গরু পাচার বন্ধে সীমান্তে ভারতের ৩০,০০০ সেনা মোতায়েন
অবৈধ
পথে গরু আসা বন্ধ করতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৩০ হাজার সেনা মোতায়েন
করেছে ভারত। প্রতি রাতে তারা সীমান্তের পাটক্ষেত, ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে
বিলি দিয়ে প্রহরা দিচ্ছে। জলপথ সাঁতরে একপাশ থেকে আরেকপাশে ছুটে যাচ্ছে-
যাতে ভারতীয় কোন গরু অবৈধ পথে বাংলাদেশে যেতে না পারে। বার্তা সংস্থা
রয়টার্স গতকাল এ খবর দিয়ে আরও বলেছে, মুসলিম প্রধান প্রতিবেশী দেশের প্রতি
ভারতীয় এ নীতি এ দেশটির ওপর অর্থনৈতিক কি প্রভাব ফেলছে তা পরিষ্কার হয়ে
গেছে। ভারতীয় গরু বাংলাদেশে আসার পথ এভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। ওই
রিপোর্টে আরও বলা হয়, ভারত থেকে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ গবাদিপশু বাংলাদেশে
আসে পাচার হয়ে। গত চার দশকে বছরে ৬০ কোটি ডলারের এ ব্যবসা বিকশিত হয়েছে।
ভারতে গত বছর হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর
সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার সরকারই এই
গরুর ব্যবসা বন্ধ করতে চায়। ওদিকে আরএসএসের পশ্চিমবঙ্গ শাখার মুখপাত্র
জিষ্ণু বসু মন্তব্য করেছেন, গরু পাচার করা হলো একটি হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ বা
একটি হিন্দু মন্দির ধ্বংসের সমতুল্য। আরএসএস নেতার এ মন্তব্যই গরু নিয়ে
ভারত সরকারের বর্তমান অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে। ভারতের বর্তমান বিজেপি
সরকার আরএসএস-এর ঘনিষ্ঠ। দলটির নীতিনির্ধারণে আরএসএস-এর ভূমিকা ও প্রভাবের
কথা অজানা নয়। ভারত সরকারের বর্তমান গরু নীতি ও এর প্রভাব নিয়ে একটি
প্রকাশিত রয়টার্সের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ভারতে প্রায় ৩০ কোটি গরু
রয়েছে। দেশটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গরুর মাংস রপ্তানিকারক। কিন্তু উগ্র
হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস-এর ঘনিষ্ঠ বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে
গরু সুরক্ষা ও মাংস রপ্তানি নিষিদ্ধের দাবিতে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য
বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমালোচকরা বলেন, গরুর মাংস নিষিদ্ধের বিষয়টি মুসলিম,
খ্রিস্টান ও নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদের জন্য বৈষম্যমূলক। কেননা, তারা
প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য সস্তা দামের গরুর মাংসের ওপর নির্ভরশীল। গরু
ব্যবসায়ী ও কসাইরা অনেকেই মুসলিম। গরুর মাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে,
হাজার হাজার কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে। কিন্তু থামেনি গরুর মাংস
নিষিদ্ধের দাবি। এমনকি ভারতের মহারাষ্ট্রে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধও হয়েছে!
গঠিত হয়েছে গরু রক্ষা বাহিনী। তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেক
গরু ব্যবসায়ী। মোহাম্মদ তরফদার নামের এক ব্যবসায়ী জানান, তাকে গরুর রক্ষা
বাহিনীর সদস্যরা গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়েছে। এমনকি হিন্দু প্রার্থনা
আওড়াতেও বাধ্য করা হয়েছে। বশিরহাট জেলার জীর্ণ কারাগারে বসে তিনি ক্ষোভ
সহকারে বলছিলেন, আমার ধর্ম আমাকে গরুর মাংস খেতে বারণ করেনি। তো এ নিয়ে
হিন্দুদের কেন সমস্যা থাকবে? বাংলাদেশে কসাইখানায়, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ
কারখানা, ট্যানারি, হাড় নিষ্পেষণকারী কারখানায় গরু সরবরাহে নিলাম আয়োজন করা
হয়। নিলামের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, এ শিল্প বাংলাদেশের ১৯০০০
কোটি ডলারের অর্থনীতিতে প্রায় তিন শতাংশ অবদান রাখে। ভারতের নীতির কারণে
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে আঘাত কতটুকু হয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি। তবে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব এইচটি ইমাম বলছেন, এ নিয়ে কোন
সন্দেহ নেই যে, মাংস ব্যবসা ও চামড়া শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের
শীর্ষ মাংস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মিটের সৈয়দ হাসান হাবিব জানান,
তার প্রতিষ্ঠান ৭৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক ফরমায়েশ বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছে।
সাধারণত, প্রতিষ্ঠানটি মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিবছর ১২৫ টন মাংস রপ্তানি করে।
তিনি আরও জানান, গরুর মাংসের দাম গত ছয় মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তার প্রতিষ্ঠান দুইটি মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।
ভারতের বাজার বন্ধ হওয়ায় হাসান হাবিব স্থানীয় চাহিদা মেটাতে নেপাল, ভুটান ও
মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি করার পরিকল্পনা করছেন। তবে তার মতে, ভারতীয় গরুর
মাংসের মান ভালো। বাংলাদেশ ট্যানারিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শাহিন
আহমেদ বলেন, চামড়ার অভাবে ১৯০টির মধ্যে ৩০টি ট্যানারি অনেক কাজ বাতিল করতে
বাধ্য হয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৪ হাজার মানুষ বর্তমানে
কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
বলেন, বাংলাদেশের উচিত গরুর নতুন উৎস খুঁজে বের করা। কেননা, ভারত তার
অবস্থানে অটল থাকবে।
No comments