকালে রাজধানীর হোটেল সুন্দরবনে বৃহত্তর রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে নূর হোসেন হত্যাকাণ্ড বিষয়ে এরশাদ বলেন, আমি নূর হোসেনকে হত্যা করিনি। নূর হোসেন লাশের রাজনীতির শিকার হয়েছে। সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা একটি লাশ চেয়েছিলেন। সেই লাশের রাজনীতির শিকার হয়ে নূর হোসেন মৃত্যুবরণ করেছিল। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে শুধু নূর হোসেনের গায়ে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। এর কী উদ্দেশ্য ছিল, সেটা আজ কারও অজানা নয়। সেটা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এদিন তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সৃষ্ট রক্ষীবাহিনী জাসদের একজন কিংবা দু’জন নয়—৩০ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করেছিল। সেই জাসদ আজ আওয়ামী লীগের আঁচলের নিচে চলে গেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে তাদের পক্ষে বড় বড় কথা বলছে। এর চেয়ে লজ্জার কথা আর কী হতে পারে। তিনি বলেন, জেল থেকে আমি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিয়েছিলাম। এর বিনিময়ে তারা আমার দল ভেঙেছে, আমাকে জেলে দিয়েছে। তাই তাদের সঙ্গে জোট করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
২০০৬ সালের ৩১ জুলাই সকালে হোটেল সুন্দরবনে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চাঁদপুর জেলা জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনা বলেন আমি চোর। আমি চোর কিংবা দুর্নীতিবাজ নই। আমি যদি চোর হতাম, তাহলে আমার রাজপ্রাসাদ থাকত। আমি তো নিজের নামে বঙ্গভবন লিখে নেইনি। মিগ কিনে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করিনি। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে মিগ কেনার মাধ্যমে। যে মিগ এখন আকাশে ওড়ে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আমাকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে জেলে নেয়ার কথা বলেছিলেন। সে কথা আমি ভুলে যাইনি। তারা যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করে, আমরা তা করি না। শেখ হাসিনার উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, তিনি আমাকে খুনি বলেছেন। আমি খুনি বা হত্যাকারী নই। আমার হাতে কোনো রক্তের দাগ নেই। আমার বিবেক পরিষ্কার।
৩০ জুলাই (২০০৬) সকালে হোটেল সুন্দরবনে বৃহত্তর সিলেট জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এরশাদ জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে বলেন, আমরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এটা আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে আছে। তাই এ আদর্শের বাইরে অন্য কারও সঙ্গে জোট করা আমাদের জন্য কঠিন। এ আদর্শের ভিত্তিতে আমরা যদি জোটবদ্ধ হই—তবে এতে কারও মাথাব্যথা হওয়ার কারণ নেই। তিনি বলেন, তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর কয়েকটি পত্রিকা আমাকে নিয়ে এমন সমালোচনায় মেতে উঠেছে যে, যেন আমি তার সঙ্গে বৈঠক করে মহা অন্যায় করে ফেলেছি। আমি ১৪ দলে যোগ না দেয়ায় মনে হচ্ছে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে কোনো ভুল করিনি। দল এবং দলের স্বার্থ বিবেচনা করেই আমি তার সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি বলেন, চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের পর অনেকেই আমাকে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হিসেবে অভিহিত করছেন; কিন্তু তাদের জানা উচিত আমি একজন সৈনিক—আমরা কখনও আনপ্রেডিক্টেবল থাকি না। আমরা সিদ্ধান্ত নেই এবং তা বাস্তবায়ন করি।
অন্যদিকে এদিন দৈনিক আমার দেশকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাত্কারে তারেক রহমান সম্পর্কে এরশাদ বলেন, রাজনীতিতে তারেক নবাগত হলেও রাজনীতিক হিসেবে তাকে আমার অত্যন্ত পরিপকস্ফ বলে মনে হয়েছে। খুব মেপে কথা বলেন। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো অপ্রাসঙ্গিকতা নেই, কারও প্রতি কটূক্তি করেন না। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি স্থান করে নিতে পারবেন। রাজনীতিতে তার একটি সম্ভাবনা আছে। পৃথিবী এখন বদলে গেছে। এখন মানুষ তরুণ নেতৃত্ব চাচ্ছে। আমি মনে করি উনি যদি নিজেকে তৈরি করতে পারেন, তাহলে তিনিই ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবেন।
এতকিছুর পরও ওই বছর ৬ নভেম্বর ভোল পাল্টান এরশাদ। এদিন দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা শেষে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে চারদলে যোগ দেয়া নিয়ে আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আজ আমার সেই ভুল ভেঙেছে। তাই আর চারদলে যাচ্ছি না। আপাতত এককভাবে নির্বাচন করার কথা ভাবছি। এরপর জোট করা নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং নিজ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নানামুখী চাপে ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে নিখোঁজ হন এরশাদ। এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা জানান, অসুস্থতার কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; কিন্তু কোনো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন—তা কেউ বলতে পারেননি। স্ত্রী রওশন তার খোঁজে সিকদার মেডিকেলে যান কিন্তু পাননি। এ সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হেলালের বাড়িতে। প্রায় দু’দিন পর ১৮ ডিসেম্বর তার খোঁজ মেলে। আত্মগোপন থেকে তিনি সরাসরি হাজির হন পল্টনে ১৪ দলের মহাসমাবেশে। সেখানে বক্তৃতায় তিনি বলেন, এতদিন আমি ছিলাম শৃঙ্খলিত—এবার এ সমাবেশে সেই শৃঙ্খল ভেঙে ফেললাম। সমাবেশে জনগণের কাছে তিনি ক্ষমা চান তার কৃতকর্মের জন্য। বলেন, তিনি একজন সৈনিক। তাই মৃত্যুকে ভয় পান না তিনি। সমাবেশে যোগ দিয়ে তিনি মহাজোট গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
No comments