জেরুজালেম: সাবেক প্রায় সব মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দ্বিমত
ইসরাইলে
নিযুক্ত আমেরিকার সাবেক ১১ জন রাষ্ট্রদূতের ৯ জনই বলছেন জেরুজালেমকে
ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল
ভুল, বিপজ্জনক। কারও কারও মতে তা ভীষণ ত্রুটিপূর্ণ। বুধবার প্রেসিডেন্ট
ডনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের দিকে ঘনিষ্ঠ নজর রেখেছেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূতরা।
কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত পোষণ
করেছেন এই যুক্তিতে যে, তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে আমেরিকার দূতাবাস সরিয়ে
নেওয়াটা হবে বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু তাদের মধ্যেও বেশিরভাগ
বলছেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। তিনি ইসরাইলকে
একটি বড় কূটনৈতিক ছাড় উপহার দিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে দেশটির কাছ থেকে তেমন
ছাড় আদায় করে নিতে পারেন নি।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে।
১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ওগডেন আর. রেইড। তিনিই ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বার্থ্যহীনভাবে একমত পোষণকারী দু’জনের একজন। আইসেনহাওয়ার প্রশাসন নিজেদের বিদায়বেলায় এই সাবেক কংগ্রেসম্যানকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছিল। তার মতে, ‘আমি মনে করি, এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই।’ আরেকজন ব্যতিক্রম ছিলেন এডওয়ার্ড এস. ওয়াকার জুনিয়র। তিনি ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আমলে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি আসলে সময়ের খেলা। বাস্তবতাকে আমরা এতদিন স্বীকৃতি দিতে পারি নি। আমরা সবাই জানি যে, ইসরাইলের একটি রাজধানী আছে, যার নাম জেরুজালেম। মধ্যপ্রাচ্যে আমার ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে, কেউই এ নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলে নি।’
কিন্তু, এটিও তো সত্য যে, ১৯৪৮ সাল থেকে অনুসৃত মার্কিন নীতি হলো, জেরুজালেম বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা নির্ধারিত হবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে। এই নীতি তো পাল্টালেন ট্রাম্প। এছাড়া আন্তর্জাতিক নিন্দাও থামছে না। এ ব্যাপারে ওয়াকার বলেন, ‘এখানে সত্যিকার প্রশ্ন হলো, ইসরাইল রাষ্ট্র ও হবু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমান্তরেখা কীভাবে টানা হবে, তা নিয়ে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেছেন, তাতে কিন্তু এই ইস্যুতে আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় নি।’
কিন্তু অবশিষ্ট রাষ্ট্রদূতদের কেউই এ কথা মানতে রাজি নন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যানিয়েল সি. কার্টজার। তার ভাষ্য, ‘ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের অনেক নেতিবাচক দিক আছে। কূটনৈতিকভাবে তো বটে, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াতেও এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কোনো ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) আন্তর্জাতিকভাবে ফের একঘরে হয়ে গেলাম, শুধু ইসরাইল সরকার ছাড়া। প্রেসিডেন্ট বলছেন, তিনি শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতা করতে চান। কিন্তু এই ভূমিকা পালনের সুযোগ আমরা নিজেরাই রুদ্ধ করছি।’ ড্যানিয়েল সি. কার্টজারের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেই বেশিরভাগ রাষ্ট্রদূত সহমত পোষণ করেছেন।
কিন্তু ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে অনেকের যুক্তি হলো, দ্বি-রাষ্ট্র কেন্দ্রীক শান্তি প্রক্রিয়া তো নিস্তেজ হয়ে গেছে। একে নাড়ানোর দরকার ছিল। প্রেসিডেন্ট ঠিক তা-ই করেছেন। এ ব্যাপারে কার্টজার বলেন, ‘শান্তি প্রক্রিয়া মৃতপ্রায়, তা সত্য। কিন্তু এটিকে নাড়া দিতে হলে দরকার ছিল আরও নাটকীয় ভূমিকা। শান্তি প্রক্রিয়াকে পুনর্জ্জীবিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের একপেশে হওয়ার দরকার ছিল না। কেউ আপনাকে বলেনি, এক পক্ষের অবস্থান মেনে নিন, অন্য পক্ষকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিন।’
