পতন ঠেকানোর শক্তিটা এখনো তলাতেই by ফারুক ওয়াসিফ
এগারো তরুণ যা করে দেখালেন, এক হলে কোটি কোটি তরুণও সব বদলে দিতে পারেন |
একবার
এক লোক মহা এক আবিষ্কার করে ফেলল: বিমান চলবে পানি দিয়ে। কোনো গ্যাস,
তেল লাগবে না। কোনো দূষণ হবে না। ব্যয় কম। খালি এটাকে পানিতে ভরে ফেলো,
তারপর দুনিয়ার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ওড়ো। সবাই তো মহা খুশি! লোকজন তখন
জানতে চাইল তার কাছে, ‘কীভাবে বানাবে সেই প্লেন, পরিকল্পনাটা বলো!’
প্রতিভাধর লোকটা বিরক্ত, ‘পরিকল্পনা?’ আমি তো মহান একটা চিন্তা করেছি। এখন ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব হলো কারিগরি দিকগুলো ঠিক করা, জিনিসটা বানিয়ে ফেলা!
এ ধরনের মহা প্রতিভাধর মানুষ চারপাশে বিস্তর আছেন। তাঁরা বিরাট বিরাট পদে আরোহণ করে নিত্যনতুন আইডিয়া নাজিল করেন। কেউ ডিজিটাল বিপ্লব করবেন, কেউবা রাতারাতি মধ্যম আয়ের দেশ বানিয়ে ফেলবেন কাগজে–কলমে, কেউবা ঢাকাকে তিলোত্তমা রাজধানী করবেন, কেউ গ্রামে গ্রামে অট্টালিকা তুলবেন ইত্যাদি আওয়াজ তোলেন। কিন্তু এক তরুণ, বেশি কথা না বলে নিজের কাজটা করে ফেললেন! সূর্য ওঠার মতো অবিসংবাদিত সেই আবির্ভাবে কারোরই সন্দেহ থাকল না।
তিনি যা করেছেন, ও রকম আইডিয়া অন্তত কয়েক হাজার তরুণের মনে ভাতের বলকের মতো অহরহ ফুটছে। কিন্তু নবীন ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান কাজটা করে দেখালেন। তিন ম্যাচে ক্রিকেটীয় পরাশক্তি ভারতের ১৩টি উইকেট অবলীলায় তুলে নিলেন! দুনিয়ার ক্রিকেটভক্তরা তাঁকে অভিবাদন জানাল। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আরও গর্বিত হয়ে উড়তে থাকল লাল–সবুজ পতাকা। কিন্তু কী অসম্ভব বিনয় তার, কী সুন্দর সরলতা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সামর্থ্যবানের বিনয় থাকে। মুস্তাফিজুরের খেলার মতোই তাঁর বিনয়ও সবাইকে মুগ্ধ করল।
বাঙালি হুজুগ তোলে একসঙ্গে, কাজ পণ্ড করে ঝগড়াঝাঁটিতে। কিন্তু একজন ১৬ কোটি হৃদয়কে এক করলেন। গভীর নলকূপ থেকে পানি তোলার মতো সহযোদ্ধাদের ভেতরের শ্রেষ্ঠত্বকে টেনে তুলে জাদুকরি ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন। বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, হোম সিরিজে পাকিস্তান-ভারতকে ছাপিয়ে ‘উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!’ করে তুললেন দলটাকে। তিনি বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট দলের (পুরুষ) অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।
তরুণতর মাশরাফি শুধু তাঁর দলের এগারো বাঘের স্কোয়াডকেই শুধু নয়, ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়কে এক তরঙ্গে উদ্বেলিত করতে পেরেছিলেন। যেন এক প্রাজ্ঞ অর্কেস্ট্রা পরিচালক, যাঁর হাতের ওঠানামায় সহস্র বাদক সুর তুলছে একই তানে একই সংগীতে। মহৎ চিন্তার পাশাপাশি মহৎ সাধনা তাঁর ছিল বলেই না! কিন্তু দেখুন, জয়ের চাইতেও তাঁর বড় অভীষ্ট দেশপ্রেম, যেখানে কোনো উগ্রতা নেই, বিদ্বেষ নেই। এর জন্য শুধু আবেগ হলে চলে না, সংকল্পও লাগে।
আমাদেরই আরেক বিশ্বসেরা খেলোয়াড় সিদ্দিকুর রহমান। তিনি এশিয়ান ট্যুর জিতে গলফ বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হওয়ার গরিমা অর্জন করেছেন। সাবেক ক্রিকেট তারকা মোহাম্মদ রফিকের মতো তাঁরও বেড়ে ওঠা বস্তির মাদক-সন্ত্রাস-দারিদ্র্যময় পরিবেশে। অভিজাত গলফ ক্লাবে বল টোকাতে টোকাতে তিনি খেলাটা শিখে নেন। সেই অভিজাতেরা টেকেননি, কিন্তু সিদ্দিকুর তলানি থেকে উঠে এসেছেন শীর্ষে—ঠিক মুস্তাফিজুরের মতো করেই। সংগ্রামী আত্মবিশ্বাস তাঁকেও বিনয়ী করেছে, ‘মুই কি হনু রে’ ভাব ধরতে যাননি।
আমাদের মফস্বল দেশকে দুই জাতের ‘প্রতিভা’ উপহার দিয়েছে: মাফিয়া ও নায়ক। গত এক দশকে প্রায় প্রতিটি জেলাতেই মাফিয়াদের উপর্যুপরি উত্থান দেখেছে বাংলাদেশ। তারা জোঁকের মতো দেশের দেহ থেকে রক্ত চোষণ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। বিপরীতে শিক্ষা-দীক্ষায়, সংগীতে, সাহিত্যে, খেলাধুলায়, উদ্ভাবনায়, ব্যবসা–বাণিজ্যে আর শ্রমের উৎকর্ষে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠায় আরেক দল তরুণ তলানি থেকে চেষ্টার সিঁড়ি বেয়ে শীর্ষে আরোহণ করেছেন। বলা যায়, একপ্রকার হেঁটেই, অর্থাৎ পরিশ্রম আর কষ্ট সয়েই তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন সফলতার সোপানে। আমাদের চিরতরুণ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের মতোই নাটকীয়তায় ভরা এঁদের উত্থানপর্ব।
বারবারই হতাশাবাদীদের বিস্মিত করে দিয়ে, শত্রুদের হতভম্ব করে দিয়ে একেবারে তলা থেকে এমন এমন পথিকৃৎ তরুণ–তরুণীরা আসবেন, যঁাদের আমরা মাপতেই পারব না। ১৬ কোটির দেশে মজুত আছে এ রকম অনেক শক্তি। ক্রমেই তাঁরা একদিন ওই সব মাফিয়ার মুখোমুখি হয়ে দেশটাকে নিজেদের হাতে নিয়ে আসবেন, এই আশাকে তাই অলীক বলা যায় না।
আমাদের মানুষ অঢেল, দৃষ্টান্তও বিস্তর। যখন জলবায়ু দুর্যোগে উপকূলের বিরাট অংশ ডুবে যাবে বলে ভয় দানা বাঁধছে, তখনই খবর হলো, পলি জমে জমে সমুদ্রে নতুন বাংলাদেশ জাগছে। আমাদের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা, আমাদের পানি ব্যবস্থাপনাবিদেরা, আমাদের বাঁধে আসক্ত সরকারি লোকজন যখন পরিকল্পনা করেন, তখন সাধারণ মানুষকে বাদ রেখে হিসাব করেন। তো, জলবায়ু বিষয়েও সেটাই হলো। মানুষ তো বাদই, তাঁরা নদীবাহিত পলির কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠেকা যার বেশি, বুদ্ধির খোঁজ সেই মানুষই করে। নোয়াখালীর চরাঞ্চলের মানুষ সেই পলি ধরে রাখার নিজস্ব উদ্যোগ নিয়ে উপকূল জাগিয়ে তোলার ব্যবস্থা করে। পরে সরকার তাদের সঙ্গে শামিল হয়। যশোরের ভবদহের জলাবদ্ধতা মোকাবিলায়ও সাধারণ মানুষ শিক্ষা দেয় সরকারকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভুলে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা দূর করার পথ দেখান এলাকার ভুক্তভোগী তরুণেরা।
আমি এমন কিছু গবেষক–তরুণকে চিনি, যাঁরা গ্রামের সন্তান বা বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের ঘরে জন্মেছেন। গবেষণার ক্ষেত্রে এঁদের কারও কারও অর্জন তাক লাগানোর মতো। এঁরা দেশেই থাকুন বা বিদেশে, বাংলাদেশের চিন্তার জগতে তাঁরা অবদান রেখে যাচ্ছেন এবং যাবেন।
এভাবে বারবার সমাজের একেবারে তলা থেকে, গ্রাম-মফস্বল থেকে মুস্তাফিজুরের মতো ‘আদর্শ’ এসেছেন। ঠিক যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম-মফস্বলের তরুণেরা এসে যুদ্ধের সামনের সারিতে থেকে দেশটাকে স্বাধীন করে গেছেন, সেভাবে এখনো সংগ্রামে, সংকটে তাঁরাই জোগান দিয়ে যান নতুন শক্তির, সম্ভাবনার আর প্রেরণার। ঠিক যেভাবে যুদ্ধের পরে ওই সব গ্রামীণ সেনানী ফিরে গেছেন খেত–খামারে, আর সংগ্রামের সোনা খেয়ে নিয়েছে একদল উটকো মানুষ, তেমনটা আজও ঘটছে বলে বাংলাদেশ জাগতে জাগতেও থমকে আছে। তারপরও এ এমন এক দেশ, যে হতাশার শেষ সীমানা থেকে আবার আশার দিকে মোড় ঘোরায়। আমরা তাই একেবারে তলিয়ে যাই না। তলানি থেকে কেউ এসে পতনটা ঠেকায়।
আমাদের ঐতিহাসিক যাত্রাটা সমুদ্রের ঢেউয়ের দোলার মতো। একবার উচ্চে, একবার নিম্নে। যেবার আমরা তলাতে থাকি, সেবারই পতনের নিম্নতম দাগ থেকে আবার ধাক্কিয়ে দেশটাকে ওঠানো শুরু করে সেই তলানির মানুষেরা।
ঢাকার জুরাইনে একদল তরুণ এলাকার জলাবদ্ধতা, নিরক্ষরতা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন এক যুগ ধরে। সম্প্রতি দেখলাম, এলাকার সাংসদ সেই তরুণদের সঙ্গে বসে সমস্যা সমাধানের চাপ মেনে নিচ্ছেন। কুড়িগ্রামের একদল তরুণ পুরোনো বাণিজ্যপোত চিলমারীর গৌরব ফিরিয়ে আনায় আন্দোলনের পর আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাঁদের আন্দোলনের ফলে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ হয়েছে, জংধরা রেললাইনে আবার ট্রেন আসা শুরু করেছে, গড়ে উঠছে পাঠাগার আন্দোলন। রানা প্লাজা ধসের পর এ ধরনের তরুণেরাই তো কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে সেই মৃত্যুপুরী থেকে অনেক জীবন ছিনিয়ে এনেছিলেন।
