বিটুমিনের বদলে কংক্রিটের ব্যবহারে টেকসই হবে সড়ক-মহাসড়ক by পার্থ সারথি দাস
পাকিস্তান আমলে ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশে রিজিড পেভমেন্ট প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণ করা হতো। সিমেন্টের সঙ্গে পাথর বা ইট দিয়ে তৈরি কংক্রিট ব্যবহার করা হয় বলে এ পেভমেন্ট দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়ে সড়ক বিভাগ। শুরু হয় বিটুমিনে পেভমেন্ট নির্মাণ। ফলে পাঁচ দিন পানি জমে থাকলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিচ উঠে যায়। সৃষ্টি হয় ছোট-বড় গর্ত। কালের কণ্ঠকে বলছিলেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কংক্রিটের সড়ক কমপক্ষে ২৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। তাই ভারত ও শ্রীলঙ্কা উড়াল সড়ক নির্মাণে সময় সাশ্রয় ও স্থায়িত্বের জন্য রিজিড পেভমেন্ট পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় মহাসড়কগুলোর এমন অংশগুলোয় জরুরি ভিত্তিতে কংক্রিটের দীর্ঘস্থায়ী সড়ক নির্মাণ করতে হবে। প্রকৌশলীরা জানান, সড়কের ওপরের স্তরকেই পেভমেন্ট বলা হয়ে থাকে। এটি সাধারণত দুই ধরনের_ফ্লেঙ্বিল ও রিজিড। ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট নির্মাণে বিটুমিন আর রিজিড পেভমেন্টের ক্ষেত্রে সিমেন্টের সঙ্গে ইট বা পাথরের কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে লাগে বালি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ২১ হাজারের মধ্যে ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়কই এখন ঝুঁকির মুখে। জানা গেছে, গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ও উপযোগী পদ্ধতি অনুসরণ না করে সড়ক নির্মাণ, অর্থ সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, রাজনৈতিক চাপে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের সংস্কৃতি, নির্মাণকাজে তদারকি ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় সড়ক ব্যবস্থার এমন হাল হয়েছে। সওজ কর্তৃপক্ষ বলেছে, ছয় মাসের মধ্যেই বিধ্বস্ত সড়ক সংস্কার কাজ শেষ হবে। জলাবদ্ধতার কারণে বিধ্বস্ত সড়কগুলো এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে।
অচল গবেষণাগার, উপেক্ষিত নির্দেশনা : সওজের সড়ক নির্মাণে গবেষণার জন্য রাজধানীতে 'বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগার' রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণসামগ্রীর মান ও পরিমাণ নির্ণয় করে সনদ দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের মাটি পরীক্ষা, বিটুমিনের পরিমাণ ও মান নির্ণয়ের জন্য এখানে ঠিকাদারদের আসতে হতো। কিন্তু তদারকি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ গবেষণাগারে এখন আর আসেন না।
বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক মতিউর রহমান তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, '৩০-৩৫ বছর আগে আমাদের সড়ক তৈরির ক্ষেত্রে বিটুমিন ও পাথর দিয়েই পেভমেন্ট নির্মাণের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন বাস্তবতার কারণে আমাদের কংক্রিটের রিজিড পেভমেন্টের দিকে যেতে হবে। দেশের নদীগুলোর তলদেশ ক্রমেই ভরাট হয়ে উঁচু হচ্ছে। এ কারণে পানির স্তরের উচ্চতা বাড়ছে। মহাসড়কগুলোর বেশির ভাগের ভিত আরো উঁচু করতে হবে। কিন্তু মহাসড়কের অবকাঠামো পরিবর্তন করতে হলে তো অনেক অর্থ ব্যয় হবে। তাই রিজিড পেভমেন্টই যথাযথ।' অনেক দেশেই কংক্রিটের তৈরি পেভমেন্ট আছে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের মধ্যে দুই লেন ফ্লেঙ্বিল ও দুই লেন রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। কোনটি সাশ্রয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী তা গবেষণার পরই প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কে পানি জমে থাকে এমন অংশগুলোয় কংক্রিট দিয়ে রিজিড পেভমেন্ট তৈরি করারও পরামর্শ দেন তিনি।
এ ছাড়া সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ত্রুটি রয়েছে। প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা যথাযথ নির্দেশনাও মেনে চলেন না। এ ব্যাপারে সওজের এইচডিএম সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রহমান বলেন, 'ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে বিটুমিনের সঙ্গে পাথর দেওয়া হয়। কিন্তু এই পাথর ছোট ছোট করে ভেঙে দিলে বেশি স্থায়ী হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি করা হয় না। রিজিড পেভমেন্ট সড়কের জলাবদ্ধ অংশকে রক্ষা করতে পারে। এখন আমাদের প্রকৌশলীদের একটি অংশ অবশ্য গবেষণার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।'
কংক্রিটের সড়ক টেকে বেশি : 'ইভালুয়েশন অব ফ্লেঙ্বিল অ্যান্ড রিজিড পেভমেন্ট কন্সট্রাকশন ইন বাংলাদেশ' শিরোনামে গবেষণাপত্র ২০০৯ সালে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি ওই গবেষণাপত্রে দেখান, রিজিড পেভমেন্টই সময় উপযোগী ও সময়সাশ্রয়ী। ড. হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশে সনাতনী ধারায় সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট নির্মাণের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণের দিকে ফিরতে হবে। আমি নিজে দেখেছি, আগে ঢাকার সচিবালয়ের সামনের সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক কংক্রিট দিয়েই নির্মিত ছিল। ওগুলো ছিল রিজিড পেভমেন্ট। কিন্তু হঠাৎ করেই বিটুমিন ব্যবহার করে ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট নির্মাণ শুরু হয়। ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্টের চারটি স্তর থাকে। একেবারে ওপরের স্তরে পাথরকে আঁকড়ে ধরে রাখে বিটুমিন। তদারকি ব্যবস্থা না থাকা ও বারবার রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যয় হয় বেশি। দুর্নীতি ও অপচয় হয়। এ কারণে এগুলো নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেবে যায়। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় নতুন উড়াল সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে রিজিড পেভমেন্টকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রকৌশলীরা। আমাদের দেশের নগর এলাকার অলিগলিতে এখন নির্মাণ হচ্ছে কংক্রিট ব্যবহারের মাধ্যমে রিজিড পেভমেন্ট।'
কংক্রিটের পেভমেন্ট নির্মাণ করে সাফল্যও আসছে। শেরপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, শেরপুর শহরে জলবদ্ধতার কারণে সড়কের বিভিন্ন অংশ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়কের পেভমেন্ট পানিতে ক্ষয় হচ্ছে। তাই আমরা শেরপুর শহরের শ্রীবরদী-বকশীবাজার সড়কের ২০০ ফুট অংশের পেভমেন্ট দুই বছর আগে কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করি। সড়কের এই অংশ এরপর আর জলাবদ্ধতায় নষ্ট হয়নি। এ কারণে শুধু এই অংশের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বছরে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। শহরের গৌড়দ্বার, ভাইটকান্দি, তারাকান্দি, তিনআনী অংশ বিপর্যস্ত হয় জলাবদ্ধতায়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে প্রায় ১৩ বছর ধরে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন সন্তোষ কুমার রায়। বর্তমানে তিনি ফরিদপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। সন্তোষ কুমার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একসময় শুধু ইন্দোনেশিয়া থেকে সিমেন্ট আমদানি হতো। সিমেন্ট সংকট ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে পড়ে বিটুমিন ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু এখন এই অবস্থা আমাদের নেই। দেশেই তৈরি হচ্ছে সিমেন্ট, রপ্তানিও চলছে। সড়ক ভবনে ২০০৭ সালে ডিএফআইডি প্রতিনিধিদলের কাছে আমি পেভমেন্ট নির্মাণের বিষয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলাম। তাতে আমি বলেছিলাম, সড়কের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ বিটুমিট পানিতে ক্ষয় হয়, কিন্তু কংক্রিট পানিতে শক্তিপ্রাপ্ত হয়। তিন-চার বছর আগে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কিছু অংশ, সিলেট শহরে সড়কের কিছু অংশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের কিছু অংশের পেভমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল কংক্রিট দিয়ে। এগুলো এখনো অক্ষত আছে।'
সন্তোষ কুমার রায়সহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কংক্রিট দিয়ে তৈরি পেভমেন্টের স্থায়িত্বকাল কমপক্ষে ২৫ বছর। কিন্তু বিটুমিনের তৈরি পেভমেন্টের স্থায়িত্বকাল চার থেকে পাঁচ বছর। বিটুমিনের তৈরি পেভমেন্ট প্রতিবছরে একবার ও পাঁচ বছরের ব্যবধানে একবারসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু কংক্রিটের তৈরি পেভমেন্টের ক্ষেত্রে এ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় না। এ কারণে অতিরিক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও সাশ্রয় হয় রিজিড পেভমেন্টের ক্ষেত্রে। তাঁরা জানান, বিটুমিন দিয়ে ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্টের চেয়ে কংক্রিট দিয়ে রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণে ১৫-২০ শতাংশ অর্থ বেশি ব্যয় হয়। কিন্তু বিটুমিন দিয়ে তৈরি পেভমেন্ট নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ চূড়ান্তভাবে ব্যয় বেশি হয়। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ না হলে যান চলাচল ব্যাহত ও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়।