২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বুশের আমলে রাষ্ট্রদূত ছিলেন রিচার্ড এইচ. জোন্স। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই সিদ্ধান্তকে হামাস ও জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট সহিংসতা উস্কে দিতে ব্যবহার করবে। তিনি অনুমান করেন যে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরাইলকে বয়কটের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করবে। তার মতে, ‘এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। এর ফলে ইসরাইল ও ওই অঞ্চলে অনেকের প্রাণ যাবে। বিশেষ করে, ইসরাইলি সেটেলাররা একে ব্যবহার করে নিজেদের তৎপরতা বৃদ্ধি করবে।’
কিছু রাষ্ট্রদূতের অবশ্য পশ্চিম জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু তারা বলেছেন, এটিও হওয়া উচিত বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে, যাতে করে ইসরাইলিরা তাদের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া স্থগিত বা শ্লথ করে। পাশাপাশি, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। বিল ক্লিনটনের আমলে দুই বার ইসরাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন মার্টিন এস. ইন্ডিক। এ বছর নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক উপ-সম্পাদকীয়তে তিনিও ঠিক এই প্রস্তাবই রেখেছিলেন। সেটি অবশ্য ট্রাম্পের শপথ গ্রহণেরও আগে। এখন তিনি বলছেন, ‘এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, প্রেসিডেন্ট আমার পরামর্শ আমলে নেন নি। আমি বলেছিলেন, জেরুজালেম নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চলুক। তবে তিনি একটা কাজ করেছেন যে, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, তিনি কিন্তু শহরটির সীমানা নির্ধারণ করে দেন নি। কিন্তু উভয় পক্ষই নিজ নিজ স্বার্থে এই সূক্ষ্ম বিষয়টি চেপে যাবে।’
১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন উইলিয়াম আন্দ্রেজ ব্রাউন। পরে ক্লিনটন জমানায় চীফ অব মিশন হিসেবে ফের যান ইসরাইলে। তিনি বলেন, একবার তিনি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরানো হোক। তিনি বলেন, ‘তখন আমার উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রিদ শান্তি আলোচনায় ইসরাইলকে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া।’ ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ আলোচনা কিছুটা বেগ পাওয়ার পরই বিখ্যাত অসলো শান্তি প্রক্রিয়ার জন্ম হয়। আন্দ্রেজ ব্রাউন বলেন, বুশ প্রশাসনে তার ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ছিলেন অনেকেই। তাই তা আর আমলে নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ‘বুশ যদি শেষমেশ তার পরামর্শ আমলে নিতেনও, তবে তা করা হতো খুবই সতর্কতার সঙ্গে, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।’ ব্রাউন মনে করেন, ট্রাম্প যেভাবে কাজটা করেছেন, সেটি ছিল খুবই দৃষ্টিকটু।
উইলিয়াম কাল্ডওয়েল হ্যারপ রাষ্ট্রদূত ছিলেন ১৯৯২ থেকে পরের বছর পর্যন্ত। তার মতে, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ছিল ‘কিছুটা কা-জ্ঞানহীন কাজ, অনেকটা যেন মর্ষকামী পদক্ষেপ।’ হ্যারপ আরও বলেন, ‘ট্রাম্প বারবার ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি আনার ‘গ্রেট ডিলে’র কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজেই নিজের সম্ভাবনাকে খর্ব করেছেন।’ তার মতে, ট্রাম্প নির্দিষ্ট করে বলতে পারতেন তিনি দূতাবাস সরাবেন পশ্চিম জেরুজালেমে। হ্যারপ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষকে আশা দিতে হবে তো। বেশিদিন লাগবে না, আমরা দেখবো ফিলিস্তিনিরা তাদের রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে আরও উঠেপড়ে লেগেছে। ইন্তিফাদার মতো কিছু একটা আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। রক্ত আরও ঝরবে।’
হ্যারপের পরের বছরজুড়ে ইসরাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন এডওয়ার্ড পি. জেরেজিয়ান। তিনি অবশ্য এখনও অসলো শান্তিচুক্তি নিয়ে আশাবাদী। তবে জেরেজিয়ানও মনে করেন ট্রাম্প ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জেরেজিয়ান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্রও ছিলেন। তার মতে, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে, আবার জেরুজালেমের সীমানা নির্দিষ্ট না করে বলার মধ্যে স্ব-বিরোধীতা রয়েছে। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মার্কিন অবস্থান স্পষ্ট করার বদলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বেশি।
