খালেদা জিয়াকে চায় বিএনপি ফের জয়ী হতে মরিয়া আ’লীগ
দিনাজপুর
সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে দিনাজপুর-৩ (সদর) আসন। এ
আসনটিতে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ৫ বার, বিএনপি ৩ বার ও জাতীয় পার্টি
জয়লাভ করেছে একবার। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী
অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রার্থী এসএ বারী এটি, ১৯৮৬
সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, ১৯৮৮ সালে জাতীয়
পার্টির প্রার্থী অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের
প্রার্থী এম আবদুর রহিম, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপির প্রার্থী খুরশীদ জাহান
হক বিজয়ী হন। এরা সবাই এখন প্রয়াত। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন
আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইকবালুর রহিম। যিনি বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ।
নির্বাচনে বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
বর্তমান সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিমের অবস্থানও বেশ শক্ত। অপরদিকে বিএনপির
চেয়ারপারসনের বড় বোন সাবেক মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হকের মৃত্যুর পর এ আসনে
প্রার্থী সংকটে পড়েছে বিএনপি। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা চান দলের
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ আসনের হাল ধরবেন। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী
হিসেবে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক
সম্পাদক আহমেদ শফি রুবেল মোটামুটি চূড়ান্ত। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এ আসনটি দখলে
ছিল বিএনপির। কিন্তু ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
ইকবালুর রহিম এ আসনে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থীকে পরাজিত করে আওয়ামী
লীগের নিয়ন্ত্রণে নেন আসনটি। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো জয়লাভের পর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে জাতীয় সংসদের হুইপ নির্বাচিত করে
প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়েছেন। ইকবালুর রহিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের পশ্চিমাঞ্চলীয়
জোনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এম আবদুর রহিমের ছেলে। হুইপ ইকবালুর রহিম
তৃতীয় লিঙ্গের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য মানবপল্লী নামে পৃথক আবাসন ব্যবস্থা
নির্মাণ, বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখায় ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ ফেডারেশনের (ডব্লিউএলএফ) সোশ্যাল ইনোভেটর
ক্যাটাগরিতে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড়
ময়দানকে দেশের বড় ঈদগাহ ময়দানে রূপান্তর করেছেন।
তিন মাস আগে তার উদ্যোগে
সদর উপজেলার প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে। তার
পরিকল্পনায় আত্রাই নদীর ওপর রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে যা হাজার হাজার
কৃষকের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজকে
আধুনিকায়ন করে এ এলাকার মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করেছেন।
জাতীয় সংসদের হুইপ হলেও নির্বাচনী এলাকায় তিনি যথেষ্ট সময় দিয়ে থাকেন।
ইকবালুর রহিম বলেন, এলাকায় সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার
চেষ্টা করে যাচ্ছি। দলীয় মনোনয়ন পেলে আবারও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হব বলে
মনে করি। এ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম
সাধারণ সম্পাদক মির্জা আশফাক হোসেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতির পর
বর্তমানে মূল দলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন তিনি। তিনি
বলেন, মনোনয়ন পেতে এলাকায় মিটিং, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে
যাচ্ছি। মনোনয়ন পেলে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে পারব বলে
আশাবাদী। তবে যিনিই মনোনয়ন পাবেন নৌকার বিজয় অব্যাহত রাখতে তার পক্ষেই কাজ
করব। মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
ফারুকুজ্জামান চৌধুরী মাইকেল। তিনি সাংগঠনিক কার্যক্রম ছাড়াও মনোনয়ন পাওয়ার
ব্যাপারে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি জানান, ছাত্রাবস্থায় থেকে
দলের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হলেও দল
যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা মেনেই কাজ করবেন। এ আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায়
বিএনপি। ২০০১ সালে খুরশীদ জাহান হক এ আসনে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত
হওয়ার পর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী হন। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় বোন হওয়ার সুবাদে দিনাজপুরে শিক্ষা বোর্ড,
জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালসহ বেশকিছু উন্নয়ন কাজ করেছেন তিনি।
কিন্তু
তার মৃত্যুর পর এখানে বিএনপির প্রার্থিতায় শূন্যতা দেখা দেয়। ২০০৮ সালে
পঞ্চগড় থেকে ডেকে এনে এ আসনে প্রার্থী করা হয় জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির
সভাপতি শফিউল আলম প্রধানকে। তিনি চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ
প্রতীকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইকবালুর রহিমের কাছে পরাজিত
হন। এবার এ আসনটি পুনরুদ্ধারে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী
চান স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। আর যদি তিনি এ আসনে প্রার্থী না হন তাহলে
আরও ৪ জনের নাম আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় স্থায়ী
কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি
ও বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফর রহমান মিন্টু, দিনাজপুর পৌর মেয়র সৈয়দ
জাহাঙ্গীর আলম এবং প্রয়াত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হকের বড় ছেলে শাহরিয়ার
আকতার হক ডন। তবে খালেদা জিয়া প্রার্থী না হলে তারেক জিয়ার স্ত্রী ডা.