সওজের এইচডিএম সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রহমান আরো বলেন, আমাদের দেশে মহাসড়কের জীবন সাধারণত ২০ বছর। এসব সড়কের ওপর দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ টন ওজনের পণ্য বা যাত্রীবাহী যান চলাচল করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দ্বিগুণ বা তারও বেশি ওজনের পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। এ কারণে কোনো কোনো সড়ক এক বছরের মধ্যে ও বেশির ভাগ সড়ক পাঁচ বছরের মধ্যেই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ১৫ টনের বেশি পণ্যবাহী যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন গড়ে ১৬ টনের বেশি পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। এতে ওই সেতুও রয়েছে ঝুঁকিতে। এরই মধ্যে সেতুটিতে ফাটল ধরেছে।
'গবেষণা করে দেখতে হবে' : সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কুদ্দুস কালের কণ্ঠকে বলেন, জলাবদ্ধতার জন্য সড়ক নষ্ট হয়ে যায় এমন এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। শুধু ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেই বাজার এলাকা রয়েছে ১২টি। জলাবদ্ধতার কারণে এসব স্থানে পেভমেন্ট উঠে গিয়ে সড়ক যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জরুরিভিত্তিতে বিটুমিনের বদলে কংক্রিটের পেভমেন্ট নির্মাণ করে এই বিপর্যয় পরিস্থিতি রোধ করা সম্ভব। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতার নিরিখে সব সড়ক-মহাসড়ক কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা কতটা যৌক্তিক তা গবেষণা করে দেখতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও।
সওজ সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে সড়ক পর্যবেক্ষণ ও জরিপ চালায় সংস্থার অধীন ২১ হাজার ২৬৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫২ কিলোমিটার সড়কে। রাফোমিটার দিয়ে চালানো পর্যবেক্ষণে এসব সড়কে বড় বড় গর্ত ফেটে যাওয়া, পাথরসহ বিভিন্ন উপাদানের স্থানচ্যুতি, সরু সড়কে একই স্থান দিয়ে বারবার যান চলাচলে চাকার চাপে মাটি দেবে যাওয়া ধরা পড়ে। এতে সওজ দেখতে পায়, তিন হাজার ৫৩৩ কিলোমিটার সড়কই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। এরপর বর্ষার কারণে সড়কের এই অংশের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। এর বাইরে সওজের আরো সাত হাজার কিলোমিটারও এভাবে অনুপযোগী বলে এর আগের জরিপে ধরা পড়েছিল। সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২১ হাজার ২৬৯ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার পাকা অংশই এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। মহাসড়কের মান বিপর্যয়ের কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়ছে। এ ছাড়া ফিটনেসহীন গাড়ির চলাচল বন্ধ না হওয়ায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ২১ হাজারের মধ্যে ১৮ হাজার কিলোমিটার সড়কই এখন ঝুঁকির মুখে। জানা গেছে, গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ও উপযোগী পদ্ধতি অনুসরণ না করে সড়ক নির্মাণ, অর্থ সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, রাজনৈতিক চাপে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের সংস্কৃতি, নির্মাণকাজে তদারকি ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় সড়ক ব্যবস্থার এমন হাল হয়েছে। সওজ কর্তৃপক্ষ বলেছে, ছয় মাসের মধ্যেই বিধ্বস্ত সড়ক সংস্কার কাজ শেষ হবে। জলাবদ্ধতার কারণে বিধ্বস্ত সড়কগুলো এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে।
অচল গবেষণাগার, উপেক্ষিত নির্দেশনা : সওজের সড়ক নির্মাণে গবেষণার জন্য রাজধানীতে 'বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগার' রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণসামগ্রীর মান ও পরিমাণ নির্ণয় করে সনদ দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের মাটি পরীক্ষা, বিটুমিনের পরিমাণ ও মান নির্ণয়ের জন্য এখানে ঠিকাদারদের আসতে হতো। কিন্তু তদারকি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ গবেষণাগারে এখন আর আসেন না।
বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক মতিউর রহমান তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, '৩০-৩৫ বছর আগে আমাদের সড়ক তৈরির ক্ষেত্রে বিটুমিন ও পাথর দিয়েই পেভমেন্ট নির্মাণের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন বাস্তবতার কারণে আমাদের কংক্রিটের রিজিড পেভমেন্টের দিকে যেতে হবে। দেশের নদীগুলোর তলদেশ ক্রমেই ভরাট হয়ে উঁচু হচ্ছে। এ কারণে পানির স্তরের উচ্চতা বাড়ছে। মহাসড়কগুলোর বেশির ভাগের ভিত আরো উঁচু করতে হবে। কিন্তু মহাসড়কের অবকাঠামো পরিবর্তন করতে হলে তো অনেক অর্থ ব্যয় হবে। তাই রিজিড পেভমেন্টই যথাযথ।' অনেক দেশেই কংক্রিটের তৈরি পেভমেন্ট আছে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের মধ্যে দুই লেন ফ্লেঙ্বিল ও দুই লেন রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। কোনটি সাশ্রয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী তা গবেষণার পরই প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কে পানি জমে থাকে এমন অংশগুলোয় কংক্রিট দিয়ে রিজিড পেভমেন্ট তৈরি করারও পরামর্শ দেন তিনি।
এ ছাড়া সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ত্রুটি রয়েছে। প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা যথাযথ নির্দেশনাও মেনে চলেন না। এ ব্যাপারে সওজের এইচডিএম সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রহমান বলেন, 'ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে বিটুমিনের সঙ্গে পাথর দেওয়া হয়। কিন্তু এই পাথর ছোট ছোট করে ভেঙে দিলে বেশি স্থায়ী হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি করা হয় না। রিজিড পেভমেন্ট সড়কের জলাবদ্ধ অংশকে রক্ষা করতে পারে। এখন আমাদের প্রকৌশলীদের একটি অংশ অবশ্য গবেষণার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।'
কংক্রিটের সড়ক টেকে বেশি : 'ইভালুয়েশন অব ফ্লেঙ্বিল অ্যান্ড রিজিড পেভমেন্ট কন্সট্রাকশন ইন বাংলাদেশ' শিরোনামে গবেষণাপত্র ২০০৯ সালে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি ওই গবেষণাপত্রে দেখান, রিজিড পেভমেন্টই সময় উপযোগী ও সময়সাশ্রয়ী। ড. হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশে সনাতনী ধারায় সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট নির্মাণের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণের দিকে ফিরতে হবে। আমি নিজে দেখেছি, আগে ঢাকার সচিবালয়ের সামনের সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক কংক্রিট দিয়েই নির্মিত ছিল। ওগুলো ছিল রিজিড পেভমেন্ট। কিন্তু হঠাৎ করেই বিটুমিন ব্যবহার করে ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্ট নির্মাণ শুরু হয়। ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্টের চারটি স্তর থাকে। একেবারে ওপরের স্তরে পাথরকে আঁকড়ে ধরে রাখে বিটুমিন। তদারকি ব্যবস্থা না থাকা ও বারবার রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যয় হয় বেশি। দুর্নীতি ও অপচয় হয়। এ কারণে এগুলো নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেবে যায়। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় নতুন উড়াল সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে রিজিড পেভমেন্টকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রকৌশলীরা। আমাদের দেশের নগর এলাকার অলিগলিতে এখন নির্মাণ হচ্ছে কংক্রিট ব্যবহারের মাধ্যমে রিজিড পেভমেন্ট।'
কংক্রিটের পেভমেন্ট নির্মাণ করে সাফল্যও আসছে। শেরপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, শেরপুর শহরে জলবদ্ধতার কারণে সড়কের বিভিন্ন অংশ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়কের পেভমেন্ট পানিতে ক্ষয় হচ্ছে। তাই আমরা শেরপুর শহরের শ্রীবরদী-বকশীবাজার সড়কের ২০০ ফুট অংশের পেভমেন্ট দুই বছর আগে কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করি। সড়কের এই অংশ এরপর আর জলাবদ্ধতায় নষ্ট হয়নি। এ কারণে শুধু এই অংশের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বছরে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। শহরের গৌড়দ্বার, ভাইটকান্দি, তারাকান্দি, তিনআনী অংশ বিপর্যস্ত হয় জলাবদ্ধতায়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে প্রায় ১৩ বছর ধরে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন সন্তোষ কুমার রায়। বর্তমানে তিনি ফরিদপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। সন্তোষ কুমার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একসময় শুধু ইন্দোনেশিয়া থেকে সিমেন্ট আমদানি হতো। সিমেন্ট সংকট ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে পড়ে বিটুমিন ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু এখন এই অবস্থা আমাদের নেই। দেশেই তৈরি হচ্ছে সিমেন্ট, রপ্তানিও চলছে। সড়ক ভবনে ২০০৭ সালে ডিএফআইডি প্রতিনিধিদলের কাছে আমি পেভমেন্ট নির্মাণের বিষয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলাম। তাতে আমি বলেছিলাম, সড়কের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ বিটুমিট পানিতে ক্ষয় হয়, কিন্তু কংক্রিট পানিতে শক্তিপ্রাপ্ত হয়। তিন-চার বছর আগে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কিছু অংশ, সিলেট শহরে সড়কের কিছু অংশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের কিছু অংশের পেভমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল কংক্রিট দিয়ে। এগুলো এখনো অক্ষত আছে।'