গত বছর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলেই দেখেছি ‘আমরা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ সহায়তার হাত নিয়ে ছুটে গেছে সেখানে। বরিশালে এক কিশোর সাংবাদিক বের করে যাচ্ছে লাল–সবুজ নামের পত্রিকা—বেশ কয়েক বছর যাবৎ। সারা দেশে খুঁজলে এ রকম অজস্র জন-উদ্যোগের খোঁজ মিলবে। সে জন্যই বিশ্বাস করি, আমাদের ওপরতলার অধিকাংশটাই দূষিত হয়ে গেলেও, তলায় এখনো সঞ্জীবনী প্রাণশক্তি আছে। ওই প্রাণশক্তির উদ্যম আর সাহসটাই বাংলাদেশের প্রাণভোমরা। এটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় তরুণদেরই। ইতিহাস যতই নিষ্ঠুর হোক, তরুণের রক্ত আর সাধনার দাম তাকে দিতেই হয়।
আজ যে গ্রাম–মফস্বলের তরুণেরা প্রথমবারের মতো ডিগ্রি পাস করে শহরে আসছেন; মাতৃভাষা, ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে ক্ষমতা ও বিত্তের সঙ্গে দর–কষাকষি করছে; সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় লিখছেন নিজের অভিজ্ঞতা, তাঁরা নির্ঘাৎ বদলে দেবেন বাস্তবতা, যদি মাশরাফির মতো অধ্যবসায় আর মুস্তাফিজুরের মতো সারল্যের শক্তি থাকে।
আমাদের ইতিহাসে যাঁরা একবারের জন্য হলেও মহৎ উচ্চতায় উঠেছিলেন, তাঁরাও তো তরুণেরই প্রতিভূ। উত্থানের যুগে তাঁদের বেশির ভাগ প্রায় তরুণই ছিলেন। এঁরা কেউ বদলে গেছেন, কেউ নীতিতে অটল থেকেছেন, কিন্তু এঁদের সূচনাটা ছিল মহৎ। এবং এঁরা পেয়েছিলেন শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর মতো বটবৃক্ষের সস্নেহ ছায়া। আজকেও তরুণদের পথ আকীর্ণ করে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সরাতে অভিজ্ঞ প্রবীণদের আশ্রয়-প্রশ্রয় খুবই প্রয়োজন।
আজকের তরুণেরা সব জায়গায় পারছেন, পারছেন না কেবল রাজনীতিতে। যেখানেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চর্চা, যেখানে পদ-প্রতিষ্ঠার কামড়াকামড়ি, সেখানে তরুণ বিপর্যস্ত ও ব্যবহৃত হতে হতে ছিবড়া হয়ে যান। যেখানেই তাঁর যোগ্যতা দেখানোর সুযোগ ততটা বাধাগ্রস্ত নয়, সেখানেই তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন। গত কয়েক বছরে ক্রিকেটে বাংলাদেশের মুখচ্ছবি যে বদলে যেতে পেরেছে, তা হতে পেরেছে সুযোগের দরজাটা খোলা ছিল বলে। যেখানেই প্রতিভার পথে কাঁটা কম, সেখানেই বিস্ময়কর সাফল্য আসছে। ক্রিকেট-বিশ্বে লেখালেখি চলছে যে বাংলাদেশে এত প্রতিভাময় খেলোয়াড় আসে কোত্থেকে?
একবার সুযোগ পেয়েই এগারো তরুণ যে জাদু দেখিয়ে দিয়েছেন, এক হলে দেশের কোটি কোটি তরুণ কী করে ফেলতে পারেন, তা কল্পনা করে শিহরিত হতে হয়। দুর্বৃত্তদের বাধা সত্ত্বেও যদি আমরা এটা পারি, তাদের সরাতে পারলে আমরা কী করতে পারি, সেটা কি ভাবছি?
