বাংলাদেশ কোথায় আছে, কেমন আছে? by ফারুক ওয়াসিফ
বাংলাদেশ কেমন আছে? উটপাখি আর জিরাফরা বলতে পারবে না। একজন দেহ উবু করে মাথাটা বন্ধক দিয়ে রেখেছে মাটিতে। আর জিরাফ মহাশয় তো মগডালের ফুল-ফল মায় নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু দেখবে না বলে ঠিক করেছে। তবে পিপীলিকারা কিছু জানলেও জানতে পারে। প্রকৃতিতে বন্যা বা ভূমিকম্পের আলামত নাকি তারাই আগাম পায়। বাংলাদেশের পিঁপড়ার মতো ব্যস্ত ও পরিশ্রমী জনগণ কিছু কি টের পাচ্ছে? এটা অন্তত দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর সহিংস, দুর্গতিময় দশায় অন্তত বাকি দেশ নেই। মফস্বল ও জেলা শহরে অপরাধ বাড়লেও, সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবন দিব্যি বয়ে যাচ্ছে। অবস্থাটা সেই সিরাজউদ্দৌলার বাংলার মতো। পরিবার ও সন্তানের বাইরে তারা রাজনীতি নিয়ে খুব পেরেশান বলে মনে হয় না। দেশভাবনার চেয়ে বড় ভাবনা হলো উন্নতির ভাবনা। এটা বুঝেই হয়তো সরকার একটানা ‘উন্নয়ন’ করে সবাইকে তাক লাগাতে চাইছে।
বড় সেনাপতি কেবল সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করেন না, জনগণের মতিগতির হিসাবও তাঁরা রাখেন। নিশ্চয়ই সিরাজউদ্দৌলার চেয়ে রবার্ট ক্লাইভ বেশি বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন, বাঙালি জনসাধারণ রাজনীতি নিয়ে উদাসীন আর জমিদার-তালুকদারেরা জমি দখল আর ক্ষমতা-বিত্ত বাড়ানোর কাজিয়া নিয়েই ব্যস্ত। সুতরাং সিরাজের মন্ত্রী-অমাত্য আর সৈন্যদলকে বিভক্ত করা ক্লাইভের জন্য কঠিন কাজ ছিল না। এখনকার মতো তখনো কৃষক-শ্রমিক-জেলে-কারিগরেরাই ছিলেন এই দেশের মূল জনগোষ্ঠী। রাজনীতির চোটপাটের চেয়ে পেটের কারবারেই তাঁরা মন দিয়েছিলেন। কৃষকেরা যেমন সারা দিন মাটিতে উবু হয়ে কাজ করেন, এঁরাও তেমনি আত্মমুখী হয়ে দিন গুজরান করে যেতেন। এখনো মোটামুটি অবস্থাটা তেমনই আছে। তাই বাংলার স্বাধীনতা কোথায় কীভাবে অস্তমিত হলো, তা নিয়ে আসলেই সিরাজ ও তাঁর মতো কিছু দেশপ্রেমিক ছাড়া আর কারও বেদনা বিষয়ে সে সময়ের দলিলপত্র নীরব।
খেয়াল করার বিষয়, সিরাজের পূর্বসূরি আলিবর্দীর শাসনে বাংলার জনগণ ভালোই ছিল। তিনি মারাঠা ও মগদের দমন করেছিলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি এনেছিলেন। তাতেও কাজ হয়নি। সুতরাং প্রবৃদ্ধি ভালো হলেই যে জনগণ শাসকের পক্ষে জানবাজি করবে, তা ঠিক নয়। ২০০৭-০৮ সালে জিডিপি সাড়ে ৬-এর ঘরে ছিল, তবু অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনপ্রিয়তা পায়নি।
জনগণের মতিগতি না বুঝে যুদ্ধ ও নির্বাচন কোনোটাতেই জেতা যায় না। ২০০ বছর আগের কথা, নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেছেন। রাজধানী মস্কোও বেহাত হয়। রুশ সেনাপতি তখনো নির্বিকার। পিছু হটছেন তো হটছেনই। একপর্যায়ে অতিষ্ঠ জেনারেলরা জবাবদিহি চাইলেন। সেনাপতি তাঁদের প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কৃষকেরা কী করছে?’ জেনারেলরা বললেন, তাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন। ‘আর কী করছে?’ যাওয়ার সময় ফসলের গোলা, খেতখামার পুড়িয়ে দিচ্ছেন আর পানিতে ঢেলে দিচ্ছেন বিষ। সেনাপতি এবার গুমর ফাঁস করলেন। বললেন, ‘জনগণকে অনুসরণ করো। তারা এখন প্রতিরোধে সক্ষম নয়। তাই তারা শত্রুদের আরও ভেতরে আসতে দিচ্ছে। খাদ্যভান্ডার ধ্বংস আর পানি বিষাক্ত করে দিয়ে তারা ফরাসিদের ভাতে-পানিতে মারার বন্দোবস্ত করছে। আসল প্রতিরোধ হবে শীতে। তখন বরফে সব জমে যাবে আর নেপোলিয়নের বাহিনী শীতে ও ক্ষুধায় মরমর হবে। সেটাই আক্রমণের মোক্ষম সময়। দেখো, জনগণ ঘাস খায় না, শত শত বছর ধরে তারা এটা শিখেছে।’
