ইয়াবা চক্রে এক কাতারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী-বৌদ্ধ আর রোহিঙ্গারা

জাতিগত পার্থক্যকে বিদ্বেষের উপাদান বানিয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা আর রাখাইন-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষকে পরস্পরের বৈরী করে তুলেছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এবার তিন পক্ষই এক কাতারে এসেছে ইয়াবা ব্যবসায়ের সূত্রে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি তাদের অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে রোহিঙ্গাদের পক্ষের সংগঠন হিসেবে দাবি করা আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি-আরসার মতো করেই সরকারবিরোধী অবস্থান রয়েছে রাখাইন বৌদ্ধদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি ও চীন সমর্থিত ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির (ইউডব্লিউএসএ)। অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ হতে তারা দুই পক্ষ ইয়াবা চোরাচালানে এক হয়েছে। এই ব্যবসার সঙ্গে সেনা-সদস্যদের সংশ্লিষ্টতারও খোঁজ পেয়েছে তারা। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবির কর্মকর্তা লেফ্টেনেন্ট কর্নেল আসাদুজ্জামান চৌধুরী বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেছেন, বাংলাদেশে ইয়াবার দাম ৩ থেকে ৩.৫ ডলারে ওঠায় ‘কে রোহিঙ্গা আর কে বৌদ্ধ, তার আর পরোয়া করছে না কেউই।’
বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। গত আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তাদের জন্য কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে স্থাপিত হয়েছে শরণার্থী শিবির। বাংলাদেশ নিবিড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে।  এরকম পরিস্থিতিতে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে সতর্ক হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাদককে কেন্দ্র করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে গোলাগুলি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের মত ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে, যা ভঙ্গুর অবস্থায়  থাকা শরণার্থী শিবিরগুলোর অবস্থা আরও করুণ করে তুলেছে। শামলাপুর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে থাকা একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এএফপিকে বলেছেন, ‘অনেক তরুণ রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ছে। শরণার্থীদের ব্যবহার করা মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক সহজ।’ ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে অন্তত ১০০ জন রোহিঙ্গাকে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কক্সবাজারে মাদকের চালান উদ্ধারের ঘটনা ধাই ধাই করে বেড়েছে। মার্চে উদ্ধার করা হয়েছে ১৮ লাখ পিস ইয়াবা। তার কয়েকদিন পরেই নৌকায় পরিত্যাক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে আরও ৯ লাখ পিস। রয়টার্স লিখেছে, যা ধরা পড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রাক্কলন অনুযায়ী, এ বছর আড়াই থেকে ৩ কোটি পিস ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে।
মিয়ানমারে কারা ইয়াবা উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত তা স্পষ্ট না হলেও, অন্তত সেখান থেকে ইয়াবা পাচারে যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জড়িত সে বিষয়ে জানতে পরেছে এএফপি। সোমবার মিয়ানমারের মংডুতে থাকা তল্লাসি চৌকিতে ২ লাখ ইয়াবা বড়িসহ আটক হয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক সদস্য। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে সন্ধান পাওয়া গেছে আরও বড় মজুতের, যেখানে পাচারের জন্য ১৬ লাখ পিস ইয়াবা রাখা ছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবরে যখন রাখাইন চরম উত্তপ্ত, তখনও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছিল প্রায় ২০ লাখ পিস ইয়াবা।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়নি দেশটির সরকার। তবে রাখাইনের বৌদ্ধদের তারা নৃতাত্ত্বিক সংখ্যাঘুর স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে খুব যে খুশি তার, তা নয়। কারণ রাখাইনের বৌদ্ধরা মনে করে, মিয়ানমারেr সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী বামারদের তুলনায় তারা প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা তাড়াতে রাখাইনের বৌদ্ধরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সহায়তা করলেও এই সম্পর্ক স্থিতিশীল নয়। তারা সেনাবাহিনীর ওপরও হামলা চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের এমন অবস্থান এক যুগের ও বেশি সময় ধরে রয়েছে। এদের সংগঠন আরাকান আর্মি। কাচিনে জন্ম নেওয়া সংগঠনটি একই সঙ্গে চীন সমর্থিত ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির (ইউডব্লিউএসএ) অংশ। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সম্প্রতি সিতওয়েতে চালানো হামলার সঙ্গে তারাই জড়িত। মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সংগঠন ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের’ বাকি সদ্যসদের মতো আরাকান আর্মিও মনে করে ঘোষিত অস্ত্র বিরতি ও অং সান সু চি সমর্থিত শান্তি সংলাপ আস্থা রাখার মতো নয়। ফলে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বোত যুদ্ধই চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
অন্যদিকে আরসার দাবি তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে লড়াই করা সংগঠন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গা উৎখাতে যে অভিযান শুরু করেছিল তা জায়েজ করিয়ে নিতে তাদের ওপর চালানো হামলার কথা বলেছিল তারা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দাবি মোতাবেক, ওই হামলাগুলো চালিয়েছিল আরসা। আরসার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠলেও সংগঠনটি বলেছিল, তাদের লড়াইয়ের সঙ্গে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের কোনও সম্পর্ক নেই।
এএফপি বলছে, ইয়াবা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আঁতাত করেছে রোহিঙ্গা ও রাখাইনের বৌদ্ধরা। সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করা দুই পক্ষের সশস্ত্র সংগঠনই অর্থায়নের জন্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছে। রাখাইনের বৌদ্ধরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করেছিল। আর এখন মাদক ব্যবসায় তাদের সঙ্গেই কাজ করছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারে মাদক নির্মূলে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা এএফপিকে বলেছেন, ‘অস্ত্র কেনার জন্যই তারা একযোগে মাদক চোরাচালানে জড়িয়েছে।’
সাধারণ পাচারকারী থেকে ইয়াবার ডিলার হয়ে ওঠা একজন রোহিঙ্গা এএফপিকে বলেছে, ‘আমি পাঁচ বছর আগে স্থানীয় একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তির মাধ্যমে এই কাজে জড়িয়েছি। যদি আমি না করি, তাহলে অন্য কেউ করবে।’ মাদক বিক্রির অর্থে ওই ব্যক্তি শরণার্থী শিবির ছেড়ে পরিবারসহ কক্সবাজার শহরের একটি ফ্ল্যাটে উঠেছে।

No comments

Powered by Blogger.