স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে প্রয়োজন আরও বিতর্ক by কামাল আহমেদ
স্থানীয়
সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের জন্য আইন সংশোধনের কথা অনেক
আগেই জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি
যখন এই পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, তখন তিনি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। তবে
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পরিবর্তন এলেও পরিকল্পনায় যে হেরফের ঘটেনি, তা
এখন স্পষ্ট। বরং আগে যেখানে ধারণা ছিল যে আইনের সংশোধনীটি সংসদে পাস করার
পরই এই পরিবর্তন আসবে, সেখানে এখন এটি করা হচ্ছে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ
জারির মাধ্যমে। কেননা, সংসদে আলোচনা, কমিটিতে বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদি করার
মতো যথেষ্ট সময় সরকারের হাতে নেই।
সৈয়দ আশরাফের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে ব্রিটেনে এবং ব্রিটিশ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ধরন-ধারণ ও পদ্ধতিটি তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করলেও করে থাকতে পারে। আর আমরা যেহেতু ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রকে অনুসরণের কথা অহরহই বলে থাকি, সেহেতু স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় তাদের মডেলটি কেন নয়? তবে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলমান বিতর্কে এই ধারণার পক্ষে-বিপক্ষে যেসব কথা উঠেছে, সেগুলো একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে।
এই ব্যবস্থার পক্ষে একটা বড় যুক্তি হচ্ছে, এখন যেভাবে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা বা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়, সেগুলোর সবই শুধু নাম ছাড়া বাস্তবে দলভিত্তিক প্রতিযোগিতা। দলই মনোনয়ন ঠিক করে, দলই সাংগঠনিকভাবে দলীয় মনোনয়নধারীর পক্ষে প্রচারকাজে নামে, ভোটারদেরও একটি বড় অংশ দলীয় আনুগত্য অনুসারে ভোট দেন এবং নির্বাচিত ব্যক্তিরা দলীয় বিবেচনা ও স্বার্থে তাঁদের কাজ পরিচালনা করে থাকেন। যে কারণে আগে দেখা যেত, প্রার্থীর পোস্টারে দলীয় প্রধানের ছবি। এখন সেটি বন্ধ হলেও তাঁদের সভা-সমাবেশ-মিছিলে দলীয় স্লোগান যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনি দলের নেতারা প্রার্থীর পক্ষে সভা করা ও লিফলেট বিতরণের মতো কাজে অংশ নিয়ে চলেছেন। বরং নির্বাচনী আচরণবিধিতে একজন প্রার্থীর জন্য অফিস বা প্রচার ক্যাম্পের সীমা নির্ধারিত থাকায় দলীয় কার্যালয়গুলো তাঁদের বাড়তি সাহায্য জোগায়। কখনো কখনো সেগুলোই হয়ে ওঠে ক্যাম্পেইন হেডকোয়ার্টার বা প্রার্থীর প্রধান দপ্তর।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের পক্ষে আরেকটা বড় যুক্তি এই যে দলের তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব গড়ে তোলায় এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এই ধারায় ইউনিয়ন পরিষদের স্তর থেকে সংসদে উঠে এসেছেন, এমন নজিরও আছে। সংসদ নির্বাচনে যাঁরা মনোনয়ন পাননি তাঁরা জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় কাজ করার সুযোগ পেতে পারেন। দলের ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী এলাকার উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন এবং তা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারেন। একই সঙ্গে এলাকাবাসী সাংসদকে কাছে না পেলেও সমস্যা নেই, তাঁরা স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে নির্বাচনব্যবস্থার আরেকটি সুবিধা হচ্ছে দলের একাধিক নেতার স্বাধীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুটা হলেও কমবে। কেননা, দল থেকে একাধিক নেতা প্রার্থী হলে তা সাধারণত বিরোধী রাজনৈতিক প্রার্থীর জন্য বাড়তি সুবিধা করে দেয়। ফলে কোনো এলাকায় দল শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও শুধু দলীয় শৃঙ্খলা প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় সেখানে বিরোধী পক্ষ নির্বাচিত হয়ে যায়। এতে করে সেখানে বিরোধী রাজনীতি শক্তিশালী ও সংহত হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কেউ অরাজনৈতিক বা নির্দলীয় খোলসে নির্বাচিত হয়ে পরে প্রতিপক্ষকে সাহায্য করতে পারবেন না।
আবার যাঁরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের বিরোধী, তাঁদের যুক্তিগুলোও ফেলনা নয়। তাঁদের প্রধান আশঙ্কা, দলীয় সরকারের অধীনে দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। কার্যত বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার রেকর্ড বিরল। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য যে ধরনের নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন, সে রকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা যেটুকু তৈরি হয়েছিল, তা-ও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বরং এখন নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের একটি অধিদপ্তরের কাজের ধরনের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য করা যায় না।
দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে যেসব রাজনৈতিক দল, তাদের মধ্যে বিএনপির প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। তারা বলেছে যে সরকারের দলীয়করণ নীতির অংশ হিসেবেই এই পরিবর্তন করা হচ্ছে এবং স্থানীয় সরকারে ভিন্নমতের প্রতিনিধিত্ব যাতে না থাকে, তা নিশ্চিত করাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য। তাদের এই প্রতিক্রিয়া মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। কেননা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা যেসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল, সেসব জায়গায় তার সুফল তারা ঘরে তুলতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলের মেয়রদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও যেখানে তাঁরা বহালতবিয়তে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, সেখানে বিএনপির মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের অধিকাংশেরই পরিণতি হয়েছে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে পদচ্যুতি বা অপসারণ (জনপ্রতিনিধি অপসারণে সরকারের দ্বৈতনীতি, প্রথম আলো, ২৭ মার্চ, ২০১৫)। প্রবণতাটি এ রকম—প্রথমে মামলা, যেগুলোকে অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা বলে সন্দেহ করেন এবং তারপর পদ থেকে অপসারণে মন্ত্রণালয়ের নোটিশ। অতীতে মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিরা উচ্চ আদালত থেকে সুরক্ষা পেলেও সাম্প্রতিককালে তেমনটি আর দেখা যায় না।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলে নতুন সংশোধনী আনা হলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়র, চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলর-সদস্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধান স্পষ্ট। বলা হচ্ছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো কারণে নির্বাচন সম্ভব না হলে সরকার প্রশাসক নিয়োগ করে কাজ চালাবে। উত্তরসূরি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকার সুযোগ আর থাকবে না। কিন্তু আইনপ্রণেতাদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটি হয়েছে এমন যে তাঁদের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে বর্তমান সাংসদেরাই কাজ চালিয়ে যাবেন। অনির্বাচিত কেউ সরকার পরিচালনায় থাকতে পারেন না, এই যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থারও বিলোপ ঘটানো হয়েছে। অথচ অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা পরিচালনার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে।
নতুন সংস্কারের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ইংল্যান্ড ও ভারতের যে দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়, সেটি আসলে কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ভারতে নির্বাচনী ব্যবস্থায় যতটা সংস্কার হয়েছে, আমরা কি তার ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পেরেছি? মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি পৌর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটকেন্দ্রে দখলবাজির বিরুদ্ধে সেখানকার নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপগুলোর কথা আমরা কি আমাদের দেশে ভাবতে পারি? কিছু ভোটকেন্দ্রে দখল ও ভোটদানে বাধা সৃষ্টির কারণে পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কয়েকজন সাংসদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করায় তিনি পদত্যাগ করেন (আনন্দবাজার, ৭ অক্টোবর, ২০১৫)। আমাদের দেশে এ রকম কোনো নজির কি কেউ দেখাতে পারবেন?
আর ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রচর্চার যে দীর্ঘ ইতিহাস, তাতে উপর্যুপরি অনুশীলনের মাধ্যমে তারা এমন একটা উন্নত মান ঠিক করে ফেলেছে, যা রাতারাতি আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। সেখানে দলের নিয়মিত চাঁদা প্রদানকারী সদস্যদের ভোটে প্রার্থী ঠিক হয়, প্রার্থীরা প্রচলিত রীতিনীতি মেনে প্রচারকাজ চালান, খরচের সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ নেই বললেই চলে, দলের ভূমিকা দখলদারি মানসিকতায় পরিচালিত হয় না এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত। প্রতিটি পৌর কর্তৃপক্ষের (কাউন্সিল বা লোকাল অথোরিটি) প্রধান নির্বাহী নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকরিবিধি (পাবলিক সার্ভিস কোড) অনুযায়ী কাউন্সিলের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোনো দলের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ভোটের দিনে তাঁদের কেউ লেবার পার্টির লাল, কনজারভেটিভদের নীল কিংবা লিবারেলদের হলুদ রংওয়ালা কোনো কাপড় (টাই, স্কার্ফ বা হ্যাট) পরে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেন না। বিপরীতে আমাদের দেশে সরকারি কর্মচারীদের পেশাজীবী সংগঠনের খোলসে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির কথা নিশ্চয়ই কাউকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ইংল্যান্ডে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা মেয়রের খেয়ালখুশিতে চলে না। অনেকটা মন্ত্রিসভার আদলে তাঁরা কাজ করেন। নিয়মিত জবাবদিহির ব্যবস্থাটিও বেশ পাকাপোক্ত। লন্ডনের মেয়রের যে দপ্তর, সেই ভবনে প্রতি মাসে তিনি নির্বাচিত অন্য জনপ্রতিনিধিদের (কাউন্সিলরের সমতুল্য) মুখোমুখি হয়ে জেরার মুখোমুখি হন। সেই সভাও হয় সাধারণ নাগরিকদের উপস্থিতিতে। সামাজিক স্বার্থ জড়িত আছে, এমন বিষয়ে নীতিমালা তৈরি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিকদের মতামত গ্রহণ সেখানে বাধ্যতামূলক।
ইংল্যান্ডে কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বা তাদের পরিচালিত নাগরিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো (স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল ইত্যাদি) পরিচালনায় সাংসদদের কোনো ক্ষমতা বা ভূমিকা নেই। অথচ আমরা আইন করে উপজেলা পরিষদে সাংসদকে যেমন উপদেষ্টা বানিয়ে ক্ষমতায়িত করেছি, তেমনি নাগরিক সেবার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সব কটিতেই তাঁদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিয়েছি।
বাংলাদেশে এখন অনেক জেলা আছে, যেখানে সেই এলাকার সাংসদ সেখানকার সব প্রতিষ্ঠানে তাঁর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভাই-ভাতিজা এমনকি স্ত্রী হচ্ছেন পৌরসভা বা উপজেলার চেয়ারম্যান, বৃহত্তর পরিবারের (আত্মীয়কুল ধরে) অন্য কোনো সদস্য ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষমতায়, জেলা চেম্বারের মূল পদে, স্কুল-কলেজের পরিচালনা বোর্ডে, মূল দল এবং অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্বে। অর্থাৎ সাংসদের পরিবারই জেলার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় এসব সাংসদের পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য পেলে দেশে বারো ভূঁইয়াদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে বেশি দিন লাগবে না বলেই মনে হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় তাদের একটা আনুষ্ঠানিক ভূমিকা থাকারই কথা। কিন্তু সেটা চালু করার জন্য আমরা যে প্রস্তুত নই, সে কথাটিও সত্য। তাড়াহুড়ো করে এটি চালু করলে তার ফল ভালো না হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার এবং নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রায়ণ না হওয়ায় জাতীয় পর্যায়ে যেমন সুশাসন অধরাই রয়ে গেছে, তেমনি স্থানীয় সরকারব্যবস্থাতেও তা দলীয় শাসন বা অপশাসনের জন্ম দিতে পারে। ওয়েস্টমিনস্টার মডেল অনুসরণের নামে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের যে নজিরবিহীন দুর্দশা ঘটিয়েছি, সেই একই ভাগ্য কি অপেক্ষা করছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক।
