তেহরানের বাংলাদেশিদের প্রথম মিলনমেলা by মুমিত আল রশিদ
চল
না ঘুরে আসি অজানাতে...যেখানে নদী এসে থেমে গেছে...। রেডিও তেহরানের
সাংবাদিক মুসা ভাইয়ের আবার এই গানে আপত্তি থাকতে পারে। কারণ এখানে তো শুধু
পাহাড়-পর্বত আর বিস্তীর্ণ মরুভূমি। তবে এটি বাঙালির বনভোজনের থিম সং। আমার
সঙ্গে এখানকার ফোন কোম্পানিগুলোতে সেবাদানকারী প্রকৌশলী জহির ভাই ও লিমন
ভাইও একমত পোষণ করবেন। ইরানের মাটিতে এই প্রথম বাংলাদেশিদের মিলনমেলা।
যাওয়ার আগেই জমজমাট এক বাঙালি খানাদানার আয়োজন করে ফেললেন তেহরানের
বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর এ টি এম মোনেমুল হক ভাই। তাঁর বাসায় দারুণ এক
রিহার্সাল হয়ে গেল। রেডিও তেহরানের সাংবাদিক ও আমাদের প্রিয় মা পাগল রশিদ
ভাই এমন গান গাইলেন যে, ভাবি এসে শেষ পর্যন্ত তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
খাওয়া পরবর্তী বনভোজন সভায় মোনেম ভাবি বললেন, বাচ্চার মায়েরা দয়া করে
বাচ্চাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেবেন তাহলেই আপনার ভ্রমণ আনন্দময় হবে। দড়ি
টানা, বালিশ খেলা থেকে শুরু করে বাঙালির ডাংগুলি খেলারও প্রস্তাব এল।
বনভোজনের স্থান মোটামুটি নিশ্চিত হলো ইরানের সর্বশেষ প্রদেশ আলবোর্যের
কেন্দ্রীয় শহর কারাজের চালুস উপত্যকায়। এটি তেহরান থেকে ৭০ কিলোমিটার
দূরে। বলা হয়ে থাকে এই উপত্যকা ইরানের তো বটেই সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম
আকর্ষণীয় একটি উপত্যকা। চিত্তাকর্ষক সব পাহাড়ি ঝরনার সমাহার এখানে রয়েছে।
তবে তেহরানের মাটিতে এই প্রথম বাংলাদেশিদের মিলনমেলা উপলক্ষে সকলে ব্যাপক
সাড়া দিয়েছেন।
পিকনিকের নানা মুহূর্ত |
সবাইকে একটি পরিবারে বেধে ফেলার কাজটি
দারুণ দক্ষতায় করেছেন হুয়াভেই টেকনোলোজির প্রকৌশলী হামিদুর রহমান ভাই।
তাঁর দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্নের বৃক্ষ আমাদের ‘হ্যালো তেহরান’। এখানেই আমরা
আমাদের সুখ-দুঃখগুলো একে-অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেই। ইরানে আগমনের এই
দীর্ঘ সময়ে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত ও ব্যথিত হয়েছি আমারই দেশের কিছু মানুষরূপী
দালাল বর্বরদের অমানুষিক কর্মকাণ্ডে। বর্তমান ইরানে অবৈধ উপায়ে বসবাসকারী
বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ এবং এদের অধিকাংশই শ্রমিক। কিন্তু
গর্বের বিষয় হচ্ছে এখনো পর্যন্ত কোনো ইরানি নাগরিকের কাছেই এদের বদনাম
শুনিনি। বাংলাদেশি দালালদের খপ্পরে পড়ে ও ইরানের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে
তুরস্ক হয়ে ইউরোপের লোভনীয় বেতনের হাতছানিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন আমাদের
হতভাগা এই শ্রমিকেরা। তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি
রাখে, কেননা তাঁরা এ বিষয়ে বেশ তৎপর এবং মাঝে মধ্যেই অভিযান পরিচালনা করে
থাকেন। তবে ‘হ্যালো তেহরান’ ইরানে বৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশি অর্থাৎ
এখানকার নেটওয়ার্কিং ও ফোন কোম্পানির বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত, মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী,
বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা ও রেডিও তেহরানে কর্মরত সাংবাদিকদের সমন্বয়ে
গঠিত প্রাণের সংগঠন।
পিকনিকের নানা মুহূর্ত |
যা হোক ৫ জুন বনভোজনের তারিখ নির্দিষ্ট
করা হলো ভানাক ময়দান থেকে। একেবারে সকাল সকাল সবাই হাজির। সবার মাঝেই ভীষণ
উত্তেজনা। কেননা এই প্রথম ইরানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের দলবলসহ পিকনিকে
যাওয়া। আমাদের যাঁরা যেতে পারেননি তাদের যে কী আফসোস হলো! ওদিকে ডাক্তার
কামরুল ভাই ফারস প্রদেশে আলেকজান্দ্রার দ্য গ্রেটের শত্রু সাইরাস দ্য
গ্রেটের সমাধিতে বসে মায়াকান্না করছেন, তিনি কেন যেতে পারছেন না। অবশেষে
দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভ্রমণ শুরু হলো। প্রথমেই বিপত্তি দেখা গেল বাস অনুযায়ী
যাত্রী সংখ্যা বেশি। কী আর করা কয়েকজন তাদের ব্যক্তিগত গাড়িতেই রওনা হলেন।
যেভাবেই হোক যেতে হবে—এই মহামিলনের সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
ভানাক থেকে এক ঘণ্টার পথ চালুস। পিকনিক স্পটটি উপত্যকার মাঝখানে হওয়ায়
মালামালগুলো কেউ কাঁধে করে কেউবা মাথায় করে একেবারে বাঙালি স্টাইলে বহন করে
নিয়ে যাচ্ছেন। মুহূর্তটি বেশ উপভোগ্য ছিল। স্রোতস্বিনী নদীটি যেন এক
প্রাকৃতিক রেফ্রিজারেটর। সঙ্গে থাকা কোমল পানীয় আর পানির বোতলগুলো কিছুক্ষণ
পাড়ে ডুবিয়ে রাখতেই পানের উপযোগী শীতল হয়ে গেল। স্পটে পৌঁছেই শুরু হয়ে গেল
বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর আরিফুর রহমান অপু ভাইয়ের জমজমাট
কথার আসর। আমরা তাকে মজা করে বলি কথক রাজা। দারুণ সব গল্প, ভ্রমণ কাহিনি,
সব যেন এই মানুষটার মাথায় গিজগিজ করে।
পিকনিকের নানা মুহূর্ত |
বিশেষ
কৃতজ্ঞতা সকল ভাবিদের, তাদের অসাধারণ রন্ধনশৈলীর জন্য। তাদের কল্যাণেই
দেশি খাবারের স্বাদ এখনো ভুলি নাই। বনভোজনের অন্যতম মূল আকর্ষণ ছিল
নিঃসন্দেহে ভাবিদের বালিশ খেলা ও পুরুষদের দড়ি টানা ও হাঁড়ি ভাঙা। কিন্তু এ
দেশে যে মাটির হাঁড়িতে রাঁধা হয় না। কী আর করা। হাঁড়ির বদলে তরকারি রাঁধার
পাত্র আর লাঠির বদলে কাঠের খুন্তিই দেওয়া হলো। দারুণ এক উত্তেজনাকর
মুহূর্ত শুরু হলো এখানে। ভাবিরাও অতি রোমাঞ্চিত হয়ে অংশগ্রহণ করলেন হাঁড়ি
ভাঙা খেলায়। এভাবেই দারুণ এক বনভোজনের পরিসমাপ্তি হলো। প্রবাসের জীবনে এই
মুহূর্তগুলো হীরক খচিত আবেগ দিয়ে ঘেরা। জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু মুহূর্তের
অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে অপরকে আপন করে নেওয়ার উত্তম কিছু পন্থা। আশা করব
বিশ্বের সকল প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এভাবেই দেশের সকল
মানুষকে আপন করে নেবেন। ভালো থাকুক প্রিয় স্বদেশ, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
উপত্যকার মনোরম দৃশ্য |
(লেখক
সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান।
সাবেক সহসভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা, জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ। ইমেইল:
mumit2020@gmail.com)
No comments