‘মোশতাক আমাদের কাউকে রেহাই দেবে না’ by জিয়াউদ্দিন চৌধুরী
বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির নেতা এবং প্রথম বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার অন্যতম
সদস্য আবু হেনা মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে শুধু নামেই চিনতাম স্বাধীনতার বেশ
কয়েক মাস পর পর্যন্ত। স্বাধীনতার পরপরই আমি সরকারি চাকরিতে পুনরায়
যোগদানের পর আমাকে নিয়োগ করা হয় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে, তত্কালীন
সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুসের সহকারী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান তখনো দেশে ফেরেননি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। কামরুজ্জামান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি তাঁর ছবি দেখেছি পত্রপত্রিকায়, টিভিতে, সামনাসামনি
নয়।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর যখন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, মন্ত্রিপরিষদের অনেক পরিবর্তন হলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তাজউদ্দীনের অর্থমন্ত্রী হওয়া আর কামরুজ্জামানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরে এসে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়া। এই পরিবর্তনের পর আমি আরও কয়েক মাস প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে কাজ করি। হঠাৎ মে মাসে রুহুল কুদ্দুস আমাকে ডেকে বলেন যে ত্রাণমন্ত্রী কামরুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁর সচিবালয় থেকে কাউকে যেন নিয়োগ করা হয় তাঁর একান্ত সচিব হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর আদেশে রুহুল কুদ্দুস জানালেন যে আমি যেন কামরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর পছন্দ হলে আমাকে সে পদে নিয়োগ করা হবে।
আমি পড়লাম মহা বিপদে। আমি কোনো দিন রাজনীতি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ধারেকাছেও যাইনি। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে কাজ করা আর একজন মন্ত্রীর সরাসরি সহকারী হিসেবে কাজ করা অনেক তফাত। এদিকে সরকারি চাকরিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনে নেওয়া উচিত। আমার ইতস্তত ভাব দেখে রুহুল কুদ্দুস বললেন, ‘কামরুজ্জামান আমার খুব পরিচিত, অত্যন্ত সজ্জন লোক, তুমি তার সঙ্গে কাজ করে খুশি হবে।’
রুহুল কুদ্দুসের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য ছিল। আমি কামরুজ্জামানের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করি তিন বছরের ওপরে, পরপর তিন মন্ত্রণালয়ে। শেষবার তিনি যখন শিল্পমন্ত্রী, ১৯৭৫ সালে, তাঁর একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ ছিল প্রায় উদয়াস্ত তাঁর সঙ্গে থাকা। নথিপত্রের কাজের সঙ্গে তাঁর সব সরকারি সভা-সমিতির দিনক্ষণ নির্ধারণ করা, তাঁর পত্রবিনিময় মুসাবিদা করা, সফরের বন্দোবস্ত করা, সফরে তাঁর সঙ্গে যাওয়া—সব দায়িত্বই ছিল। তিন বছরে যতই কামরুজ্জামানকে দেখেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি তাঁর ব্যবহারে, বুদ্ধিমত্তায়, রাজনৈতিক পরিপক্বতায় এবং সর্বোপরি তাঁর সাধুতা ও সত্যতায়। তিনি কেবল একজন দেশনেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ রাজনীতিবিদ।
৩ নভেম্বর রাতে কামরুজ্জামান ও অন্য তিন নেতাকে ঢাকা জেলে হত্যা হয়তো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হিসেবে তৎকালীন দখলদার সরকার কার্যকর করে, কিন্তু তাঁদের হত্যা করা যে আগস্ট অভ্যুত্থানকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তা কামরুজ্জামান আমাকে বলেছিলেন ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরপরই।
