ব্র্যাকেটবন্দী বিএনপি, ব্র্যাকেটমুক্ত বিএনপি by সোহরাব হাসান
ভয়মুক্ত নন ক্ষমতাসীনেরা:
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় বিএনপি এখন সংসদের বাইরে। তারপরও
জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৪ সালজুড়ে
গণসংযোগ ও মহাসমাবেশ করে আসছিলেন। কিন্তু লন্ডন থেকে অদৃশ্য সুতার টানে
কোথা থেকে কী হয়ে গেল। সেখান থেকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান
ইতিহাস নিয়ে একেকটি অ্যাটম বোমা ছুড়তে থাকেন আর বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঘটতে
থাকে। অবশ্য এই অ্যাটম বোমার পেছনে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার ‘জিয়ার
আইএসআই সংযোগতত্ত্ব’ও কাজ করেছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
চলতি বছরের শুরুতে বিএনপির তিন মাসব্যাপী হরতাল-অবরোধে পেট্রলবোমা ও আগুনে পুড়ে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পর দলটির প্রকাশ্য কার্যক্রম এখন দলীয় অফিসে রুটিন প্রেস ব্রিফিং, আদালতে মামলা মোকাবিলা এবং ঘরোয়া আলোচনা সভা বা সেমিনারের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে। তারপরও বিএনপি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দারুণ উৎকণ্ঠা লক্ষ করা যায় মন্ত্রী-নেতাদের বিরতিহীন বক্তৃতা-বিবৃতিতে। অনেকের মতে, নিষ্ক্রিয় বিএনপিকে এখন আওয়ামী লীগের নেতারাই ‘সক্রিয়’ রেখেছেন। চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের কাছ থেকে ধার করে, তেমনি বাংলাদেশে বিরোধী দলের জনসমর্থনের জন্যও নিজেদের কিছু করতে হয় না। ক্ষমতাসীনদের বাড়াবাড়ির কারণেই ‘মধ্যবর্তী’ ভোটাররা বিরোধী দলের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিজস্ব ভোটব্যাংক যত সমৃদ্ধই হোক না কেন, তাতে ‘মধ্যবর্তী’ ভোট ছাড়া নৌকা কিংবা ধানের শীষ কারও জিতে আসা সম্ভব নয়। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচন সেটাই প্রমাণ করে। এই ‘মধ্যবর্তী’ ভোটাররা যে দলকে ভোট দিয়েছেন, সে দলই জিতেছে।
তাই, ক্ষমতাসীনেরা মুখে যতই বিএনপিকে জনগণ থেকে ধিক্কৃত ও নিন্দিত বলে বুলন্দ আওয়াজ তুলুক না কেন, ভেতরে-ভেতরে ভয় রয়েই গেছে। নাবিক বুদ্ধিমান হলে উজানে নৌকা না চালিয়ে অনুকূল স্রোত তৈরি করেন। অন্য দলের দোষ খোঁজার চেয়ে নিজ দলের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে তুলতে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতাসীনেরা সে রকম শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে হয় না। এমনকি তারা যে জনগণের নামে রাজনীতি করেন, সেই জনগণের রায়ের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল সব সময় থাকেন না। ফলে নির্বাচনে হেরে গেলেই তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ আনেন এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন। পরবর্তী পাঁচ বছর তারা সরকারকে রাজপথে ফেলে দেওয়ার আন্দোলনে ব্যস্ত থাকেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনেরা দায়িত্ব গ্রহণের পয়লা দিন থেকেই সবকিছু বিজয়ীর দখলে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এখানে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা পরস্পরের কাছ থেকে যে শিক্ষা নেন, তা হলো আমার জন্য যা অবশ্যকর্তব্য, তোমার জন্য তা হারাম। তোমার জন্য যা অবশ্যপালনীয়, আমার জন্য তা পরিত্যাজ্য। আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দল এভাবেই ‘গণতান্ত্রিক কর্মসম্পর্ক’ গড়ে তুলেছে। তবে ৫ জানুয়ারির পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
বিএনপি যদি এতই গণধিক্কৃত ও নিন্দিত দল হয়ে থাকে, তাহলে তাদের নিয়ে প্রতিদিন মন্ত্রী ও নেতাদের গলা ফাটানোর প্রয়োজন পড়ে না। তাদের কৃত অপরাধ ও দুষ্কর্মগুলো সবারই জানা। কিন্তু সেসবের পরও কেন মানুষ ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিরূপ, সেটি একবার চিন্তা করা উচিত। আওয়ামী লীগের বক্তৃতাবাজ নেতাদের বলব, বিএনপি নিয়ে ঘুম হারাম না করে একটু জনগণের সমস্যার দিকে নজর দিন। উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের মধ্যেও ঢাকা শহর প্রায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। শহরের রাস্তাঘাটের দুরবস্থা অবর্ণনীয়। ভিভিআইপি সড়ক ছাড়া সর্বত্রই খানাখন্দে ভরা। এ ব্যাপারে কি গণবান্ধব সরকারের কিংবা সরকারের বিশ্বস্ত দুই মেয়রের কিছুই করণীয় নেই?
