‌এক ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন

ফিরলেন মাহাথির মোহাম্মদ। অবসরের ১৫ বছর পর রাজনীতিতে ফিরেই চমক সৃষ্টি করেছিলেন। এবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাহাথির মোহাম্মদ সৃষ্টি করলেন ইতিহাস। আধুনিক মালয়েশিয়ার রুপকার খ্যাতি পাওয়া ৯২ বছর বয়সী এই নেতা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। যে দলের হয়ে ১৯৮১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় ছিলেন, যাবতীয় প্রাক নির্বাচনি জরিপকে ভুল প্রমাণ করে সেই বারিসন ন্যাসিওনালকে (বিএন) বুধবারের নির্বাচনে হারিয়েছেন তিনি। এ যেন এক অনন্য ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। যাট বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বিএন জোটকে হারাতে মাহাথির কাছে টেনে নিয়েছেন পাকাতান হারাপান জোট নেতা ও তার এক সময়ের রাজনৈতিক শীষ্য আনোয়ার ইব্রাহীমকে। ক্ষমতায় থাকার সময়ে এই আনোয়ার ইব্রাহীমকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮১ সালে মাহাথির যখন প্রথমবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন দেশটির পরিচিতি ছিল দরিদ্র হিসেবে। ২০০৩ সালে যখন তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন তখন দেশটি এশিয়ার শীর্ষ এক অর্থনীতি। নিজে আধুনিক মালয়েশিয়ার রুপকার খ্যাতি পাওয়ার পাশাপাশি ১৯৯৮ সালের এশিয়ার মন্দা কাটিয়ে দেশকে তুলে ধরেছেন অর্থনৈতিক বাঘ হিসেবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের কণ্ঠস্বরে পরিণত করেছিলেন তিনি। আবার টুইন টাওয়ারে ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সমর্থনও জানিয়েছিলেন মাহাথির।
২০০৩ সাল থেকে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করা মাহাথির ২০১৬ সালে নিজের ইউনাইটেড মালয়েশিয়া ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (উমনো) ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে ৭০ কোটি ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন মাহাথির। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা নিজের রাজনৈতিক শীষ্য নাজিবকে ক্ষমতা থেকে সরানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি। যোগ দিয়েছিলেন এক সময় যাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন সেই আনোয়ার ইব্রাহীমের দলে।
২০১৬ সালে আল জাজিরার মেহেদী হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেছিলেন, নাজিব কক্ষচ্যুত হয়েছেন বলেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তিনি এবং  নাজিব এমন অনেক কিছুই করেছে যা সত্যিকার অর্থেই ভুল। ফলাফল হিসেবে তিনি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থানে নিয়ে গেছেন। বিশ্বজুড়ে তিনি বাজেভাবে পরিচিত হয়েছেন। সেকারণে তাকে চলে যেতে হবে।
মালয়েশিয়ার ভবিষ্যত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মাহাথির বলেন, নাজিব ক্ষমতায় থাকলে দেশ কুকুরে পরিণত হবে। দেশকে এই পরিণতি থেকে ঠেকাতে ৯২ বছর বয়সী মাহাথির যোগ দিয়েছিলেন বিরোধি জোটে। জোটের নেতা আনোয়ার ইব্রাহীমকে মাহাথির প্রশাসন কারাগারে পাঠিয়েছিল। অনেকেই বলেছিলেন, আনোয়ারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সমকামের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মাহাথির এক সময়ে সমালোচিত হয়েছিলেন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন নামে বিতর্কিত এক নিরাপত্তা আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে। তার সমালোচকেরা বলে থাকনে এর মাধ্যমে তিনি সংবাদমাধ্যম, একটিভিস্ট, ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক বিরোধিদের প্রতি দমন চালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। এই আইনের মাধ্যমেই মাহাথিরের পরিবারের বিরুদ্ধে এক সময় দুর্নীতির অভিযোগ তোলা আনোয়ার ইবাহীমকে ‘শায়েস্তা’ করেছিলেন তিনি।
৭০ বছর বয়স্ক আনোয়ার এক সময় মাহাথিরের রাজনৈতিক শীষ্য ছিলেন। ১৯৯০ এর দশকে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করেন মাহাথির। পরে তাকে কারাদণ্ড দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়। তারা আলাদা হয়ে যান।
তবে এখন আনোয়ার আর তার পরিবারের দুর্ভোগ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছেন মাহাথির। মালয়েশিয়া ইনসাইটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি আনোয়ারের কষ্ট বুঝতে পারি। আমার প্রশাসনের সময়েই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আমাকে গ্রহণ করে আমার সঙ্গে হাত মেলানো তার জন্য সহজ নয়। আর কারাগারে পাঠানোয় শুধু আনোয়ার নয় তার পরিবারের সদস্যরাও চাপে পড়েছিল। তারা ২০ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
আনোয়ারের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ এখন মাহাথিরের জোটে।  এখন তাকেই উপপ্রধানমন্ত্রী করার ঘোষণা দিয়েছেন মাহাথির।  জোট গঠনের শর্ত হিসেবে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে আনোয়ারকে ক্ষমা করে দিয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে হবে। আগের ক্ষমতাসীন বারিসন ন্যাসিওনাল জোটভুক্ত দল উমনো একে রাজনৈতিক ‘সুবিধাবাদ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এখন বিরোধি জোটে থাকা মাহাথিরের দিকে সেই সুবিধাবাদের টেবিল উল্টে গেছে।
নির্বাচনের কয়েকদিন আগে মালেয়েশিয়ার কর্মকর্তারা মাহাথিরের বিরুদ্ধে গুজব ঠেকানো সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছেন। গত ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের প্রার্থীতা দাখিল করতে লঙ্কাওয়াই দ্বীপে যাওয়ার কথা ছিল মাহাথিরের। মূল ভূমি থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের দ্বীপটিতে যেতে বিমানে চড়েন তিনি। কিন্তু উড্ডয়নের আগে বৈমানিক বিমানে ত্রুটি আবিষ্কার করেন।বাতিল হয়ে যায় সেই ফ্লাইট। মাহাথির একে ‘নাশকতা’ আখ্যা দেন।
সরকারের নির্দেশে ওই ঘটনার তদন্ত শুরু করে মালয়েশিয়ার সিভিল এভিয়শন অথিরিটি। তারা এই ঘটনায় কোনও নাশকতা খুঁজে না পাওয়ার কথা জানিয়ে দাবি করে, চাকায় ছোটখাট ত্রুটির জন্য বিমানটি উড়তে পারেনি।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আজহারুদ্দিন রহমান ওই ত্রুটিকে ‘সাধারণ কারিগরি ত্রুটি’ আখ্যা দেন। আজহারুদ্দিন বলেন, বিমানে নাশকতার অভিযোগ খুবই ভয়াবহ আর তা মালয়েশিয়ার বিমান উড্ডয়ন এবং সর্বোপরি দেশের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.