যেন ২৯ বছর বয়সী এক জাদুকর

মাহাথির মোহাম্মদ তখনো ক্ষমতায়। বয়স ৭২। তার অবসর নিয়ে বলাবলি চলছিল। অনেকেই বলতেন, মাহাথিরের বয়সতো আসলে ২৭। সত্যইতো। ৯২ বছর বয়সে বিস্ময়কর এক জয় নিয়ে মাহাথির যখন গতকাল মালয়েশিয়ার মসনদে ফিরলেন তখন নতুন করে সে আলোচনা আবার ফিরে এসেছে। রেকর্ডের বরপুত্র মাহাথির মোহাম্মদ। তার হাত ধরেই তৈরি হলো নতুন ইতিহাস। গত সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী রাষ্ট্রপ্রধান এখন তিনি। আরেকটি রেকর্ডও গড়েছেন তিনি। ৬১ বছর পর তিনিই প্রথম ক্ষমতাসীন বারিশান ন্যাশনাল জোটকে পরাজিত করলেন।
বুধবার অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচন ছিল মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তাই সারা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল দেশটির দিকে। জরিপ নানা মতামতকে উপেক্ষা করে মাহাথির প্রমাণ করে দিলেন তিনিই পারেন। তিনিই পারেন মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব দিতে। ২২২ আসনের পার্লামেন্টে তার নির্বাচনী জোট পাকাতান হারাপান (এলায়েন্স অব হোপ) পেয়েছে ১১৩ আসন। এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে এ সংখ্যা যথেষ্ট। কারণ, সরকার গঠন করতে হলে একটি দলকে কমপক্ষে ১১২টি আসন পেতে হয়। এর থেকেও একটি আসন বেশি পেয়েছে পাকাতান হারাপান। ফলে মালয়েশিয়া ঝুলন্ত পার্লামেন্টের দিকে যাচ্ছে এমন পূর্বাভাস মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেল। অন্যদিকে ভরাডুবি ঘটেছে ক্ষমতাসীন বারিশান ন্যাশনাল (বিএন) দলের। তারা পেয়েছে মাত্র ৭৯টি আসন। বাদবাকি আসন পেয়েছে অন্যান্য দল। এখন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যেতে পারে। এমনই আভাস মিলেছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। তাকে দলের নেতৃত্ব থেকেও সরিয়ে দেয়া হতে পারে। তা ছাড়া তার বিরুদ্ধে ‘১-এমডিবি’ রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে তারও নতুন করে তদন্ত হতে পারে। বিচার করা হতে পারে। তাতে তিনি অভিযুক্ত হলে পেতে পারেন শাস্তি। তিনি নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন। ৪৮ বছর বয়সী একজন ডাক্তার সুভা সেলভান বলেছেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে আমি আশা করি দেশে ভবিষ্যতে ভালো কিছু দেখতে পাবো। আমরা আশা করি ভবিষ্যৎ সরকার হবে উন্নততর, অবাধ, মুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ। ওদিকে বুধবার গভীর রাতে নির্বাচনের ফল প্রকাশ হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে রাতের মালয়েশিয়ার রাস্তার দৃশ্য পাল্টে যেতে থাকে। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করতে থাকে।
বিজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে বৃহস্পতিবার দিনের একেবারে শুরুতে সংবাদ সম্মেলন করেন মাহাথির। সেখানে তিনি বলেন, হ্যাঁ এখনো আমি বেঁচে আছি। আমার জোট কোনো প্রতিশোধ নেবে না। তবে আইনের শাসন প্রবর্তন করবে। এ সময় তিনি উল্লাসরত নেতাকর্মী সমর্থকদের বলেন, দু’দিনের সরকারি ছুটি দেয়া হবে। তবে এই ছুটি বিজয়ীদের জন্য নয়।
মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির। তিনিও বারিশান ন্যাশনাল জোটের প্রধান ছিলেন। তখন ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আর এ সময়েই একটি দরিদ্র দেশ মালয়েশিয়াকে বিশ্বের উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গেছেন। অনেকেই তার সমালোচনা করেন। কিন্তু তিনি মালয়েশিয়াকে যা দিয়েছেন তাতে দেশটি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। এখন উন্নয়নশীল অনেক দেশের মানুষ সেখানে কাজ খুঁজেতে পাড়ি জমান। এ জন্য মাহাথিরের নেতৃত্বে থাকা মালয়েশিয়া হয়ে ওঠে এশিয়ান টাইগারদের অন্যতম। ১৯৯০ এর দশকের পর এ অঞ্চলের যেসব দেশের অর্থনীতির দ্রুত বিস্তার ঘটে তাদেরকে এশিয়ান টাইগারস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে কেউ কেউ তাকে কর্তৃত্ববাদী বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ, তিনি বিতর্কিত নিরাপত্তামূলক আইন ব্যবহার করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে ভরেছেন। সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন তার অধীনে থাকা উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ইস্যুতে। প্রথমে তিনি তাকে বরখাস্ত করেন।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগ আনা হয়। সমকামিতার অভিযোগে তাকে জেলে ঢুকান। এটা এমন একটি সময়ে ঘটে যখন আনোয়ার ইব্রাহিম অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সংস্কার দাবি করেছিলেন। নাজিব রাজাকের রাজনৈতিক গুরুও মাহাথির মোহাম্মদ। তারই প্রচ্ছন্ন সমর্থনে ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হন নাজিব। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। অভিযোগে বলা হয় তিনি ‘১-এমডিবি’ তহবিল থেকে প্রায় ৭০ কোটি ডলার নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়েছেন। তবে নাজিব এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তদন্তে যাতে তিনি ধরা না পড়েন এজন্য তদন্ত করতে পারেন এমন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের তিনি সরিয়ে দেন। তখনও বিএন পার্টির সঙ্গে যুক্ত মাহাথির। নাজিবের এই দুর্নীতি দেখে তিনি ঠিক থাকতে পারেননি। তাই ২০১৬ সালে তিনি ওই দল থেকে বেরিয়ে আসেন। যোগ দেন হাকাতান হারাপানের সঙ্গে। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতিকে তিনি সমর্থন দিতে দেখেছেন তার দলকে। তাই তিনি বিব্রত বিএনের বিষয়ে। এরপর জানুয়ারিতে তিনি ঘোষণা দেন, আবারও রাজনীতির মাঠে নামবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এজন্য পুরনো ‘শত্রু’ আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে হাত মেলান। চুক্তি হয় মাহাথির নির্বাচিত হলে দু’বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে আইন সংশোধন করে বর্তমান জেলবন্দি আনোয়ার ইব্রাহিমকে বের করে আনবেন। তারপর তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২০০৩ সালের অক্টোবরে অবসরের সময় তিনি বলেছিলেন, আমি অসন্তুষ্ট। কারণ, সফল হওয়ার জন্য আমি যেসব অর্জন করতে চেয়েছিলাম তার সামান্যই অর্জন করতে পেরেছি। অনেককে অবাক করে দিয়ে মাহাথির স্বীকার করেছেন, তিনি জীবনে অনেক ভুল করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে আনোয়ার ইব্রাহিমকে বরখাস্ত করা। ক্ষমতায় থাকার সময় নিয়ে লেখা একটি বইয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বাদাইয়ি বলেছেন, মাহাথির তার নিজের পথেই চলেন এবং তিনি বিশ্বাস করেন তার পথই একমাত্র পথ।
সে যাই হোক, এবারের বিজয়ের পর এটা বলাই যায়, মাহাথিরের বয়স ৯২ নয়। তিনি যেন ২৯ বছর বয়সী এক জাদুকর।

No comments

Powered by Blogger.