শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগে প্রশ্ন করা হবে না : বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভে ঊর্ধ্বমুখী সূচক
শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করা হলে উত্স সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলে জানিয়েছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। গতকাল এসইসি চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন বলেন, শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কারও বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) একাউন্টে যদি টাকা থাকে এবং তা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয় তাহলে সে অর্থের উত্স সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।
তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, কোনো সন্ত্রাসী কাজে অর্থ ব্যবহার করা না হলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা থেকেও অর্থের উত্স সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এছাড়া শেয়ারাবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর রেয়াত সুবিধা বহাল, ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর আরোপিত কর কমানো ও মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর আরোপিত কর প্রত্যাহারে এসইসির সুপারিশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে এবং আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এসব ব্যাপারে এনবিআরের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এসইসি চেয়ারম্যান। অপরদিকে শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে এসইসি। বৈঠকে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মার্চেন্ট ব্যাংকের মার্জিন লোনের সুদ মওকুফের বিষয়সহ পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে এসইসির সংবাদ সম্মেলন ও বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের ফলে গতকাল সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দিনের লেনদেন। আগের দিনের তুলনায় দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক ৬৬ পয়েন্ট বেড়েছে। দিনশেষে ডিএসই সূচক ৫ হাজার ৩৫৯ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের দিন ডিএসই সূচকের পতন হয়েছিল ২২৫ পয়েন্টের। গতকালও সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতা দিয়েই শুরু হয় দিনের লেনদেন। লেনদেন শুরুর মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে ডিএসই সূচকের পতন ঘটে ১০০ পয়েন্টের। এ সময় লেনদেনে অংশ নেয়া প্রায় সবকটি কোম্পানির শেয়ারের দর কমে যায়। দরপতনে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। বিনিয়োগকারীরা অন্যান্য দিনের মতো শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পদত্যাগ দাবি করেন। একই সঙ্গে তারা প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আতিউর রহমান, ডিএসই প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভীরও পদত্যাগের দাবি জানান। বিনিয়োগকারীরা এ চারজনের বিরুদ্ধে নানা সেম্লাগান দেন। বিক্ষোভ চলাকালে ইত্তেফাকের মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ থাকে। বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের পর থেকে শেয়ারবাজারে সূচক বাড়তে থাকে। একঘণ্টার ব্যবধানে সূচক দিনের সর্বনিম্ন অবস্থা থেকে প্রায় ১৫০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। বেলা ২টার দিকে এ ব্যবধান বেড়ে যায় ২৫০ পয়েন্টে। দিনশেষে আগের দিনের তুলনায় ৬৬ দশমিক ৩০ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৩৫৯ দশমিক ৬১ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিন লেনদেনে অংশ নেয়া অধিকাংশ কোম্পানিরই শেয়ারের দর বেড়েছে। ২৫৩টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২১৮টির, কমেছে ২৮টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৭টির দর। তবে সূচক বাড়লেও লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। আগের দিনের তুলনায় ১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা কমে গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩১৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
সরকারের শীর্ষ মহল বিচলিত : শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনে সরকারের শীর্ষ মহল বিচলিত বলে জানিয়েছেন এসইসির চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থাকবেই। সব দেশের শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন হয়ে থাকে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজারে ক্রমাগত নিম্নমুখী প্রবণতায় এসইসি ও সরকারের শীর্ষ মহল বিচলিত। পুঁজিবজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহল এবং অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল দেখতে চায়। কারণ, পুঁজিবাজার অর্থায়নের বিকল্প উত্স হিসেবে কাজ করে এবং এর সঙ্গে অনেক লোক জড়িত রয়েছেন। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এনবিআরের আশ্বাস : শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করেছে এসইসি। বৈঠক শেষে এসইসি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা আজ বুধবার এনবিআরের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এনবিআরের পক্ষ থেকে এসব বিষয় বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে আগে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যেত। কিন্তু বাজেটে সে সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। আমরা এনবিআরকে আগের সুবিধা বহাল রাখার জন্য সুপারিশ করেছি। এছাড়া মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। আমরা তাও প্রত্যাহার করার কথা বলেছি। এনবিআর এগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এসব বিষয়ে এনবিআর সিদ্ধান্ত জানাবে।
