মর্মান্তিক by মতিউল আলম
তখন
ভোর ৫টা। সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাচ্ছিল শহরের মানুষ। আর নীরব,
নিস্তব্ধ শহরের গরিব-অসহায়, নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধরা তখন ছুটছিলেন এক
টুকরো কাপড়ের আশায়। অতুল চক্রবর্তী রোডে ‘নূরানী জর্দা’ ফ্যাক্টরির
অভিমুখে। দ্রুতই সেখানে জমে উঠেছিল প্রত্যাশীদের ভিড়। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে
চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো জাকাতের একটি নতুন কাপড়ের আশায় ভিড় করা মানুষগুলোর
চিৎকার আর কান্নার রোল। এতে আশপাশের মানুষ ঘুম ভেঙে ছুটে গেল ঘটনাস্থলে।
ইতিমধ্যেই সেখানে ঘটে গেছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। প্রাণ চলে গেছে অনেকের।
নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির সামনে তখন হতাহত মানুষের স্তূপ। দ্রুত সে খবর
ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। ফের ঘটনাস্থল নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরি অভিমুখে
মানুষের ঢল নামলো। এবার জাকাতের কাপড়ের আশায় নয়, হতাহত মানুষের উদ্ধারে।
সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ৪ শিশু, ২৩ মহিলাসহ ২৭ জনের লাশ। আহতদের আর্তনাদ
ছাপিয়ে উঠলো হতাহতের স্বজনদের আহাজারিতে। ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। আর এমন
ট্র্যাজেডিতে স্তব্ধ হয়ে পড়ে ময়মনসিংহবাসী।
এ যেন ডাকাতের কাপড়ের বদলে কাফনের কাপড় পেলো হতভাগা মানুষগুলো। এ ঘটনায় নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক মোহাম্মদ শামীম, তার পুত্রসহ ৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন ৩ সদস্যবিশিষ্ট দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল ও সিকিউরিটি সেলের একজন পুলিশ সুপারকে সদস্য করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এদিকে জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মল্লিকা খাতুনকে প্রধান করে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে ফয়জুল হক ও এনডিসি তৌহিদুল ইসলামকে সদস্য করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলোকে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান নেয়া হয়েছে।
পদদলিত হয়ে নিহতরা হলেন, হালিমা বেগম (৪৫) স্বামী হায়দর আলী আকুয়া; নাজমা বেগম (৫০) স্বামী জালাল উদ্দিন, আকুয়া মোড়লপাড়া; ফাতেমা (৬০) স্বামী আবদুস ছালাম আকুয়া মোড়লপাড়া; জোহরা খাতুন (৫৫) স্বামী ইসমাইল, আকুয়া মোড়লপাড়া; রেজিয়া আক্তার (৪০) স্বামী আবদুল মজিদ, গাঠগোলা বাজার; ফাতেমা বেগম (৪২) স্বামী রবি হোসেন, আকুয়া দক্ষিণ পাড়া; সুফিয়া বেগম (৬০) স্বামী লাল মিয়া, চর ঈশ্বরদিয়া; খোদেজা বেগম (৫৫), স্বামী আবদুল সালেক, থানাঘাট বালুর চর; সিদ্দিক (১২) পিতা সিরাজুল ইসলাম, থানাঘাট বালুর চর; লামিয়া (৫) পিতা কৃষ্ণা মিয়া, থানাঘাট বালুর চর; সখিনা (৪০) স্বামী কৃষ্ণা মিয়া, থানাঘাট বালুর চর; সামু বেগম (৬০) স্বামী আবদুল বারেক, থানাঘাট বালুর চর; ফজিলা বেগম (৭৫) স্বামী মাহতাব উদ্দিন, কাছারি ঘাট; হাজেরা বেগম (৭০) স্বামী লালু মিয়া, পাটগুদাম বিহারি ক্যাম্প; রুবিয়া আক্তার (১২) পিতা রতন মিয়া, ঢোলাদিয়া; রহিমা বেগম (৫৫) স্বামী শামসুল হক, আকুয়া দরগাপাড়া; আঙ্গুরী বেগম (৩৫) স্বামী শফিকুল ইসলাম, কালিবাড়ী গোদারাঘাট; সাহারন বেগম (৪০) স্বামী আরজু মিয়া, বালিপাড়া ত্রিশাল; মেঘনা বসাক (৪০), বসাকপট্টি; রুপালী (৪০) অতুল চক্রবর্তী রোড; সুধারণী সরকার (৫৫) ধোপাখোলা ময়মনসিংহ শহর ও বৃষ্টি (১১)। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও একজন মহিলা। নিহতদের মধ্যে শহরের থানাঘাট ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত বাস্তুহারা ক্যাম্পের একই পরিবারের শামিমা বেগম (৬০), তার মেয়ে সখিনা (৩৫) ও নাতি লামিয়া (৬) এবং থানাঘাট বালুর চর মা-মেয়ে লামিয়া (৫) ও সখিনা (৪০) রয়েছেন। অন্যদিকে আহত হেনা (৫৪) ময়না (৭০), রাসেলসহ (২৫) ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে থানা পুলিশ ও পোস্টমর্টেমের ভয়ে পদদলিত মৃত্যুর পর ঘটনাস্থল ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেট থেকেই নিহতদের অনেকের লাশ নিয়ে গেছেন স্বজনরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনরা অনেকের লাশ বাড়িতে নিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় অর্ধশত আহত হয়েছেন। এ ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী, পুলিশ সুপার মইনুল হক দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন।
ঘটনার পরপরই পুলিশ নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিকসহ ৮ জনকে আটক করেছে। আটককৃতরা হলেন মালিক মোহাম্মদ শামীম (৬৫) ও তার পুত্র হেদায়েত (৩০), ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ইকবাল হোসেন (৩৫), ইকবাল (৪০), আরমান হোসেন (৩৫), আলমগীর হোসেন (৩৪), আরশাদুল ইসলাম (৩২), ড্রাইভার পারভেজ (৩৫) ও কর্মচারী আবদুল হামিদ (৩৬)। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম জানান, নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে পদদলিত মৃত এ পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। এদিকে বৃষ্টির কারণে নিহতদের লাশ দাফন-কাফন নিয়ে বিপাকে পড়েন স্বজনরা।
জাকাতের কাপড় আনতে যাওয়া আনোয়ারা বেগম বলেন, তিনি শহরের থানাঘাট বস্তিতে থাকেন। সেহরির আগে তিনিও শামীম তালুকদারের বাড়িতে জাকাতের কাপড় নিতে যান। কেবল থানাঘাট বস্তি থেকেই ৫০০ জনের মতো মানুষ ওই বাড়িতে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়েছিলেন। আনোয়ারা বেগম বলেন, ভোর হওয়ার আগেই ওই বাড়ির সামনে তিনটি লাইনে মানুষের ভিড় জমে যায়। একপর্যায়ে ওই বাড়ির দারোয়ান এসে দুই পাশ থেকে বাঁশ বেঁধে দেন। তারা কাপড় নিতে আসা ব্যক্তিদের একটি লাইনে আসতে বলেন। ভোর পাঁচটার দিকে ওই বাড়ির প্রবেশ ফটক খুলে দেয়া হয়। এ সময় হুড়োহুড়ি করে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে অনেকে পড়ে গেলে এই পদদলনের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোরে ফ্যাক্টরির গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে শত শত জাকাতপ্রত্যাশী হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ সময় পদদলিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী এক মহিলা জানান, গেটের সামনে অনেক লোক বইসা ছিল। ভোরে গেটের সামনে অনেক লোক পীড়াপীড়ি শুরু করে। কিন্তু কেউ গেট খুলেনি। শামীম সাহেব ফজরের নামাজে যাওয়ার সময় ছোট গেটা একটু খুলেন। ঝামেলা হয় ওই সময়ই। তারা অভিযোগ করেন, বাড়ির মালিক শামীম ছোট গেটের বদলে বড় গেট খুলে দিলে এ ঘটনা ঘটতো না। এতজন মানুষেরও প্রাণ যেতো না। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভ্যানচালক দুলাল মিয়া জানান, প্রায় কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ভিড় করেছিলেন জাকাতের কাপড়ের জন্য। গেট খুলতেই হুড়োহুড়ি করে ভেতরে ঢোকার সময়ই কমপক্ষে শতাধিক মানুষ পদপিষ্ট হন। স্থানীয় সূত্র জানায়, জাকাতের কাপড় দেয়ার জন্য ছয় দিন ধরে কার্ড বিলি করেন কারখানার মালিক শামীমের লোকজন। শহরের দুলদুল ক্যাম্প, বিহারি ক্যাম্প ও থানাঘাটসহ শহরের বিভিন্ন বস্তির গরিব ও দুস্থদের মধ্যে এ কার্ড বিতরণ করা হয়। জাকাতের কাপড় বিতরণের জন্য কারখানা ও বাসার সামনে গতকাল দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু জাকাত দেয়ার এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির গেট ও সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক শ দুস্থ নারী-পুরুষ অবস্থান নেন। মুক্তাগাছা, ঈশ্বরগঞ্জ, তারাকান্দাসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে দরিদ্ররা ভিড় করেন কারখানার সামনে। সেহরির পর আরও হাজারখানেক লোক জড়ো হন সেখানে। প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতের স্বজন ও আহতরা জানান, হঠাৎ করে ভোর ৫টায় খুলে দেয়া হয় কারখানায় প্রবেশের ছোট গেট। গেটের সামনে বসেছিলেন কমপক্ষে ৩ থেকে সাড়ে ৪ শ মানুষ। বেশির ভাগই ছিলেন বৃদ্ধ, নারী ও শিশু। আর তাদের পেছনে ছিলেন হাজারেরও অধিক মানুষ।
গ্রেপ্তারকৃত জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম জানান, প্রতি বছরের মতো এবারো ৬০০ জনকে জাকাতের কাপড় দেয়ার জন্য কার্ড দেয়া হয়েছিল। তিনি এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দুঃখ প্রকাশ করে জানান, এর আগে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। স্থানীয়দের মতে, ঘটা করে প্রতি বছরই জাকাত দেন নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার অবশ্যই সচেতন হওয়ার দরকার ছিল। বিশেষ করে যখন কার্ডের বিপরীতে আরও কয়েক হাজার দুস্থ ও গরিব মানুষ ভিড় করার পর প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য নিতে পারতেন তিনি। ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকা ও তাদের এ উদাসীনতার কারণেই এত মানুষের মৃত্যু হলো।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, কারখানার মালিক শামীমের অসচেতনতাই এ ট্র্যাজেডির অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা জানতে পেরেছি তিনি যদি ছোট গেটের বদলে বড় গেটটি খুলে দিতেন তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা ঘটতো না। জেলা প্রশাসক আরও জানান, কার্ড বিলি করে জাকাত দেয়ার এ খবর পুলিশ প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের জানাননি তিনি। পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ যেন ডাকাতের কাপড়ের বদলে কাফনের কাপড় পেলো হতভাগা মানুষগুলো। এ ঘটনায় নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক মোহাম্মদ শামীম, তার পুত্রসহ ৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন ৩ সদস্যবিশিষ্ট দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল ও সিকিউরিটি সেলের একজন পুলিশ সুপারকে সদস্য করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এদিকে জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মল্লিকা খাতুনকে প্রধান করে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে ফয়জুল হক ও এনডিসি তৌহিদুল ইসলামকে সদস্য করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলোকে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান নেয়া হয়েছে।