খালেদা জিয়ার ফেরা না-ফেরা: গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর ফেরা না-ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন চলছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে যে বিচার–প্রক্রিয়া এড়াতেই তিনি লন্ডন গিয়েছেন এবং শিগগিরই দেশে ফিরছেন না। কিন্তু বিএনপির নেতাদের দাবি, তিনি চিকিৎসা ও ছেলেকে দেখতে লন্ডন গিয়েছেন এবং শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন। তবে বিএনপির কোনো কোনো নেতা এ কথাও বলছেন যে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলেও সেখানে দল ও রাজনীতি নিয়ে কথা হবে। যেহেতু তারেক রহমান দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান, সেহেতু সাংগঠনিক বিষয় এবং দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতেই পারে। বিএনপি দীর্ঘদিন চলেছে স্থায়ী মহাসচিব ছাড়া। আগামী ডিসেম্বরে দলের সম্মেলন হলে অস্থায়ী মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও কেউ কেউ আভাস দিচ্ছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন লন্ডন থাকতেই দেশে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। এই সময়েই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এতে আপিল বিভাগ কর্তৃক তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পথ প্রশস্ত হলো। তাঁরা দুজনই রিভিউয়ের জন্য যে আবেদন করেছেন এবং তাও অবিলম্বে নিষ্পত্তি হবে আশা করা যায়। এরই মধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা ঢাকায় ও ৩ অক্টোবর জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি রংপুরে আততায়ীর হাতে নিহত হন। ক্ষমতাসীনদের দাবি, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তাঁরা বিএনপির প্রতিই সন্দেহের তির ছুড়ছেন। কুনিও হোশি হত্যার ঘটনায় যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বিএনপি ও যুবদলের নেতা-কর্মীও আছেন। তবে তদন্তকারী সংস্থা এখনো হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বিএনপি নেত্রীর নাম ধরে অভিযোগ করছেন। এ অবস্থায় তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চলছে। কেউ বলছেন, তিনি শিগগিরই ফিরে আসবেন। আবার কারও মতে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন।
এদিকে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করার সিদ্ধান্তকে বিএনপি দুরভিসন্ধিমূলক বললেও শেষ পর্যন্ত দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন দলের চেয়ারপারসনই। ডিসেম্বরে দুই শতাধিক পৌরসভায় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী মনে করেন, চ্যালেঞ্জ হিসেবে হলেও নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া উচিত। নির্বাচনী প্রচারের সুযোগে দলের প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাবেন। বিএনপি নির্বাচনে গেলে ভালো ফল করবে বলেও আশাবাদী তাঁরা। নির্বাচনে না গেলে সরকার এ কথা বলার সুযোগ পাবে যে জামায়াতে ইসলামীর কারণেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী জামায়াত দলীয়ভাবে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
ব্র্যাকেটবন্দী-ব্র্যাকেটমুক্ত: সম্প্রতি দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের নেতারা সেটিকে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির কাজ বলে অভিযোগ করেছিলেন। এ বিষয়ে ডেইলি স্টার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেছেন, ‘সব ব্যাপারে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী করা উচিত নয়। বিএনপি জামায়াতের রাজনীতি করে না। বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন ও নীতি আছে। সে অনুযায়ী বিএনপি চলে। গণতন্ত্র উদ্ধারে বিএনপি যে ২০-দলীয় জোট করেছে, জামায়াত তার একটি শরিক মাত্র। এর আগে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তাই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিকে ব্র্যাকেটবন্দী করা ঠিক নয়।