যাঁরা ভাবছেন, বাংলাদেশকে পদাবনত রাখা যাবে, তরুণদের হ্যামিলনের চতুর বাঁশিওয়ালাদের পিছে দৌড়িয়ে হয়রান করে ফেলা যাবে, নিশ্চয়ই তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন চমক। এই দেশ সংকটের কালে যত দিন তার সেরাটাকে সামনে আনতে পারবে, তত দিন আশা আছে। যে বিগ ব্যাং থেকে জগতের সৃষ্টি, তার সূচনা হয়েছিল কিন্তু ছোট এক বিন্দুর স্ফুলিঙ্গ থেকে। বিন্দু থেকেই বৃত্ত হয়, মুস্তাফিজ-তাসকিন-সৌম্যদের মতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি থেকেই পরিবর্তনের লংমার্চ যে শুরু হবে না, তা কে বলতে পারে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
প্রতিভাধর লোকটা বিরক্ত, ‘পরিকল্পনা?’ আমি তো মহান একটা চিন্তা করেছি। এখন ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব হলো কারিগরি দিকগুলো ঠিক করা, জিনিসটা বানিয়ে ফেলা!
এ ধরনের মহা প্রতিভাধর মানুষ চারপাশে বিস্তর আছেন। তাঁরা বিরাট বিরাট পদে আরোহণ করে নিত্যনতুন আইডিয়া নাজিল করেন। কেউ ডিজিটাল বিপ্লব করবেন, কেউবা রাতারাতি মধ্যম আয়ের দেশ বানিয়ে ফেলবেন কাগজে–কলমে, কেউবা ঢাকাকে তিলোত্তমা রাজধানী করবেন, কেউ গ্রামে গ্রামে অট্টালিকা তুলবেন ইত্যাদি আওয়াজ তোলেন। কিন্তু এক তরুণ, বেশি কথা না বলে নিজের কাজটা করে ফেললেন! সূর্য ওঠার মতো অবিসংবাদিত সেই আবির্ভাবে কারোরই সন্দেহ থাকল না।
তিনি যা করেছেন, ও রকম আইডিয়া অন্তত কয়েক হাজার তরুণের মনে ভাতের বলকের মতো অহরহ ফুটছে। কিন্তু নবীন ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান কাজটা করে দেখালেন। তিন ম্যাচে ক্রিকেটীয় পরাশক্তি ভারতের ১৩টি উইকেট অবলীলায় তুলে নিলেন! দুনিয়ার ক্রিকেটভক্তরা তাঁকে অভিবাদন জানাল। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আরও গর্বিত হয়ে উড়তে থাকল লাল–সবুজ পতাকা। কিন্তু কী অসম্ভব বিনয় তার, কী সুন্দর সরলতা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সামর্থ্যবানের বিনয় থাকে। মুস্তাফিজুরের খেলার মতোই তাঁর বিনয়ও সবাইকে মুগ্ধ করল।
বাঙালি হুজুগ তোলে একসঙ্গে, কাজ পণ্ড করে ঝগড়াঝাঁটিতে। কিন্তু একজন ১৬ কোটি হৃদয়কে এক করলেন। গভীর নলকূপ থেকে পানি তোলার মতো সহযোদ্ধাদের ভেতরের শ্রেষ্ঠত্বকে টেনে তুলে জাদুকরি ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন। বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, হোম সিরিজে পাকিস্তান-ভারতকে ছাপিয়ে ‘উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!’ করে তুললেন দলটাকে। তিনি বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট দলের (পুরুষ) অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।
তরুণতর মাশরাফি শুধু তাঁর দলের এগারো বাঘের স্কোয়াডকেই শুধু নয়, ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়কে এক তরঙ্গে উদ্বেলিত করতে পেরেছিলেন। যেন এক প্রাজ্ঞ অর্কেস্ট্রা পরিচালক, যাঁর হাতের ওঠানামায় সহস্র বাদক সুর তুলছে একই তানে একই সংগীতে। মহৎ চিন্তার পাশাপাশি মহৎ সাধনা তাঁর ছিল বলেই না! কিন্তু দেখুন, জয়ের চাইতেও তাঁর বড় অভীষ্ট দেশপ্রেম, যেখানে কোনো উগ্রতা নেই, বিদ্বেষ নেই। এর জন্য শুধু আবেগ হলে চলে না, সংকল্পও লাগে।
আমাদেরই আরেক বিশ্বসেরা খেলোয়াড় সিদ্দিকুর রহমান। তিনি এশিয়ান ট্যুর জিতে গলফ বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হওয়ার গরিমা অর্জন করেছেন। সাবেক ক্রিকেট তারকা মোহাম্মদ রফিকের মতো তাঁরও বেড়ে ওঠা বস্তির মাদক-সন্ত্রাস-দারিদ্র্যময় পরিবেশে। অভিজাত গলফ ক্লাবে বল টোকাতে টোকাতে তিনি খেলাটা শিখে নেন। সেই অভিজাতেরা টেকেননি, কিন্তু সিদ্দিকুর তলানি থেকে উঠে এসেছেন শীর্ষে—ঠিক মুস্তাফিজুরের মতো করেই। সংগ্রামী আত্মবিশ্বাস তাঁকেও বিনয়ী করেছে, ‘মুই কি হনু রে’ ভাব ধরতে যাননি।
আমাদের মফস্বল দেশকে দুই জাতের ‘প্রতিভা’ উপহার দিয়েছে: মাফিয়া ও নায়ক। গত এক দশকে প্রায় প্রতিটি জেলাতেই মাফিয়াদের উপর্যুপরি উত্থান দেখেছে বাংলাদেশ। তারা জোঁকের মতো দেশের দেহ থেকে রক্ত চোষণ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। বিপরীতে শিক্ষা-দীক্ষায়, সংগীতে, সাহিত্যে, খেলাধুলায়, উদ্ভাবনায়, ব্যবসা–বাণিজ্যে আর শ্রমের উৎকর্ষে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠায় আরেক দল তরুণ তলানি থেকে চেষ্টার সিঁড়ি বেয়ে শীর্ষে আরোহণ করেছেন। বলা যায়, একপ্রকার হেঁটেই, অর্থাৎ পরিশ্রম আর কষ্ট সয়েই তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন সফলতার সোপানে। আমাদের চিরতরুণ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের মতোই নাটকীয়তায় ভরা এঁদের উত্থানপর্ব।
বারবারই হতাশাবাদীদের বিস্মিত করে দিয়ে, শত্রুদের হতভম্ব করে দিয়ে একেবারে তলা থেকে এমন এমন পথিকৃৎ তরুণ–তরুণীরা আসবেন, যঁাদের আমরা মাপতেই পারব না। ১৬ কোটির দেশে মজুত আছে এ রকম অনেক শক্তি। ক্রমেই তাঁরা একদিন ওই সব মাফিয়ার মুখোমুখি হয়ে দেশটাকে নিজেদের হাতে নিয়ে আসবেন, এই আশাকে তাই অলীক বলা যায় না।
আমাদের মানুষ অঢেল, দৃষ্টান্তও বিস্তর। যখন জলবায়ু দুর্যোগে উপকূলের বিরাট অংশ ডুবে যাবে বলে ভয় দানা বাঁধছে, তখনই খবর হলো, পলি জমে জমে সমুদ্রে নতুন বাংলাদেশ জাগছে। আমাদের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা, আমাদের পানি ব্যবস্থাপনাবিদেরা, আমাদের বাঁধে আসক্ত সরকারি লোকজন যখন পরিকল্পনা করেন, তখন সাধারণ মানুষকে বাদ রেখে হিসাব করেন। তো, জলবায়ু বিষয়েও সেটাই হলো। মানুষ তো বাদই, তাঁরা নদীবাহিত পলির কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠেকা যার বেশি, বুদ্ধির খোঁজ সেই মানুষই করে। নোয়াখালীর চরাঞ্চলের মানুষ সেই পলি ধরে রাখার নিজস্ব উদ্যোগ নিয়ে উপকূল জাগিয়ে তোলার ব্যবস্থা করে। পরে সরকার তাদের সঙ্গে শামিল হয়। যশোরের ভবদহের জলাবদ্ধতা মোকাবিলায়ও সাধারণ মানুষ শিক্ষা দেয় সরকারকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভুলে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা দূর করার পথ দেখান এলাকার ভুক্তভোগী তরুণেরা।
আমি এমন কিছু গবেষক–তরুণকে চিনি, যাঁরা গ্রামের সন্তান বা বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের ঘরে জন্মেছেন। গবেষণার ক্ষেত্রে এঁদের কারও কারও অর্জন তাক লাগানোর মতো। এঁরা দেশেই থাকুন বা বিদেশে, বাংলাদেশের চিন্তার জগতে তাঁরা অবদান রেখে যাচ্ছেন এবং যাবেন।
এভাবে বারবার সমাজের একেবারে তলা থেকে, গ্রাম-মফস্বল থেকে মুস্তাফিজুরের মতো ‘আদর্শ’ এসেছেন। ঠিক যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম-মফস্বলের তরুণেরা এসে যুদ্ধের সামনের সারিতে থেকে দেশটাকে স্বাধীন করে গেছেন, সেভাবে এখনো সংগ্রামে, সংকটে তাঁরাই জোগান দিয়ে যান নতুন শক্তির, সম্ভাবনার আর প্রেরণার। ঠিক যেভাবে যুদ্ধের পরে ওই সব গ্রামীণ সেনানী ফিরে গেছেন খেত–খামারে, আর সংগ্রামের সোনা খেয়ে নিয়েছে একদল উটকো মানুষ, তেমনটা আজও ঘটছে বলে বাংলাদেশ জাগতে জাগতেও থমকে আছে। তারপরও এ এমন এক দেশ, যে হতাশার শেষ সীমানা থেকে আবার আশার দিকে মোড় ঘোরায়। আমরা তাই একেবারে তলিয়ে যাই না। তলানি থেকে কেউ এসে পতনটা ঠেকায়।
আমাদের ঐতিহাসিক যাত্রাটা সমুদ্রের ঢেউয়ের দোলার মতো। একবার উচ্চে, একবার নিম্নে। যেবার আমরা তলাতে থাকি, সেবারই পতনের নিম্নতম দাগ থেকে আবার ধাক্কিয়ে দেশটাকে ওঠানো শুরু করে সেই তলানির মানুষেরা।
ঢাকার জুরাইনে একদল তরুণ এলাকার জলাবদ্ধতা, নিরক্ষরতা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন এক যুগ ধরে। সম্প্রতি দেখলাম, এলাকার সাংসদ সেই তরুণদের সঙ্গে বসে সমস্যা সমাধানের চাপ মেনে নিচ্ছেন। কুড়িগ্রামের একদল তরুণ পুরোনো বাণিজ্যপোত চিলমারীর গৌরব ফিরিয়ে আনায় আন্দোলনের পর আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাঁদের আন্দোলনের ফলে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ হয়েছে, জংধরা রেললাইনে আবার ট্রেন আসা শুরু করেছে, গড়ে উঠছে পাঠাগার আন্দোলন। রানা প্লাজা ধসের পর এ ধরনের তরুণেরাই তো কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে সেই মৃত্যুপুরী থেকে অনেক জীবন ছিনিয়ে এনেছিলেন।
গত বছর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলেই দেখেছি ‘আমরা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ সহায়তার হাত নিয়ে ছুটে গেছে সেখানে। বরিশালে এক কিশোর সাংবাদিক বের করে যাচ্ছে লাল–সবুজ নামের পত্রিকা—বেশ কয়েক বছর যাবৎ। সারা দেশে খুঁজলে এ রকম অজস্র জন-উদ্যোগের খোঁজ মিলবে। সে জন্যই বিশ্বাস করি, আমাদের ওপরতলার অধিকাংশটাই দূষিত হয়ে গেলেও, তলায় এখনো সঞ্জীবনী প্রাণশক্তি আছে। ওই প্রাণশক্তির উদ্যম আর সাহসটাই বাংলাদেশের প্রাণভোমরা। এটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় তরুণদেরই। ইতিহাস যতই নিষ্ঠুর হোক, তরুণের রক্ত আর সাধনার দাম তাকে দিতেই হয়।
আজ যে গ্রাম–মফস্বলের তরুণেরা প্রথমবারের মতো ডিগ্রি পাস করে শহরে আসছেন; মাতৃভাষা, ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে ক্ষমতা ও বিত্তের সঙ্গে দর–কষাকষি করছে; সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় লিখছেন নিজের অভিজ্ঞতা, তাঁরা নির্ঘাৎ বদলে দেবেন বাস্তবতা, যদি মাশরাফির মতো অধ্যবসায় আর মুস্তাফিজুরের মতো সারল্যের শক্তি থাকে।
আমাদের ইতিহাসে যাঁরা একবারের জন্য হলেও মহৎ উচ্চতায় উঠেছিলেন, তাঁরাও তো তরুণেরই প্রতিভূ। উত্থানের যুগে তাঁদের বেশির ভাগ প্রায় তরুণই ছিলেন। এঁরা কেউ বদলে গেছেন, কেউ নীতিতে অটল থেকেছেন, কিন্তু এঁদের সূচনাটা ছিল মহৎ। এবং এঁরা পেয়েছিলেন শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর মতো বটবৃক্ষের সস্নেহ ছায়া। আজকেও তরুণদের পথ আকীর্ণ করে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সরাতে অভিজ্ঞ প্রবীণদের আশ্রয়-প্রশ্রয় খুবই প্রয়োজন।
আজকের তরুণেরা সব জায়গায় পারছেন, পারছেন না কেবল রাজনীতিতে। যেখানেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চর্চা, যেখানে পদ-প্রতিষ্ঠার কামড়াকামড়ি, সেখানে তরুণ বিপর্যস্ত ও ব্যবহৃত হতে হতে ছিবড়া হয়ে যান। যেখানেই তাঁর যোগ্যতা দেখানোর সুযোগ ততটা বাধাগ্রস্ত নয়, সেখানেই তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন। গত কয়েক বছরে ক্রিকেটে বাংলাদেশের মুখচ্ছবি যে বদলে যেতে পেরেছে, তা হতে পেরেছে সুযোগের দরজাটা খোলা ছিল বলে। যেখানেই প্রতিভার পথে কাঁটা কম, সেখানেই বিস্ময়কর সাফল্য আসছে। ক্রিকেট-বিশ্বে লেখালেখি চলছে যে বাংলাদেশে এত প্রতিভাময় খেলোয়াড় আসে কোত্থেকে?
একবার সুযোগ পেয়েই এগারো তরুণ যে জাদু দেখিয়ে দিয়েছেন, এক হলে দেশের কোটি কোটি তরুণ কী করে ফেলতে পারেন, তা কল্পনা করে শিহরিত হতে হয়। দুর্বৃত্তদের বাধা সত্ত্বেও যদি আমরা এটা পারি, তাদের সরাতে পারলে আমরা কী করতে পারি, সেটা কি ভাবছি?
যাঁরা ভাবছেন, বাংলাদেশকে পদাবনত রাখা যাবে, তরুণদের হ্যামিলনের চতুর বাঁশিওয়ালাদের পিছে দৌড়িয়ে হয়রান করে ফেলা যাবে, নিশ্চয়ই তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন চমক। এই দেশ সংকটের কালে যত দিন তার সেরাটাকে সামনে আনতে পারবে, তত দিন আশা আছে। যে বিগ ব্যাং থেকে জগতের সৃষ্টি, তার সূচনা হয়েছিল কিন্তু ছোট এক বিন্দুর স্ফুলিঙ্গ থেকে। বিন্দু থেকেই বৃত্ত হয়, মুস্তাফিজ-তাসকিন-সৌম্যদের মতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি থেকেই পরিবর্তনের লংমার্চ যে শুরু হবে না, তা কে বলতে পারে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments