সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান- ধীরে চলা বাংলাদেশ মিয়ানমারের পেছনে by বদরূল ইমাম
বাংলাদেশ
ও মিয়ানমার উভয় দেশের পক্ষেই ২০১২ সালের ১৪ মার্চ দিনটি ছিল যথেষ্ট
তাৎপর্যপূর্ণ। ওই দিন আন্তর্জাতিক আদালত দুই দেশের মধ্যকার সমুদ্রসীমানা
বিরোধ মামলার রায় ঘোষণা করে এবং এর ফলে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের
সমুদ্রসীমানা বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। দেশ দুটিতে এর আগে দীর্ঘদিন ধরে
সমুদ্রসীমানা নিয়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করেছে।
এর অন্যতম কারণ হলো স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে দুটি দেশের কাছেই তাদের
অর্থনীতি চাঙা করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সম্পদ জোগান দেওয়ার
চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান এবং উভয় দেশই মনে করে বঙ্গোপসাগরে তাদের সমুদ্রসীমানায়
বড় আকারে গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০০ দশকে মিয়ানমারের
আরাকান রাজ্যসংলগ্ন সাগরে বড় কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার উপরিউক্ত
ধারণাকে আরও জোরদার করে তোলে। অতিসম্প্রতি প্রায় একই এলাকায় আরও গ্যাস
আবিষ্কার বঙ্গোপসাগরকে দেশি-বিদেশি তেল কোম্পানির কাছে আরও আকর্ষণীয় স্থান
হিসেবে গণ্য করে।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ তার সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্লকগুলোকে পুনর্নির্ধারণ করে ও নতুনভাবে চিহ্নিত করে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রে ২৬টি অনুসন্ধান ব্লক নির্ধারিত হয়, যার মধ্যে ১১টি অগভীর সমুদ্র ব্লক ও ১৫টি গভীর সমুদ্র ব্লক। বহুলভাবে প্রচারিত সমুদ্র বিজয় বা ব্লু-ইকোনমি ইস্যুর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সাগরে তেল-গ্যাসসম্পদের সম্ভাবনাকে কার্যকরভাবে উন্মোচন করার ত্বরিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করে। বিষয়টি যেমন বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য, মিয়ানমারের জন্যও তা-ই। প্রকৃতপক্ষে লক্ষ করা যায় যে পারস্পরিক সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর গত তিন বছরে মিয়ানমার যেভাবে ত্বরিত উদ্যোগের মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের উদ্যোগগুলো ধীর, অপ্রতুল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত।
মিয়ানমার ২০১৩ সালে তার সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করে এবং ২০১৪ সালের প্রথমার্ধেই প্রতিযোগী বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। সমুদ্রবক্ষে মোট ২০টি অনুসন্ধান ব্লকে ১০টির বেশি বিদেশি কোম্পানিকে উৎপাদনে অংশীদারত্ব চুক্তির অধীনে নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা ইতিমধ্যে অনুসন্ধানকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত তেল কোম্পানি ফ্রান্সের টোটাল, ব্রিটেনের শেল অয়েল, ব্রিটিশ গ্যাস, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন, কনোকোফিলিপস, ইতালির ইএনআই এবং নরওয়ের স্ট্যাট অয়েল অন্তর্ভুক্ত। মিয়ানমার তার চুক্তির শর্তে প্রতিটি বিদেশি কোম্পানিকে তার সঙ্গে একটি দেশীয় (মিয়ানমার) কোম্পানিকে যুক্ত করার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে ২০১২ সালে সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসার পর থেকে মিয়ানমারের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে একটি গতিশীল কার্যক্রম লক্ষ করা যায়, যেখানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর স্পন্দন সুস্পষ্ট।
তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ গত তিন বছরে কেবল তিনটি সমুদ্র ব্লকে (অগভীর ব্লক নম্বর ৪, ৯ ও ১১) মাত্র দুটি বিদেশি কোম্পানিকে (ভারতের ওএনজিসি এবং অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস/ক্রিস এনার্জি) পিএসসি চুক্তির অধীনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োগ করতে সক্ষম হয়। বাকি ২৩টি সমুদ্র ব্লকে, যা কিনা দেশের মোট সমুদ্র এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশ, বর্তমানে কোনো কোম্পানির কোনো কার্যক্রম নেই। দেশের মোট সমুদ্র এলাকার এই ৮০ শতাংশ এলাকা অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে রেখে কোনো কোনো মহল কর্তৃক বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় ও ব্লু–ইকোনমি নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতির আড়ম্বর যে নেহাতই অসার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একই সমুদ্রে বাংলাদেশের অংশে আন্তর্জাতিক কোম্পানিদের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনাগ্রহ অথচ সীমানার অন্য পারে মিয়ানমারের অংশে জোরালোভাবে অনুসন্ধানকাজে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ তার পিএসসি চুক্তি মডেলে অতীতের ধারাগুলোকে ধরে রেখেছে মাত্র এবং তাকে যুগোপযোগী করার যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্যবস্থাপনায় আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমলা মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপও সামগ্রিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
সমুদ্রে সাইসমিক জরিপ কাজ পিছিয়ে গেল: এটি সবাই অনুধাবন করে যে বাংলাদেশ তার সাগরবক্ষে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান শুরু করতে যথেষ্ট দেরি করে ফেলেছে এবং কালক্ষেপণ না করে শিগগিরই এ কাজ শুরু করা বাঞ্ছনীয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত যোগ্য বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাছাই করে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োগ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এ কাজে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাড়া পায়নি। বিদেশি তেল কোম্পানিকে সমুদ্রে অনুসন্ধানকাজে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে যে দুর্বলতাটি রয়েছে, তা হলো তথ্যের অপ্রতুলতা। সমুদ্র ব্লকগুলোর ওপর নিজের কাছে তথ্য না থাকায় বিদেশি কোম্পানির কাছে তা আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারা এ দুর্বলতার একটি অংশ। দ্বিতীয়ত, তথ্যের অভাবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির টেবিলে বসে বাংলাদেশ দর-কষাকষির ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানে থাকে।
এ অবস্থায় জাতীয় তেল-গ্যাস কোম্পানি পেট্রোবাংলা সিদ্ধান্ত নেয় যে সমুদ্রে যেসব এলাকা উন্মুক্ত বা খালি রয়েছে, তাতে সাইসমিক জরিপ করে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যোগ্য সাইসমিক জরিপ কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হবে। মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে নামে পরিচিত এ ব্যবস্থাপনায় নিয়োগপ্রাপ্ত সাইসমিক কোম্পানি সমুদ্রবক্ষে সাইসমিক জরিপ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণমাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে পেট্রোবাংলাকে দেবে। এর জন্য কোম্পানি বাংলাদেশের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেবে না বরং এই তথ্য প্যাকেজ বিদেশি তেল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে নিজের লভ্যাংশ রেখে বাংলাদেশকে একটি অর্থ অংশ প্রদান করবে।
উপরিউক্ত কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পরই বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করতে বিডিং প্রক্রিয়া শুরু করবে। যেহেতু সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসার পর প্রায় তিন বছর পার হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রমে আশাপ্রদ অগ্রগতি হয়নি, সে কারণে এই মাল্টিক্লায়েন্ট সাইসমিক সার্ভে কাজটি শিগগিরই করার প্রয়োজনীয়তা বিচার করে পেট্রোবাংলা এ বছরের প্রথম দিকে সাইসমিক সার্ভে কোম্পানির কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করে। পাঁচটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পেট্রোবাংলা এদের মধ্য থেকে সবচেয়ে যোগ্য কোম্পানিকে বাছাই করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে, যেখানে পেট্রোবাংলার জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মূল্যায়ন কমিটি যথাসময়ে মূল্যায়ন শেষ করে সুনির্দিষ্টভাবে একটি কোম্পানিকে সর্বাপেক্ষা যোগ্য বিবেচনা করে বাছাই করে। পেট্রোবাংলা তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা যায় যে মন্ত্রণালয় বেশ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পর মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পেট্রোবাংলাকে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করে নতুনভাবে বাছাইপ্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশ দেয়। এ ধরনের নির্দেশের পেছনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞ মহল মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছে যে সরকারি আমলা মহল কীভাবে একটি বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটির মূল্যায়নকে বাতিল করতে পারে? এর পেছনে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে প্রভাবশালী কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের হাত রয়েছে—এমন আশঙ্কার কথা নানা মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে একাধিক কারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রথমত, সাইসমিক জরিপের কাজ শুষ্ক মৌসুমে (অক্টোবর-মার্চ) করতে হয় বিধায় এই বছর সাইসমিক জরিপ কাজ শুরুই করা যাবে না বরং পরবর্তী শুষ্ক মৌসুমে তা শুরু হতে পারে। এ জরিপের ফলাফল পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়ার পরই পেট্রোবাংলা বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ–প্রক্রিয়া শুরু করবে। অর্থাৎ পেট্রোবাংলা সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে বিডিং প্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনা করেছিল, তা অন্তত দুই বছর পিছিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির কারিগরি মূল্যায়নের মাধ্যমে যোগ্যতম বিবেচিত হওয়ার পর কোনো কারণ না দেখিয়ে যোগ্য বিবেচিত কোম্পানিকে নিয়োগ না দিয়ে তা বাতিল ঘোষণা করার ফলে বিদেশিদের মাঝে সরকারি প্রশাসনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে, যা কিনা এ দেশে তাদের কাজ করার আগ্রহকে ক্ষুণ্ন করবে। তৃতীয়ত, পেট্রোবাংলা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে যে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেছিল, তাদের কারিগরি মূল্যায়নকে মন্ত্রণালয়ের আমলা মহল যেভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে, তা ভবিষ্যতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে সবাইকে নিরুৎসাহিত করবে। সর্বোপরি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশের যে অভিযোগগুলো বিভিন্ন সময় পাওয়া যায় এবং তার কারণে জনগণের মাঝে সরকারি প্রশাসনের প্রতি যে অবিশ্বাস জন্মে, তা আরও সুদৃঢ় হবে।
পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার গত তিন বছরে তার সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে যেভাবে গতিশীল করেছে, বাংলাদেশ তা পারেনি কেন, এটি বিশ্লেষণের সময় এসেছে। বাংলাদেশকে তার অনুসন্ধানকাজের ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি, আমলা মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও অস্বচ্ছ প্রশাসনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু সরকারি প্রশাসনিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা না গেলে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষা করা সহজ হবে না।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ তার সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্লকগুলোকে পুনর্নির্ধারণ করে ও নতুনভাবে চিহ্নিত করে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রে ২৬টি অনুসন্ধান ব্লক নির্ধারিত হয়, যার মধ্যে ১১টি অগভীর সমুদ্র ব্লক ও ১৫টি গভীর সমুদ্র ব্লক। বহুলভাবে প্রচারিত সমুদ্র বিজয় বা ব্লু-ইকোনমি ইস্যুর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সাগরে তেল-গ্যাসসম্পদের সম্ভাবনাকে কার্যকরভাবে উন্মোচন করার ত্বরিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করে। বিষয়টি যেমন বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য, মিয়ানমারের জন্যও তা-ই। প্রকৃতপক্ষে লক্ষ করা যায় যে পারস্পরিক সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর গত তিন বছরে মিয়ানমার যেভাবে ত্বরিত উদ্যোগের মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের উদ্যোগগুলো ধীর, অপ্রতুল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত।
মিয়ানমার ২০১৩ সালে তার সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করে এবং ২০১৪ সালের প্রথমার্ধেই প্রতিযোগী বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। সমুদ্রবক্ষে মোট ২০টি অনুসন্ধান ব্লকে ১০টির বেশি বিদেশি কোম্পানিকে উৎপাদনে অংশীদারত্ব চুক্তির অধীনে নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা ইতিমধ্যে অনুসন্ধানকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত তেল কোম্পানি ফ্রান্সের টোটাল, ব্রিটেনের শেল অয়েল, ব্রিটিশ গ্যাস, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন, কনোকোফিলিপস, ইতালির ইএনআই এবং নরওয়ের স্ট্যাট অয়েল অন্তর্ভুক্ত। মিয়ানমার তার চুক্তির শর্তে প্রতিটি বিদেশি কোম্পানিকে তার সঙ্গে একটি দেশীয় (মিয়ানমার) কোম্পানিকে যুক্ত করার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে ২০১২ সালে সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসার পর থেকে মিয়ানমারের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে একটি গতিশীল কার্যক্রম লক্ষ করা যায়, যেখানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর স্পন্দন সুস্পষ্ট।
তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ গত তিন বছরে কেবল তিনটি সমুদ্র ব্লকে (অগভীর ব্লক নম্বর ৪, ৯ ও ১১) মাত্র দুটি বিদেশি কোম্পানিকে (ভারতের ওএনজিসি এবং অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস/ক্রিস এনার্জি) পিএসসি চুক্তির অধীনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োগ করতে সক্ষম হয়। বাকি ২৩টি সমুদ্র ব্লকে, যা কিনা দেশের মোট সমুদ্র এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশ, বর্তমানে কোনো কোম্পানির কোনো কার্যক্রম নেই। দেশের মোট সমুদ্র এলাকার এই ৮০ শতাংশ এলাকা অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে রেখে কোনো কোনো মহল কর্তৃক বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় ও ব্লু–ইকোনমি নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতির আড়ম্বর যে নেহাতই অসার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একই সমুদ্রে বাংলাদেশের অংশে আন্তর্জাতিক কোম্পানিদের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনাগ্রহ অথচ সীমানার অন্য পারে মিয়ানমারের অংশে জোরালোভাবে অনুসন্ধানকাজে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ তার পিএসসি চুক্তি মডেলে অতীতের ধারাগুলোকে ধরে রেখেছে মাত্র এবং তাকে যুগোপযোগী করার যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্যবস্থাপনায় আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমলা মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপও সামগ্রিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
সমুদ্রে সাইসমিক জরিপ কাজ পিছিয়ে গেল: এটি সবাই অনুধাবন করে যে বাংলাদেশ তার সাগরবক্ষে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান শুরু করতে যথেষ্ট দেরি করে ফেলেছে এবং কালক্ষেপণ না করে শিগগিরই এ কাজ শুরু করা বাঞ্ছনীয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত যোগ্য বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাছাই করে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োগ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এ কাজে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাড়া পায়নি। বিদেশি তেল কোম্পানিকে সমুদ্রে অনুসন্ধানকাজে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে যে দুর্বলতাটি রয়েছে, তা হলো তথ্যের অপ্রতুলতা। সমুদ্র ব্লকগুলোর ওপর নিজের কাছে তথ্য না থাকায় বিদেশি কোম্পানির কাছে তা আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারা এ দুর্বলতার একটি অংশ। দ্বিতীয়ত, তথ্যের অভাবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির টেবিলে বসে বাংলাদেশ দর-কষাকষির ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানে থাকে।
এ অবস্থায় জাতীয় তেল-গ্যাস কোম্পানি পেট্রোবাংলা সিদ্ধান্ত নেয় যে সমুদ্রে যেসব এলাকা উন্মুক্ত বা খালি রয়েছে, তাতে সাইসমিক জরিপ করে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যোগ্য সাইসমিক জরিপ কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হবে। মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে নামে পরিচিত এ ব্যবস্থাপনায় নিয়োগপ্রাপ্ত সাইসমিক কোম্পানি সমুদ্রবক্ষে সাইসমিক জরিপ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণমাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে পেট্রোবাংলাকে দেবে। এর জন্য কোম্পানি বাংলাদেশের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেবে না বরং এই তথ্য প্যাকেজ বিদেশি তেল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে নিজের লভ্যাংশ রেখে বাংলাদেশকে একটি অর্থ অংশ প্রদান করবে।
উপরিউক্ত কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পরই বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করতে বিডিং প্রক্রিয়া শুরু করবে। যেহেতু সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসার পর প্রায় তিন বছর পার হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রমে আশাপ্রদ অগ্রগতি হয়নি, সে কারণে এই মাল্টিক্লায়েন্ট সাইসমিক সার্ভে কাজটি শিগগিরই করার প্রয়োজনীয়তা বিচার করে পেট্রোবাংলা এ বছরের প্রথম দিকে সাইসমিক সার্ভে কোম্পানির কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করে। পাঁচটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পেট্রোবাংলা এদের মধ্য থেকে সবচেয়ে যোগ্য কোম্পানিকে বাছাই করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে, যেখানে পেট্রোবাংলার জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মূল্যায়ন কমিটি যথাসময়ে মূল্যায়ন শেষ করে সুনির্দিষ্টভাবে একটি কোম্পানিকে সর্বাপেক্ষা যোগ্য বিবেচনা করে বাছাই করে। পেট্রোবাংলা তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা যায় যে মন্ত্রণালয় বেশ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পর মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পেট্রোবাংলাকে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করে নতুনভাবে বাছাইপ্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশ দেয়। এ ধরনের নির্দেশের পেছনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞ মহল মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছে যে সরকারি আমলা মহল কীভাবে একটি বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটির মূল্যায়নকে বাতিল করতে পারে? এর পেছনে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে প্রভাবশালী কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের হাত রয়েছে—এমন আশঙ্কার কথা নানা মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে একাধিক কারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রথমত, সাইসমিক জরিপের কাজ শুষ্ক মৌসুমে (অক্টোবর-মার্চ) করতে হয় বিধায় এই বছর সাইসমিক জরিপ কাজ শুরুই করা যাবে না বরং পরবর্তী শুষ্ক মৌসুমে তা শুরু হতে পারে। এ জরিপের ফলাফল পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়ার পরই পেট্রোবাংলা বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ–প্রক্রিয়া শুরু করবে। অর্থাৎ পেট্রোবাংলা সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে বিডিং প্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনা করেছিল, তা অন্তত দুই বছর পিছিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির কারিগরি মূল্যায়নের মাধ্যমে যোগ্যতম বিবেচিত হওয়ার পর কোনো কারণ না দেখিয়ে যোগ্য বিবেচিত কোম্পানিকে নিয়োগ না দিয়ে তা বাতিল ঘোষণা করার ফলে বিদেশিদের মাঝে সরকারি প্রশাসনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে, যা কিনা এ দেশে তাদের কাজ করার আগ্রহকে ক্ষুণ্ন করবে। তৃতীয়ত, পেট্রোবাংলা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে যে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেছিল, তাদের কারিগরি মূল্যায়নকে মন্ত্রণালয়ের আমলা মহল যেভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে, তা ভবিষ্যতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে সবাইকে নিরুৎসাহিত করবে। সর্বোপরি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশের যে অভিযোগগুলো বিভিন্ন সময় পাওয়া যায় এবং তার কারণে জনগণের মাঝে সরকারি প্রশাসনের প্রতি যে অবিশ্বাস জন্মে, তা আরও সুদৃঢ় হবে।
পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার গত তিন বছরে তার সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে যেভাবে গতিশীল করেছে, বাংলাদেশ তা পারেনি কেন, এটি বিশ্লেষণের সময় এসেছে। বাংলাদেশকে তার অনুসন্ধানকাজের ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি, আমলা মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও অস্বচ্ছ প্রশাসনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু সরকারি প্রশাসনিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা না গেলে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষা করা সহজ হবে না।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments