অবশেষে হচ্ছে বিচারকদের চাকরির বিধিমালা
অবশেষে
বহু প্রতীক্ষিত অধস্তন আদালতের বিচারকের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ
সংক্রান্ত চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ হতে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে বিধিমালার চূড়ান্ত খসড়া কপি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে
রাষ্ট্রপতির দফতরে পাঠানো হয়েছে। চলতি সপ্তাহে বিধিমালাটি রাষ্ট্রপতির দফতর
থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে বলে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত
করেছে। বিচারকদের পদোন্নতি, বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিমকোর্টের হাতে না
থাকায় ‘দ্বৈত শাসন’ সৃষ্টি হচ্ছে মন্তব্য করে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল
করে ’৭২-এর সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ফেরানোর কথা বলে আসছিলেন
পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। ওই অনুচ্ছেদকে বিচার বিভাগের কাজের
ধীরগতির অন্যতম কারণ হিসেবেও চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। বর্তমান সংবিধানের ১১৬
অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার
বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ,
পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে
এবং সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত
হবে।’ সংবিধান প্রদত্ত এ ক্ষমতায় সরকারের আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির পক্ষে
এসব কাজ করে থাকে। আর ১৯৭২ সালের সংবিধানের এ ধারায় বলা ছিল,
‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত
ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি
মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।’ আওয়ামী লীগ
নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানের চার
মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে বাহাত্তরের বিধান আর ফেরেনি।
মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে
আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায়
সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনায় সরকার নিন্ম আদালতের বিচারকদের চাকরির
শৃঙ্খলাবিধির একটি খসড়া করে পাঠালেও গত বছর আপিল বিভাগ তা সংশোধনের জন্য
আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়। এরপর দফায় দফায় সময় দেয়া হলেও সরকার ওই
বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করায় বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের
টানাপোড়েন সংবাদের শিরোনামে আসে। শৃঙ্খলা বিধিমালা না করায় এক বছরের বেশি
সময় ধরে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন চলে আসছে। এ
সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকার বেশ কয়েক দফা সময় নেয়।
শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে
বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই বিধিমালার খসড়া সুপ্রিমকোর্টে জমা দিলেও সাবেক
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি
নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। পরদিন সুপ্রিমকোর্টে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী
আইনজীবী পরিষদের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নিন্ম আদালতের
বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের যে ক্ষমতা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে
দেয়া হয়েছে, তা সুপ্রিমকোর্ট নিয়ে নিতে চায়। বিধিমালার গেজেট নিয়ে প্রধান
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বৈঠকে বসার জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের
প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর জবাবে সেদিনই আইনমন্ত্রী টেলিফোনে প্রধান
বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেন এবং ৩ আগস্ট বৈঠকের দিন নির্ধারণ করেন। কিন্তু
আইনমন্ত্রী অসুস্থ থাকায় নির্ধারিত দিনে বৈঠক হয়নি। এ অবস্থায় প্রধান
বিচারপতি ৬ আগস্ট আবারও বৈঠকে বসার আহ্বান জানান। একপর্যায়ে বিধিমালার ওই
খসড়া গ্রহণ না করে প্রধান বিচারপতি মতপার্থক্য নিরসনে আইনমন্ত্রী,
অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় ডাকেন এসকে
সিনহা। কিন্তু এরই মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে তোপের মুখে পড়েন
প্রধান বিচারপতি। ছুটি নিয়ে দেশত্যাগের ২৮ দিনের মাথায় ১০ নভেম্বর
সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
পরে এসকে সিনহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
শৃঙ্খলা বিধিমালা গেজেটের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে শনিবার আইনমন্ত্রী
আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, নিন্ম আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা
বিধিমালার চূড়ান্ত খসড়াটি রাষ্ট্রপতির দফতরে পাঠানো হয়েছে। রোববার (আজ)
নাগাদ এটা আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত আসতে পারে। ইনশাআল্লাহ, দু-একদিনের মধ্যে
প্রকাশ হতে পারে। এর আগে শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী
একই কথা বলেছিলেন। আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক
যুগান্তরকে বলেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির বিধিমালার চূড়ান্ত
খসড়াটি রাষ্ট্রপতির দফতরে পাঠানো হয়েছে। এ সপ্তাহে এটা আইন মন্ত্রণালয়ে
ফেরত আসতে পারে। গেজেট নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল
জাকির হোসেন যুগান্তরকে একই তথ্য জানান। ৮ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত প্রধান
বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বিধিমালা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসার
আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালতে বলেন, ‘আমার
মনে হয়, এটা (বিধিমালা) হওয়া দরকার। এটা নিয়ে বসা দরকার। কোথায় কোথায়
আপত্তি আছে, সেটা খোঁজা দরকার। সময় চাচ্ছেন, সময় দিচ্ছি। তবুও এটা হওয়া
দরকার। এরপর ১১ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সুপ্রিমকোর্টে
এক বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে বসব। আশা করি, আগামী নির্ধারিত তারিখের
আগেই সুরাহা হবে।’ ১৬ নভেম্বর আপিল বিভাগের বিচারকদের সঙ্গে বৈঠকের পর
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, বিধিমালা নিয়ে সরকারের সঙ্গে
যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটেছে। বিধিমালাটি এখন
রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। তিনি অনুমতি দিলে ৩ ডিসেম্বরের আগে গেজেট প্রকাশ
করতে পারব। এখন রাষ্ট্রপতির অনুমতির অপেক্ষা। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের
আলোকে বিচারকের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ সংক্রান্ত শৃঙ্খলা বিধিমালা না
করায় এক বছর ধরে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন চলে
আসছে। সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর বিধিমালার গেজেট প্রকাশে আজ রোববার পর্যন্ত সময়
মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ?হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন আপিল
বিভাগ এ আদেশ দেন।
No comments