পদদলিত হয়ে নিহতরা হলেন, হালিমা বেগম (৪৫) স্বামী হায়দর আলী আকুয়া; নাজমা বেগম (৫০) স্বামী জালাল উদ্দিন, আকুয়া মোড়লপাড়া; ফাতেমা (৬০) স্বামী আবদুস ছালাম আকুয়া মোড়লপাড়া; জোহরা খাতুন (৫৫) স্বামী ইসমাইল, আকুয়া মোড়লপাড়া; রেজিয়া আক্তার (৪০) স্বামী আবদুল মজিদ, গাঠগোলা বাজার; ফাতেমা বেগম (৪২) স্বামী রবি হোসেন, আকুয়া দক্ষিণ পাড়া; সুফিয়া বেগম (৬০) স্বামী লাল মিয়া, চর ঈশ্বরদিয়া; খোদেজা বেগম (৫৫), স্বামী আবদুল সালেক, থানাঘাট বালুর চর; সিদ্দিক (১২) পিতা সিরাজুল ইসলাম, থানাঘাট বালুর চর; লামিয়া (৫) পিতা কৃষ্ণা মিয়া, থানাঘাট বালুর চর; সখিনা (৪০) স্বামী কৃষ্ণা মিয়া, থানাঘাট বালুর চর; সামু বেগম (৬০) স্বামী আবদুল বারেক, থানাঘাট বালুর চর; ফজিলা বেগম (৭৫) স্বামী মাহতাব উদ্দিন, কাছারি ঘাট; হাজেরা বেগম (৭০) স্বামী লালু মিয়া, পাটগুদাম বিহারি ক্যাম্প; রুবিয়া আক্তার (১২) পিতা রতন মিয়া, ঢোলাদিয়া; রহিমা বেগম (৫৫) স্বামী শামসুল হক, আকুয়া দরগাপাড়া; আঙ্গুরী বেগম (৩৫) স্বামী শফিকুল ইসলাম, কালিবাড়ী গোদারাঘাট; সাহারন বেগম (৪০) স্বামী আরজু মিয়া, বালিপাড়া ত্রিশাল; মেঘনা বসাক (৪০), বসাকপট্টি; রুপালী (৪০) অতুল চক্রবর্তী রোড; সুধারণী সরকার (৫৫) ধোপাখোলা ময়মনসিংহ শহর ও বৃষ্টি (১১)। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও একজন মহিলা। নিহতদের মধ্যে শহরের থানাঘাট ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত বাস্তুহারা ক্যাম্পের একই পরিবারের শামিমা বেগম (৬০), তার মেয়ে সখিনা (৩৫) ও নাতি লামিয়া (৬) এবং থানাঘাট বালুর চর মা-মেয়ে লামিয়া (৫) ও সখিনা (৪০) রয়েছেন। অন্যদিকে আহত হেনা (৫৪) ময়না (৭০), রাসেলসহ (২৫) ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে থানা পুলিশ ও পোস্টমর্টেমের ভয়ে পদদলিত মৃত্যুর পর ঘটনাস্থল ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেট থেকেই নিহতদের অনেকের লাশ নিয়ে গেছেন স্বজনরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনরা অনেকের লাশ বাড়িতে নিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় অর্ধশত আহত হয়েছেন। এ ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী, পুলিশ সুপার মইনুল হক দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন।
ঘটনার পরপরই পুলিশ নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিকসহ ৮ জনকে আটক করেছে। আটককৃতরা হলেন মালিক মোহাম্মদ শামীম (৬৫) ও তার পুত্র হেদায়েত (৩০), ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ইকবাল হোসেন (৩৫), ইকবাল (৪০), আরমান হোসেন (৩৫), আলমগীর হোসেন (৩৪), আরশাদুল ইসলাম (৩২), ড্রাইভার পারভেজ (৩৫) ও কর্মচারী আবদুল হামিদ (৩৬)। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম জানান, নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে পদদলিত মৃত এ পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। এদিকে বৃষ্টির কারণে নিহতদের লাশ দাফন-কাফন নিয়ে বিপাকে পড়েন স্বজনরা।
জাকাতের কাপড় আনতে যাওয়া আনোয়ারা বেগম বলেন, তিনি শহরের থানাঘাট বস্তিতে থাকেন। সেহরির আগে তিনিও শামীম তালুকদারের বাড়িতে জাকাতের কাপড় নিতে যান। কেবল থানাঘাট বস্তি থেকেই ৫০০ জনের মতো মানুষ ওই বাড়িতে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়েছিলেন। আনোয়ারা বেগম বলেন, ভোর হওয়ার আগেই ওই বাড়ির সামনে তিনটি লাইনে মানুষের ভিড় জমে যায়। একপর্যায়ে ওই বাড়ির দারোয়ান এসে দুই পাশ থেকে বাঁশ বেঁধে দেন। তারা কাপড় নিতে আসা ব্যক্তিদের একটি লাইনে আসতে বলেন। ভোর পাঁচটার দিকে ওই বাড়ির প্রবেশ ফটক খুলে দেয়া হয়। এ সময় হুড়োহুড়ি করে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে অনেকে পড়ে গেলে এই পদদলনের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোরে ফ্যাক্টরির গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে শত শত জাকাতপ্রত্যাশী হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ সময় পদদলিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী এক মহিলা জানান, গেটের সামনে অনেক লোক বইসা ছিল। ভোরে গেটের সামনে অনেক লোক পীড়াপীড়ি শুরু করে। কিন্তু কেউ গেট খুলেনি। শামীম সাহেব ফজরের নামাজে যাওয়ার সময় ছোট গেটা একটু খুলেন। ঝামেলা হয় ওই সময়ই। তারা অভিযোগ করেন, বাড়ির মালিক শামীম ছোট গেটের বদলে বড় গেট খুলে দিলে এ ঘটনা ঘটতো না। এতজন মানুষেরও প্রাণ যেতো না। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভ্যানচালক দুলাল মিয়া জানান, প্রায় কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ভিড় করেছিলেন জাকাতের কাপড়ের জন্য। গেট খুলতেই হুড়োহুড়ি করে ভেতরে ঢোকার সময়ই কমপক্ষে শতাধিক মানুষ পদপিষ্ট হন। স্থানীয় সূত্র জানায়, জাকাতের কাপড় দেয়ার জন্য ছয় দিন ধরে কার্ড বিলি করেন কারখানার মালিক শামীমের লোকজন। শহরের দুলদুল ক্যাম্প, বিহারি ক্যাম্প ও থানাঘাটসহ শহরের বিভিন্ন বস্তির গরিব ও দুস্থদের মধ্যে এ কার্ড বিতরণ করা হয়। জাকাতের কাপড় বিতরণের জন্য কারখানা ও বাসার সামনে গতকাল দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু জাকাত দেয়ার এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির গেট ও সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক শ দুস্থ নারী-পুরুষ অবস্থান নেন। মুক্তাগাছা, ঈশ্বরগঞ্জ, তারাকান্দাসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে দরিদ্ররা ভিড় করেন কারখানার সামনে। সেহরির পর আরও হাজারখানেক লোক জড়ো হন সেখানে। প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতের স্বজন ও আহতরা জানান, হঠাৎ করে ভোর ৫টায় খুলে দেয়া হয় কারখানায় প্রবেশের ছোট গেট। গেটের সামনে বসেছিলেন কমপক্ষে ৩ থেকে সাড়ে ৪ শ মানুষ। বেশির ভাগই ছিলেন বৃদ্ধ, নারী ও শিশু। আর তাদের পেছনে ছিলেন হাজারেরও অধিক মানুষ।
গ্রেপ্তারকৃত জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক শামীম জানান, প্রতি বছরের মতো এবারো ৬০০ জনকে জাকাতের কাপড় দেয়ার জন্য কার্ড দেয়া হয়েছিল। তিনি এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দুঃখ প্রকাশ করে জানান, এর আগে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। স্থানীয়দের মতে, ঘটা করে প্রতি বছরই জাকাত দেন নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরির মালিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার অবশ্যই সচেতন হওয়ার দরকার ছিল। বিশেষ করে যখন কার্ডের বিপরীতে আরও কয়েক হাজার দুস্থ ও গরিব মানুষ ভিড় করার পর প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য নিতে পারতেন তিনি। ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকা ও তাদের এ উদাসীনতার কারণেই এত মানুষের মৃত্যু হলো।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, কারখানার মালিক শামীমের অসচেতনতাই এ ট্র্যাজেডির অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা জানতে পেরেছি তিনি যদি ছোট গেটের বদলে বড় গেটটি খুলে দিতেন তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা ঘটতো না। জেলা প্রশাসক আরও জানান, কার্ড বিলি করে জাকাত দেয়ার এ খবর পুলিশ প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের জানাননি তিনি। পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
No comments