এক মৃত্যুহীন প্রাণ
মৃত্যু
জীবনের এক অবধারিত সত্য। তারপরও এমন কিছু মৃত্যু আছে যা বিশ্বাস করতে কষ্ট
হয়। তেমনই এক মৃত্যু হল আমাদের মেয়র আনিসুল হকের। মেয়র বলে নয়- ব্যক্তি
আনিসুল হক আমার কাছে অনেক বড় বিষয়। এমন এক সদা
হাস্যোজ্জ্বল-প্রাণোচ্ছল-অমায়িক, নীতি ও আদর্শের কাছে অটল, সৎ ও জনসেবায়
নিবেদিত মানুষ এই সমাজে ক’জন পাওয়া যায়! সেই আনিসুল হক আজ আর নেই- ভাবতেই
মনটা ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। যাকে আর ইহজগতে ফিরে পাওয়ার নয়- কিন্তু
তার স্মৃতিগুলো ঘুরে-ফিরে চোখের সামনে চলে আসে- তাই মনে কথা জাগে- যা লিখতে
পারলে হয়তো কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়া যাবে। জীবদ্দশায় আনিসুল হকের সঙ্গে
আমার যে একান্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা নয়, তবে তার গুণাবলি আমাকে আকৃষ্ট
করে রেখেছে সেই তাকে জানাশোনার সময় থেকেই। প্রথমে পরিচিত হয়েছি- তার
গুণাবলির সঙ্গে। একজন মেধাবী ও মার্জিত টিভি উপস্থাপক হিসেবে তিনি দেশবাসীর
দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন- তার মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। নির্বাচনের ফলাফল
ঘোষণায়- তার কোনো জুড়ি ছিল না। তার সেই উপস্থাপনার মধ্যে ছিল সম্পূর্ণ
নিরপেক্ষতার সুর। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আমি তিনটি
নির্বাচনে ১৩টি আসনে বিজয়ী হয়েছি। তার মধ্যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কারাগারে
থেকে ৫ আসনে এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আবার জেলে থেকেই ৫ আসনে বিজয়ী
হয়েছিলাম। সেই বিজয়ের খবর যার কণ্ঠে শুনেছিলাম- আজও মনে পড়ে- তিনিই ছিলেন
আনিসুল হক। চারটি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে একবার মাত্র ২০০৮ সালের নির্বাচনের
সময় মুক্তভাবে নির্বাচন করতে পেরেছি। সেবার সর্বোচ্চ তিনটি আসনে নির্বাচন
করার সুযোগ থাকার কারণে তিন আসনেই নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলাম। সেই
বিজয়ের খবরটাও শুনেছি আনিসুল হকের কণ্ঠে টিভিতে ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এভাবেই
আনিসুল হককে আমার চেনা ও জানার সূত্রপাত। আশির দশকে ঈদের বিনোদনমূলক
অনুষ্ঠান আনন্দমেলা এবং রাজনীতিবিষয়ক অনুষ্ঠানের কথা এখনও মনে পড়ে। সেই
অনুষ্ঠান অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তার স্বকীয় উপস্থাপনার গুণে। সেই
সময়টা ছিল আমার শাসনামল। শুধু টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবেই নয়- ব্যবসায়ী
হিসেবেও তিনি ছিলেন দেশজোড়া পরিচিত। আনিসুল হক তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও
রফতানিকারক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হিসেবেও অসামান্য কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন। তারপর
আনিসুল হক প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে এলেন। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর
সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেন। আমার সঙ্গে তার
একাধিকবার দেখা-সাক্ষাৎ হল। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে
অমায়িক ব্যবহারে সম্বোধন-কুশল বিনিময়, সিটি কর্পোরেশন নিয়ে উচ্চাভিলাষী
পরিকল্পনা নিয়ে কত যে কথা হয়েছে- এখনও তা মনের বীণায় গুনগুনিয়ে বেজে যায়।
আমিও তার কাজের অনেক প্রশংসা করেছি- যা শুনে তিনি লাজুক হাসি হেসেছেন- আর
বলতেন ‘চেষ্টা করছি স্যার’। সমস্যাকবলিত ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার কঠিন
প্রয়াসে তিনি হাত দিয়েছিলেন। তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে বদলে
যাচ্ছিল রাজধানী ঢাকার উত্তরাংশ। তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সড়ক দখলমুক্ত
করতে কী যে সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয় দেখিয়েছেন- তা আমরা ভুলতে পারব না। ঢাকাকে
যানজটের অভিশাপমুক্ত করতে তার প্রচেষ্টাকে আমি স্মরণ না করে পারি না। যদিও
