আল-নুসরার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র by রবার্ট ফিস্ক
আল নুসরা ফ্রন্টের যোদ্ধা |
না, ‘মধ্যপন্থী’ জাবহাত-আল-নুসরার
বিদ্রোহীদের কথা উল্লেখ করার জন্য আজ কোনো দুঃখ নেই। এরাও গলাকাটা ও
খুনি বাহিনী, এখন তারা আইএস-বিরোধী অবস্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
প্রণয় প্রার্থনা করছে।
আপনাদের মনে থাকতে পারে, এই দলের নেতা কাতারের আল–জাজিরা টিভিকে বলেছিলেন, আল–কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত তাঁর যোদ্ধারা আইএস ও বাশার আল আসাদ উভয়েরই বিরোধিতা করবে। এমনকি তারা সিরিয়ার খ্রিষ্টান ও আলাওয়িদদের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক প্রবণতা সম্পর্কে যারা জানে তারা বলবে, এর কোনো মানে নেই। তারা আরও বলবে, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদী’দের ঘাড়েই দোষটা বর্তায়। কারণ, তারা এমন কথা বলছে যে যুক্তরাষ্ট্র এসব মানুষের কাছে নতুন নতুন অস্ত্র পাঠাচ্ছে। না, যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত সন্ত্রাসী তালিকায় যারা আছে, তাদের সঙ্গে সে কখনো কোনো সম্পর্কে যাবে না। আর কাতার তো কখনো এই খুনিদের মধ্যপন্থী তকমা দেবে না, তাই না?
এবার ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদীদের দিকে আরেকবার নজর দেওয়া যাক। ফরাসি পত্রিকা লে মঁদ ডিপ্লোমাতিক এই মাসে ‘আপনি কি ষড়যন্ত্রের কথা বললেন?’ শিরোনামে অনেকগুলো নিবন্ধ ছেপেছে। খুব বেদনার সঙ্গে তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, কতগুলো ফলস ফ্ল্যাগ অভিযানের (একাধিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছদ্ম অভিযান) খবর সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মাকদেনের ঘটনার কথাই বলা যেতে পারে। যেমন ১৯৩১ সালে সাম্রাজ্যবাদী জাপানের ওপর চীনের আক্রমণ উল্টো চীনের ওপর জাপানের আক্রমণ বলে প্রতীয়মান হয়, যেখান থেকে জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়। তারপর সেখানে জাপানের আগ্রাসন-বিষয়ক রেপ অব নানকিং-এর মতো বইও লেখা হয়েছে।
তারপর আমরা দেখলাম, রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগল। এই কাজটা সম্ভবত নাৎসিরা করেছিল, কমিউনিস্টরা নয়। তারপর দেখা গেল সিআইএ ও এমআই ৫-এর ষড়যন্ত্র সফল হলো, যার মাধ্যমে তারা ইরানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে উৎখাত করে। অনুমান করা হয়, সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কমিউনিস্টরাই বোমা পুঁতে রেখেছিল। ১৯৫৪ সালে ইসরায়েল কায়রোর মার্কিন ও ব্রিটিশ ভবনে হামলা চালায়, আর তার দোষ চাপানো হয় মিসরীয় জাতীয়তাবাদীদের ওপর। তারপর দেখলাম ১৯৬৪ সালের টনকিন কাণ্ড, তখন যুক্তরাষ্ট্র গায়েবি অভিযোগ করে, উত্তর ভিয়েতনাম মার্কিন যুদ্ধ জাহাজে হামলা চালিয়েছে। সেখান থেকে এক বাস্তব যুদ্ধের শুরু হয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধ। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের এমন ষড়যন্ত্রের আরও নিদর্শন দেখা যায়, গুয়েতেমালা, ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, কিউবা ও আরও অনেক দেশে।
যারা বিশ্বাস করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তাঁর সহযোগীরা ৯/১১-এর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন, উপরোক্ত ফরাসি জার্নালে তাঁদের পক্ষপাতহীনভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। ব্যাপারটা যেন এমন, যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্যে কোনো কিছু করতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলেছেন, তিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করতে পারেন। আর পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আরব বিশ্বের আচ্ছন্নতা, যার আড়ালে তারা নিজেদের দায়-দায়িত্ব লুকাতে চান।
ঠিক সেভাবেই একজন ইসরায়েলি নারী কর্মকর্তা আরব নেতাদের শয্যাসঙ্গী হয়ে তাঁদের ইসরায়েলপন্থী রাজনীতি সমর্থন করতে প্রলুব্ধ করেছেন—এই মিথ্যা খবর ছাপানোর পর মিসরের পত্রিকা আল মাসরি আল ইয়ৌম পরবর্তীকালে ক্ষমাও চেয়েছিল। কিন্তু ইন্টারনেটের সৌজন্যে এই মিথ্যার পুনরুৎপাদন চলছেই।