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির জোট নিয়ে দলের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। দলের উদারপন্থীরা মনে করেন, মৌলবাদী এই দলটির সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপি লাভবান হয়নি। তাঁরা মনে করেন, বিএনপির উচিত সময় ও সুযোগমতো জামায়াতকে ত্যাগ করা। বিএনপি যে সরকারবিরোধী সব শক্তিকে এক করতে চাইছে, তারও অন্তরায় জামায়াত। তাদের ধারণা, বিএনপি জামায়াতকে ছাড়লেই সরকারবিরোধী বৃহত্তর মোর্চা হতে পারে। আর সেটি শুধু রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই নয়, জামায়াত যে রাজনৈতিক দর্শন ও নীতি পোষণ করে, তা কখনোই গণতন্ত্রের সহায়ক নয়।
পত্রিকায় খবর দেখলাম, বিএনপি নেত্রী নাকি জামায়াতকে সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়েই দল করার কথা বলেছেন। তাঁর সেই যুক্তি মেনে নিলে বিএনপির ভেতরের সংস্কারটি আরও বেশি জরুরি। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরও তাঁকে স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ না দেওয়া সংস্কারের লক্ষণ নয়।
বিএনপি নেতারা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, পাঁচ বছরের জোট সরকারের শাসন এবং নয় বছরের জোটীয় রাজনীতি বিএনপি নিজেকে জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী করে ফেলেছে। এই ব্র্যাকেট মুক্ত করতে হলে কেবল মুখে বিএনপির রাজনীতি আলাদা বললে হবে না, কাজেও তার প্রমাণ দিতে হবে। সেটি কীভাবে সম্ভব? প্রথমত, বিএনপিকে প্রকাশ্যে বলতে হবে, তারাও যুদ্ধাপরাধের বিচার সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, দলে যেসব যুদ্ধাপরাধী আছেন, তাঁরা দণ্ডিত হোন বা অভিযুক্ত, তাঁদের দল থেকে বের করে দিতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষমতায় থাকাকালে দলের যেসব নেতা-কর্মী জঙ্গিবাদীদের মদদ দিয়েছেন, নানাভাবে সহায়তা করেছেন, যাঁরা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার জোগানদার হয়ে কাজ করেছেন, যাঁরা জজ মিয়া কাহিনি বানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বের পক্ষে সেটি করা সম্ভব হবে না, যদি না তাঁরা লন্ডনের গ্রিন সিগন্যাল পান। তত তিন হয়তো বিএনপিকে ব্র্যাকেটবন্দী হয়েই থাকতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
চলতি বছরের শুরুতে বিএনপির তিন মাসব্যাপী হরতাল-অবরোধে পেট্রলবোমা ও আগুনে পুড়ে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পর দলটির প্রকাশ্য কার্যক্রম এখন দলীয় অফিসে রুটিন প্রেস ব্রিফিং, আদালতে মামলা মোকাবিলা এবং ঘরোয়া আলোচনা সভা বা সেমিনারের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে। তারপরও বিএনপি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দারুণ উৎকণ্ঠা লক্ষ করা যায় মন্ত্রী-নেতাদের বিরতিহীন বক্তৃতা-বিবৃতিতে। অনেকের মতে, নিষ্ক্রিয় বিএনপিকে এখন আওয়ামী লীগের নেতারাই ‘সক্রিয়’ রেখেছেন। চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের কাছ থেকে ধার করে, তেমনি বাংলাদেশে বিরোধী দলের জনসমর্থনের জন্যও নিজেদের কিছু করতে হয় না। ক্ষমতাসীনদের বাড়াবাড়ির কারণেই ‘মধ্যবর্তী’ ভোটাররা বিরোধী দলের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিজস্ব ভোটব্যাংক যত সমৃদ্ধই হোক না কেন, তাতে ‘মধ্যবর্তী’ ভোট ছাড়া নৌকা কিংবা ধানের শীষ কারও জিতে আসা সম্ভব নয়। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচন সেটাই প্রমাণ করে। এই ‘মধ্যবর্তী’ ভোটাররা যে দলকে ভোট দিয়েছেন, সে দলই জিতেছে।
তাই, ক্ষমতাসীনেরা মুখে যতই বিএনপিকে জনগণ থেকে ধিক্কৃত ও নিন্দিত বলে বুলন্দ আওয়াজ তুলুক না কেন, ভেতরে-ভেতরে ভয় রয়েই গেছে। নাবিক বুদ্ধিমান হলে উজানে নৌকা না চালিয়ে অনুকূল স্রোত তৈরি করেন। অন্য দলের দোষ খোঁজার চেয়ে নিজ দলের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে তুলতে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতাসীনেরা সে রকম শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে হয় না। এমনকি তারা যে জনগণের নামে রাজনীতি করেন, সেই জনগণের রায়ের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল সব সময় থাকেন না। ফলে নির্বাচনে হেরে গেলেই তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ আনেন এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন। পরবর্তী পাঁচ বছর তারা সরকারকে রাজপথে ফেলে দেওয়ার আন্দোলনে ব্যস্ত থাকেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনেরা দায়িত্ব গ্রহণের পয়লা দিন থেকেই সবকিছু বিজয়ীর দখলে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এখানে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা পরস্পরের কাছ থেকে যে শিক্ষা নেন, তা হলো আমার জন্য যা অবশ্যকর্তব্য, তোমার জন্য তা হারাম। তোমার জন্য যা অবশ্যপালনীয়, আমার জন্য তা পরিত্যাজ্য। আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দল এভাবেই ‘গণতান্ত্রিক কর্মসম্পর্ক’ গড়ে তুলেছে। তবে ৫ জানুয়ারির পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
বিএনপি যদি এতই গণধিক্কৃত ও নিন্দিত দল হয়ে থাকে, তাহলে তাদের নিয়ে প্রতিদিন মন্ত্রী ও নেতাদের গলা ফাটানোর প্রয়োজন পড়ে না। তাদের কৃত অপরাধ ও দুষ্কর্মগুলো সবারই জানা। কিন্তু সেসবের পরও কেন মানুষ ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিরূপ, সেটি একবার চিন্তা করা উচিত। আওয়ামী লীগের বক্তৃতাবাজ নেতাদের বলব, বিএনপি নিয়ে ঘুম হারাম না করে একটু জনগণের সমস্যার দিকে নজর দিন। উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের মধ্যেও ঢাকা শহর প্রায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। শহরের রাস্তাঘাটের দুরবস্থা অবর্ণনীয়। ভিভিআইপি সড়ক ছাড়া সর্বত্রই খানাখন্দে ভরা। এ ব্যাপারে কি গণবান্ধব সরকারের কিংবা সরকারের বিশ্বস্ত দুই মেয়রের কিছুই করণীয় নেই?
খালেদা জিয়ার ফেরা না-ফেরা: গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর ফেরা না-ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন চলছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে যে বিচার–প্রক্রিয়া এড়াতেই তিনি লন্ডন গিয়েছেন এবং শিগগিরই দেশে ফিরছেন না। কিন্তু বিএনপির নেতাদের দাবি, তিনি চিকিৎসা ও ছেলেকে দেখতে লন্ডন গিয়েছেন এবং শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন। তবে বিএনপির কোনো কোনো নেতা এ কথাও বলছেন যে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলেও সেখানে দল ও রাজনীতি নিয়ে কথা হবে। যেহেতু তারেক রহমান দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান, সেহেতু সাংগঠনিক বিষয় এবং দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতেই পারে। বিএনপি দীর্ঘদিন চলেছে স্থায়ী মহাসচিব ছাড়া। আগামী ডিসেম্বরে দলের সম্মেলন হলে অস্থায়ী মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও কেউ কেউ আভাস দিচ্ছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন লন্ডন থাকতেই দেশে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। এই সময়েই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এতে আপিল বিভাগ কর্তৃক তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পথ প্রশস্ত হলো। তাঁরা দুজনই রিভিউয়ের জন্য যে আবেদন করেছেন এবং তাও অবিলম্বে নিষ্পত্তি হবে আশা করা যায়। এরই মধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা ঢাকায় ও ৩ অক্টোবর জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি রংপুরে আততায়ীর হাতে নিহত হন। ক্ষমতাসীনদের দাবি, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তাঁরা বিএনপির প্রতিই সন্দেহের তির ছুড়ছেন। কুনিও হোশি হত্যার ঘটনায় যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বিএনপি ও যুবদলের নেতা-কর্মীও আছেন। তবে তদন্তকারী সংস্থা এখনো হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বিএনপি নেত্রীর নাম ধরে অভিযোগ করছেন। এ অবস্থায় তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চলছে। কেউ বলছেন, তিনি শিগগিরই ফিরে আসবেন। আবার কারও মতে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন।