সেই যুদ্ধে নেপোলিয়নের বাহিনী মস্কো পুড়িয়ে দিলেও জয়ী হয়নি। সাড়ে পাঁচ লাখ ফরাসি সেনার মধ্যে এক লাখ বন্দী হয় আর নিহত হয় ৩ লাখ ৮০ হাজার। জনগণকে শিক্ষক মেনে বুড়ো সেনাপতি ঠিক কৌশলই নিয়েছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সামরিক নেতারাও ঠিক এই কৌশলটাই নিয়েছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।
যখন ওপরতলা ফাঁপা হয়ে যায়, তখন জনগণই পথ দেখায়। রাজনীতির আঙ্গু বনাম মাঙ্গু কাবিলার যুদ্ধে না জড়িয়ে তারা উৎপাদন ও আয়ের কাজে নিয়োজিত আছে। পিঁপড়ার মতো একেকজন উপার্জনক্ষম তরুণ ও প্রবীণ সাধ্যের চেয়েও বেশি ওজন বহন করছেন। তাঁদের কাঁধে চড়েই কিন্তু সহায়সম্পদহীন বিপুল জনসংখ্যার এই ছোট দেশটা শত বিপদেও মুখ থুবড়ে পড়ছে না। এ বছরও ফসল ভালো হয়েছে, হরতাল-অবরোধ, পেট্রলবোমা ও তাজরীন-রানা প্লাজা সত্ত্বেও, বেতন ও মর্যাদার বৈষম্যে ভুগেও শ্রমিকেরা অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে গেছেন। প্রবাসীরা সাধ্যমতো রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এসবের জোরে সরকার ‘উন্নয়ন’ করছে, লুটেরারা দুর্নীতি-লুটপাট চালাচ্ছে, ভোগবাদীরা ভোগের মচ্ছব চালাতে পারছে। শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় নৈরাজ্য ঠেকানোর অবস্থায় জনগণ নেই, ফলে সে ব্যাপারে তাদের কাছে বেশি দাবি রেখে লাভ নেই।
মানা উচিত, বাংলাদেশ যতটা ভালো আছে, তা তলার মানুষের অবদান। আর খুনখারাবি ও নৈরাজ্য-দুর্নীতি উঁচুতলার উপহার। মুঘল সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আবুল ফজল বলেছিলেন, বঙ্গভূমি হলো বুলঘাখানা অর্থাৎ অশান্তি ও নৈরাজ্যের দেশ। আঠারো শতকে সৈয়দ গোলাম হোসেন তবাতবাঈ রচিত সিয়ার-উল-মুতাখ্খেরিন এর অনুবাদক হাজি মুস্তাফা (ইনি ফরাসি খ্রিষ্টান, পরে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন।) জানিয়েছেন, ভারতবর্ষে কাশ্মীরিরা বি-পীরী আর বেঙ্গলি জেঞ্জালি। অর্থাৎ কাশ্মীরিরা ধর্মহীন আর বাঙালিরা গোলমালপ্রিয়। গোলাম হোসেনও বলেছেন যে উচ্চশ্রেণির মানুষেরা মুখে এক আর মনে আরেক। ল্যুক স্ক্র্যাফটন লিখেছেন, ‘আনুগত্য ও দেশপ্রেম বাঙালির অজানা...বাঙালিরা অনুগত থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ তাদের মনে ভয় থাকে; ভয় গেলে আনুগত্যও উবে যায়। টাকা এখানে শক্তির উৎস...সুতরাং যার যত টাকা, সে তত শক্তিশালী।’ ব্রিটিশ বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসও মনে করতেন, উপমহাদেশে মারাঠা ছাড়া অন্য কোনো জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধন নেই। কাশিমবাজার ফরাসি কুঠির প্রধান মঁশিয়ে লয়ের মতে, এ দেশীয় সেপাই-বরকন্দাজরা উর্দি আর বন্দুক হাতে পেলে নিজেকে অন্য মানুষ মনে করে। (ঊধ্বৃতিসূত্র: প্রাক্পলাশী বাংলা/সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়)