১৫ আগস্টের আকস্মিকতা সবাইকে যেমন করে বিহ্বল, তার নিষ্ঠুরতা মানুষকে করে বিমূঢ়। আসলে সেদিনের পুরো ঘটনা আর নৃশংসতার কথা লোকের জানতে বেশ দেরি হয়। সকালে মেজর ডালিমের রেডিওতে অভ্যুত্থানের ঘোষণার অনেক আগেই আমার ঘুম ভাঙে ভোরে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে। আমি ছিলাম ধানমন্ডি লেকের পাড়ে একটি বাসায়, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ির খুব কাছে। গোলাগুলির শব্দে ঘরের সবাই ভীতসন্ত্রস্ত, বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। শুধু এটা বুঝতে পারছিলাম যে আওয়াজ লেকের উল্টো দিক থেকে আসছে। তখনো চিন্তায় আসেনি যে গোলাগুলি ৩২ নম্বর বাড়িতেই হচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টা পর গোলাগুলি থামলে এক আত্মীয়র ফোন পেলাম, তিনি বললেন রেডিও শুনতে। তখনই মেজর ডালিমের কণ্ঠে শুনতে পেলাম খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের কথা।
মেজর ডালিমের এ ঘোষণা আমাকে বেশি উদ্বিগ্ন করেছে মন্ত্রী কামরুজ্জামানের কথা ভেবে। সশস্ত্র অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হলে তাঁর সহকর্মীরাও বিপদে পড়বেন এই আশঙ্কায়। আর কামরুজ্জামান ছিলেন তাঁর অন্যতম নিকট সহযোগী, যিনি কয়েক মাস আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এর আগের দিন আমি শিল্প ভবনে মন্ত্রীর দপ্তরে রাত আটটা অবধি ছিলাম। মন্ত্রী আমার অফিস ছাড়ার সময় তাঁর দপ্তরেই ছিলেন।
ঢাকা থেকে দূরে এক জেলা শহরে বসে যখন এ হত্যার কথা শুনি, আমার কানে বাজতে থাকে আমার মন্ত্রীর কথা, ‘মোশতাককে চিনি বলেই বলছি তোমাকে, মোশতাক আমাদের কাউকে রেহাই দেবে না, আমাদের সবাইকে খুন করবে’ আমি রেডিও শোনা বন্ধ করে তড়িঘড়ি তাঁকে ফোন করলাম আর পেয়েও গেলাম। চলমান ঘটনা সম্পর্কে কোনো কথা না বলে কামরুজ্জামান আমাকে বললেন তাড়াতাড়ি তাঁর বাসায় যেতে, তিনি ধানমন্ডিতেই থাকতেন। আমি তাঁকে জানালাম যে আমার গাড়ি সরকারি পুল থেকে ডেকে এনে তারপর আসছি। মন্ত্রী একটু অসহিষ্ণুভাবে বললেন, আমি যেন যেভাবে পারি তাড়াতাড়ি যাই। জানালাম, আমি আসছি।
বাড়িতে একটি গাড়ি ছিল, কিন্তু ড্রাইভার ছিল না। আমি নিজেই গাড়িতে করে আমার এক আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মন্ত্রীর বাড়ি পৌঁছে গিয়ে দেখি, বাড়িতে কেউ নেই। বাড়িতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা জানালেন, মন্ত্রী সাহেব কিছুক্ষণ আগে সপরিবারে একটি গাড়িতে করে চলে গেছেন; কোথায় গেছেন, তা তাঁরা জানেন না। কার সঙ্গে গিয়েছেন, সেটাও তাঁরা জানেন না। আমি পড়লাম মহা চিন্তায়, তাঁকে অভ্যুত্থানকারীরা নিয়ে গেছে কি না।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পরে একটি টেলিফোন পেলাম এক ব্যক্তির কাছ থেকে। তিনি জানালেন, তাঁর বাড়িতে মন্ত্রী আছেন সপরিবারে এবং তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। ব্যক্তিটি ছিলেন কামরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বগুড়ার এক সাংসদের জামাতা। তিনিও ধানমন্ডিতে থাকতেন, তাঁর বাড়ি আমি চিনতাম।
ধানমন্ডির সেই বাড়িতে যখন পৌঁছাই, সময় প্রায় দশটা। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর প্রচারিত হয়ে গেছে। আমি কামরুজ্জামানের দেখা পাই সেই বাড়ির অন্দরে শোয়ারঘরে। বিছানায় বসে তিনি, পাশে তাঁর স্ত্রী আর তিন মেয়ে (তাঁর দুই ছেলে তখন ভারতে স্কুলে)। অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত চেহারা নিয়ে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুর কথা। তখনো তিনি জানেন না যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।
খোন্দকার মোশতাককে তো আপনি ভালো করে চেনেন, আমি বললাম।
মুখ ঘুরিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে কামরুজ্জামান গভীর স্বরে বললেন, ‘মোশতাককে চিনি বলেই বলছি তোমাকে, মোশতাক আমাদের কাউকে রেহাই দেবে না, আমাদের সবাইকে খুন করবে।’ কামরুজ্জামানের এ কথা আজও আমার কানে বাজে।