সৈয়দ আশরাফের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে ব্রিটেনে এবং ব্রিটিশ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ধরন-ধারণ ও পদ্ধতিটি তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করলেও করে থাকতে পারে। আর আমরা যেহেতু ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রকে অনুসরণের কথা অহরহই বলে থাকি, সেহেতু স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় তাদের মডেলটি কেন নয়? তবে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলমান বিতর্কে এই ধারণার পক্ষে-বিপক্ষে যেসব কথা উঠেছে, সেগুলো একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে।
এই ব্যবস্থার পক্ষে একটা বড় যুক্তি হচ্ছে, এখন যেভাবে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা বা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়, সেগুলোর সবই শুধু নাম ছাড়া বাস্তবে দলভিত্তিক প্রতিযোগিতা। দলই মনোনয়ন ঠিক করে, দলই সাংগঠনিকভাবে দলীয় মনোনয়নধারীর পক্ষে প্রচারকাজে নামে, ভোটারদেরও একটি বড় অংশ দলীয় আনুগত্য অনুসারে ভোট দেন এবং নির্বাচিত ব্যক্তিরা দলীয় বিবেচনা ও স্বার্থে তাঁদের কাজ পরিচালনা করে থাকেন। যে কারণে আগে দেখা যেত, প্রার্থীর পোস্টারে দলীয় প্রধানের ছবি। এখন সেটি বন্ধ হলেও তাঁদের সভা-সমাবেশ-মিছিলে দলীয় স্লোগান যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনি দলের নেতারা প্রার্থীর পক্ষে সভা করা ও লিফলেট বিতরণের মতো কাজে অংশ নিয়ে চলেছেন। বরং নির্বাচনী আচরণবিধিতে একজন প্রার্থীর জন্য অফিস বা প্রচার ক্যাম্পের সীমা নির্ধারিত থাকায় দলীয় কার্যালয়গুলো তাঁদের বাড়তি সাহায্য জোগায়। কখনো কখনো সেগুলোই হয়ে ওঠে ক্যাম্পেইন হেডকোয়ার্টার বা প্রার্থীর প্রধান দপ্তর।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের পক্ষে আরেকটা বড় যুক্তি এই যে দলের তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব গড়ে তোলায় এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এই ধারায় ইউনিয়ন পরিষদের স্তর থেকে সংসদে উঠে এসেছেন, এমন নজিরও আছে। সংসদ নির্বাচনে যাঁরা মনোনয়ন পাননি তাঁরা জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় কাজ করার সুযোগ পেতে পারেন। দলের ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী এলাকার উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন এবং তা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারেন। একই সঙ্গে এলাকাবাসী সাংসদকে কাছে না পেলেও সমস্যা নেই, তাঁরা স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে নির্বাচনব্যবস্থার আরেকটি সুবিধা হচ্ছে দলের একাধিক নেতার স্বাধীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুটা হলেও কমবে। কেননা, দল থেকে একাধিক নেতা প্রার্থী হলে তা সাধারণত বিরোধী রাজনৈতিক প্রার্থীর জন্য বাড়তি সুবিধা করে দেয়। ফলে কোনো এলাকায় দল শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও শুধু দলীয় শৃঙ্খলা প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় সেখানে বিরোধী পক্ষ নির্বাচিত হয়ে যায়। এতে করে সেখানে বিরোধী রাজনীতি শক্তিশালী ও সংহত হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কেউ অরাজনৈতিক বা নির্দলীয় খোলসে নির্বাচিত হয়ে পরে প্রতিপক্ষকে সাহায্য করতে পারবেন না।
আবার যাঁরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের বিরোধী, তাঁদের যুক্তিগুলোও ফেলনা নয়। তাঁদের প্রধান আশঙ্কা, দলীয় সরকারের অধীনে দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। কার্যত বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার রেকর্ড বিরল। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য যে ধরনের নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন, সে রকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা যেটুকু তৈরি হয়েছিল, তা-ও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বরং এখন নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের একটি অধিদপ্তরের কাজের ধরনের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য করা যায় না।
দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে যেসব রাজনৈতিক দল, তাদের মধ্যে বিএনপির প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। তারা বলেছে যে সরকারের দলীয়করণ নীতির অংশ হিসেবেই এই পরিবর্তন করা হচ্ছে এবং স্থানীয় সরকারে ভিন্নমতের প্রতিনিধিত্ব যাতে না থাকে, তা নিশ্চিত করাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য। তাদের এই প্রতিক্রিয়া মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। কেননা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা যেসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল, সেসব জায়গায় তার সুফল তারা ঘরে তুলতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলের মেয়রদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও যেখানে তাঁরা বহালতবিয়তে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, সেখানে বিএনপির মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের অধিকাংশেরই পরিণতি হয়েছে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে পদচ্যুতি বা অপসারণ (জনপ্রতিনিধি অপসারণে সরকারের দ্বৈতনীতি, প্রথম আলো, ২৭ মার্চ, ২০১৫)। প্রবণতাটি এ রকম—প্রথমে মামলা, যেগুলোকে অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা বলে সন্দেহ করেন এবং তারপর পদ থেকে অপসারণে মন্ত্রণালয়ের নোটিশ। অতীতে মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিরা উচ্চ আদালত থেকে সুরক্ষা পেলেও সাম্প্রতিককালে তেমনটি আর দেখা যায় না।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলে নতুন সংশোধনী আনা হলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়র, চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলর-সদস্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধান স্পষ্ট। বলা হচ্ছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো কারণে নির্বাচন সম্ভব না হলে সরকার প্রশাসক নিয়োগ করে কাজ চালাবে। উত্তরসূরি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকার সুযোগ আর থাকবে না। কিন্তু আইনপ্রণেতাদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটি হয়েছে এমন যে তাঁদের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে বর্তমান সাংসদেরাই কাজ চালিয়ে যাবেন। অনির্বাচিত কেউ সরকার পরিচালনায় থাকতে পারেন না, এই যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থারও বিলোপ ঘটানো হয়েছে। অথচ অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা পরিচালনার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে।
নতুন সংস্কারের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ইংল্যান্ড ও ভারতের যে দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়, সেটি আসলে কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ভারতে নির্বাচনী ব্যবস্থায় যতটা সংস্কার হয়েছে, আমরা কি তার ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পেরেছি? মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি পৌর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটকেন্দ্রে দখলবাজির বিরুদ্ধে সেখানকার নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপগুলোর কথা আমরা কি আমাদের দেশে ভাবতে পারি? কিছু ভোটকেন্দ্রে দখল ও ভোটদানে বাধা সৃষ্টির কারণে পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কয়েকজন সাংসদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করায় তিনি পদত্যাগ করেন (আনন্দবাজার, ৭ অক্টোবর, ২০১৫)। আমাদের দেশে এ রকম কোনো নজির কি কেউ দেখাতে পারবেন?
