পঁচাত্তরের নভেম্বর: অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান by এইচ এম এ গাফফার
সেনাপ্রধান নিয়োগের পর মেজর জেনারেলের ব্যাজ পরানো হয় খালেদ মোশাররফকে |
পঁচাত্তরের
৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল যখন বঙ্গবন্ধুর
খুনি চক্রকে উৎখাত করার উদ্যোগ নেন, তখন ২২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের
অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার। সে সময়ের
ঘটনাবলি ও তাঁর নিজের সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন এই লেখায়।
৩ নভেম্বরের আগেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল বঙ্গভবন থেকে পথভ্রষ্ট খুনি চক্রকে উৎখাত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের এই সিদ্ধান্তের কথা কর্নেল তাহের কিংবা অন্য কাউকে বলেননি। ৩ নভেম্বর ভোরেই ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের ব্যাটালিয়নগুলো থেকে সেনাদল পাঠিয়ে বঙ্গভবন অবরোধ করা হলো। সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁর গৃহে অন্তরীণ করা হলো এবং তাঁর টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো। এ ছাড়া বাইরে থেকে অন্তরীণকারী হাউস গার্ড ছাড়া কাউকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা নিষিদ্ধ করা হলো। কারণ, আমরা প্রথম থেকেই তাঁকে খুনি চক্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সন্দেহ করতাম। প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলো। নতুন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের আদেশবলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সেনাপ্রধান এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হলো।
কিন্তু ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষক’ হিসেবে সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাই জিয়াকে অন্তরীণ রাখাকে সৈনিকেরা পছন্দ করেনি। খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বরের পর বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে কোনো চেষ্টা করেননি, কিংবা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও সব অফিসার ও জওয়ানদের উদ্দেশে কোনো দরবার কিংবা কনফারেন্সের ব্যবস্থা করেননি। ফলে তাঁর অনুগত ব্যাটালিয়নগুলো ছাড়া সারা সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে তিনি অচেনা-অজানাই রয়ে গেলেন। অপর দিকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি রেডিও এবং টেলিভিশনে কোনো বক্তব্য দিলেন না। ফলে দেশবাসীও তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধকারে রয়ে গেল।
ইতিমধ্যে কর্নেল তাহের এবং জাসদের নেতারা প্রচারণা চালালেন যে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল সাফায়াত জামিল ‘ভারতের দালাল’। এই প্রচারণা সব ব্যারাকে দ্রুত লিফলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিল ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সদস্যরা। ফলে সৈনিক ও জাতীয়তাবাদী জনতার মধ্যে খালেদের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেল। এই সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিল। খালেদের ছোট ভাই রাশেদ মোশাররফ (আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ) ও তাঁর মা ধানমন্ডিতে একটি মিছিল বের করেন, যেখানে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিষয়ে অনেক স্লোগান দেওয়া হয়। প্রায় সব পত্রিকা এই মিছিলের খবর প্রচার করেছিল। এই মিছিলের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ধারণা হলো যে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি মূলত ভারতপন্থী ও আওয়ামী লীগের অভ্যুত্থান। প্রকৃতপক্ষে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ কখনোই ভারতপন্থী
ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী। যুদ্ধের সময়ও আমি লক্ষ করেছিলাম যে ভারতীয় জেনারেলরা খালেদকে কখনোই বিশ্বাস করতেন না। অথচ কর্নেল তাহের তাঁর দলীয় সর্বশক্তি নিয়োগ করে দ্রুত এই দেশপ্রেমিক বীরকে একজন বিশ্বাসঘাতক বিদেশি দালাল বলে ব্র্যান্ডিং করে দিতে সমর্থ হলেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল, যেন যেকোনো মুহূর্তে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে দিয়ে বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাঁর ওই ভাষণ জাতির কাছে তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পেল না।
৬ নভেম্বর দিনের বেলা কর্নেল শাফায়াত জামিল আমাকে ও আমার ইউনিটকে (২২তম ইস্ট বেঙ্গল) নির্দেশ দিলেন যে একটি পদাতিক কোম্পানিকে মহাখালী চৌরাস্তায় এমনভাবে অবস্থান গ্রহণ করাতে, যাতে গুলশান-বনানীর দিক থেকে কোনো বিদেশি শহরে আসতে না পারেন এবং কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারেন। আমার আরেকটা কোম্পানিকে বঙ্গভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত করলাম। এই কোম্পানিকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের একটি দায়িত্বরত কোম্পানির কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতে আদেশ করা হলো। আমার তৃতীয় কোম্পানিটি, যেটি আগেই মানিকগঞ্জে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল, সেটিকে সেখানেই থাকতে বলা হলো। আমার চতুর্থ কোম্পানিটিকে রিজার্ভ হিসেবে ব্যাটালিয়ন সদরে রাখার আদেশ করা হলো। আমি তখন কমান্ডারকে অনুরোধ করলাম যে আমার জন্য নির্ধারিত নির্দেশাবলি যেন আমাকে লিখিত আকারে দেওয়া হয়। ফলে কমান্ডার আমাকে লিখিতভাবে আদেশগুলো প্রদান করলেন। লিখিত আদেশ পাওয়ার পরই আমি আমার তিনটি কোম্পানিকে আদেশানুযায়ী নিয়োজিত করলাম। উল্লেখ্য, এই লিখিত আদেশটির কপি আমাকে পরবর্তীকালে সামরিক আদালতে আমার সপক্ষে শক্তিশালী যুক্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
আমাদের অভ্যুত্থানবিরোধী জাসদের প্রচারণা যখন তুঙ্গে, তখন ৬ নভেম্বর রাত আনুমানিক ১০টায় ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল আমাকে টেলিফোনে আদেশ দিলেন, যেন আমি তাড়াতাড়ি আমার ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে গিয়ে ব্যাটালিয়নের নিয়ন্ত্রণ করি। ব্যাটালিয়নে পৌঁছে আমি সরাসরি আমার অফিসের দিকে এগোচ্ছিলাম। এ সময় আমি ইঞ্জিনিয়ার্স ও অর্ডন্যান্স কোরের কিছু সৈনিককে আমার ইউনিটের গেটের সামনে জটলা করতে দেখলাম। তারা উত্তেজিতভাবে কিছু একটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিল। আমি আমার সুবেদার মেজর চান মিয়াকে ডাকলাম এবং কী ব্যাপার তা জানতে চাইলাম। চান মিয়া আমাকে জানাল যে ‘স্যার, ওরা কী যেন একটা লিফলেট পেয়েছে, তাই নিয়ে আলোচনা করছে এবং তারা অস্বাভাবিকভাবে উত্তেজিত।’ আমি তাদের আমার কাছে ডাকতে বললাম। প্রথমে তো তারা আসতেই চায়নি, একটু পরে গড়িমসি করে কাছে এলে তাদের আমার খুবই অস্বাভাবিক মনে হলো। কথাবার্তা শুনেও মনে হলো তারা অপ্রকৃতিস্থ। আমি তাদের শান্ত হতে বললাম এবং স্বাভাবিক আচরণ করতে বললাম। আমি তাদের আমার ইউনিটের সামনে জটলা ও হইচই করতে নিষেধ করে চলে যেতে বললাম।
জাসদের প্রতি অনুগত ওই উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদের বিদায় করে আমি আমার অফিসে ঢুকে আমার চেয়ারে বসলাম। ঘটনাচক্রে আমার চেয়ারটি ঠিক যেখানে থাকার কথা ছিল, সেখান থেকে একটু সরিয়ে একপাশে বসে ছিলাম। এমন সময় আমার সামনের খোলা দরজা দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের একঝাঁক গুলি আমার চেয়ারের স্বাভাবিক অবস্থান বরাবর পেছনের দেয়ালে এসে বিঁধল। আমার সুবেদার মেজর চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘স্যার! সর্বনাশ হয়েছে। শিগগির আমার সঙ্গে আসেন।’ আমরা দ্রুত ঘরের পেছনের জানালা টপকে বাইরে চলে এলাম। ইতিমধ্যে আমার ব্যাটালিয়নের ২৫-৩০ জন সৈনিক একত্র হয়ে আমার কাছে চলে এল এবং আমাকে ঘিরে দাঁড়াল।
যা-ই হোক, বুঝতে পারছিলাম যে একটা পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার্সের যেদিক থেকে গুলি আসছিল, তা এড়িয়ে আমরা রেললাইনের দিকে হেঁটে গেলাম। আমরা রেললাইন আর ময়মনসিংহ সড়কটি পার হয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করলাম। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে একত্র হওয়া সৈন্যদের সংখ্যা ৫০ পেরিয়ে গেছে। আমরা সবাই সশস্ত্র এবং যেকোনো অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। সেখান থেকে আমরা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে স্টাফ রোডের অফিসার্স কোয়ার্টারগুলোর একটিতে লে. কর্নেল ডা. জামানের বাসার গেটে নক করলাম। কর্নেল জামান নিজেই গেট খুলে দিলে আমি তাঁকে বললাম যে আমার ৫০ জন সৈন্যসহ আমি অবস্থানের জন্য একটা নিরিবিলি স্থান চাই। উনি আমাকে তাঁর পাঁচিলঘেরা বাসার সামনের লনটা দেখিয়ে বললেন, আপনি এখানেই অবস্থান করতে পারেন। লনে বেশ কিছু গাছ আর ঝোপঝাড়সহ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ ছিল।
কিছু পরে আমি আর আমার সুবেদার মেজর সৈনিকদের দুই ভাগে ভাগ করে রেললাইন ধরে দক্ষিণ দিকে হেঁটে অগ্রসর হতে লাগলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ দেখলাম বিপ্লবী সৈনিকদের আর একটি দল স্লোগান দিতে দিতে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে, অর্থাৎ আমাদের দিকে আসছে। আমরাও তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অফিসারদের মুণ্ডুপাত করে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চললাম। আমাদের পাশ কাটানোর সময় তারা স্লোগান দিল, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। কিছু দূর এগিয়ে আমরা কুর্মিটোলা গলফ মাঠে পৌঁছালাম। তখন মাঠের পশ্চিম দিকে অবস্থিত সেনা ভবনে গিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সৌভাগ্য যে সেনা ভবনে তখন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকেরা ডিউটি করছিল। তখন ৭ নভেম্বরের ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা সেনা ভবনের পেছনে থাকা একটি ছোট গেট দিয়ে ভবনে প্রবেশ করলাম।
আমি সেনা ভবনের দরজার কাছেই দেখলাম মে. জে. (অব) সফিউল্লাহ তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে বারান্দায় বসে উচ্চ স্বরে কোরআন তিলাওয়াত করছেন। আমি সংক্ষেপে সেই রাতের অভিজ্ঞতা তাঁকে জানালাম এবং এই অবস্থায় আমার করণীয় কী তা জানতে চাইলাম। তিনি হাস্যকরভাবে তাঁর হাতের দুটি তালু উল্টে দিয়ে বললেন, ‘গাফফার! আমার বাড়ি হলো জাতিসংঘ। আমার কারও জন্য কোনো আদেশ নাই। তোমার যা ভালো লাগে তা করতে পারো।’ তাঁর কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম।
আমি আবার সেনা ভবনের পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল লাইনসের দিকে অগ্রসর হলাম। আমি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের লাইনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। সেখানে সুবেদার মেজর ইদ্রিস মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা প্রতিরক্ষার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?’ তিনি আমাকে জানালেন যে ব্যাটালিয়নের চারদিকে রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লঞ্চার আর ভারী মেশিনগান বসানো হয়েছে। তিনি আরও প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন যে বিপ্লবীরা ট্যাংক নিয়ে এলেও ফিরে যেতে দেওয়া হবে না। সুবেদার মেজর এরপর আমাদের জন্য গরম চায়ের ব্যবস্থা করলেন।
লে. কর্নেল (অব.) হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার (বীর উত্তম): অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধকালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক। পরবর্তী সময়ে ২২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী।
৩ নভেম্বরের আগেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল বঙ্গভবন থেকে পথভ্রষ্ট খুনি চক্রকে উৎখাত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের এই সিদ্ধান্তের কথা কর্নেল তাহের কিংবা অন্য কাউকে বলেননি। ৩ নভেম্বর ভোরেই ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের ব্যাটালিয়নগুলো থেকে সেনাদল পাঠিয়ে বঙ্গভবন অবরোধ করা হলো। সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁর গৃহে অন্তরীণ করা হলো এবং তাঁর টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো। এ ছাড়া বাইরে থেকে অন্তরীণকারী হাউস গার্ড ছাড়া কাউকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা নিষিদ্ধ করা হলো। কারণ, আমরা প্রথম থেকেই তাঁকে খুনি চক্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সন্দেহ করতাম। প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলো। নতুন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের আদেশবলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সেনাপ্রধান এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হলো।
কিন্তু ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষক’ হিসেবে সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। তাই জিয়াকে অন্তরীণ রাখাকে সৈনিকেরা পছন্দ করেনি। খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বরের পর বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে কোনো চেষ্টা করেননি, কিংবা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও সব অফিসার ও জওয়ানদের উদ্দেশে কোনো দরবার কিংবা কনফারেন্সের ব্যবস্থা করেননি। ফলে তাঁর অনুগত ব্যাটালিয়নগুলো ছাড়া সারা সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে তিনি অচেনা-অজানাই রয়ে গেলেন। অপর দিকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি রেডিও এবং টেলিভিশনে কোনো বক্তব্য দিলেন না। ফলে দেশবাসীও তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধকারে রয়ে গেল।
ইতিমধ্যে কর্নেল তাহের এবং জাসদের নেতারা প্রচারণা চালালেন যে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল সাফায়াত জামিল ‘ভারতের দালাল’। এই প্রচারণা সব ব্যারাকে দ্রুত লিফলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিল ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সদস্যরা। ফলে সৈনিক ও জাতীয়তাবাদী জনতার মধ্যে খালেদের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেল। এই সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিল। খালেদের ছোট ভাই রাশেদ মোশাররফ (আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ) ও তাঁর মা ধানমন্ডিতে একটি মিছিল বের করেন, যেখানে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিষয়ে অনেক স্লোগান দেওয়া হয়। প্রায় সব পত্রিকা এই মিছিলের খবর প্রচার করেছিল। এই মিছিলের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ধারণা হলো যে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি মূলত ভারতপন্থী ও আওয়ামী লীগের অভ্যুত্থান। প্রকৃতপক্ষে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ কখনোই ভারতপন্থী
ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী। যুদ্ধের সময়ও আমি লক্ষ করেছিলাম যে ভারতীয় জেনারেলরা খালেদকে কখনোই বিশ্বাস করতেন না। অথচ কর্নেল তাহের তাঁর দলীয় সর্বশক্তি নিয়োগ করে দ্রুত এই দেশপ্রেমিক বীরকে একজন বিশ্বাসঘাতক বিদেশি দালাল বলে ব্র্যান্ডিং করে দিতে সমর্থ হলেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল, যেন যেকোনো মুহূর্তে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে দিয়ে বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাঁর ওই ভাষণ জাতির কাছে তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পেল না।
৬ নভেম্বর দিনের বেলা কর্নেল শাফায়াত জামিল আমাকে ও আমার ইউনিটকে (২২তম ইস্ট বেঙ্গল) নির্দেশ দিলেন যে একটি পদাতিক কোম্পানিকে মহাখালী চৌরাস্তায় এমনভাবে অবস্থান গ্রহণ করাতে, যাতে গুলশান-বনানীর দিক থেকে কোনো বিদেশি শহরে আসতে না পারেন এবং কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারেন। আমার আরেকটা কোম্পানিকে বঙ্গভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত করলাম। এই কোম্পানিকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের একটি দায়িত্বরত কোম্পানির কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতে আদেশ করা হলো। আমার তৃতীয় কোম্পানিটি, যেটি আগেই মানিকগঞ্জে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল, সেটিকে সেখানেই থাকতে বলা হলো। আমার চতুর্থ কোম্পানিটিকে রিজার্ভ হিসেবে ব্যাটালিয়ন সদরে রাখার আদেশ করা হলো। আমি তখন কমান্ডারকে অনুরোধ করলাম যে আমার জন্য নির্ধারিত নির্দেশাবলি যেন আমাকে লিখিত আকারে দেওয়া হয়। ফলে কমান্ডার আমাকে লিখিতভাবে আদেশগুলো প্রদান করলেন। লিখিত আদেশ পাওয়ার পরই আমি আমার তিনটি কোম্পানিকে আদেশানুযায়ী নিয়োজিত করলাম। উল্লেখ্য, এই লিখিত আদেশটির কপি আমাকে পরবর্তীকালে সামরিক আদালতে আমার সপক্ষে শক্তিশালী যুক্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
আমাদের অভ্যুত্থানবিরোধী জাসদের প্রচারণা যখন তুঙ্গে, তখন ৬ নভেম্বর রাত আনুমানিক ১০টায় ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল আমাকে টেলিফোনে আদেশ দিলেন, যেন আমি তাড়াতাড়ি আমার ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে গিয়ে ব্যাটালিয়নের নিয়ন্ত্রণ করি। ব্যাটালিয়নে পৌঁছে আমি সরাসরি আমার অফিসের দিকে এগোচ্ছিলাম। এ সময় আমি ইঞ্জিনিয়ার্স ও অর্ডন্যান্স কোরের কিছু সৈনিককে আমার ইউনিটের গেটের সামনে জটলা করতে দেখলাম। তারা উত্তেজিতভাবে কিছু একটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিল। আমি আমার সুবেদার মেজর চান মিয়াকে ডাকলাম এবং কী ব্যাপার তা জানতে চাইলাম। চান মিয়া আমাকে জানাল যে ‘স্যার, ওরা কী যেন একটা লিফলেট পেয়েছে, তাই নিয়ে আলোচনা করছে এবং তারা অস্বাভাবিকভাবে উত্তেজিত।’ আমি তাদের আমার কাছে ডাকতে বললাম। প্রথমে তো তারা আসতেই চায়নি, একটু পরে গড়িমসি করে কাছে এলে তাদের আমার খুবই অস্বাভাবিক মনে হলো। কথাবার্তা শুনেও মনে হলো তারা অপ্রকৃতিস্থ। আমি তাদের শান্ত হতে বললাম এবং স্বাভাবিক আচরণ করতে বললাম। আমি তাদের আমার ইউনিটের সামনে জটলা ও হইচই করতে নিষেধ করে চলে যেতে বললাম।
জাসদের প্রতি অনুগত ওই উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদের বিদায় করে আমি আমার অফিসে ঢুকে আমার চেয়ারে বসলাম। ঘটনাচক্রে আমার চেয়ারটি ঠিক যেখানে থাকার কথা ছিল, সেখান থেকে একটু সরিয়ে একপাশে বসে ছিলাম। এমন সময় আমার সামনের খোলা দরজা দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের একঝাঁক গুলি আমার চেয়ারের স্বাভাবিক অবস্থান বরাবর পেছনের দেয়ালে এসে বিঁধল। আমার সুবেদার মেজর চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘স্যার! সর্বনাশ হয়েছে। শিগগির আমার সঙ্গে আসেন।’ আমরা দ্রুত ঘরের পেছনের জানালা টপকে বাইরে চলে এলাম। ইতিমধ্যে আমার ব্যাটালিয়নের ২৫-৩০ জন সৈনিক একত্র হয়ে আমার কাছে চলে এল এবং আমাকে ঘিরে দাঁড়াল।
যা-ই হোক, বুঝতে পারছিলাম যে একটা পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার্সের যেদিক থেকে গুলি আসছিল, তা এড়িয়ে আমরা রেললাইনের দিকে হেঁটে গেলাম। আমরা রেললাইন আর ময়মনসিংহ সড়কটি পার হয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করলাম। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে একত্র হওয়া সৈন্যদের সংখ্যা ৫০ পেরিয়ে গেছে। আমরা সবাই সশস্ত্র এবং যেকোনো অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। সেখান থেকে আমরা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে স্টাফ রোডের অফিসার্স কোয়ার্টারগুলোর একটিতে লে. কর্নেল ডা. জামানের বাসার গেটে নক করলাম। কর্নেল জামান নিজেই গেট খুলে দিলে আমি তাঁকে বললাম যে আমার ৫০ জন সৈন্যসহ আমি অবস্থানের জন্য একটা নিরিবিলি স্থান চাই। উনি আমাকে তাঁর পাঁচিলঘেরা বাসার সামনের লনটা দেখিয়ে বললেন, আপনি এখানেই অবস্থান করতে পারেন। লনে বেশ কিছু গাছ আর ঝোপঝাড়সহ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ ছিল।
কিছু পরে আমি আর আমার সুবেদার মেজর সৈনিকদের দুই ভাগে ভাগ করে রেললাইন ধরে দক্ষিণ দিকে হেঁটে অগ্রসর হতে লাগলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ দেখলাম বিপ্লবী সৈনিকদের আর একটি দল স্লোগান দিতে দিতে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে, অর্থাৎ আমাদের দিকে আসছে। আমরাও তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অফিসারদের মুণ্ডুপাত করে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চললাম। আমাদের পাশ কাটানোর সময় তারা স্লোগান দিল, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। কিছু দূর এগিয়ে আমরা কুর্মিটোলা গলফ মাঠে পৌঁছালাম। তখন মাঠের পশ্চিম দিকে অবস্থিত সেনা ভবনে গিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সৌভাগ্য যে সেনা ভবনে তখন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকেরা ডিউটি করছিল। তখন ৭ নভেম্বরের ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা সেনা ভবনের পেছনে থাকা একটি ছোট গেট দিয়ে ভবনে প্রবেশ করলাম।
আমি সেনা ভবনের দরজার কাছেই দেখলাম মে. জে. (অব) সফিউল্লাহ তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে বারান্দায় বসে উচ্চ স্বরে কোরআন তিলাওয়াত করছেন। আমি সংক্ষেপে সেই রাতের অভিজ্ঞতা তাঁকে জানালাম এবং এই অবস্থায় আমার করণীয় কী তা জানতে চাইলাম। তিনি হাস্যকরভাবে তাঁর হাতের দুটি তালু উল্টে দিয়ে বললেন, ‘গাফফার! আমার বাড়ি হলো জাতিসংঘ। আমার কারও জন্য কোনো আদেশ নাই। তোমার যা ভালো লাগে তা করতে পারো।’ তাঁর কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম।
আমি আবার সেনা ভবনের পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল লাইনসের দিকে অগ্রসর হলাম। আমি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের লাইনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। সেখানে সুবেদার মেজর ইদ্রিস মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা প্রতিরক্ষার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?’ তিনি আমাকে জানালেন যে ব্যাটালিয়নের চারদিকে রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লঞ্চার আর ভারী মেশিনগান বসানো হয়েছে। তিনি আরও প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন যে বিপ্লবীরা ট্যাংক নিয়ে এলেও ফিরে যেতে দেওয়া হবে না। সুবেদার মেজর এরপর আমাদের জন্য গরম চায়ের ব্যবস্থা করলেন।
লে. কর্নেল (অব.) হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার (বীর উত্তম): অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধকালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক। পরবর্তী সময়ে ২২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী।
No comments