জোবাইদা রহমানের নামও শোনা যাচ্ছে। দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রার্থী হওয়া
না-হওয়ার ওপরই বিএনপির সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। দিনাজপুর জেলা বিএনপির
আহ্বায়ক এজেডএম রেজওয়ানুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমি যতদূর জানি- দলের
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াই দিনাজপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। তাছাড়া
দিনাজপুরের মানুষও দিনাজপুর-৩ আসনে ‘ম্যাডামকে’ প্রার্থী হিসেবে চায়।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান বাবু জানান, এ আসনটিতে
প্রার্থী হিসেবে তাদের সবার চাওয়া বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। তিনি এ
এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছেন, এক সময়ে এ আসন থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে
মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তারই বড় বোন খুরশীদ জাহান হক।
যদি সেটি না হয়
তাহলে বিএনপি থেকে যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তার হয়েই কাজ করবেন। বিএনপির
কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত
দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনিও চান খালেদা জিয়াই এ
আসন থেকে নির্বাচন করুক। আর যদি তিনি এ আসনে প্রার্থী না হন, সে ক্ষেত্রে
সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম মনোনয়ন চাইবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলেও এ এলাকার
ভোটাররা অনেক ঝুঁকি নিয়ে ধানের শীষ প্রতীকে দ্বিতীয়বারের মতো দিনাজপুর
পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত করেছেন। শুধু পৌরসভা নয়, গোটা সদর উপজেলার মানুষ
আমাকে ভালোবাসেন। জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফর রহমান মিন্টু জানান,
যদি খালেদা জিয়া প্রার্থী না হন তাহলে তিনি দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থীর জন্য
মনোনয়ন চাইবেন। তিনি দিনাজপুর-৬ অথবা দিনাজপুর-৩ আসন থেকে মনোনয়ন চান বলে
জানান বিএনপির এ নেতা। জাতীয় পার্টির প্রার্থী দিনাজপুর জেলা জাতীয় পার্টির
সাধারণ সম্পাদক ও পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ শফি
রুবেল। আহমেদ শফি রুবেল জানান, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ
এরশাদ ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী প্রার্থী
হতে কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তাকে বলা হয়েছে। আর এ নির্দেশ অনুযায়ী
তিনি জনমানুষের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। রুবেল বলেন, এ আসনে আওয়ামী লীগ ও
বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে, জাতীয় পার্টিতে নেই। দিনাজপুরে যতই উন্নয়ন
হোক, এর সূচনা হয়েছে জাতীয় পার্টির আমলে। এ আসনের মানুষের জাতীয় পার্টি ও
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি দুর্বলতা আছে। এ ‘ইমেজকে’ কাজে লাগিয়ে জাতীয়
পার্টির মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী হতে চাই।
No comments