আনিসুল হক, আপনাকে শ্রদ্ধা
মেয়র
আনিসুল হক তার নির্বাচনী জনসভায় ভোটারদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনাদের জন্য
কাজ করব- ‘আমি আমার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাঁচ বছরের ছুটি নিয়ে
এসেছি’। তার সেই ছুটির মেয়াদ ফুরানোর আগেই তিনি ছুটি নিয়ে চলে গেলেন আমাদের
কাছ থেকে। তার এই চলে যাওয়া কোনোভাবেই কাম্য ছিল না নগরবাসীর কাছে।
নগরবাসী তাকে নগরপিতার আসনে অধিষ্ঠিত করে আস্থা পোষণ করেছিল, তিনি পারবেন।
সে আস্থা পূরণে তিনি মাঠে নেমেছিলেন। মাঠে নেমে কাজ করতে গিয়ে নগরের ছোট-বড়
মাফিয়ার রক্তচক্ষুর উপলক্ষও হয়ে পড়েছিলেন। হয়েছেন তাদের দ্বারা
‘অবরুদ্ধ’ও। তারপরও থেমে যাননি। কোনো রক্তচক্ষু, কোনো হুমকি-ধমকিকে ভয়
পাননি তিনি- কর্তব্যে এমন অটল থাকার উদাহরণ জানামতে খুবই বিরল। সবাই যখন
আপসে সমর্পিত হন তখন তিনি অবিচল থেকে জনগণের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করেছেন।
এভাবেই হয়ে উঠেছিলেন তাদের নেতা। সেটি বোঝা যায়নি যখন তিনি বেঁচে ছিলেন,
বোঝা গেল তার আকস্মিক তিরধানে। মহানগরের সর্বস্তরের মানুষ চোখের পানিতে
বিদায় জানিয়েছেন। সার্থক জীবন প্রসঙ্গে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়, ‘যেদিন
তুমি এসেছিলে সেদিন কেঁদেছিলে, সবাই হেসেছিল। যে দিন চলে যাবে সেদিন তুমি
হেসে চলে যাবে, আর অন্য সবাই কাঁদবে।’ এমনটিই হয়েছে মেয়র আনিসুল হকের
বেলায়। আমাদের গতানুগতিক প্রাত্যহিক জীবনযাপনে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র,
উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তার কাজের ধরন একেবারেই তার মতো। কর্মে ছিলেন
নিখাদ আন্তরিক। যখন যে কাজটি করেছেন তা করেছেন সর্বোচ্চ নিষ্ঠা আর গভীর
আন্তরিকতায়- ফলে সাফল্য অর্জন করেছেন। জন্মগত নেতৃত্বের যে গুণ তা তাকে
সর্বত্রই অনুসরণ করেছে। দেশের গণমাধ্যমে এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ডের বেলায়ও। আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যে দেশে খণ্ডিত পরিচয়ের
দাপটে প্রায় সব কিছু সংঘটিত হয়। খণ্ডিত পরিচয়ের বাইরে যেন দাঁড়ানোর জায়গাই
মেলে না কারও- আনিসুল হক সেই খণ্ডিত পরিচিতির বাইরে- সাধারণ মানুষের একজন
হিসেবে নিজের পরিচয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
২. মহানগরী ঢাকার যে জনসংখ্যা তার অর্ধেক অনেক দেশেও নেই। এমন একটি মহানগরীর অর্ধেক অংশের নগরপিতার দায়িত্ব বর্তেছিল তার কাঁধে। এ দায়িত্ব মোটেই সুসহ নয়, বরং দুর্বহই। তদুপরি এমন এক নগরীতে এমন এক সময়ে যখন সেই নগরীর অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ‘নাগরিক কর্তব্যবোধ’ প্রায় অনুপস্থিত! এমন বন্ধুর পথে তিনি যাত্রা শুরু করেন। বলা চলে, অনিবার্য ব্যর্থতার কণ্টকাকীর্ণ গন্তব্যে। সেই যাত্রায় শুভানুধ্যায়ীরা যখন তার নিশ্চিত ব্যর্থতার ওপর বাজি ধরছিল তখনও তিনি তার সংশপ্তক অভিযাত্রা থেকে পিছু হটেননি। ব্যর্থও হননি। যে কটি কাজে হাত লাগিয়েছেন সফলও হয়েছেন। তিনি জানতেন- তিনি কী করতে চান, কতটুকু করণীয় আর কতটুকুই বা তার বলার অধিকার। এই পরিমিতিবোধ তার ছিল। এ কথা সত্যি বারো রকম মানুষের তেরো রকম চাহিদা। আর বহুমাত্রিক ঢাকা মহানগরীর ‘নাগরিক’দের সহস্র-সহস্রাধিক পারস্পরিক সাংঘর্ষিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ এক সুকঠিন কাজ। সেই সুকঠিন কাজটিকেই কর্তব্য হিসেবে পালনের প্রয়াস পেয়েছিলেন আনিসুল হক। বহু কায়েমি-অকায়েমি স্বার্থ-সংশ্লিষ্টসহ মাফিয়া-অমাফিয়া, বিত্তবান, মধ্যবিত্ত, হকার, দরিদ্র- সবার স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে যানজটে স্থবির, নিশ্চল মহানগরীকে গতিশীল করার কাজেও তিনি হাত দিয়েছিলেন। প্রতিদিন মহানগরীর পথে চলাচলের যে বিড়ম্বনা, পরিবহন ব্যবস্থার যে মরণোন্মুুখ পরিণতি তারও একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার রোডম্যাপ তুলে ধরেছিলেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি তার পরিবারের কাছ থেকে নেয়া ছুটির সময়টা সত্যি সত্যি সাধারণ মানুষের কাজে ব্যয় করে তার অংশের ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এ কাজপাগল মেয়রকে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সম্মান জানিয়েছেন- আরও কাজ করে। এমন উদাহরণ কি বাংলাদেশের আর কোনো জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে আছে? শ্রদ্ধা জানানো ওইসব পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাছ থেকে আমরা যদি কিছু শিক্ষা নিতাম তাহলে আর কিছু না হোক নিজের চেতনাকে পরিচ্ছন্ন করে অন্তত তার প্রতি সর্বান্তকরণে শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম।
৩. তার প্রিয় কবিতা- ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে।
আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।
তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে।
নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে।
স্মরণের গ্রন্থি টুটে
যে যায় ছুটে
বিশ্বপথে বন্ধনহীন।’
এই উদ্ধৃতি দিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া ও মিলাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে নগরবাসীকে। জীবনকে যিনি নক্ষত্রলোকের আমন্ত্রণ বলে জানেন, সেই মহাজাগতিক যাত্রাপথের অভিযাত্রী হয়তো জীবনের বন্ধন ছাড়িয়ে যাত্রা করেন অমরালোকের উদ্দেশে। কিন্তু স্মরণের বন্ধন ছিন্ন করে আনিসুল হক বিস্মৃতির অন্ধকারে যে কখনোই তলিয়ে যাবেন না- এ কথা আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণে লিখেছিলেন-
‘এনেছিলে সাথে করে
মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই তুমি
করে গেলে দান।’
দেশবন্ধু আর আনিসুল হকরা মৃত্যুহীন। কোনো ক্ষয় তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তারা দীপ জ্বালিয়ে যান চিরকাল। জীবন বিলিয়ে যান মানুষের কল্যাণে। যাওয়ার বেলায় হাসি মুখে বলে যান, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’।
আনিসুল হক, আপনাকে শ্রদ্ধা।
সাইফুল আলম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, যুগান্তর
২. মহানগরী ঢাকার যে জনসংখ্যা তার অর্ধেক অনেক দেশেও নেই। এমন একটি মহানগরীর অর্ধেক অংশের নগরপিতার দায়িত্ব বর্তেছিল তার কাঁধে। এ দায়িত্ব মোটেই সুসহ নয়, বরং দুর্বহই। তদুপরি এমন এক নগরীতে এমন এক সময়ে যখন সেই নগরীর অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ‘নাগরিক কর্তব্যবোধ’ প্রায় অনুপস্থিত! এমন বন্ধুর পথে তিনি যাত্রা শুরু করেন। বলা চলে, অনিবার্য ব্যর্থতার কণ্টকাকীর্ণ গন্তব্যে। সেই যাত্রায় শুভানুধ্যায়ীরা যখন তার নিশ্চিত ব্যর্থতার ওপর বাজি ধরছিল তখনও তিনি তার সংশপ্তক অভিযাত্রা থেকে পিছু হটেননি। ব্যর্থও হননি। যে কটি কাজে হাত লাগিয়েছেন সফলও হয়েছেন। তিনি জানতেন- তিনি কী করতে চান, কতটুকু করণীয় আর কতটুকুই বা তার বলার অধিকার। এই পরিমিতিবোধ তার ছিল। এ কথা সত্যি বারো রকম মানুষের তেরো রকম চাহিদা। আর বহুমাত্রিক ঢাকা মহানগরীর ‘নাগরিক’দের সহস্র-সহস্রাধিক পারস্পরিক সাংঘর্ষিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ এক সুকঠিন কাজ। সেই সুকঠিন কাজটিকেই কর্তব্য হিসেবে পালনের প্রয়াস পেয়েছিলেন আনিসুল হক। বহু কায়েমি-অকায়েমি স্বার্থ-সংশ্লিষ্টসহ মাফিয়া-অমাফিয়া, বিত্তবান, মধ্যবিত্ত, হকার, দরিদ্র- সবার স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে যানজটে স্থবির, নিশ্চল মহানগরীকে গতিশীল করার কাজেও তিনি হাত দিয়েছিলেন। প্রতিদিন মহানগরীর পথে চলাচলের যে বিড়ম্বনা, পরিবহন ব্যবস্থার যে মরণোন্মুুখ পরিণতি তারও একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার রোডম্যাপ তুলে ধরেছিলেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি তার পরিবারের কাছ থেকে নেয়া ছুটির সময়টা সত্যি সত্যি সাধারণ মানুষের কাজে ব্যয় করে তার অংশের ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এ কাজপাগল মেয়রকে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সম্মান জানিয়েছেন- আরও কাজ করে। এমন উদাহরণ কি বাংলাদেশের আর কোনো জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে আছে? শ্রদ্ধা জানানো ওইসব পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাছ থেকে আমরা যদি কিছু শিক্ষা নিতাম তাহলে আর কিছু না হোক নিজের চেতনাকে পরিচ্ছন্ন করে অন্তত তার প্রতি সর্বান্তকরণে শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম।
৩. তার প্রিয় কবিতা- ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে।
আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।
তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে।
নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে।
স্মরণের গ্রন্থি টুটে
যে যায় ছুটে
বিশ্বপথে বন্ধনহীন।’
এই উদ্ধৃতি দিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া ও মিলাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে নগরবাসীকে। জীবনকে যিনি নক্ষত্রলোকের আমন্ত্রণ বলে জানেন, সেই মহাজাগতিক যাত্রাপথের অভিযাত্রী হয়তো জীবনের বন্ধন ছাড়িয়ে যাত্রা করেন অমরালোকের উদ্দেশে। কিন্তু স্মরণের বন্ধন ছিন্ন করে আনিসুল হক বিস্মৃতির অন্ধকারে যে কখনোই তলিয়ে যাবেন না- এ কথা আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণে লিখেছিলেন-
‘এনেছিলে সাথে করে
মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই তুমি
করে গেলে দান।’
দেশবন্ধু আর আনিসুল হকরা মৃত্যুহীন। কোনো ক্ষয় তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তারা দীপ জ্বালিয়ে যান চিরকাল। জীবন বিলিয়ে যান মানুষের কল্যাণে। যাওয়ার বেলায় হাসি মুখে বলে যান, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’।
আনিসুল হক, আপনাকে শ্রদ্ধা।
সাইফুল আলম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, যুগান্তর
No comments