২৮শে জুনের মধ্যে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের নির্দেশ

আগামী ২৮শে জুনের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন (গাসিক) নির্বাচন সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গাসিক নির্বাচনে হাইকোর্টের দেয়া স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থীর করা আবেদন এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) করা লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত চার বিচারপতির আপিল বিভাগ এই আদেশ দেন।
গত ৩১শে মার্চ গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল ইসি। তফসিল অনুযায়ী ১৫ই মে গাজীপুরে ভোট গ্রহণের কথা ছিল। ১ নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ৬ই মে এক আদেশে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। আদেশের পর ইসিও গাজীপুরে ভোটের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরে হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে ওই নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার ও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম চেম্বার আদালতে আবেদন করেন। চেম্বার আদালতের বিচারপতি আবেদন দুটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। বুধবার শুনানিতে হাজির হয়ে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীও হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। আপিল বিভাগ তিনটি আবেদন একসঙ্গে শোনার জন্য গতকাল দিন ধার্য রাখেন। গতকাল আদালতে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন ও শফিকুল ইসলাম বাবুল। রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ। আর নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. ওবায়দুর রহমান মোস্তফা। সকাল সোয়া ১০টায় শুনানি শুরুর পর মাঝখানে আধা ঘণ্টার বিরতি দিয়ে দুপুর ১২টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত শুনানি চলে।
শুনানিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দীন বলেন, ২০১৩ সালে গেজেট হয়েছে, ঢাকা জেলা থেকে ৬টি মৌজা গাজীপুরে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রিটকারী বলছেন, এটি ঢাকা জেলা, এটি এখন আদালতের বিবেচ্য বিষয়। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশেই গাজীপুর জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লোকদের নিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত হয়েছিল। পরে দেখানো হয়েছে, এই ছয়টি মৌজা জয়দেবপুরে ছিল। পরে তা গাজীপুর সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে, এই রিটটি গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ২০১৩ সালে যখন সিটি করপোরশেন নির্বাচন হয়েছিল, তখন এই ছয়টি মৌজা সেখানে ছিল। তিনি বলেন, ২০১২ সালেই মৌজা নিয়ে করা এই আবেদনটি নিষ্পত্তি হয়েছে। রিটকারী ওই এলাকার বাসিন্দা কি না- এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন জয়নুল আবেদীন। আদালতের উদ্দেশ্যে জয়নুল আবেদীন বলেন, অনেকদিন পর গাজীপুরবাসী ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টের ওই স্থগিতাদেশের কারণে তারা তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। আশা করি আপনারা বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
শুনানিতে রিটকারীর আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ২০১৩ সালে ১৬ই জানুয়ারি গাজীপুর সিটি করপোরেশন বেআইনিভাবে ছয়টি মৌজা নিয়ে নেয়। গাজীপুর সিটিতে ওই চয় মৌজাকে নেয়া হয়, কিন্তু ঢাকা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়নি। একপর্যায়ে আদালত বলেন, নির্বাচনের তফসিল হলো, মনোনয়পত্র প্রত্যাহার হলো, নির্বাচনের ১০ দিন আগে রিট করলেন কেন? আদালত বলেন, সংক্ষুব্ধ হলে আগে আসেন না কেন? রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, পরে এসেছি বলে কি বাদ দিয়ে দেয়া হবে? শুনানিতে রিটের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ওবায়দুর রহমান মোস্তফা শুনানিতে বলেন, ১৫ই মে নির্বাচনের জন্য ব্যালট পেপার ছাপার কাজও শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে ১৫ই মে ভোট গ্রহণ করা এখন আর সম্ভব নয়। তবে, আদালত যে নির্দেশনা ইসি তা পালন করবে বলে জানান তিনি। শুনানির সময় ইসির আইনজীবীর কাছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালার বই না থাকায় আদালত তার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন। সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদেশের আগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, চিফ জাস্টিসই সব করেন। কিন্তু আমাদের (আপিল বিভাগের বিচারপতি) সকল সিদ্ধান্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। এখানে সব বিচারকেরই বিচারিক ক্ষমতা সমান। চিফ জাস্টিস মূলত আদেশটি ঘোষণা করেন। এরপর কিছুক্ষণের বিরতিতে যান আদালত। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে ২৮শে জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্নের জন্য ইসিকে নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, ঢাকার সাভারের এক নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা (শিমুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বড়বাড়ী, ডোমনা, শিবরামপুর, পশ্চিম পানিশাইল, পানিশাইল ও ডোমনাগ) গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ২০১৫ সালে এক নম্বর শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবিএম আজহারুল ইসলাম সুরুজ ওই মৌজাগুলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন থেকে বাদ দিতে স্থানীয় সরকার বিভাগে আবেদন করেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন এ বি এম আজহারুল ইসলাম। ইসিতে আবেদন করেন। রিটের শুনানি শেষে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে রুল নিষ্পত্তি করে আদেশ দেন আদালত। আদেশে স্থানীয় সরকার বিভাগকে এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলা হয়। গত ৪ঠা মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগ ওই ৬টি মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত রেখেই গেজেট প্রকাশ করে। গত ৩রা এপ্রিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের স্থানীয় সরকার বিভাগের ওই গেজেট, ৪ঠা মার্চের গেজেট এবং গত ৩রা এপ্রিল ইসি ঘোষিত তফসিল চ্যালেঞ্জ করে রোববার হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজ। আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে ৬ই মে হাইকোর্ট গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেয়।
গাজীপুরে ভোটের নতুন তারিখ ঘোষণা রোববার
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। রোববার কমিশন সভায় নতুন তারিখ চূড়ান্ত করা হবে। গতকাল নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গাজীপুরে ২৮শে জুনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে আমাদের। ১৫ই মে গাজীপুরের নির্বাচন যেহেতু হচ্ছে না, সেহেতু কবে, ক’দিন সময় দেয়া হবে তা নিয়ে কমিশন ১৩ই মে বৈঠকে বসবে। ওই কমিশন সভায় গাজীপুরের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হবে। রোববার বিকাল তিনটায় সিইসি ও অন্য কমিশনারদের নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আসার পর গতকাল বিকাল ৫টার পরে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ও ইসি সচিবকে নিয়ে বৈঠক করেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা। তারপরই ইসি সচিব কমিশনের অবস্থান তুলে ধরেন।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত রমজান মাসে কোনো সাধারণ নির্বাচন করা হয় না। তাই ঈদের পরে নির্বাচনের তারিখ দেয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে নতুন তারিখ ঘোষণার পর প্রার্থীদের জন্য প্রচারণার সাতদিন সময় দেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.