আঠারো শতকের মূল্যায়ন এই একুশ শতকেও কেমন খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উঁচুতলার রাজনীতি এখনো জয়-জিন্দাবাদ ঝগড়াপুরী রাজনীতি! বন্দুক, পোশাক, টাকা ও স্লোগানের জোরের কাছে জনগণ অসহায়। নীতির মা মারা গেছে, দুর্নীতি তার জায়গায় বসে সমাজ-সংসার চালাচ্ছে।
তার পরও ঝগড়া-ঝগড়ি নিয়ে ভালোই আছে বাংলাদেশ। সরকার রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদকে রাজপথ থেকে উঠিয়ে টেলিভিশনের টক শো আর ফেসবুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। একটা সময় ছিল, যখন সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি দেখা যেত। বিরোধী দল যতটা না আন্দোলিত, তার চেয়ে বেশি আন্দোলন-বাগ্যুদ্ধ আর হাতাহাতি দেখা যেত টেলিভিশনের টক শোগুলোয়। এখন ৫৭ ধারার আগমনে দশ দিক শান্ত। এই শান্তির মধ্যে দু-চারজন বিদেশি হত্যা, কিছু মন্দির ভাঙচুর, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে জমি দখলে শান্তি নষ্ট হচ্ছে না। বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ ছিল, এখন তা আরও ভীষণ রকম, কঠিন রকম সম্প্রীতির দেশ হয়েছে। দেশের ৮০ ভাগ ফৌজদারি তথা মারামারির মামলাই জমি নিয়ে। তবু বলতে হবে, সুশাসন বজায় আছে।
উন্নয়ন চলছে। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির বড় নেতারা বিদেশে থাকায় এবং বাদবাকিরা কারাগারস্থ হওয়ায় আপাতত হরতাল-অবরোধের দিন আসছে না। উত্তেজনা, বিবাদ এখন কেবল ফেসবুকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থনীতি বিষয়টা জনগণের জানাবোঝার বাইরে। তারা জেনেছে যে দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের স্তরে প্রমোশন পেয়েছে। সুতরাং জীবনযাত্রা, বাসভাড়া, ভ্যাট, কর ইত্যাদি বাবদ আগের চেয়ে বেশি খরচ তো করতেই হবে।
কবি শঙ্খ ঘোষ নিদারুণ দুঃসময়ে লিখেছিলেন, ‘আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে।’ আমরাও বলতে পারি, আপাতত শান্তি চুপচাপ পড়ে আছে।
বড় সেনাপতি কেবল সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করেন না, জনগণের মতিগতির হিসাবও তাঁরা রাখেন। নিশ্চয়ই সিরাজউদ্দৌলার চেয়ে রবার্ট ক্লাইভ বেশি বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন, বাঙালি জনসাধারণ রাজনীতি নিয়ে উদাসীন আর জমিদার-তালুকদারেরা জমি দখল আর ক্ষমতা-বিত্ত বাড়ানোর কাজিয়া নিয়েই ব্যস্ত। সুতরাং সিরাজের মন্ত্রী-অমাত্য আর সৈন্যদলকে বিভক্ত করা ক্লাইভের জন্য কঠিন কাজ ছিল না। এখনকার মতো তখনো কৃষক-শ্রমিক-জেলে-কারিগরেরাই ছিলেন এই দেশের মূল জনগোষ্ঠী। রাজনীতির চোটপাটের চেয়ে পেটের কারবারেই তাঁরা মন দিয়েছিলেন। কৃষকেরা যেমন সারা দিন মাটিতে উবু হয়ে কাজ করেন, এঁরাও তেমনি আত্মমুখী হয়ে দিন গুজরান করে যেতেন। এখনো মোটামুটি অবস্থাটা তেমনই আছে। তাই বাংলার স্বাধীনতা কোথায় কীভাবে অস্তমিত হলো, তা নিয়ে আসলেই সিরাজ ও তাঁর মতো কিছু দেশপ্রেমিক ছাড়া আর কারও বেদনা বিষয়ে সে সময়ের দলিলপত্র নীরব।
খেয়াল করার বিষয়, সিরাজের পূর্বসূরি আলিবর্দীর শাসনে বাংলার জনগণ ভালোই ছিল। তিনি মারাঠা ও মগদের দমন করেছিলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি এনেছিলেন। তাতেও কাজ হয়নি। সুতরাং প্রবৃদ্ধি ভালো হলেই যে জনগণ শাসকের পক্ষে জানবাজি করবে, তা ঠিক নয়। ২০০৭-০৮ সালে জিডিপি সাড়ে ৬-এর ঘরে ছিল, তবু অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনপ্রিয়তা পায়নি।
জনগণের মতিগতি না বুঝে যুদ্ধ ও নির্বাচন কোনোটাতেই জেতা যায় না। ২০০ বছর আগের কথা, নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেছেন। রাজধানী মস্কোও বেহাত হয়। রুশ সেনাপতি তখনো নির্বিকার। পিছু হটছেন তো হটছেনই। একপর্যায়ে অতিষ্ঠ জেনারেলরা জবাবদিহি চাইলেন। সেনাপতি তাঁদের প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কৃষকেরা কী করছে?’ জেনারেলরা বললেন, তাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন। ‘আর কী করছে?’ যাওয়ার সময় ফসলের গোলা, খেতখামার পুড়িয়ে দিচ্ছেন আর পানিতে ঢেলে দিচ্ছেন বিষ। সেনাপতি এবার গুমর ফাঁস করলেন। বললেন, ‘জনগণকে অনুসরণ করো। তারা এখন প্রতিরোধে সক্ষম নয়। তাই তারা শত্রুদের আরও ভেতরে আসতে দিচ্ছে। খাদ্যভান্ডার ধ্বংস আর পানি বিষাক্ত করে দিয়ে তারা ফরাসিদের ভাতে-পানিতে মারার বন্দোবস্ত করছে। আসল প্রতিরোধ হবে শীতে। তখন বরফে সব জমে যাবে আর নেপোলিয়নের বাহিনী শীতে ও ক্ষুধায় মরমর হবে। সেটাই আক্রমণের মোক্ষম সময়। দেখো, জনগণ ঘাস খায় না, শত শত বছর ধরে তারা এটা শিখেছে।’
সেই যুদ্ধে নেপোলিয়নের বাহিনী মস্কো পুড়িয়ে দিলেও জয়ী হয়নি। সাড়ে পাঁচ লাখ ফরাসি সেনার মধ্যে এক লাখ বন্দী হয় আর নিহত হয় ৩ লাখ ৮০ হাজার। জনগণকে শিক্ষক মেনে বুড়ো সেনাপতি ঠিক কৌশলই নিয়েছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সামরিক নেতারাও ঠিক এই কৌশলটাই নিয়েছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।
যখন ওপরতলা ফাঁপা হয়ে যায়, তখন জনগণই পথ দেখায়। রাজনীতির আঙ্গু বনাম মাঙ্গু কাবিলার যুদ্ধে না জড়িয়ে তারা উৎপাদন ও আয়ের কাজে নিয়োজিত আছে। পিঁপড়ার মতো একেকজন উপার্জনক্ষম তরুণ ও প্রবীণ সাধ্যের চেয়েও বেশি ওজন বহন করছেন। তাঁদের কাঁধে চড়েই কিন্তু সহায়সম্পদহীন বিপুল জনসংখ্যার এই ছোট দেশটা শত বিপদেও মুখ থুবড়ে পড়ছে না। এ বছরও ফসল ভালো হয়েছে, হরতাল-অবরোধ, পেট্রলবোমা ও তাজরীন-রানা প্লাজা সত্ত্বেও, বেতন ও মর্যাদার বৈষম্যে ভুগেও শ্রমিকেরা অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে গেছেন। প্রবাসীরা সাধ্যমতো রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এসবের জোরে সরকার ‘উন্নয়ন’ করছে, লুটেরারা দুর্নীতি-লুটপাট চালাচ্ছে, ভোগবাদীরা ভোগের মচ্ছব চালাতে পারছে। শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় নৈরাজ্য ঠেকানোর অবস্থায় জনগণ নেই, ফলে সে ব্যাপারে তাদের কাছে বেশি দাবি রেখে লাভ নেই।
মানা উচিত, বাংলাদেশ যতটা ভালো আছে, তা তলার মানুষের অবদান। আর খুনখারাবি ও নৈরাজ্য-দুর্নীতি উঁচুতলার উপহার। মুঘল সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আবুল ফজল বলেছিলেন, বঙ্গভূমি হলো বুলঘাখানা অর্থাৎ অশান্তি ও নৈরাজ্যের দেশ। আঠারো শতকে সৈয়দ গোলাম হোসেন তবাতবাঈ রচিত সিয়ার-উল-মুতাখ্খেরিন এর অনুবাদক হাজি মুস্তাফা (ইনি ফরাসি খ্রিষ্টান, পরে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন।) জানিয়েছেন, ভারতবর্ষে কাশ্মীরিরা বি-পীরী আর বেঙ্গলি জেঞ্জালি। অর্থাৎ কাশ্মীরিরা ধর্মহীন আর বাঙালিরা গোলমালপ্রিয়। গোলাম হোসেনও বলেছেন যে উচ্চশ্রেণির মানুষেরা মুখে এক আর মনে আরেক। ল্যুক স্ক্র্যাফটন লিখেছেন, ‘আনুগত্য ও দেশপ্রেম বাঙালির অজানা...বাঙালিরা অনুগত থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ তাদের মনে ভয় থাকে; ভয় গেলে আনুগত্যও উবে যায়। টাকা এখানে শক্তির উৎস...সুতরাং যার যত টাকা, সে তত শক্তিশালী।’ ব্রিটিশ বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসও মনে করতেন, উপমহাদেশে মারাঠা ছাড়া অন্য কোনো জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধন নেই। কাশিমবাজার ফরাসি কুঠির প্রধান মঁশিয়ে লয়ের মতে, এ দেশীয় সেপাই-বরকন্দাজরা উর্দি আর বন্দুক হাতে পেলে নিজেকে অন্য মানুষ মনে করে। (ঊধ্বৃতিসূত্র: প্রাক্পলাশী বাংলা/সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়)
আঠারো শতকের মূল্যায়ন এই একুশ শতকেও কেমন খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উঁচুতলার রাজনীতি এখনো জয়-জিন্দাবাদ ঝগড়াপুরী রাজনীতি! বন্দুক, পোশাক, টাকা ও স্লোগানের জোরের কাছে জনগণ অসহায়। নীতির মা মারা গেছে, দুর্নীতি তার জায়গায় বসে সমাজ-সংসার চালাচ্ছে।
তার পরও ঝগড়া-ঝগড়ি নিয়ে ভালোই আছে বাংলাদেশ। সরকার রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদকে রাজপথ থেকে উঠিয়ে টেলিভিশনের টক শো আর ফেসবুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। একটা সময় ছিল, যখন সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি দেখা যেত। বিরোধী দল যতটা না আন্দোলিত, তার চেয়ে বেশি আন্দোলন-বাগ্যুদ্ধ আর হাতাহাতি দেখা যেত টেলিভিশনের টক শোগুলোয়। এখন ৫৭ ধারার আগমনে দশ দিক শান্ত। এই শান্তির মধ্যে দু-চারজন বিদেশি হত্যা, কিছু মন্দির ভাঙচুর, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে জমি দখলে শান্তি নষ্ট হচ্ছে না। বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ ছিল, এখন তা আরও ভীষণ রকম, কঠিন রকম সম্প্রীতির দেশ হয়েছে। দেশের ৮০ ভাগ ফৌজদারি তথা মারামারির মামলাই জমি নিয়ে। তবু বলতে হবে, সুশাসন বজায় আছে।
উন্নয়ন চলছে। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির বড় নেতারা বিদেশে থাকায় এবং বাদবাকিরা কারাগারস্থ হওয়ায় আপাতত হরতাল-অবরোধের দিন আসছে না। উত্তেজনা, বিবাদ এখন কেবল ফেসবুকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থনীতি বিষয়টা জনগণের জানাবোঝার বাইরে। তারা জেনেছে যে দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের স্তরে প্রমোশন পেয়েছে। সুতরাং জীবনযাত্রা, বাসভাড়া, ভ্যাট, কর ইত্যাদি বাবদ আগের চেয়ে বেশি খরচ তো করতেই হবে।
কবি শঙ্খ ঘোষ নিদারুণ দুঃসময়ে লিখেছিলেন, ‘আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে।’ আমরাও বলতে পারি, আপাতত শান্তি চুপচাপ পড়ে আছে।
No comments