সেই আরবও নেই, সেই জেরুজালেমও নেই by মাহমুদ ফেরদৌস
দশকের
পর দশক জেরুজালেমকে রাজধানী সমেত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাকে
হিম্মত ছিল। পুরো আরব বিশ্বকে একত্রিত করতে পারে, এমন বিরল কিছু ইস্যুর
মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। আরব বিশ্বের একনায়ক থেকে বাদশাহ - সবাই ফিলিস্তিন
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হোক, তা মন থেকে চাইতেন। মসজিদে মসজিদে মোনাজাত ধরতেন
ইমামরা। জিহাদী থেকে শুরু করে বিক্ষোভকারী, অনেকের প্রাণ গেছে ফিলিস্তিনের
জন্য। টিভি স্টেশন, মহাসড়ক থেকে শুরু করে মানুষের নামও রাখা হয়েছে আল কুদস।
আল কুদস হলো জেরুজালেম শহরের আরবি নাম।
বুধবার জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই আকাক্সক্ষায় যেন কুঠারাঘাত করেছেন। পবিত্র শহরটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইহুদী ও আরবদের মধ্যে যে দীর্ঘদিনের বিরোধ, তাতে ইসরাইলকে বিরাট এক জয় পাইয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প।
আরব ও মুসলিম নেতারা ট্রাম্পের পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন বটে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অনেকে ভেবে অবাক হয়েছেন, এই কয়েক বছরে কি এমন পাল্টে গেল? এত বড় পদক্ষেপের পরও আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া এত মৃদু কেন? অনেকটা খেদ নিয়েই যেন লেবাননের ব্লগার মুস্তাফা হামোয়ি টুইটারে লিখলেন, ‘একদিন নিজ দেশে ফিরবে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা’ স্লোগানের মতোই ‘জেরুজালেম ফিলিস্তিনের রাজধানী’- এই বাক্যটিও করুণ ভাগ্য বরণ করলো। এ যেন অনেকটা এমন যে, ‘আশা করি এটি হবে, কিন্তু বাস্তবে কখনই হবে না।’
এখনও ফিলিস্তিনি আন্দোলনের পক্ষে আরব নেতারা কথা বলেন বটে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নিচে পড়ে গেছেন। আরব বসন্ত, ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেনের যুদ্ধ, ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর হুমকি এবং সৌদি আরব ও ইরানের আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ের তলে চাপা পড়ে গেছেন ফিলিস্তিনিরা। সৌদি আরবের মতো পারস্য উপসাগরীয় অনেক দেশ এখন ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশি চিন্তিত। ফলে, ইসরাইল ও এই আরব দেশগুলোর স্বার্থ যেন ক্রমেই অভিন্ন হয়ে উঠছে।
ফিলিস্তিনি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থনের তেজস্বী ঘোষণাকে জনসমর্থন বৃদ্ধিতে সবসময়ই ব্যবহার করে এসেছেন আরব নেতারা। ঘরোয়া সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতেও ফিলিস্তিন নিয়ে বাগাড়ম্বর ছোটাতেন তারা। আরব জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনকে ঘিরে আবেদন সবসময়ই ছিল খাঁটি। কিন্তু তাদের নেতারা প্রায়ই এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের স্বার্থে।
ফিলিস্তিনি নেতারাও বোঝেন যে, তাদের আরব ভ্রাতারা যেই সমর্থনের ঘোষণা দিয়ে থাকেন, সেসব খুব কম সময়ই বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর পূর্ব জেরুজালেম দখলে নেয় ইসরাইল, যা কখনই বিশ্ব সম্প্রদায় স্বীকৃতি দেয়নি। যুদ্ধের পর থেকে ক্রমেই পূর্ব জেরুজালেমে (যেখানে পবিত্র স্থাপনা অবস্থিত) নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণ করেছে ইসরাইল। কিন্তু শুধু মৌখিক প্রতিবাদ জানানো ছাড়া তেমন কিছুই করেনি আরব বিশ্ব। কারণ, আরব দুনিয়ার অগ্রাধিকারের তালিকা পাল্টে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, একসময় মিশর ছিল ফিলিস্তিনের নির্ভরযোগ্য সমর্থক। নব্বইয়ের দশক, এমনকি এ শতাব্দীর শুরুর দিকেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিয়মিতই মিছিল হতো দেশটিতে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নিষ্ঠুর নির্যাতনমূলক শাসনের কারণে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। আরব বসন্ত পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য অনেক বেশি অস্থিতিশীল হয়েছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে সেখানকার মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ কারণেও প্রতিবাদে নামতে আগ্রহী নয় বেশিরভাগ জনগণ।
প্রখ্যাত সাংবাদিক হোসাম বাগাত ব্যাখ্যার সুরে বলেন, ‘মানুষ এখনও ফিলিস্তিনি ইস্যুর কথা ভাবে। কিন্তু এক সময়কার প্রবাদতুল্য উত্তাল আরব রাজপথ এখন শান্ত হয়ে গেছে।’ ২০১৩ সালে সিসি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারের সমালোচকরা অপহৃত হয়েছেন। সেদিকেই ইঙ্গিত করছিলেন বাগাত। আরব বিশ্বের ক্ষমতার ভারকেন্দ্র ঐতিহ্যগতভাবে ছিল দামেস্ক, কায়রো আর বাগদাদ। কিন্তু তিনটি রাজধানীই এখন দুর্বল। এই সুযোগে নিজেকে জাহির করার উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি আরব।
সৌদি বাদশাহ ও রাজপরিবারের সদস্যরাও একসময় নিয়মিত ফিলিস্তিনের কথা বলতেন। কিন্তু দেশটির বর্তমান অলিখিত শাসক উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (৩২) এই ইস্যুতে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন খুব কমই। এ বছর সফররত অনেক বিদেশী নেতা ও কূটনীতিককে সালমান বলেছেন যে, ইরানকে মোকাবিলা ও দেশে সংস্কার বাস্তবায়ন করার তুলনায়, ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতকে তিনি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন না।
আরব বিশ্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় দুই অনুরাগী হলেন মিশরের সিসি ও সৌদি বাদশাহ সালমান। মে মাসে রিয়াদে এক সম্মেলনে তারা তিনজন একত্র হন। একটি অক্ষিগোলকের ওপর তাদের হাত রাখার সেই বিখ্যাত ছবিটি ছিল তাদের মধ্যকার মৈত্রীর বহিঃপ্রকাশ, যদিও এ নিয়ে ইন্টারনেটে হাসাহাসি হয়েছিল প্রচুর।
সেপ্টেম্বরে, প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সিসি। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কারণে শক্তিশালী হচ্ছে। ওই সাক্ষাতের পর তা যেন আরও মজবুত হয়। অপরদিকে গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগির পরিমাণ সৌদি আরব আরও বৃদ্ধি করছে বলে ভাবা হচ্ছে।
কিন্তু জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত তার এই দুই মিত্রকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। তাদেরকে অন্তত মৌখিকভাবে হলেও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে হচ্ছে। বাদশাহ সালমান বলেছেন, আমেরিকার এই পদক্ষেপ খুবই বিপজ্জনক, যেটি বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের আবেগকে নাড়া দিতে পারে। সিসির কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে যে, তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা উভয়েই ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন, কারণ এর মাধ্যমে আরব ও মুসলিমদের মধ্যে জেরুজালেমের বিশেষ স্থান থাকাকে অগ্রাহ্য করা হলো। মিশরের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত আল আহরাম ওয়েবসাইটের শিরোনাম ছিল: ‘ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও, জেরুজালেমই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী।’
আমেরিকার আরেক মিত্র জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ওপর বিপজ্জনক পরিণতি নেমে আসবে। আরব বিশ্বের বাইরে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেছেন, জেরুজালেম ‘মুসলিমদের জন্য রেড লাইন।’ তিনি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের হুমকি দিয়েছেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে বৈশ্বিক দম্ভের নতুন দুঃসাহস দেখা গেলো এই সিদ্ধান্তে।’
এটি এখনও সম্ভব যে, ট্রাম্পের ওই ঘোষণার ফলে ফিলিস্তিনি ইস্যু ফের নাড়া দেবে আরব বিশ্বকে। কিন্তু বুধবার নাগাদ যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তার মধ্যে ক্ষোভ ও হুমকি যতটা ছিল, তততাই ছিল হতাশা। ব্যপক সহিংসতা ঘটার সম্ভাবনা এখনও আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত শুধু দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারই দেখা গেছে বেশি।
হ্যাঁ, ট্রাম্পের ওই পদক্ষেপ অনেকটাই প্রতীকী। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যে কতটা দূরবর্তী, সেটিই যেন দেখিয়ে দেওয়া হলো। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভেবে আসছে। তারা জানেন যে, টেকসই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের আশা ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দেওয়ায় ফিলিস্তিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশাটি বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই প্রত্যাশাটি পূরণ হবে, এমন সম্ভাবনাও ছিল। সেটি হলো পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে পাওয়া। কিন্তু জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প যেন ওই আশাকেও স্তব্ধ করে দিলেন। এ যেন জেরুজালেমের ওপর আরব ও মুসলিম অধিকারকে অস্বীকার করার শামিল।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা বার্নেট আর. রুবিন বলেন, ‘ফিলিস্তিনি, আরব ও মুসলিমদের কাছে ঠিক তেমনই লাগছে, যেমনটা জেরুজালেমের ওপর ইহুদীদের দাবি অস্বীকার করলে ইহুদীদের লেগে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, এই পদক্ষেপের ফলে অনেকের কাছেই মনে হবে, সত্যি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। মুসলিম ও আরব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি দেশটির কোনো সম্মানবোধ নেই। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
মিশরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিল ফাহমি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ভাবমূর্তি ও স্বার্থ দারুণ ক্ষতিগ্রস্থ হলো।’ ট্রাম্প সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনি যেন চরমপন্থীদের হিসাব অনুযায়ীই খেলছেন। চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের হাতে তিনি গোলা তুলে দিচ্ছেন।’
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে লাভবান হতে পারে ইরান। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদ সরকারের পক্ষালম্বন করে প্রতিরোধের যোদ্ধা হিসেবে নিজেদের আবেদন হারায় দেশটি। কিন্তু সেই আবেদন ফের ফিরে পেতে পারে ইরান। দেশটির বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর সবচেয়ে অভিজাত বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) ইরানি জেনারেল কাশিম সোলেমানি। এই বাহিনীর নাম কুদস ফোর্স। জেরুজালেম তথা আল কুদস থেকে এই নামকরণ করা হয়।
বার্নেট আর রুবিন বলেন, ‘আমরা যেন ইরানিদের হাতে ফিলিস্তিনি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পদ তুলে দিলাম।’ জেরুজালেম নিয়ে এখন যে আলোচনা, তার ফলে নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে চরমপন্থী জঙ্গিরা। মিশরে ইসলামিক স্টেটের শক্তিশালী শাখা গোষ্ঠী আনসার বেইত আল-মাকদিসের নাম অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘জেরুজালেমের সমর্থকদল।’
কিন্তু আরব বিশ্বের অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে তেমন কিছুই হবে না। তাদের কণ্ঠে হেরে যাওয়ার সুর। লিবিয়ার মিসরাতার বাসিন্দা নাদিয়া মোহাম্মেদ টুইটারে লিখেছেন, ‘আমরা কিছু লোক দেখানো প্রতিবাদ দেখবো। কিছু দেশ সমালোচনা করবে। গণমাধ্যমও কয়েকদিন চেঁচামেচি করবে। কিন্তু এরপর সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
(নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে)
আল কুদস হলো জেরুজালেম শহরের আরবি নাম।
বুধবার জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই আকাক্সক্ষায় যেন কুঠারাঘাত করেছেন। পবিত্র শহরটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইহুদী ও আরবদের মধ্যে যে দীর্ঘদিনের বিরোধ, তাতে ইসরাইলকে বিরাট এক জয় পাইয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প।
আরব ও মুসলিম নেতারা ট্রাম্পের পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন বটে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অনেকে ভেবে অবাক হয়েছেন, এই কয়েক বছরে কি এমন পাল্টে গেল? এত বড় পদক্ষেপের পরও আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া এত মৃদু কেন? অনেকটা খেদ নিয়েই যেন লেবাননের ব্লগার মুস্তাফা হামোয়ি টুইটারে লিখলেন, ‘একদিন নিজ দেশে ফিরবে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা’ স্লোগানের মতোই ‘জেরুজালেম ফিলিস্তিনের রাজধানী’- এই বাক্যটিও করুণ ভাগ্য বরণ করলো। এ যেন অনেকটা এমন যে, ‘আশা করি এটি হবে, কিন্তু বাস্তবে কখনই হবে না।’
এখনও ফিলিস্তিনি আন্দোলনের পক্ষে আরব নেতারা কথা বলেন বটে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নিচে পড়ে গেছেন। আরব বসন্ত, ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেনের যুদ্ধ, ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর হুমকি এবং সৌদি আরব ও ইরানের আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ের তলে চাপা পড়ে গেছেন ফিলিস্তিনিরা। সৌদি আরবের মতো পারস্য উপসাগরীয় অনেক দেশ এখন ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশি চিন্তিত। ফলে, ইসরাইল ও এই আরব দেশগুলোর স্বার্থ যেন ক্রমেই অভিন্ন হয়ে উঠছে।
ফিলিস্তিনি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থনের তেজস্বী ঘোষণাকে জনসমর্থন বৃদ্ধিতে সবসময়ই ব্যবহার করে এসেছেন আরব নেতারা। ঘরোয়া সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতেও ফিলিস্তিন নিয়ে বাগাড়ম্বর ছোটাতেন তারা। আরব জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনকে ঘিরে আবেদন সবসময়ই ছিল খাঁটি। কিন্তু তাদের নেতারা প্রায়ই এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের স্বার্থে।
ফিলিস্তিনি নেতারাও বোঝেন যে, তাদের আরব ভ্রাতারা যেই সমর্থনের ঘোষণা দিয়ে থাকেন, সেসব খুব কম সময়ই বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর পূর্ব জেরুজালেম দখলে নেয় ইসরাইল, যা কখনই বিশ্ব সম্প্রদায় স্বীকৃতি দেয়নি। যুদ্ধের পর থেকে ক্রমেই পূর্ব জেরুজালেমে (যেখানে পবিত্র স্থাপনা অবস্থিত) নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণ করেছে ইসরাইল। কিন্তু শুধু মৌখিক প্রতিবাদ জানানো ছাড়া তেমন কিছুই করেনি আরব বিশ্ব। কারণ, আরব দুনিয়ার অগ্রাধিকারের তালিকা পাল্টে গেছে।
উদাহরণস্বরূপ, একসময় মিশর ছিল ফিলিস্তিনের নির্ভরযোগ্য সমর্থক। নব্বইয়ের দশক, এমনকি এ শতাব্দীর শুরুর দিকেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিয়মিতই মিছিল হতো দেশটিতে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নিষ্ঠুর নির্যাতনমূলক শাসনের কারণে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। আরব বসন্ত পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য অনেক বেশি অস্থিতিশীল হয়েছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে সেখানকার মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ কারণেও প্রতিবাদে নামতে আগ্রহী নয় বেশিরভাগ জনগণ।
প্রখ্যাত সাংবাদিক হোসাম বাগাত ব্যাখ্যার সুরে বলেন, ‘মানুষ এখনও ফিলিস্তিনি ইস্যুর কথা ভাবে। কিন্তু এক সময়কার প্রবাদতুল্য উত্তাল আরব রাজপথ এখন শান্ত হয়ে গেছে।’ ২০১৩ সালে সিসি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারের সমালোচকরা অপহৃত হয়েছেন। সেদিকেই ইঙ্গিত করছিলেন বাগাত। আরব বিশ্বের ক্ষমতার ভারকেন্দ্র ঐতিহ্যগতভাবে ছিল দামেস্ক, কায়রো আর বাগদাদ। কিন্তু তিনটি রাজধানীই এখন দুর্বল। এই সুযোগে নিজেকে জাহির করার উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি আরব।
সৌদি বাদশাহ ও রাজপরিবারের সদস্যরাও একসময় নিয়মিত ফিলিস্তিনের কথা বলতেন। কিন্তু দেশটির বর্তমান অলিখিত শাসক উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (৩২) এই ইস্যুতে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন খুব কমই। এ বছর সফররত অনেক বিদেশী নেতা ও কূটনীতিককে সালমান বলেছেন যে, ইরানকে মোকাবিলা ও দেশে সংস্কার বাস্তবায়ন করার তুলনায়, ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতকে তিনি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন না।
আরব বিশ্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় দুই অনুরাগী হলেন মিশরের সিসি ও সৌদি বাদশাহ সালমান। মে মাসে রিয়াদে এক সম্মেলনে তারা তিনজন একত্র হন। একটি অক্ষিগোলকের ওপর তাদের হাত রাখার সেই বিখ্যাত ছবিটি ছিল তাদের মধ্যকার মৈত্রীর বহিঃপ্রকাশ, যদিও এ নিয়ে ইন্টারনেটে হাসাহাসি হয়েছিল প্রচুর।
সেপ্টেম্বরে, প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সিসি। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কারণে শক্তিশালী হচ্ছে। ওই সাক্ষাতের পর তা যেন আরও মজবুত হয়। অপরদিকে গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগির পরিমাণ সৌদি আরব আরও বৃদ্ধি করছে বলে ভাবা হচ্ছে।
কিন্তু জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত তার এই দুই মিত্রকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। তাদেরকে অন্তত মৌখিকভাবে হলেও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে হচ্ছে। বাদশাহ সালমান বলেছেন, আমেরিকার এই পদক্ষেপ খুবই বিপজ্জনক, যেটি বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের আবেগকে নাড়া দিতে পারে। সিসির কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে যে, তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা উভয়েই ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন, কারণ এর মাধ্যমে আরব ও মুসলিমদের মধ্যে জেরুজালেমের বিশেষ স্থান থাকাকে অগ্রাহ্য করা হলো। মিশরের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত আল আহরাম ওয়েবসাইটের শিরোনাম ছিল: ‘ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও, জেরুজালেমই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী।’
আমেরিকার আরেক মিত্র জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ওপর বিপজ্জনক পরিণতি নেমে আসবে। আরব বিশ্বের বাইরে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেছেন, জেরুজালেম ‘মুসলিমদের জন্য রেড লাইন।’ তিনি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের হুমকি দিয়েছেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে বৈশ্বিক দম্ভের নতুন দুঃসাহস দেখা গেলো এই সিদ্ধান্তে।’
এটি এখনও সম্ভব যে, ট্রাম্পের ওই ঘোষণার ফলে ফিলিস্তিনি ইস্যু ফের নাড়া দেবে আরব বিশ্বকে। কিন্তু বুধবার নাগাদ যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তার মধ্যে ক্ষোভ ও হুমকি যতটা ছিল, তততাই ছিল হতাশা। ব্যপক সহিংসতা ঘটার সম্ভাবনা এখনও আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত শুধু দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারই দেখা গেছে বেশি।
হ্যাঁ, ট্রাম্পের ওই পদক্ষেপ অনেকটাই প্রতীকী। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যে কতটা দূরবর্তী, সেটিই যেন দেখিয়ে দেওয়া হলো। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভেবে আসছে। তারা জানেন যে, টেকসই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের আশা ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দেওয়ায় ফিলিস্তিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশাটি বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই প্রত্যাশাটি পূরণ হবে, এমন সম্ভাবনাও ছিল। সেটি হলো পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে পাওয়া। কিন্তু জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প যেন ওই আশাকেও স্তব্ধ করে দিলেন। এ যেন জেরুজালেমের ওপর আরব ও মুসলিম অধিকারকে অস্বীকার করার শামিল।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা বার্নেট আর. রুবিন বলেন, ‘ফিলিস্তিনি, আরব ও মুসলিমদের কাছে ঠিক তেমনই লাগছে, যেমনটা জেরুজালেমের ওপর ইহুদীদের দাবি অস্বীকার করলে ইহুদীদের লেগে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, এই পদক্ষেপের ফলে অনেকের কাছেই মনে হবে, সত্যি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। মুসলিম ও আরব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি দেশটির কোনো সম্মানবোধ নেই। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
মিশরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিল ফাহমি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ভাবমূর্তি ও স্বার্থ দারুণ ক্ষতিগ্রস্থ হলো।’ ট্রাম্প সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনি যেন চরমপন্থীদের হিসাব অনুযায়ীই খেলছেন। চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের হাতে তিনি গোলা তুলে দিচ্ছেন।’
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে লাভবান হতে পারে ইরান। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদ সরকারের পক্ষালম্বন করে প্রতিরোধের যোদ্ধা হিসেবে নিজেদের আবেদন হারায় দেশটি। কিন্তু সেই আবেদন ফের ফিরে পেতে পারে ইরান। দেশটির বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর সবচেয়ে অভিজাত বাহিনীর নেতৃত্বে আছেন বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) ইরানি জেনারেল কাশিম সোলেমানি। এই বাহিনীর নাম কুদস ফোর্স। জেরুজালেম তথা আল কুদস থেকে এই নামকরণ করা হয়।
বার্নেট আর রুবিন বলেন, ‘আমরা যেন ইরানিদের হাতে ফিলিস্তিনি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পদ তুলে দিলাম।’ জেরুজালেম নিয়ে এখন যে আলোচনা, তার ফলে নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে চরমপন্থী জঙ্গিরা। মিশরে ইসলামিক স্টেটের শক্তিশালী শাখা গোষ্ঠী আনসার বেইত আল-মাকদিসের নাম অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘জেরুজালেমের সমর্থকদল।’
কিন্তু আরব বিশ্বের অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে তেমন কিছুই হবে না। তাদের কণ্ঠে হেরে যাওয়ার সুর। লিবিয়ার মিসরাতার বাসিন্দা নাদিয়া মোহাম্মেদ টুইটারে লিখেছেন, ‘আমরা কিছু লোক দেখানো প্রতিবাদ দেখবো। কিছু দেশ সমালোচনা করবে। গণমাধ্যমও কয়েকদিন চেঁচামেচি করবে। কিন্তু এরপর সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
(নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে)
No comments