ভোটের লড়াইয়ে শামীম-আইভী দু'জনেই by নিয়াজ মোর্শেদ, অমরেশ রায় ও এমএ খান মিঠু
নিয়াজ মোর্শেদ/অমরেশ রায়/এমএ খান মিঠুনারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে নাটকীয়তাই থেকে গেল। গতকাল বুধবার ছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহলের গত কয়েক দিনের তৎপরতা সত্ত্বেও মেয়র পদে দলীয় সমর্থনপ্রত্যাশী দুই প্রার্থী সাবেক সাংসদ একেএম শামীম ওসমান এবং সাবেক পৌরসভার মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াননি। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই হেভিওয়েট প্রার্থীই নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায়রয়ে যাওয়ায় দলীয় সমর্থন প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলকে আরও কৌশলী হতে হচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, মেয়র পদে শেষ পর্যন্ত কাউকেই সমর্থন না দিয়ে পরিস্থিতি 'পর্যবেক্ষণের' নীতি অনুসরণ করা হবে।ভোটের মাঠে আইভী-শামীম দু'জনই থেকে যাওয়ায় নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াই হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো_ শামীম, আইভী না বিএনপির অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার কাকে বেছে নেবেন নারায়ণগঞ্জবাসী। এদিকে মেয়র প্রার্থী সমর্থন প্রশ্নে বুধবার দলীয় সিদ্ধান্ত নিতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত থাকলেও সেটি হয়নি। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যরা নীলফামারী সফরে যাওয়ায় এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
বুধবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে সমকালকে হানিফ জানান, দুই প্রার্থীর কেউই মনোনয়ন প্রত্যাহার না করায় এ বিষয়ে করণীয় এবং সাংগঠনিক অবস্থান ঠিক করতে দলীয় ফোরামে শিগগিরই আলোচনা করবেন তারা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নির্বাচনী আচরণবিধি পর্যালোচনা করে দেখা হবে উল্লেখ করলেও কবে নাগাদ দলীয় ফোরামের বৈঠকটি হবে, তা পরিষ্কার করেননি তিনি। তার কথায়, 'কাল-পরশুই যে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে_ তা নয়। নির্বাচনের এখনও সময় আছে।'
দলীয় নীতিনির্ধারকদের সূত্রে জানা গেছে, দুই প্রার্থী বহাল থাকলেও এ মুহূর্তে এ বিষয়ে দলের তেমন কিছু করণীয় নেই। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী কোনো প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়ে মাঠে নামারও সুযোগ নেই। একইভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নির্দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এ নির্বাচনে দলের একাধিক প্রার্থী থাকলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব নয়। এ ছাড়া দুই প্রার্থী শামীম ও আইভী দু'জনেই স্থানীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়াটাও সহজ নয়। এ অবস্থায় দল কাউকে সমর্থন না দিয়ে আপাতত পরিস্থিতি 'পর্যবেক্ষণ' করে যেতে চাচ্ছে।
এর আগে গত কয়েকদিনে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুই দফা এবং দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের সঙ্গে এক দফা বৈঠকে বসলেও নির্বাচন করার বিষয়ে অনড় অবস্থান দেখিয়ে আসছিলেন শামীম ও আইভী। একাধিক বৈঠকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে সম্মত হলে শামীম ওসমানকে প্রতিমন্ত্রী ও দলের জেলা সভাপতি কিংবা আগামী সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হচ্ছিল। অন্যদিকে মেয়র পদ থেকে সরে দাঁড়ালে আইভীকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। গতকাল দুই প্রার্থীই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। গতকালও শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, 'আমিই দলের সমর্থন পাব।' তিনি বলেন, 'আমাদের পরিবারের মর্যাদা রয়েছে। আমি শুধু শুধু মাঠে নেই।' অন্যদিকে ডা. আইভী বলেছেন, 'আমার বাবার মতো আমিও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করব না। একটি ভোট পেলেও এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব।'
আওয়ামী লীগের দুই প্রধান প্রার্থী ভোটের ময়দানে লড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পুরোপুরি জমে উঠেছে নাসিক নির্বাচন। ভোটের লড়াইয়ে তৈমুর এখন কোনো বিশেষ সুবিধা পাবেন কি-না সেই প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। সেই সঙ্গে জটিল সমীকরণের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে নতুন এ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন। বুধবারও তিন প্রার্থী গণসংযোগ করেছেন বিরামহীনভাবেই। আজ বৃহস্পতিবার সকালে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ হবে। এর আগেই অবশ্য মেয়র প্রার্থী ডা. আইভী দোয়াত-কলম এবং শামীম ওসমান দেওয়াল ঘড়ি প্রতীকে ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে শুরু করে দিয়েছেন।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার নিয়ে নাটকীয়তা : মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন বুধবার নারায়ণগঞ্জ শহর নানা নাটকীয়তায় মোড়া ছিল। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় শহরের চাষাঢ়া ডাকবাংলোয় সকাল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উৎসুক নেতাকর্মী-সমর্থকদের ভিড় লেগেই ছিল। সেই সঙ্গে সাংবাদিক আর ভোটাররাও জড় হয়েছিলেন সেখানে। আশপাশের বাসিন্দারাও কিছুক্ষণ পরপর এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন, সর্বশেষ কে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেন? শামীম ওসমান কিংবা সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রত্যাহার করেছেন কি-না? আওয়ামী লীগের অপর দুই প্রার্থী এসএম আকরাম কিংবা হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরী প্রত্যাহার করেছেন কি-না?
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কেটেছে সবার অপেক্ষার প্রহর। আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু দুই প্রার্থীর কেউই শেষ পর্যন্ত সেখানে এলেন না। বৃথা অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষে বিকেল ৫টায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন সবাই, শামীম ওসমান কিংবা সেলিনা হায়াৎ আইভী_ কেউই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। শামীম ও আইভী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করলেও বুধবার মেয়র পদের অপর দুই প্রার্থী নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সাবেক সাংসদ এসএম আকরাম এবং ওলামা লীগ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি হাবিবউল্লাহ কাঁচপুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। উভয়েই দলীয় হাইকমান্ডের 'নির্দেশে' মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়ের (বিকেল ৫টা) দেড় ঘণ্টা আগে বিকেল সাড়ে ৩টার কিছু পরে এসএম আকরামের পক্ষে তার মনোনীত ব্যক্তি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে গিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দেন। অন্যদিকে দুপুর পৌনে ২টায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন হাবিবউল্লাহ কাঁচপুরী। জানতে চাইলে এসএম আকরাম টেলিফোনে সমকালকে জানান, দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশ পেয়েই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছি। তিনি আরও বলেন, আগে থেকেই বলে আসছি, দল সমর্থন না দিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না। এখন অপেক্ষায় আছি, দল কাকে সমর্থন দেয়। দল কাকে সমর্থন দেয় তার ওপর নির্ভর করছে আমি কাকে সমর্থন দেব।
একই বক্তব্য দিলেও হাবিবউল্লাহ কাঁচপুরী দাবি করেন, সকালে টেলিফোনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের তাকে জানিয়েছেন শামীম ওসমানই হচ্ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। এ কারণেই তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বহিষ্কৃত নেতাকে কী করে দলীয় হাইকমান্ড নির্দেশ দেয়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'আমি আগেও আওয়ামী লীগে ছিলাম, এখনও আছি।'
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার কার্যক্রম শেষে বিকেলে রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান বলেন, নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মনিটরিং টিম, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা, ভ্রাম্যমাণ আদালত, পুলিশের ভ্রাম্যমাণ দল ও ভিডিও ক্যামেরা স্থাপনসহ সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
যা বললেন শামীম ও আইভী : মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় পার হয়ে যাওয়ার পর শামীম ওসমান টেলিফোনে বিকেলে সমকালের কাছে দাবি করেন, দলের সবুজ সংকেত পেয়েই মাঠে নেমেছেন তিনি। দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবির মুখেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী আইভীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, দলের সমর্থন এবং সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে জনগণই তাকে প্রত্যাখ্যান করবে।
এর আগে সকাল থেকে সাংবাদিকরা আরেক প্রার্থী ডা. আইভীর বাড়ির সামনে জড়ো হলেও তিনি সাংবাদিকসহ কারও সঙ্গেই দেখা করেননি। দিনভর নিজের মোবাইল ফোনও বন্ধ রাখেন। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরাও তাদের ফোন বন্ধ করে রাখেন। ফলে কারও পক্ষেই দিনভর তার সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা তার অবস্থান সম্পর্কেও জানা সম্ভব হয়নি।
অবশ্য বিকেলের পরে শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকায় গণসংযোগকালে ডা. আইভী সাংবাদিকদের বলেন, দলীয় সমর্থন বড় বিষয় নয়, নারায়ণগঞ্জবাসীর 'ইচ্ছাতেই' নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের মানুষ চায় বলেই তার এই নির্বাচন। এ কারণে দলের অনুরোধ উপেক্ষা করেই তিনি নির্বাচন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেননা জনগণের চাপ উপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, 'যদি মনে করি, এক ভোটও পাব_ তার পরও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াব না।'
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেন যারা : মেয়র পদে ৮ প্রার্থীর মধ্যে এসএম আকরাম এবং হাবিবউল্লাহ কাঁচপুরী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ওই পদে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা ৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে সাধারণ আসনে ২৫৫ কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ১৭ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন রহিমউদ্দিন (ওয়ার্ড-২), এসএম নিজামউদ্দিন (ওয়ার্ড-১৮), তোফাজ্জেল হোসেন (ওয়ার্ড-১৮), আজমত উল্লাহ খন্দকার (ওয়ার্ড-১৫), দেলোয়ার হোসেন (ওয়ার্ড-১৫), আশু (ওয়ার্ড-২০), রফিকুল ইসলাম মৃধা (ওয়ার্ড-২০), শফিকুল ইসলাম (ওয়ার্ড-২০), আরিফুল হক (ওয়ার্ড-৪), সালাউদ্দিন আহমেদ (ওয়ার্ড-৫), মোহাম্মাদ হোসেন মেম্বার (ওয়ার্ড-৬), ইয়াকুব আলী (ওয়ার্ড-৬), এসএম আসলাম (ওয়ার্ড-৬), মজিবুর রহমান (ওয়ার্ড-৬), মঞ্জুর হোসেন (ওয়ার্ড-১১), আজহারুল ইসলাম (ওয়ার্ড-১২) এবং জাহাঙ্গীর আলম (ওয়ার্ড-২৪)।
No comments