আর ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রচর্চার যে দীর্ঘ ইতিহাস, তাতে উপর্যুপরি অনুশীলনের মাধ্যমে তারা এমন একটা উন্নত মান ঠিক করে ফেলেছে, যা রাতারাতি আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। সেখানে দলের নিয়মিত চাঁদা প্রদানকারী সদস্যদের ভোটে প্রার্থী ঠিক হয়, প্রার্থীরা প্রচলিত রীতিনীতি মেনে প্রচারকাজ চালান, খরচের সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ নেই বললেই চলে, দলের ভূমিকা দখলদারি মানসিকতায় পরিচালিত হয় না এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত। প্রতিটি পৌর কর্তৃপক্ষের (কাউন্সিল বা লোকাল অথোরিটি) প্রধান নির্বাহী নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকরিবিধি (পাবলিক সার্ভিস কোড) অনুযায়ী কাউন্সিলের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোনো দলের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ভোটের দিনে তাঁদের কেউ লেবার পার্টির লাল, কনজারভেটিভদের নীল কিংবা লিবারেলদের হলুদ রংওয়ালা কোনো কাপড় (টাই, স্কার্ফ বা হ্যাট) পরে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেন না। বিপরীতে আমাদের দেশে সরকারি কর্মচারীদের পেশাজীবী সংগঠনের খোলসে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির কথা নিশ্চয়ই কাউকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ইংল্যান্ডে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা মেয়রের খেয়ালখুশিতে চলে না। অনেকটা মন্ত্রিসভার আদলে তাঁরা কাজ করেন। নিয়মিত জবাবদিহির ব্যবস্থাটিও বেশ পাকাপোক্ত। লন্ডনের মেয়রের যে দপ্তর, সেই ভবনে প্রতি মাসে তিনি নির্বাচিত অন্য জনপ্রতিনিধিদের (কাউন্সিলরের সমতুল্য) মুখোমুখি হয়ে জেরার মুখোমুখি হন। সেই সভাও হয় সাধারণ নাগরিকদের উপস্থিতিতে। সামাজিক স্বার্থ জড়িত আছে, এমন বিষয়ে নীতিমালা তৈরি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিকদের মতামত গ্রহণ সেখানে বাধ্যতামূলক।
ইংল্যান্ডে কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বা তাদের পরিচালিত নাগরিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো (স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল ইত্যাদি) পরিচালনায় সাংসদদের কোনো ক্ষমতা বা ভূমিকা নেই। অথচ আমরা আইন করে উপজেলা পরিষদে সাংসদকে যেমন উপদেষ্টা বানিয়ে ক্ষমতায়িত করেছি, তেমনি নাগরিক সেবার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সব কটিতেই তাঁদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিয়েছি।
বাংলাদেশে এখন অনেক জেলা আছে, যেখানে সেই এলাকার সাংসদ সেখানকার সব প্রতিষ্ঠানে তাঁর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভাই-ভাতিজা এমনকি স্ত্রী হচ্ছেন পৌরসভা বা উপজেলার চেয়ারম্যান, বৃহত্তর পরিবারের (আত্মীয়কুল ধরে) অন্য কোনো সদস্য ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষমতায়, জেলা চেম্বারের মূল পদে, স্কুল-কলেজের পরিচালনা বোর্ডে, মূল দল এবং অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্বে। অর্থাৎ সাংসদের পরিবারই জেলার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় এসব সাংসদের পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য পেলে দেশে বারো ভূঁইয়াদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে বেশি দিন লাগবে না বলেই মনে হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় তাদের একটা আনুষ্ঠানিক ভূমিকা থাকারই কথা। কিন্তু সেটা চালু করার জন্য আমরা যে প্রস্তুত নই, সে কথাটিও সত্য। তাড়াহুড়ো করে এটি চালু করলে তার ফল ভালো না হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার এবং নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রায়ণ না হওয়ায় জাতীয় পর্যায়ে যেমন সুশাসন অধরাই রয়ে গেছে, তেমনি স্থানীয় সরকারব্যবস্থাতেও তা দলীয় শাসন বা অপশাসনের জন্ম দিতে পারে। ওয়েস্টমিনস্টার মডেল অনুসরণের নামে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের যে নজিরবিহীন দুর্দশা ঘটিয়েছি, সেই একই ভাগ্য কি অপেক্ষা করছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক।
No comments