আরবদের বলা হয়েছে, পশ্চিমা বিশ্ব ষড়যন্ত্র করে ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবের জোয়ার তৈরি করেছিল, যাতে সেখানে অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর মোবারকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাও করেছে মার্কিনরা। প্রথমটির লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রতিবেশীর সাহচর্য থেকে দূরে রাখা, আর দ্বিতীয়টির লক্ষ্য ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় আনা এবং ‘মিসরের মহত্ত্ব খর্ব করা’। মিসরের রাজনৈতিক কর্মীরা সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিরোধিতা করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তারা পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাদের স্বার্থের বাড়বাড়ন্ত করছে। এমনকি ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল-প্রেসিডেন্ট আল সিসিও তা বিশ্বাস করেন। আলজেরিয়ার মানুষ এখনো দাবি করে, সেখানকার সব রাজনৈতিক আন্দোলনের পেছনে রয়েছে ফরাসি দিউক্সিয়েম ব্যুরো (১৯৪০ সালের পর থেকে যাদের অস্তিত্ব আর নেই)।
তাই আমিও এতে যোগ দিচ্ছি। আমার মনে হয়, ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সাধারণ কোনো পাঠক এই বোকামির কথা শুনে ইংরেজি ভাষার বাগ্রীতির এক মহান দৃষ্টান্তের দ্বারস্থ হবেন: হোয়াট আ লোড অব ওল্ড কবলার্স! (বাজে কথা) কিন্তু অপেক্ষা করুন।
কিছুদিন আগে সিরিয়ায় থাকার সময় আমি কয়েকবার শুনেছি, ইরানিরা আসাদের জামানাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিলেও অর্থনৈতিক সহায়তার ব্যাপারে তারা খুবই কৃপণ। দামেস্কের এক সূত্র আমাকে জানিয়েছে, তারা সিরিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য কোনো খরচ করলে তার নিশ্চয়তা হিসেবে রিয়েল এস্টেট দাবি করে। জানি না এটা সত্য কি না। তবে জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্তাফান দে মিস্তুরা হিসাব দিয়েছেন, ইরান সিরিয়ার বর্তমান জামানাকে রক্ষায় প্রতিবছর চার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এর মধ্যে ইরানের সেনা কর্মকর্তা, হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ার হয়ে লড়াই করা ইরাকি শিয়াদের খরচ ধরা হয়নি। তবে ‘ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের’ এক ভদ্রলোক এই হিসাব খারিজ করে বলেছেন, এই খরচের পরিমাণ বছরে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার।
আর এর সব টাকাই নাকি আসে এমন এক দেশ থেকে, যার অর্থনীতি নিষেধাজ্ঞার কারণে ভেঙে পড়েছে? এটা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই যে ইরান যদি এখনো পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায় বা সমমনাদের দেওয়ার মতো এত টাকা তার থাকে, তাহলে সে আল-নুসরা, আইএস ও মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো গুপ্ত ইসলামপন্থীদের চেয়ে ইসরায়েল ও সুন্নি রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় হুমকি। আর এভাবেই কাতারের জনগণ এখন আল-নুসরা থেকে আল কায়েদার খুনিদের দূর করার প্রচারণায় আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিচ্ছে। হ্যাঁ, ষড়যন্ত্রতত্ত্বই বটে।
আবারও ভাবুন। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালেদ আল আতিয়াহ গত মাসে বলেছেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবেই যেকোনো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আইএস ছাড়া সবাই আসাদকে উৎখাতের চেষ্টা করছে।’ মধ্যপন্থীরা নুসরা ফ্রন্টকে বলতে পারে না, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে কাজ করব না। তোমাদের পরিস্থিতি বুঝতে হবে, বাস্তববাদী হতে হবে।’
অন্য কথায়, আল-নুসরার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে আসাদ সরকারকে উৎখাত করা। ফলে তারা মধ্যপন্থীদের কাতারেই পড়ে, তাদের মতো সামরিক সহায়তাও পেতে পারে। যদি মধ্যপন্থীরা আল-নুসরাকে বলতে না পারে, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে কাজ করব না’, তাহলে মার্কিনরা করবে কীভাবে?
ফরাসি সরকারের কাছে পেশকৃত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আইসিসের বিরুদ্ধে বিমান হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। তারা আল-নুসরার অধিকৃত বিপজ্জনক স্থান ত্যাগ করেছে। গত মাসে যখন হাজার হাজার আইএস সেনা মূলত দিনের আলোয় পালমিরা আক্রমণ করে, তখন একটিও মার্কিন বিমান সিরিয়ার আকাশে দেখা যায়নি। আর এসবই ঘটেছে যখন মার্কিন সেনারা আইএসের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণ শেষে ফিরছিল। তাদের বিমানে তখনো বোমা ছিল, কারণ তারা লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পায়নি।
সিরিয়ায় ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে’ কেন্দ্র করে যে সতর্কসংকেত আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা বোঝার জন্য আপনাকে প্রতিবেদক হতে হবে না। কারণ, কিছু কিছু সন্ত্রাসী শিগগিরই আমাদের সন্ত্রাসী হতে যাচ্ছে, যত দিন তারা একই সঙ্গে আরও ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও আসাদের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ে। তাদের দরকার হচ্ছে আরও টাকা ও অস্ত্র। আমি বাজি ধরতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের বদৌলতে তারা সেটা পেয়ে যাবে। শুধু ষড়যন্ত্র শব্দটা উল্লেখ করলাম না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; যুক্তরাজ্যের দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
আপনাদের মনে থাকতে পারে, এই দলের নেতা কাতারের আল–জাজিরা টিভিকে বলেছিলেন, আল–কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত তাঁর যোদ্ধারা আইএস ও বাশার আল আসাদ উভয়েরই বিরোধিতা করবে। এমনকি তারা সিরিয়ার খ্রিষ্টান ও আলাওয়িদদের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক প্রবণতা সম্পর্কে যারা জানে তারা বলবে, এর কোনো মানে নেই। তারা আরও বলবে, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদী’দের ঘাড়েই দোষটা বর্তায়। কারণ, তারা এমন কথা বলছে যে যুক্তরাষ্ট্র এসব মানুষের কাছে নতুন নতুন অস্ত্র পাঠাচ্ছে। না, যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত সন্ত্রাসী তালিকায় যারা আছে, তাদের সঙ্গে সে কখনো কোনো সম্পর্কে যাবে না। আর কাতার তো কখনো এই খুনিদের মধ্যপন্থী তকমা দেবে না, তাই না?
এবার ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদীদের দিকে আরেকবার নজর দেওয়া যাক। ফরাসি পত্রিকা লে মঁদ ডিপ্লোমাতিক এই মাসে ‘আপনি কি ষড়যন্ত্রের কথা বললেন?’ শিরোনামে অনেকগুলো নিবন্ধ ছেপেছে। খুব বেদনার সঙ্গে তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, কতগুলো ফলস ফ্ল্যাগ অভিযানের (একাধিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছদ্ম অভিযান) খবর সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মাকদেনের ঘটনার কথাই বলা যেতে পারে। যেমন ১৯৩১ সালে সাম্রাজ্যবাদী জাপানের ওপর চীনের আক্রমণ উল্টো চীনের ওপর জাপানের আক্রমণ বলে প্রতীয়মান হয়, যেখান থেকে জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়। তারপর সেখানে জাপানের আগ্রাসন-বিষয়ক রেপ অব নানকিং-এর মতো বইও লেখা হয়েছে।
তারপর আমরা দেখলাম, রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগল। এই কাজটা সম্ভবত নাৎসিরা করেছিল, কমিউনিস্টরা নয়। তারপর দেখা গেল সিআইএ ও এমআই ৫-এর ষড়যন্ত্র সফল হলো, যার মাধ্যমে তারা ইরানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে উৎখাত করে। অনুমান করা হয়, সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কমিউনিস্টরাই বোমা পুঁতে রেখেছিল। ১৯৫৪ সালে ইসরায়েল কায়রোর মার্কিন ও ব্রিটিশ ভবনে হামলা চালায়, আর তার দোষ চাপানো হয় মিসরীয় জাতীয়তাবাদীদের ওপর। তারপর দেখলাম ১৯৬৪ সালের টনকিন কাণ্ড, তখন যুক্তরাষ্ট্র গায়েবি অভিযোগ করে, উত্তর ভিয়েতনাম মার্কিন যুদ্ধ জাহাজে হামলা চালিয়েছে। সেখান থেকে এক বাস্তব যুদ্ধের শুরু হয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধ। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের এমন ষড়যন্ত্রের আরও নিদর্শন দেখা যায়, গুয়েতেমালা, ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, কিউবা ও আরও অনেক দেশে।
যারা বিশ্বাস করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তাঁর সহযোগীরা ৯/১১-এর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন, উপরোক্ত ফরাসি জার্নালে তাঁদের পক্ষপাতহীনভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। ব্যাপারটা যেন এমন, যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্যে কোনো কিছু করতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলেছেন, তিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করতে পারেন। আর পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আরব বিশ্বের আচ্ছন্নতা, যার আড়ালে তারা নিজেদের দায়-দায়িত্ব লুকাতে চান।
ঠিক সেভাবেই একজন ইসরায়েলি নারী কর্মকর্তা আরব নেতাদের শয্যাসঙ্গী হয়ে তাঁদের ইসরায়েলপন্থী রাজনীতি সমর্থন করতে প্রলুব্ধ করেছেন—এই মিথ্যা খবর ছাপানোর পর মিসরের পত্রিকা আল মাসরি আল ইয়ৌম পরবর্তীকালে ক্ষমাও চেয়েছিল। কিন্তু ইন্টারনেটের সৌজন্যে এই মিথ্যার পুনরুৎপাদন চলছেই।
আরবদের বলা হয়েছে, পশ্চিমা বিশ্ব ষড়যন্ত্র করে ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবের জোয়ার তৈরি করেছিল, যাতে সেখানে অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর মোবারকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাও করেছে মার্কিনরা। প্রথমটির লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রতিবেশীর সাহচর্য থেকে দূরে রাখা, আর দ্বিতীয়টির লক্ষ্য ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় আনা এবং ‘মিসরের মহত্ত্ব খর্ব করা’। মিসরের রাজনৈতিক কর্মীরা সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিরোধিতা করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তারা পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাদের স্বার্থের বাড়বাড়ন্ত করছে। এমনকি ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল-প্রেসিডেন্ট আল সিসিও তা বিশ্বাস করেন। আলজেরিয়ার মানুষ এখনো দাবি করে, সেখানকার সব রাজনৈতিক আন্দোলনের পেছনে রয়েছে ফরাসি দিউক্সিয়েম ব্যুরো (১৯৪০ সালের পর থেকে যাদের অস্তিত্ব আর নেই)।
তাই আমিও এতে যোগ দিচ্ছি। আমার মনে হয়, ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সাধারণ কোনো পাঠক এই বোকামির কথা শুনে ইংরেজি ভাষার বাগ্রীতির এক মহান দৃষ্টান্তের দ্বারস্থ হবেন: হোয়াট আ লোড অব ওল্ড কবলার্স! (বাজে কথা) কিন্তু অপেক্ষা করুন।
কিছুদিন আগে সিরিয়ায় থাকার সময় আমি কয়েকবার শুনেছি, ইরানিরা আসাদের জামানাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিলেও অর্থনৈতিক সহায়তার ব্যাপারে তারা খুবই কৃপণ। দামেস্কের এক সূত্র আমাকে জানিয়েছে, তারা সিরিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য কোনো খরচ করলে তার নিশ্চয়তা হিসেবে রিয়েল এস্টেট দাবি করে। জানি না এটা সত্য কি না। তবে জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্তাফান দে মিস্তুরা হিসাব দিয়েছেন, ইরান সিরিয়ার বর্তমান জামানাকে রক্ষায় প্রতিবছর চার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এর মধ্যে ইরানের সেনা কর্মকর্তা, হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ার হয়ে লড়াই করা ইরাকি শিয়াদের খরচ ধরা হয়নি। তবে ‘ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের’ এক ভদ্রলোক এই হিসাব খারিজ করে বলেছেন, এই খরচের পরিমাণ বছরে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার।
আর এর সব টাকাই নাকি আসে এমন এক দেশ থেকে, যার অর্থনীতি নিষেধাজ্ঞার কারণে ভেঙে পড়েছে? এটা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই যে ইরান যদি এখনো পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায় বা সমমনাদের দেওয়ার মতো এত টাকা তার থাকে, তাহলে সে আল-নুসরা, আইএস ও মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো গুপ্ত ইসলামপন্থীদের চেয়ে ইসরায়েল ও সুন্নি রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় হুমকি। আর এভাবেই কাতারের জনগণ এখন আল-নুসরা থেকে আল কায়েদার খুনিদের দূর করার প্রচারণায় আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিচ্ছে। হ্যাঁ, ষড়যন্ত্রতত্ত্বই বটে।
আবারও ভাবুন। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালেদ আল আতিয়াহ গত মাসে বলেছেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবেই যেকোনো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আইএস ছাড়া সবাই আসাদকে উৎখাতের চেষ্টা করছে।’ মধ্যপন্থীরা নুসরা ফ্রন্টকে বলতে পারে না, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে কাজ করব না। তোমাদের পরিস্থিতি বুঝতে হবে, বাস্তববাদী হতে হবে।’
অন্য কথায়, আল-নুসরার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে আসাদ সরকারকে উৎখাত করা। ফলে তারা মধ্যপন্থীদের কাতারেই পড়ে, তাদের মতো সামরিক সহায়তাও পেতে পারে। যদি মধ্যপন্থীরা আল-নুসরাকে বলতে না পারে, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে কাজ করব না’, তাহলে মার্কিনরা করবে কীভাবে?
ফরাসি সরকারের কাছে পেশকৃত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আইসিসের বিরুদ্ধে বিমান হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। তারা আল-নুসরার অধিকৃত বিপজ্জনক স্থান ত্যাগ করেছে। গত মাসে যখন হাজার হাজার আইএস সেনা মূলত দিনের আলোয় পালমিরা আক্রমণ করে, তখন একটিও মার্কিন বিমান সিরিয়ার আকাশে দেখা যায়নি। আর এসবই ঘটেছে যখন মার্কিন সেনারা আইএসের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণ শেষে ফিরছিল। তাদের বিমানে তখনো বোমা ছিল, কারণ তারা লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পায়নি।
সিরিয়ায় ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে’ কেন্দ্র করে যে সতর্কসংকেত আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা বোঝার জন্য আপনাকে প্রতিবেদক হতে হবে না। কারণ, কিছু কিছু সন্ত্রাসী শিগগিরই আমাদের সন্ত্রাসী হতে যাচ্ছে, যত দিন তারা একই সঙ্গে আরও ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও আসাদের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ে। তাদের দরকার হচ্ছে আরও টাকা ও অস্ত্র। আমি বাজি ধরতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের বদৌলতে তারা সেটা পেয়ে যাবে। শুধু ষড়যন্ত্র শব্দটা উল্লেখ করলাম না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; যুক্তরাজ্যের দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
No comments