এদিকে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করার সিদ্ধান্তকে বিএনপি দুরভিসন্ধিমূলক বললেও শেষ পর্যন্ত দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন দলের চেয়ারপারসনই। ডিসেম্বরে দুই শতাধিক পৌরসভায় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী মনে করেন, চ্যালেঞ্জ হিসেবে হলেও নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া উচিত। নির্বাচনী প্রচারের সুযোগে দলের প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাবেন। বিএনপি নির্বাচনে গেলে ভালো ফল করবে বলেও আশাবাদী তাঁরা। নির্বাচনে না গেলে সরকার এ কথা বলার সুযোগ পাবে যে জামায়াতে ইসলামীর কারণেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী জামায়াত দলীয়ভাবে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
ব্র্যাকেটবন্দী-ব্র্যাকেটমুক্ত: সম্প্রতি দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের নেতারা সেটিকে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির কাজ বলে অভিযোগ করেছিলেন। এ বিষয়ে ডেইলি স্টার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেছেন, ‘সব ব্যাপারে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী করা উচিত নয়। বিএনপি জামায়াতের রাজনীতি করে না। বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন ও নীতি আছে। সে অনুযায়ী বিএনপি চলে। গণতন্ত্র উদ্ধারে বিএনপি যে ২০-দলীয় জোট করেছে, জামায়াত তার একটি শরিক মাত্র। এর আগে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তাই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিকে ব্র্যাকেটবন্দী করা ঠিক নয়।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির জোট নিয়ে দলের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। দলের উদারপন্থীরা মনে করেন, মৌলবাদী এই দলটির সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপি লাভবান হয়নি। তাঁরা মনে করেন, বিএনপির উচিত সময় ও সুযোগমতো জামায়াতকে ত্যাগ করা। বিএনপি যে সরকারবিরোধী সব শক্তিকে এক করতে চাইছে, তারও অন্তরায় জামায়াত। তাদের ধারণা, বিএনপি জামায়াতকে ছাড়লেই সরকারবিরোধী বৃহত্তর মোর্চা হতে পারে। আর সেটি শুধু রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই নয়, জামায়াত যে রাজনৈতিক দর্শন ও নীতি পোষণ করে, তা কখনোই গণতন্ত্রের সহায়ক নয়।
পত্রিকায় খবর দেখলাম, বিএনপি নেত্রী নাকি জামায়াতকে সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়েই দল করার কথা বলেছেন। তাঁর সেই যুক্তি মেনে নিলে বিএনপির ভেতরের সংস্কারটি আরও বেশি জরুরি। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরও তাঁকে স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ না দেওয়া সংস্কারের লক্ষণ নয়।
বিএনপি নেতারা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, পাঁচ বছরের জোট সরকারের শাসন এবং নয় বছরের জোটীয় রাজনীতি বিএনপি নিজেকে জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী করে ফেলেছে। এই ব্র্যাকেট মুক্ত করতে হলে কেবল মুখে বিএনপির রাজনীতি আলাদা বললে হবে না, কাজেও তার প্রমাণ দিতে হবে। সেটি কীভাবে সম্ভব? প্রথমত, বিএনপিকে প্রকাশ্যে বলতে হবে, তারাও যুদ্ধাপরাধের বিচার সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, দলে যেসব যুদ্ধাপরাধী আছেন, তাঁরা দণ্ডিত হোন বা অভিযুক্ত, তাঁদের দল থেকে বের করে দিতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষমতায় থাকাকালে দলের যেসব নেতা-কর্মী জঙ্গিবাদীদের মদদ দিয়েছেন, নানাভাবে সহায়তা করেছেন, যাঁরা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার জোগানদার হয়ে কাজ করেছেন, যাঁরা জজ মিয়া কাহিনি বানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বের পক্ষে সেটি করা সম্ভব হবে না, যদি না তাঁরা লন্ডনের গ্রিন সিগন্যাল পান। তত তিন হয়তো বিএনপিকে ব্র্যাকেটবন্দী হয়েই থাকতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments