অপর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ হিজড়াদের ভাগ্য পরিবর্তন ভূমিকা রাখে না by আমানুর রহমান রনি

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিললেও হিজড়াদের মৌলিক অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় এখনও অমীমাংসিত। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির পরেও হিজড়াদের ব্যাপারে সমাজের নীতিগত অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হয়নি। জানা গেছে, হিজড়াদের জন্য সরকারের প্রকল্প থেকে বেশ কিছু সহায়তামূলক কার্যক্রম চালু আছে। এসব প্রকল্পের আওতায় তাদের জন্য কিছু ভাতা বরাদ্দ করা হয়। তবে সে ভাতা জীবনযাত্রা পরিবর্তনে কোনও প্রভাব ফেলে না। সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও হিজড়া জনগোষ্ঠী উভয় পক্ষ থেকেই এ বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে।
জানা গেছে, হিজড়া জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সাহায্য পেয়ে থাকে- সমাজে এমন কথা প্রচলিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে একজন বয়স্ক হিজড়া মাসিক ভাতা হিসেবে পান মাত্র ছয়শ’ টাকা।
এ ব্যাপারে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আসাদ আলমের বলেন, ‘হিজড়ারা প্রতি মঙ্গলবার দোকানে টাকা নিতে আসেন। হিজড়ারা এখন সরকারের কাছ থেকেও টাকা পায়, তারপরও রাস্তায় আসে। দোকানেও আসে চাঁদা নিতে।’
সমাজসেবা অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার ৪শ’ জন। দেশের ১০ হাজার হিজড়ার মধ্যে ৫০-এর বেশি বয়সের দুই হাজার ৫০০ জন হিজড়া মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পান, যা নিয়ে হিজড়াদের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে। কারণ তাদের কাছে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এই ভাতা খুবই নগণ্য।
এদিকে হিজড়া জনগোষ্ঠীও এই ভাতা নিয়ে বিব্রত। তাদের বলছেন- ‘এই টাকা দিয়ে কিছুই হচ্ছে না। না খাওয়া, না বাসাভাড়া, না চিকিৎসা। কিন্তু সাধারণ মানুষ মনে করে- আমরা সরকারের কাছ থেকে অনেক টাকা পাই। তাই তারা এখন আর সাহায্য করতেও চায় না।’
সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১২-১৩ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছিল ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ১১ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এসব অর্থ শিক্ষাখাত, বয়স্কভাতা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা খাতে ব্যয় হচ্ছে।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার জন্য চারটি স্তরে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। প্রাথমিকে ৩০০, মাধ্যমিকে ৪৫০, উচ্চমাধ্যমিকে ৬০০ এবং উচ্চতর স্তরে ১০০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান অর্থবছরে সারাদেশে চারটি স্তরে উপবৃত্তি গ্রহণকারী হিজড়ার সংখ্যা ১৩৫০ জন। বর্তমানে আর্থসামাজিক প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ১৯০০ জন। প্রশিক্ষণোত্তর সহায়তা গ্রহণকারীও ১৯০০ জন, যাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়, তবে সেই টাকা দিয়ে কেউ স্বাবলম্বী হয়েছেন এমন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে এমন হিজড়া রয়েছে অসংখ্য।
রাজধানীর মগবাজারের পিয়ারাবাগে ভাড়া বাসায় থাকেন জোন্সা হিজড়া। তার কাছে জানা যায়, তিনি নিয়মিত বাংলামোটর ও কারওয়ান বাজার অঞ্চলে বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলেন। জোন্সা ২০১৫ সালে মিরপুর ১০ নম্বরে ফাস্টফুড তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাই ১০ হাজার টাকাও পেয়েছেন। তবে ওই টাকা দিয়ে তিনি কিছুই করতে পারেননি। তা খরচ করে ফেলেছেন। জোন্সা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তাতে একটা ভালো সেলাই মেশিনও হয় না। কাজ শিখেছি, কেউ কাজেও নেয় না। তাই বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করে খাই।’
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবন উন্নয়নে সমাজসেবা অধিদফতরে এই প্রকল্প তাই সফল হচ্ছে না বলে এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাও তা স্বীকার করেছেন। এ কারণেই হিজড়াদের জীবন মানেরও উন্নয়ন হচ্ছে না বলে তারা জানান। 
প্রকল্পের পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা হিজড়াদের প্রশিক্ষণের পর তাদের যে মূলধন দেই, তা অপর্যাপ্ত। তবে কেউ আন্তরিক হলে এটা দিয়েও কিছু করা সম্ভব। অনেক হিজড়া নিজেরাই কিছু করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বেশিরভাগই প্রশিক্ষণ নিলেও তারা সেই অনুযায়ী পরবর্তীতে কাজ করছেন না। এজন্য কেবল হিজড়া জনগোষ্ঠী দায়ী না। আমরা এখনও তাদের জন্য সমাজ ও পরিবারকে সেভাবে তৈরি করতে পারিনি।’

No comments

Powered by Blogger.