সন্তোষ কুমার রায়সহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কংক্রিট দিয়ে তৈরি পেভমেন্টের স্থায়িত্বকাল কমপক্ষে ২৫ বছর। কিন্তু বিটুমিনের তৈরি পেভমেন্টের স্থায়িত্বকাল চার থেকে পাঁচ বছর। বিটুমিনের তৈরি পেভমেন্ট প্রতিবছরে একবার ও পাঁচ বছরের ব্যবধানে একবারসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু কংক্রিটের তৈরি পেভমেন্টের ক্ষেত্রে এ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় না। এ কারণে অতিরিক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও সাশ্রয় হয় রিজিড পেভমেন্টের ক্ষেত্রে। তাঁরা জানান, বিটুমিন দিয়ে ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্টের চেয়ে কংক্রিট দিয়ে রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণে ১৫-২০ শতাংশ অর্থ বেশি ব্যয় হয়। কিন্তু বিটুমিন দিয়ে তৈরি পেভমেন্ট নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ চূড়ান্তভাবে ব্যয় বেশি হয়। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ না হলে যান চলাচল ব্যাহত ও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়।
সওজের এইচডিএম সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রহমান আরো বলেন, আমাদের দেশে মহাসড়কের জীবন সাধারণত ২০ বছর। এসব সড়কের ওপর দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ টন ওজনের পণ্য বা যাত্রীবাহী যান চলাচল করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দ্বিগুণ বা তারও বেশি ওজনের পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। এ কারণে কোনো কোনো সড়ক এক বছরের মধ্যে ও বেশির ভাগ সড়ক পাঁচ বছরের মধ্যেই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ১৫ টনের বেশি পণ্যবাহী যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন গড়ে ১৬ টনের বেশি পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। এতে ওই সেতুও রয়েছে ঝুঁকিতে। এরই মধ্যে সেতুটিতে ফাটল ধরেছে।
'গবেষণা করে দেখতে হবে' : সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কুদ্দুস কালের কণ্ঠকে বলেন, জলাবদ্ধতার জন্য সড়ক নষ্ট হয়ে যায় এমন এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। শুধু ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেই বাজার এলাকা রয়েছে ১২টি। জলাবদ্ধতার কারণে এসব স্থানে পেভমেন্ট উঠে গিয়ে সড়ক যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জরুরিভিত্তিতে বিটুমিনের বদলে কংক্রিটের পেভমেন্ট নির্মাণ করে এই বিপর্যয় পরিস্থিতি রোধ করা সম্ভব। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতার নিরিখে সব সড়ক-মহাসড়ক কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা কতটা যৌক্তিক তা গবেষণা করে দেখতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও।
সওজ সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে সড়ক পর্যবেক্ষণ ও জরিপ চালায় সংস্থার অধীন ২১ হাজার ২৬৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫২ কিলোমিটার সড়কে। রাফোমিটার দিয়ে চালানো পর্যবেক্ষণে এসব সড়কে বড় বড় গর্ত ফেটে যাওয়া, পাথরসহ বিভিন্ন উপাদানের স্থানচ্যুতি, সরু সড়কে একই স্থান দিয়ে বারবার যান চলাচলে চাকার চাপে মাটি দেবে যাওয়া ধরা পড়ে। এতে সওজ দেখতে পায়, তিন হাজার ৫৩৩ কিলোমিটার সড়কই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। এরপর বর্ষার কারণে সড়কের এই অংশের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। এর বাইরে সওজের আরো সাত হাজার কিলোমিটারও এভাবে অনুপযোগী বলে এর আগের জরিপে ধরা পড়েছিল। সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২১ হাজার ২৬৯ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার পাকা অংশই এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। মহাসড়কের মান বিপর্যয়ের কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়ছে। এ ছাড়া ফিটনেসহীন গাড়ির চলাচল বন্ধ না হওয়ায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
No comments