এটা অনেক কঠিন কাজ- তবে যে কোনো সমস্যাই উপযুক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের
মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। মেয়র আনিস সেভাবেই সুপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর
হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য- তিনি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে যেতে পারলেন না। এই
সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি এবং নগরবাসীর কল্যাণে তার চেষ্টা ছিল
অপরিসীম। কিন্তু অকাল মৃত্যুর কাছে তিনি হেরে যাবেন- এটা ছিল আমার মতো সবার
দুঃস্বপ্নেরও অধিক কিছু। কিন্তু অসময়ে জীবনের ধ্রুব সত্যকে মেনে নিতে হল।
মৃত্যুকে আমাদের মেনে নিতেই হয়।
মৃত্যু হচ্ছে জাগতিক জীবনের সমাপ্তি এবং
মৃত্যু-পরবর্তী জীবন থেকে আখিরাতের প্রবেশদ্বার। মৃত্যু হচ্ছে জাগতিক দেহ
থেকে আত্মার পৃথকীকরণ এবং একইসঙ্গে এই আত্মার জাগতিক দুনিয়া হতে আখিরাতের
উদ্দেশে যাত্রা। মৃত্যু হচ্ছে চলমান জীবন প্রক্রিয়ায় একটি পরিবর্তনীয়
অবস্থা। সব জীবিত প্রাণের জন্যই মৃত্যু একটি সর্বোচ্চ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। সেই
অভিজ্ঞতা আনিসুল হক এত তাড়াতাড়ি অর্জন করবেন- সেটাই আমার মতো তার অসংখ্য
গুণগ্রাহীর অমোচনীয় বেদনার কারণ। বারেবারে মনে হয়- আনিস যদি আরও সময় বেঁচে
থাকতেন- তাহলে মানুষের কল্যাণে আরও অনেক কাজ করে যেতে পারতেন। তাই মনে হয়
কী বিচিত্র মানুষের জীবন! কত আশা-আকাক্সক্ষা-ভালোবাসা মুহূর্তেই মুছে যায়।
বাকি থেকে যায় কিছু দিনের স্মৃতি। আনিসুল হক লন্ডন গিয়েছিলেন একটা সুসংবাদ
শুনতে। তার বড় মেয়ের সন্তান হবে- নাতির মুখ দেখবেন- কত আশা নিয়ে গিয়েছিলেন
সেখানে। অথচ নিয়তি তাকেই শোনালো একটি দুঃসংবাদ। শোনলেন তার অসুস্থতার কথা।
আর দেশকে শোনালেন একটি অসহনীয় শোকের খবর। আমরা জানলাম আনিসুল হক আর নেই।
মাঝখানে কিছুটা দিন কেটে গেল তার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আর শেষ পর্যন্ত
হারমানা। জানি, এভাবে জীবজগতের সবাইকে একদিন হার মানতেই হবে। তবুও যতটা সময়
পাওয়া যায়- বাঁচতে ইচ্ছা করে। এই ইচ্ছাটাই বড়। কারণ, প্রত্যেক জীব তার
জীবনকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট
করতে হয়। এর বড় কারণ- পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের দুর্বিনীত লোভ। এই পৃথিবীর
রূপ-রস-গন্ধ-মাটি-পানি-বাতাস- কোনো কিছু ছেড়ে যেতে মন চায় না। একান্ত আপনজন
হারিয়ে যায়- তারপরও শোক বুকে নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। মা সন্তান-শোক ভুলে
আবার গর্ভে সন্তান ধারণ করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। এই হচ্ছে পৃথিবীর আকর্ষণ।
কিন্তু মৃত্যু সেই আকর্ষণকে ছিন্ন করে ফেলে। তাই কোনো একটি মৃত্যু দেখলে-
মনের মধ্যে ভয় জাগে- আমাকেও তো এভাবে পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হবে। সেই মায়ার
টানে, জীবনের অস্তিত্ব থাকাকালীন রেখে যেতে হয় এমন কিছু কাজ- যা তাকে অমর
করে রাখতে পারে বেঁচে থাকা মানুষের কাছে। আমাদের বিশ্বাস, তাতেই হয়তো
আমাদের বিদেহী আত্মা শান্তি ও সুখ অনুভব করবে। যখন আমাকে কেউ ভালোবেসে
স্মরণ করবে কিংবা আমার কোনো সৎগুণের গুণকীর্তন করবে- তখন নিশ্চয়ই আমার
আত্মা নামের শক্তিটি আখিরাতের যেখানেই থাকবে- সেখানে সুখে বিভোর হবে। এটাই
আমার চূড়ান্ত বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস নিয়েই কাজ করে যাই। আমি এটাও বিশ্বাস
করি- আনিসুল হকও তার জীবদ্দশায় যে কাজ করে গেছেন- তার বিনিময়ে তিনিও
আখিরাতে সুখে বিভোর থাকবেন। একজন দেশবরেণ্য নেতার মৃত্যুতে- একজন কবি
বলেছিলেন- এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে
দান। আমার কাছে আনিসুল হকও- এক মৃত্যুহীন প্রাণ।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ : সাবেক রাষ্ট্রপতি; চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ : সাবেক রাষ্ট্রপতি; চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
No comments