প্রেসিডেন্ট বুশ ও বারাক ওবামা - উভয়ের আমলে রাষ্ট্রদূত ছিলেন জেমস বি. কানিংহ্যাম। তিনি মনে করেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বেশ গুরুতর একটি ভুল। তিনি বলেন, দূতাবাস সরানোর পদক্ষেপ যৌক্তিক মনে হতো যদি আপনি তা নিজেকে ব্যতিক্রম প্রমাণের জন্য না করে, কোনো কৌশলের অংশ হিসেবে করতেন। তার মতে, এটি ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র কাউকে অধিকতর নিরাপদ করছে না। মধ্যপ্রাচ্যও স্থিতিশীল হচ্ছে না।
ইসরাইলে নিযুক্ত সর্বশেষ সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল বি. শ্যাপিরো প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, ‘জেরুজালেম ইসরাইলের রাজধানী। একে ওভাবে স্বীকৃতি দেওয়াটা যথাযথ। বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এখানে যে সুযোগ হেলায় হারানো হয়েছে তা হলো এই সিদ্ধান্ত একটি বৃহত্তর কৌশলগত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নেওয়া হয়নি। সেটি হলো দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আরও শলাপরামর্শ করার দরকার পড়তো। এছাড়া ফিলিস্তিনিরা যে জেরুজালেমকে চান, তার কী হবে, সেটিও সুনির্দিষ্ট করে বলা হতো।’ তিনি বলেন, কোনো কৌশলকে মাথায় না রেখে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায়, ট্রাম্পের মেয়ের জামাই ও জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার ও বিশেষ দূত জ্যাসন গ্রিনব্লাট যেই শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছেন, তা বাধাগ্রস্থ হবে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে কারণ কী থাকতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে বেশিরভাগ সাবেক রাষ্ট্রদূতই অনীহা প্রকাশ করেছেন। তবে কেউ কেউ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের কট্টর সমর্থক ও ট্রাম্পের ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান সমর্থকদের তুষ্ট করতেই তিনি এই পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারেন।
তবে রিগ্যান প্রশাসনের আমলে ইসরাইলে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা থমাস আর. পিকারিং বলেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত একটি গুরুতর ভুল। প্রেসিডেন্ট সম্ভবত নিজের ‘ইগো’র কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অথবা, রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সম্পর্ক নিয়ে স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট মুয়েলার যে তদন্ত চালাচ্ছেন, তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতেই তিনি এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
ওয়াগ দ্য ডগ ছবির সঙ্গে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে তুলনা করেন পিকারিং। ছবিটিতে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার নিজের এক যৌন কেলেঙ্কারি থেকে মানুষের মনোযোগ সরাতে রীতিমত যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে।
১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ওগডেন আর. রেইড। তিনিই ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বার্থ্যহীনভাবে একমত পোষণকারী দু’জনের একজন। আইসেনহাওয়ার প্রশাসন নিজেদের বিদায়বেলায় এই সাবেক কংগ্রেসম্যানকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছিল। তার মতে, ‘আমি মনে করি, এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই।’ আরেকজন ব্যতিক্রম ছিলেন এডওয়ার্ড এস. ওয়াকার জুনিয়র। তিনি ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আমলে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি আসলে সময়ের খেলা। বাস্তবতাকে আমরা এতদিন স্বীকৃতি দিতে পারি নি। আমরা সবাই জানি যে, ইসরাইলের একটি রাজধানী আছে, যার নাম জেরুজালেম। মধ্যপ্রাচ্যে আমার ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে, কেউই এ নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলে নি।’
কিন্তু, এটিও তো সত্য যে, ১৯৪৮ সাল থেকে অনুসৃত মার্কিন নীতি হলো, জেরুজালেম বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা নির্ধারিত হবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে। এই নীতি তো পাল্টালেন ট্রাম্প। এছাড়া আন্তর্জাতিক নিন্দাও থামছে না। এ ব্যাপারে ওয়াকার বলেন, ‘এখানে সত্যিকার প্রশ্ন হলো, ইসরাইল রাষ্ট্র ও হবু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমান্তরেখা কীভাবে টানা হবে, তা নিয়ে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেছেন, তাতে কিন্তু এই ইস্যুতে আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় নি।’