এনবিআরের কাছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর লেনদেনের ওপর কর ০.১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.০৫ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান এসইসি চেয়ারম্যান। তবে করের হার কমানো হলে বিনিয়োগকারীরা তার সুবিধা পাবে কিনা তা জানতে চেয়েছে এনবিআর। এসইসি’র চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে এনবিআরকে জানিয়েছেন, করের হার কমানো হলে সকল ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট হাউসগুলোকে গ্রাহকের লেনদেনের ওপর কমিশন কমানোর জন্য চিঠি দেয়া হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান তা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কালোটাকা বিনিয়োগের প্রসঙ্গে এসইসি চেয়ারম্যান বলেন, গত বছরও শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। গত বাজেটেও এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। কালোটাকা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করলে অবশ্যই তার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হবে। কিন্তু কারো বেনিফিশিয়ারি একাউন্টে যদি কোনো অর্থ থাকে এবং সে অর্থ যদি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয় তাহলে সে অর্থের উত্স সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এর ফলে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তির অবসান হবে বলে মনে করছেন তিনি। এখানে প্রসঙ্গত কালোটাকার উত্স সম্পর্কে এনবিআর থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করা হলেও দুদক বা সরকারের অন্যান্য সংস্থা থেকে টাকার উত্স সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে বলে অর্থমন্ত্রী গত কয়েক মাস আগে বলেছিলেন। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগে আগ্রহীরা পিছিয়ে যান। এতে বাজারে তারল্য প্রবাহও আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়।
ফোর্সড সেল বন্ধের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ফোর্সড সেল বন্ধের ব্যাপারে আমরা আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও কেউ যদি ফোর্সড সেল হয়ে থাকে আমাদের কাছে অভিযোগ আকারে তা দাখিল করলে আমরা তা দেখব। তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্নভাব ফোর্সড সেলের বিষয়টি তদন্ত করছি। কিছু সময়ের জন্য ফোর্সড সেল বন্ধে কোনো নির্দেশনা জারি করা যায় কিনা তা কমিশন পরীক্ষা করে দেখবে বলে জানান তিনি।
পুনর্গঠিত হওয়ার ৬ মাসেও শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে না পারার কারণে কমিশন ব্যর্থ কিনা জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, এখনও এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় হয়নি। একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা এখানে এসেছি। আমরা কিছু করতে এসেছি। কোরাম পূর্ণ হওয়ার পর আমরা বেশ কিছু আইন-কানুন সংশোধন করেছি। বুকবিল্ডিং পদ্ধতি, মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা সংশোধনসহ মূলধন সংগ্রহে নীতিমালা করা হয়েছে। এসব থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে সময় লাগবে। আমরা শেয়ারবাজারকে একটি স্থিতিশীল, স্বচ্ছ, দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এসইসির বৈঠক : শেয়ারবাজারে অব্যাহত ধস ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে এসইসি। বৈঠকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে এসইসি’র সদস্য হেলাল উদ্দিন নিজামী বলেন, বাজারে তীব্র তারল্য সঙ্কট রয়েছে। আর বিনিয়োগকারীদের মাঝেও এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হচ্ছে না। তাই শেয়ারবাজারের স্বার্থে এসব সমস্যা নিরসন করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরকে বাজারমুখী করতে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট রয়েছে। কিভাবে তারল্য বাড়ানো যায় সে ব্যাপারেও কথা হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কোনো ব্যাংক যদি মার্চেন্ট ব্যাংকের ঋণের সুদ মওকুফ করে দেয় তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আপত্তি করা হবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মূলধনের মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে বাজারে। এক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়া হবে না। তবে ব্যাংকগুলো চাইলে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বিনিয়োগ করতে পারবে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, নতুন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যাদের নামের মধ্যে ফাইনান্স বা ইনভেস্টমেন্ট উল্লেখ থাকবে তাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) সংগ্রহ করতে হবে।
বৈঠক শেষে নিজামী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর রুটিন মাফিক বৈঠক এটি। বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয়ের জন্যই এই বৈঠক করা হয়। আশা করছি যে, বৈঠকে যেসব বিষয়ে কথা হয়েছে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এসইসি’র চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন, আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদসহ চার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এসইসির সংবাদ সম্মেলন ও বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের ফলে গতকাল সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দিনের লেনদেন। আগের দিনের তুলনায় দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক ৬৬ পয়েন্ট বেড়েছে। দিনশেষে ডিএসই সূচক ৫ হাজার ৩৫৯ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের দিন ডিএসই সূচকের পতন হয়েছিল ২২৫ পয়েন্টের। গতকালও সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতা দিয়েই শুরু হয় দিনের লেনদেন। লেনদেন শুরুর মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে ডিএসই সূচকের পতন ঘটে ১০০ পয়েন্টের। এ সময় লেনদেনে অংশ নেয়া প্রায় সবকটি কোম্পানির শেয়ারের দর কমে যায়। দরপতনে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। বিনিয়োগকারীরা অন্যান্য দিনের মতো শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পদত্যাগ দাবি করেন। একই সঙ্গে তারা প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আতিউর রহমান, ডিএসই প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভীরও পদত্যাগের দাবি জানান। বিনিয়োগকারীরা এ চারজনের বিরুদ্ধে নানা সেম্লাগান দেন। বিক্ষোভ চলাকালে ইত্তেফাকের মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ থাকে। বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের পর থেকে শেয়ারবাজারে সূচক বাড়তে থাকে। একঘণ্টার ব্যবধানে সূচক দিনের সর্বনিম্ন অবস্থা থেকে প্রায় ১৫০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। বেলা ২টার দিকে এ ব্যবধান বেড়ে যায় ২৫০ পয়েন্টে। দিনশেষে আগের দিনের তুলনায় ৬৬ দশমিক ৩০ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৩৫৯ দশমিক ৬১ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিন লেনদেনে অংশ নেয়া অধিকাংশ কোম্পানিরই শেয়ারের দর বেড়েছে। ২৫৩টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২১৮টির, কমেছে ২৮টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৭টির দর। তবে সূচক বাড়লেও লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। আগের দিনের তুলনায় ১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা কমে গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩১৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
সরকারের শীর্ষ মহল বিচলিত : শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনে সরকারের শীর্ষ মহল বিচলিত বলে জানিয়েছেন এসইসির চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থাকবেই। সব দেশের শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন হয়ে থাকে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজারে ক্রমাগত নিম্নমুখী প্রবণতায় এসইসি ও সরকারের শীর্ষ মহল বিচলিত। পুঁজিবজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহল এবং অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল দেখতে চায়। কারণ, পুঁজিবাজার অর্থায়নের বিকল্প উত্স হিসেবে কাজ করে এবং এর সঙ্গে অনেক লোক জড়িত রয়েছেন। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন না হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এনবিআরের আশ্বাস : শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করেছে এসইসি। বৈঠক শেষে এসইসি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা আজ বুধবার এনবিআরের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এনবিআরের পক্ষ থেকে এসব বিষয় বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে আগে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যেত। কিন্তু বাজেটে সে সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। আমরা এনবিআরকে আগের সুবিধা বহাল রাখার জন্য সুপারিশ করেছি। এছাড়া মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। আমরা তাও প্রত্যাহার করার কথা বলেছি। এনবিআর এগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এসব বিষয়ে এনবিআর সিদ্ধান্ত জানাবে।
এনবিআরের কাছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর লেনদেনের ওপর কর ০.১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.০৫ শতাংশ করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান এসইসি চেয়ারম্যান। তবে করের হার কমানো হলে বিনিয়োগকারীরা তার সুবিধা পাবে কিনা তা জানতে চেয়েছে এনবিআর। এসইসি’র চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে এনবিআরকে জানিয়েছেন, করের হার কমানো হলে সকল ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট হাউসগুলোকে গ্রাহকের লেনদেনের ওপর কমিশন কমানোর জন্য চিঠি দেয়া হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান তা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কালোটাকা বিনিয়োগের প্রসঙ্গে এসইসি চেয়ারম্যান বলেন, গত বছরও শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। গত বাজেটেও এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। কালোটাকা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করলে অবশ্যই তার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হবে। কিন্তু কারো বেনিফিশিয়ারি একাউন্টে যদি কোনো অর্থ থাকে এবং সে অর্থ যদি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয় তাহলে সে অর্থের উত্স সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এর ফলে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তির অবসান হবে বলে মনে করছেন তিনি। এখানে প্রসঙ্গত কালোটাকার উত্স সম্পর্কে এনবিআর থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন না করা হলেও দুদক বা সরকারের অন্যান্য সংস্থা থেকে টাকার উত্স সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে বলে অর্থমন্ত্রী গত কয়েক মাস আগে বলেছিলেন। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগে আগ্রহীরা পিছিয়ে যান। এতে বাজারে তারল্য প্রবাহও আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়।
ফোর্সড সেল বন্ধের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ফোর্সড সেল বন্ধের ব্যাপারে আমরা আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও কেউ যদি ফোর্সড সেল হয়ে থাকে আমাদের কাছে অভিযোগ আকারে তা দাখিল করলে আমরা তা দেখব। তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্নভাব ফোর্সড সেলের বিষয়টি তদন্ত করছি। কিছু সময়ের জন্য ফোর্সড সেল বন্ধে কোনো নির্দেশনা জারি করা যায় কিনা তা কমিশন পরীক্ষা করে দেখবে বলে জানান তিনি।
পুনর্গঠিত হওয়ার ৬ মাসেও শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে না পারার কারণে কমিশন ব্যর্থ কিনা জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, এখনও এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় হয়নি। একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা এখানে এসেছি। আমরা কিছু করতে এসেছি। কোরাম পূর্ণ হওয়ার পর আমরা বেশ কিছু আইন-কানুন সংশোধন করেছি। বুকবিল্ডিং পদ্ধতি, মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা সংশোধনসহ মূলধন সংগ্রহে নীতিমালা করা হয়েছে। এসব থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে সময় লাগবে। আমরা শেয়ারবাজারকে একটি স্থিতিশীল, স্বচ্ছ, দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এসইসির বৈঠক : শেয়ারবাজারে অব্যাহত ধস ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে এসইসি। বৈঠকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে এসইসি’র সদস্য হেলাল উদ্দিন নিজামী বলেন, বাজারে তীব্র তারল্য সঙ্কট রয়েছে। আর বিনিয়োগকারীদের মাঝেও এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হচ্ছে না। তাই শেয়ারবাজারের স্বার্থে এসব সমস্যা নিরসন করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরকে বাজারমুখী করতে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট রয়েছে। কিভাবে তারল্য বাড়ানো যায় সে ব্যাপারেও কথা হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কোনো ব্যাংক যদি মার্চেন্ট ব্যাংকের ঋণের সুদ মওকুফ করে দেয় তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আপত্তি করা হবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মূলধনের মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে বাজারে। এক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়া হবে না। তবে ব্যাংকগুলো চাইলে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বিনিয়োগ করতে পারবে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, নতুন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যাদের নামের মধ্যে ফাইনান্স বা ইনভেস্টমেন্ট উল্লেখ থাকবে তাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) সংগ্রহ করতে হবে।
বৈঠক শেষে নিজামী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর রুটিন মাফিক বৈঠক এটি। বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয়ের জন্যই এই বৈঠক করা হয়। আশা করছি যে, বৈঠকে যেসব বিষয়ে কথা হয়েছে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এসইসি’র চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন, আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদসহ চার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
No comments