কামরুজ্জামান সেই বন্ধুর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আরও দিন কয়েক থাকেন। তিনি ঢাকার বাইরে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করেননি, যাওয়ার কোনো আগ্রহও ছিল না। সেই বাড়িতে থাকার সময় আমি প্রায় প্রতিদিন দেখা করতে যেতাম। কয়েক দিন পর তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনে ফিরে যান সরকারের নিরাপত্তার মিথ্যা আশ্বাসে, কারণ ফিরে যাওয়ার পর তাঁকে বাইরের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হতো না। আমিও পারিনি, কারণ সরকারিভাবে আমি আর তাঁর সহকারী ছিলাম না।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর যখন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, মন্ত্রিপরিষদের অনেক পরিবর্তন হলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তাজউদ্দীনের অর্থমন্ত্রী হওয়া আর কামরুজ্জামানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরে এসে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়া। এই পরিবর্তনের পর আমি আরও কয়েক মাস প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে কাজ করি। হঠাৎ মে মাসে রুহুল কুদ্দুস আমাকে ডেকে বলেন যে ত্রাণমন্ত্রী কামরুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁর সচিবালয় থেকে কাউকে যেন নিয়োগ করা হয় তাঁর একান্ত সচিব হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর আদেশে রুহুল কুদ্দুস জানালেন যে আমি যেন কামরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর পছন্দ হলে আমাকে সে পদে নিয়োগ করা হবে।
আমি পড়লাম মহা বিপদে। আমি কোনো দিন রাজনীতি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ধারেকাছেও যাইনি। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে কাজ করা আর একজন মন্ত্রীর সরাসরি সহকারী হিসেবে কাজ করা অনেক তফাত। এদিকে সরকারি চাকরিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনে নেওয়া উচিত। আমার ইতস্তত ভাব দেখে রুহুল কুদ্দুস বললেন, ‘কামরুজ্জামান আমার খুব পরিচিত, অত্যন্ত সজ্জন লোক, তুমি তার সঙ্গে কাজ করে খুশি হবে।’
রুহুল কুদ্দুসের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য ছিল। আমি কামরুজ্জামানের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করি তিন বছরের ওপরে, পরপর তিন মন্ত্রণালয়ে। শেষবার তিনি যখন শিল্পমন্ত্রী, ১৯৭৫ সালে, তাঁর একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ ছিল প্রায় উদয়াস্ত তাঁর সঙ্গে থাকা। নথিপত্রের কাজের সঙ্গে তাঁর সব সরকারি সভা-সমিতির দিনক্ষণ নির্ধারণ করা, তাঁর পত্রবিনিময় মুসাবিদা করা, সফরের বন্দোবস্ত করা, সফরে তাঁর সঙ্গে যাওয়া—সব দায়িত্বই ছিল। তিন বছরে যতই কামরুজ্জামানকে দেখেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি তাঁর ব্যবহারে, বুদ্ধিমত্তায়, রাজনৈতিক পরিপক্বতায় এবং সর্বোপরি তাঁর সাধুতা ও সত্যতায়। তিনি কেবল একজন দেশনেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ রাজনীতিবিদ।
৩ নভেম্বর রাতে কামরুজ্জামান ও অন্য তিন নেতাকে ঢাকা জেলে হত্যা হয়তো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হিসেবে তৎকালীন দখলদার সরকার কার্যকর করে, কিন্তু তাঁদের হত্যা করা যে আগস্ট অভ্যুত্থানকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তা কামরুজ্জামান আমাকে বলেছিলেন ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরপরই।
১৫ আগস্টের আকস্মিকতা সবাইকে যেমন করে বিহ্বল, তার নিষ্ঠুরতা মানুষকে করে বিমূঢ়। আসলে সেদিনের পুরো ঘটনা আর নৃশংসতার কথা লোকের জানতে বেশ দেরি হয়। সকালে মেজর ডালিমের রেডিওতে অভ্যুত্থানের ঘোষণার অনেক আগেই আমার ঘুম ভাঙে ভোরে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে। আমি ছিলাম ধানমন্ডি লেকের পাড়ে একটি বাসায়, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ির খুব কাছে। গোলাগুলির শব্দে ঘরের সবাই ভীতসন্ত্রস্ত, বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। শুধু এটা বুঝতে পারছিলাম যে আওয়াজ লেকের উল্টো দিক থেকে আসছে। তখনো চিন্তায় আসেনি যে গোলাগুলি ৩২ নম্বর বাড়িতেই হচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টা পর গোলাগুলি থামলে এক আত্মীয়র ফোন পেলাম, তিনি বললেন রেডিও শুনতে। তখনই মেজর ডালিমের কণ্ঠে শুনতে পেলাম খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের কথা।
মেজর ডালিমের এ ঘোষণা আমাকে বেশি উদ্বিগ্ন করেছে মন্ত্রী কামরুজ্জামানের কথা ভেবে। সশস্ত্র অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হলে তাঁর সহকর্মীরাও বিপদে পড়বেন এই আশঙ্কায়। আর কামরুজ্জামান ছিলেন তাঁর অন্যতম নিকট সহযোগী, যিনি কয়েক মাস আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এর আগের দিন আমি শিল্প ভবনে মন্ত্রীর দপ্তরে রাত আটটা অবধি ছিলাম। মন্ত্রী আমার অফিস ছাড়ার সময় তাঁর দপ্তরেই ছিলেন।
ঢাকা থেকে দূরে এক জেলা শহরে বসে যখন এ হত্যার কথা শুনি, আমার কানে বাজতে থাকে আমার মন্ত্রীর কথা, ‘মোশতাককে চিনি বলেই বলছি তোমাকে, মোশতাক আমাদের কাউকে রেহাই দেবে না, আমাদের সবাইকে খুন করবে’ আমি রেডিও শোনা বন্ধ করে তড়িঘড়ি তাঁকে ফোন করলাম আর পেয়েও গেলাম। চলমান ঘটনা সম্পর্কে কোনো কথা না বলে কামরুজ্জামান আমাকে বললেন তাড়াতাড়ি তাঁর বাসায় যেতে, তিনি ধানমন্ডিতেই থাকতেন। আমি তাঁকে জানালাম যে আমার গাড়ি সরকারি পুল থেকে ডেকে এনে তারপর আসছি। মন্ত্রী একটু অসহিষ্ণুভাবে বললেন, আমি যেন যেভাবে পারি তাড়াতাড়ি যাই। জানালাম, আমি আসছি।
বাড়িতে একটি গাড়ি ছিল, কিন্তু ড্রাইভার ছিল না। আমি নিজেই গাড়িতে করে আমার এক আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মন্ত্রীর বাড়ি পৌঁছে গিয়ে দেখি, বাড়িতে কেউ নেই। বাড়িতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা জানালেন, মন্ত্রী সাহেব কিছুক্ষণ আগে সপরিবারে একটি গাড়িতে করে চলে গেছেন; কোথায় গেছেন, তা তাঁরা জানেন না। কার সঙ্গে গিয়েছেন, সেটাও তাঁরা জানেন না। আমি পড়লাম মহা চিন্তায়, তাঁকে অভ্যুত্থানকারীরা নিয়ে গেছে কি না।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পরে একটি টেলিফোন পেলাম এক ব্যক্তির কাছ থেকে। তিনি জানালেন, তাঁর বাড়িতে মন্ত্রী আছেন সপরিবারে এবং তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। ব্যক্তিটি ছিলেন কামরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বগুড়ার এক সাংসদের জামাতা। তিনিও ধানমন্ডিতে থাকতেন, তাঁর বাড়ি আমি চিনতাম।
ধানমন্ডির সেই বাড়িতে যখন পৌঁছাই, সময় প্রায় দশটা। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর প্রচারিত হয়ে গেছে। আমি কামরুজ্জামানের দেখা পাই সেই বাড়ির অন্দরে শোয়ারঘরে। বিছানায় বসে তিনি, পাশে তাঁর স্ত্রী আর তিন মেয়ে (তাঁর দুই ছেলে তখন ভারতে স্কুলে)। অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত চেহারা নিয়ে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুর কথা। তখনো তিনি জানেন না যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।
খোন্দকার মোশতাককে তো আপনি ভালো করে চেনেন, আমি বললাম।
মুখ ঘুরিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে কামরুজ্জামান গভীর স্বরে বললেন, ‘মোশতাককে চিনি বলেই বলছি তোমাকে, মোশতাক আমাদের কাউকে রেহাই দেবে না, আমাদের সবাইকে খুন করবে।’ কামরুজ্জামানের এ কথা আজও আমার কানে বাজে।
কামরুজ্জামান সেই বন্ধুর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আরও দিন কয়েক থাকেন। তিনি ঢাকার বাইরে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করেননি, যাওয়ার কোনো আগ্রহও ছিল না। সেই বাড়িতে থাকার সময় আমি প্রায় প্রতিদিন দেখা করতে যেতাম। কয়েক দিন পর তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনে ফিরে যান সরকারের নিরাপত্তার মিথ্যা আশ্বাসে, কারণ ফিরে যাওয়ার পর তাঁকে বাইরের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হতো না। আমিও পারিনি, কারণ সরকারিভাবে আমি আর তাঁর সহকারী ছিলাম না।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, আবু হেনা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান |
কিছুদিন
পর কামরুজ্জামান আর তাঁর তিন সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ,
মনসুর আলীকে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে বন্দী করে মোশতাক সরকার। এর দুই মাস
পর এই চার জাতীয় নেতা জেলখানায় ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হত্যার শিকার হন। ঢাকা
থেকে দূরে এক জেলা শহরে বসে যখন এ হত্যার কথা শুনি, আমার কানে বাজতে থাকে
আমার মন্ত্রীর কথা, ‘মোশতাককে চিনি বলেই বলছি তোমাকে, মোশতাক আমাদের কাউকে
রেহাই দেবে না, আমাদের সবাইকে খুন করবে।’
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।
No comments