কিন্তু অবশিষ্ট রাষ্ট্রদূতদের কেউই এ কথা মানতে রাজি নন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যানিয়েল সি. কার্টজার। তার ভাষ্য, ‘ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের অনেক নেতিবাচক দিক আছে। কূটনৈতিকভাবে তো বটে, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াতেও এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কোনো ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) আন্তর্জাতিকভাবে ফের একঘরে হয়ে গেলাম, শুধু ইসরাইল সরকার ছাড়া। প্রেসিডেন্ট বলছেন, তিনি শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতা করতে চান। কিন্তু এই ভূমিকা পালনের সুযোগ আমরা নিজেরাই রুদ্ধ করছি।’ ড্যানিয়েল সি. কার্টজারের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেই বেশিরভাগ রাষ্ট্রদূত সহমত পোষণ করেছেন।
কিন্তু ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে অনেকের যুক্তি হলো, দ্বি-রাষ্ট্র কেন্দ্রীক শান্তি প্রক্রিয়া তো নিস্তেজ হয়ে গেছে। একে নাড়ানোর দরকার ছিল। প্রেসিডেন্ট ঠিক তা-ই করেছেন। এ ব্যাপারে কার্টজার বলেন, ‘শান্তি প্রক্রিয়া মৃতপ্রায়, তা সত্য। কিন্তু এটিকে নাড়া দিতে হলে দরকার ছিল আরও নাটকীয় ভূমিকা। শান্তি প্রক্রিয়াকে পুনর্জ্জীবিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের একপেশে হওয়ার দরকার ছিল না। কেউ আপনাকে বলেনি, এক পক্ষের অবস্থান মেনে নিন, অন্য পক্ষকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিন।’
২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বুশের আমলে রাষ্ট্রদূত ছিলেন রিচার্ড এইচ. জোন্স। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই সিদ্ধান্তকে হামাস ও জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট সহিংসতা উস্কে দিতে ব্যবহার করবে। তিনি অনুমান করেন যে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরাইলকে বয়কটের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করবে। তার মতে, ‘এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। এর ফলে ইসরাইল ও ওই অঞ্চলে অনেকের প্রাণ যাবে। বিশেষ করে, ইসরাইলি সেটেলাররা একে ব্যবহার করে নিজেদের তৎপরতা বৃদ্ধি করবে।’
কিছু রাষ্ট্রদূতের অবশ্য পশ্চিম জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু তারা বলেছেন, এটিও হওয়া উচিত বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে, যাতে করে ইসরাইলিরা তাদের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া স্থগিত বা শ্লথ করে। পাশাপাশি, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। বিল ক্লিনটনের আমলে দুই বার ইসরাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন মার্টিন এস. ইন্ডিক। এ বছর নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক উপ-সম্পাদকীয়তে তিনিও ঠিক এই প্রস্তাবই রেখেছিলেন। সেটি অবশ্য ট্রাম্পের শপথ গ্রহণেরও আগে। এখন তিনি বলছেন, ‘এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, প্রেসিডেন্ট আমার পরামর্শ আমলে নেন নি। আমি বলেছিলেন, জেরুজালেম নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চলুক। তবে তিনি একটা কাজ করেছেন যে, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, তিনি কিন্তু শহরটির সীমানা নির্ধারণ করে দেন নি। কিন্তু উভয় পক্ষই নিজ নিজ স্বার্থে এই সূক্ষ্ম বিষয়টি চেপে যাবে।’
১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন উইলিয়াম আন্দ্রেজ ব্রাউন। পরে ক্লিনটন জমানায় চীফ অব মিশন হিসেবে ফের যান ইসরাইলে। তিনি বলেন, একবার তিনি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরানো হোক। তিনি বলেন, ‘তখন আমার উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রিদ শান্তি আলোচনায় ইসরাইলকে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া।’ ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ আলোচনা কিছুটা বেগ পাওয়ার পরই বিখ্যাত অসলো শান্তি প্রক্রিয়ার জন্ম হয়। আন্দ্রেজ ব্রাউন বলেন, বুশ প্রশাসনে তার ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ছিলেন অনেকেই। তাই তা আর আমলে নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ‘বুশ যদি শেষমেশ তার পরামর্শ আমলে নিতেনও, তবে তা করা হতো খুবই সতর্কতার সঙ্গে, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।’ ব্রাউন মনে করেন, ট্রাম্প যেভাবে কাজটা করেছেন, সেটি ছিল খুবই দৃষ্টিকটু।
উইলিয়াম কাল্ডওয়েল হ্যারপ রাষ্ট্রদূত ছিলেন ১৯৯২ থেকে পরের বছর পর্যন্ত। তার মতে, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ছিল ‘কিছুটা কা-জ্ঞানহীন কাজ, অনেকটা যেন মর্ষকামী পদক্ষেপ।’ হ্যারপ আরও বলেন, ‘ট্রাম্প বারবার ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি আনার ‘গ্রেট ডিলে’র কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজেই নিজের সম্ভাবনাকে খর্ব করেছেন।’ তার মতে, ট্রাম্প নির্দিষ্ট করে বলতে পারতেন তিনি দূতাবাস সরাবেন পশ্চিম জেরুজালেমে। হ্যারপ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষকে আশা দিতে হবে তো। বেশিদিন লাগবে না, আমরা দেখবো ফিলিস্তিনিরা তাদের রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে আরও উঠেপড়ে লেগেছে। ইন্তিফাদার মতো কিছু একটা আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। রক্ত আরও ঝরবে।’
হ্যারপের পরের বছরজুড়ে ইসরাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন এডওয়ার্ড পি. জেরেজিয়ান। তিনি অবশ্য এখনও অসলো শান্তিচুক্তি নিয়ে আশাবাদী। তবে জেরেজিয়ানও মনে করেন ট্রাম্প ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জেরেজিয়ান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্রও ছিলেন। তার মতে, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে, আবার জেরুজালেমের সীমানা নির্দিষ্ট না করে বলার মধ্যে স্ব-বিরোধীতা রয়েছে। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মার্কিন অবস্থান স্পষ্ট করার বদলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বেশি।
প্রেসিডেন্ট বুশ ও বারাক ওবামা - উভয়ের আমলে রাষ্ট্রদূত ছিলেন জেমস বি. কানিংহ্যাম। তিনি মনে করেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বেশ গুরুতর একটি ভুল। তিনি বলেন, দূতাবাস সরানোর পদক্ষেপ যৌক্তিক মনে হতো যদি আপনি তা নিজেকে ব্যতিক্রম প্রমাণের জন্য না করে, কোনো কৌশলের অংশ হিসেবে করতেন। তার মতে, এটি ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র কাউকে অধিকতর নিরাপদ করছে না। মধ্যপ্রাচ্যও স্থিতিশীল হচ্ছে না।
ইসরাইলে নিযুক্ত সর্বশেষ সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল বি. শ্যাপিরো প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, ‘জেরুজালেম ইসরাইলের রাজধানী। একে ওভাবে স্বীকৃতি দেওয়াটা যথাযথ। বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এখানে যে সুযোগ হেলায় হারানো হয়েছে তা হলো এই সিদ্ধান্ত একটি বৃহত্তর কৌশলগত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নেওয়া হয়নি। সেটি হলো দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আরও শলাপরামর্শ করার দরকার পড়তো। এছাড়া ফিলিস্তিনিরা যে জেরুজালেমকে চান, তার কী হবে, সেটিও সুনির্দিষ্ট করে বলা হতো।’ তিনি বলেন, কোনো কৌশলকে মাথায় না রেখে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায়, ট্রাম্পের মেয়ের জামাই ও জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার ও বিশেষ দূত জ্যাসন গ্রিনব্লাট যেই শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছেন, তা বাধাগ্রস্থ হবে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে কারণ কী থাকতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে বেশিরভাগ সাবেক রাষ্ট্রদূতই অনীহা প্রকাশ করেছেন। তবে কেউ কেউ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের কট্টর সমর্থক ও ট্রাম্পের ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান সমর্থকদের তুষ্ট করতেই তিনি এই পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারেন।
তবে রিগ্যান প্রশাসনের আমলে ইসরাইলে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা থমাস আর. পিকারিং বলেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত একটি গুরুতর ভুল। প্রেসিডেন্ট সম্ভবত নিজের ‘ইগো’র কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অথবা, রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সম্পর্ক নিয়ে স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট মুয়েলার যে তদন্ত চালাচ্ছেন, তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতেই তিনি এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
ওয়াগ দ্য ডগ ছবির সঙ্গে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে তুলনা করেন পিকারিং। ছবিটিতে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার নিজের এক যৌন কেলেঙ্কারি থেকে মানুষের মনোযোগ সরাতে রীতিমত যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেন।
No comments