ওষুধ চোর সিন্ডিকেট by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) রোগীর ওষুধ যাচ্ছে চোরের পকেটে। আর
ওষুধ না পেয়ে মারা যায় রোগী। অথচ রোগীর ওষুধ কয়েকবার বেচাকেনা হয় রাজধানীর
অলিগলির ফার্মেসিতে। শুধু তা-ই নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলো কৌশলে নগরীর
চানখাঁরপুল, মিটফোর্ড রোডসহ অলিগলির ফার্মেসিতে বিক্রি করে ওই চক্র।
ঢামেকের ওষুধ চুরির সঙ্গে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট জড়িত বলে ব্যাপক অভিযোগ
পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মচারী,
কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও ডাক্তারদের যোগসাজশে ওই চক্রটি এ কাজ করে
যাচ্ছে। কিন্তু রোগীরা প্রাণরক্ষার প্রয়োজনীয় ওষুধ পান না। ঢামেকে চোর
সিন্ডিকেটের সদস্যরা হাসপাতাল থেকে নানা কৌশলে ওষুধ চুরি করে থাকে। প্রতি
বছরের জুনে এমন ঘটনা বেশি ঘটে। ওই চক্রটি হাসপাতালের বিভিন্ন পদে কর্মরত
রয়েছেন। হাসপাতালে রয়েছে তাদের ব্যাপক আধিপত্য। এদের অনেকেই সরকারি দলের
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আবার কেউ জড়িত বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে। তারা
একদিকে যেমন সরকারি চাকরিজীবী অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। এই দুই
পরিচয়ের বাইরেও আরেকটি পরিচয় আছে এদের, যা অনেকেরই অজানা। ঢামেকের
শক্তিশালী ওষুধ চোর সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা
গেছে। সিন্ডিকেটটি প্রতিমাসে অন্তত ৫ লাখ টাকার ওষুধ চুরি করে বাইরে পাচার
করে। চুরি করা ওষুধ বিক্রি হচ্ছে হাসপাতালের সামনের বিভিন্ন ফার্মেসিসহ
বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ওষুধের দোকান ও মিটফোর্ডের দোকানগুলোতে। হাসপাতালের
কয়েকজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।
সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরেই ওষুধ চোর সিন্ডিকেট সক্রিয়। ইতিপূর্বে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে চাকরি খুইয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য বিভাগ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই সিন্ডিকেটের তৎপরতা। হাসপাতাল থেকে ওষুধ চুরি অব্যাহত আছে। ওষুধ চুরির চেয়েও ভয়াবহ বিষয় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা চুরি করা ওষুধের জায়গায় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রেখে দেয়। ওই সব ওষুধ কৌশলে নিরীহ ও দরিদ্র রোগীদের জন্য দেয়া হয়। এতে রোগীর প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। প্রায়ই চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী মৃত্যু বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুসহ নানা অভিযোগ ওঠে।
সরেজমিন দেখা গেছে, হাসপাতালে বহির্বিভাগের পাশের গেটে এবং হাসপাতালের ফার্মেসির খুব কাছে (ডিএমসিএইচ) লেখা তিন প্যাকেট ওষুধ নিয়ে দুজন পুরুষ এবং দুজন মহিলা এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন আর দ্রুত ভাগবাটোয়ারা করছেন। পরিচয় না দিয়ে তাদের কাছে ওষুধগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তর না দিয়েই দুজন মহিলা তাদের ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে ওষুধের ছোট ছোট কয়েকটি প্যাকেট ঢুকিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। পুরুষদের একজন বললেন, আমরা গ্লোব ফার্মেসি লিমিটেডের লোক। ওষুধগুলো ফার্মেসিতে বিক্রি করতে এনেছি। কিন্তু ওষুধের প্যাকেটে ডিএমসিএইচ লেখা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা এই প্রতিবেদকের দিকে তেড়ে আসেন। ছবি তুলতে চাইলে তারা দ্রুত পালিয়ে যান। এরপর এই বিষয়ে প্রশাসনকে জানাতে গেলে পরে এসে তাদের আর সেখানে পাওয়া যায়নি।
গত বছর আগস্ট মাসে ভোলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের আব্বাস নামের এক রোগী বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে ঢামেকে আসেন। ওই রোগী জিবিএস মুমূর্মু রোগে ভুগছিলেন। রোগীর বোন সাঈদা আক্তার অভিযোগ করেন, তার ভাইকে হাসপাতাল থেকে কোন ওষুধই দেয়নি। ডাক্তাররা তাকে আইসিইউতে রাখার নির্দেশ দিলেও তাকে সেখানে রাখেনি। তারা গরিব হওয়ায় বেসরকারি হাসপাতালেও যেতে পারেননি। পরে আব্বাসের মৃত্যু হয়।
চলতি বছরের ২২শে জুন ১১০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন শামীম। তার পিত্তনালিতে পাথর জমেছে। হাসপাতালের প্রশাসনের কাছে তার স্ত্রী রুমা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে অভিযোগ করেন, ওয়ার্ডে তার স্বামীর অপারেশনের কথা বলে ২৮০০ টাকার উপরে ওষুধ কিনিয়েছে। কিন্তু একটি ওষুধও তাদেরকে দেয়নি। এমনকি তার স্বামীকে বলেছে, এই অপারেশন শাহবাগ মোড়ে করাতে হবে। তাদেরকে ২রা জুলাই রিলিজও দেয়া হয়েছে। কিন্তু টাকা-পয়সা না থাকায় তারা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, তাহলে কি তার ওষুধগুলো চুরি হয়ে গেছে ? এই রোগী সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন। এদিকে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওষুধ চোরদের ধরতে বহুবার অভিযানও চালিয়েছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ২২শে জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর গেটের বাইরে এক কার্টন সরকারি ওষুধসহ শাহীন ওরফে সানুকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
২০১১ সালের ৯ই মে আনুমানিক ১২ হাজার টাকার সরকারি ওষুধসহ ধরা পড়ে ঢামেকর স্টোর ইনচার্জ মুজিবুর রহমান খান। ওষুধ চুরির দায়ে মুজিবুর রহমান খানকে ঢামেক থেকে নোয়াখালীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে বদলি করা হয়। বর্তমানে মুজিবুর রহমান খান তদবির করে আবার ঢামেকে এসেছেন।
এ ছাড়াও বহুবার মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভের ব্যাগ তল্লাশি করে ঢামেকের জন্য ব্যবহৃত সরকারি ওষুধ উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ওষুধগুলো বাইরে বিক্রির জন্য পাচার করা হচ্ছিল। ওষুধ চুরির সঙ্গে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা জড়িত। হাসপাতালের ওষুধসহ নানা জিনিসপত্র চুরির সঙ্গে ওষুধ চোরদের সিন্ডিকেট রয়েছে হাসপাতালের স্টোর ইনচার্জ মুজিবুর রহমান খান, প্রধান ওষুধ স্টোরের ফার্মাসিস্ট শ্রী বিমল চন্দ্র, ডিএমসির কর্মচারী মো. শাহীন ও মোহাম্মদ জুয়েল, মোহাম্মদ শাহজাহানসহ সাব-ওষুধ স্টোরের দুই ফার্মাসিস্ট, ২১০ নম্বর ওয়ার্ডের বয় নাসির উদ্দিন, ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডের বয় মো. আবদুল হালিম, ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের বয় আবুল হাশেম। ইতিপূর্বে সাজা পাওয়া ঢামেকের কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান খান, শাহীন ও মোজাহার হোসেন মোল্লা সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। এদের ইন্ধনে সিন্ডিকেটটি সক্রিয়। ডিএমসির ব্যারেজ শপের ইনচার্জ মো. মোজাহার হোসেন মোল্লাকে চুরির ঘটনায় পঙ্গু হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সিন্ডিকেট সদস্যরা নানা কৌশলে ওষুধ চুরি করে থাকে। এর মধ্যে হিসাব বিবরণীতে গরমিল একটি অন্যতম কৌশল। চোর সিন্ডিকেটের সদস্য ফার্মাসিস্টরা ওষুধের হিসাব বিবরণীতে ইচ্ছাকৃতভাবে গরমিল করে থাকে। হিসেবে গরমিল দেখিয়ে ওষুধ চুরি করে। চুরি করা ওষুধগুলো সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে থাকা ওয়ার্ড বয়দের কাছে পৌঁছে দেয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেবিন ব্লক ছাড়াও ৭০টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত ওষুধ উত্তোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই জড়িত। প্রয়োজনের তুলনায় উত্তোলন করা অতিরিক্ত ওষুধ ওয়ার্ড বয়দের মাধ্যমে হাসপাতালের বাইরে বিক্রি করে থাকে সিন্ডিকেট সদস্যরা। ওয়ার্ড বয় ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মেডিক্যাল প্রতিনিধি ও আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমেও হাসপাতাল থেকে ওষুধ বাইরে পাচার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া চোর সিন্ডিকেটের সদস্য ফার্মাসিস্টরা স্টোর হতে চাহিদাপত্রের বিপরীতে ওষুধ সরবরাহকালে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। ওয়ার্ডগুলোতে থাকা চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা স্বল্পমেয়াদের ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলো রেখে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধগুলো বাইরে বিক্রি করে থাকে। এতে নতুন করে হাসপাতাল থেকে ওষুধ উত্তোলনের সুযোগ থাকে। এর ফলে প্রায়ই বিভিন্ন ওয়ার্ডে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধরা পড়ে। শুধু ওষুধ নয়, হাসপাতাল থেকে মূল্যবান সামগ্রীও চুরি হয়ে যায়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহির্বিভাগের একজন কর্মচারী অভিযোগ করেন, হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগে একজন করে নার্স ইনচার্জ থাকেন। সাধারণত তারাই ওয়ার্ডে ভর্তি করা রোগীর সংখ্যা বেশি দেখিয়ে কমিশনের বিনিময়ে চোর সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। এভাবেই প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার ওষুধ বাইরে পাচার হয়ে যায়। তিনি জানান, ওষুধ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডের বয় মো. শাহীনকে শাস্তি স্বরূপ অন্য ওয়ার্ডে বদলি করা হয়। কিন্তু ওয়ার্ড মাস্টারকে ‘ম্যানেজ’ করে আবারও ওই ওয়ার্ডে ফিরে যান তিনি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ২১০ নম্বর ওয়ার্ডের বয় মামা নাসিরকে প্রায় ২০ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের ওষুধসহ হাতেনাতে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন আনসার সদস্যরা। সেসময় তাকে হাসপাতাল থেকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু মুক্তি পেয়ে আবারও আগের কাজ শুরু করেছেন নাসির।
ওষুধ চুরির অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢামেকের পরিচালক ব্রি. জে. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এখন ওষুধ চুরি নাই বললেই চলে। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। হাসপাতালের সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছি এবং কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি আনুমানিক ১৫ হাজার টাকার ওষুধসহ মো. জসিম, ফার্মাসিস্ট মো. সাগরসহ বহিরাগত মো. রফিককে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। আটক এই তিনজন হাসপাতালের কেউ না হলেও এরা নিয়মিতই ডাক্তারদের ‘বিশেষ কর্মচারী’ হিসেবে কাজ করতো। ডাক্তাররা ছোটখাটো কাজ এদের দিয়েই করাতেন। এর বিনিময়ে তারা ডাক্তারদের মাধ্যমে হাসপাতাল থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিতো। এদের বড় একটি চক্র গড়ে উঠেছে হাসপাতালে।
ডাক্তারদের কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র লিখিয়ে নিয়ে ওষুধের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। এটি সবার চোখের সামনেই ঘটছে। প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এই চক্রটি বিভিন্ন ডাক্তারদের কাছ থেকে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখিয়ে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ওষুধ তুলে বিক্রি করে। এটা ডাক্তারের সঙ্গে যাদের ভাল সম্পর্ক তারা এই কাজ করেন। ডাক্তারদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০টি ওষুধের লিস্ট নিয়ে হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ তুলে বাইরে বিক্রি করে এ চক্রটি। ডাক্তারদের আশ্রয়-প্রশ্র্রয়ে তারা ওষুধর চুরির ঘটনা ঘটায় হাসপাতালে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন স্টোরের প্রধান ডা. মশিউর রহমান জানান, বছরে ২৪ কোটি টাকার ওষুধ ক্রয় করা হয় হাসপাতালে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে কোন ওষুধ উদ্বৃত্ত ছিল না। বরং সরকারি ওষুধ কোম্পানি এসেনসিয়াল ড্রাগসের কাছে ৫৮ হাজার টাকা দেনা রয়েছে হাসপাতালটি।
সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরেই ওষুধ চোর সিন্ডিকেট সক্রিয়। ইতিপূর্বে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে চাকরি খুইয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য বিভাগ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই সিন্ডিকেটের তৎপরতা। হাসপাতাল থেকে ওষুধ চুরি অব্যাহত আছে। ওষুধ চুরির চেয়েও ভয়াবহ বিষয় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা চুরি করা ওষুধের জায়গায় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রেখে দেয়। ওই সব ওষুধ কৌশলে নিরীহ ও দরিদ্র রোগীদের জন্য দেয়া হয়। এতে রোগীর প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। প্রায়ই চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী মৃত্যু বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুসহ নানা অভিযোগ ওঠে।
সরেজমিন দেখা গেছে, হাসপাতালে বহির্বিভাগের পাশের গেটে এবং হাসপাতালের ফার্মেসির খুব কাছে (ডিএমসিএইচ) লেখা তিন প্যাকেট ওষুধ নিয়ে দুজন পুরুষ এবং দুজন মহিলা এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন আর দ্রুত ভাগবাটোয়ারা করছেন। পরিচয় না দিয়ে তাদের কাছে ওষুধগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তর না দিয়েই দুজন মহিলা তাদের ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে ওষুধের ছোট ছোট কয়েকটি প্যাকেট ঢুকিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। পুরুষদের একজন বললেন, আমরা গ্লোব ফার্মেসি লিমিটেডের লোক। ওষুধগুলো ফার্মেসিতে বিক্রি করতে এনেছি। কিন্তু ওষুধের প্যাকেটে ডিএমসিএইচ লেখা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা এই প্রতিবেদকের দিকে তেড়ে আসেন। ছবি তুলতে চাইলে তারা দ্রুত পালিয়ে যান। এরপর এই বিষয়ে প্রশাসনকে জানাতে গেলে পরে এসে তাদের আর সেখানে পাওয়া যায়নি।
গত বছর আগস্ট মাসে ভোলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের আব্বাস নামের এক রোগী বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে ঢামেকে আসেন। ওই রোগী জিবিএস মুমূর্মু রোগে ভুগছিলেন। রোগীর বোন সাঈদা আক্তার অভিযোগ করেন, তার ভাইকে হাসপাতাল থেকে কোন ওষুধই দেয়নি। ডাক্তাররা তাকে আইসিইউতে রাখার নির্দেশ দিলেও তাকে সেখানে রাখেনি। তারা গরিব হওয়ায় বেসরকারি হাসপাতালেও যেতে পারেননি। পরে আব্বাসের মৃত্যু হয়।
চলতি বছরের ২২শে জুন ১১০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন শামীম। তার পিত্তনালিতে পাথর জমেছে। হাসপাতালের প্রশাসনের কাছে তার স্ত্রী রুমা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে অভিযোগ করেন, ওয়ার্ডে তার স্বামীর অপারেশনের কথা বলে ২৮০০ টাকার উপরে ওষুধ কিনিয়েছে। কিন্তু একটি ওষুধও তাদেরকে দেয়নি। এমনকি তার স্বামীকে বলেছে, এই অপারেশন শাহবাগ মোড়ে করাতে হবে। তাদেরকে ২রা জুলাই রিলিজও দেয়া হয়েছে। কিন্তু টাকা-পয়সা না থাকায় তারা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, তাহলে কি তার ওষুধগুলো চুরি হয়ে গেছে ? এই রোগী সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন। এদিকে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওষুধ চোরদের ধরতে বহুবার অভিযানও চালিয়েছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ২২শে জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর গেটের বাইরে এক কার্টন সরকারি ওষুধসহ শাহীন ওরফে সানুকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
২০১১ সালের ৯ই মে আনুমানিক ১২ হাজার টাকার সরকারি ওষুধসহ ধরা পড়ে ঢামেকর স্টোর ইনচার্জ মুজিবুর রহমান খান। ওষুধ চুরির দায়ে মুজিবুর রহমান খানকে ঢামেক থেকে নোয়াখালীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে বদলি করা হয়। বর্তমানে মুজিবুর রহমান খান তদবির করে আবার ঢামেকে এসেছেন।
এ ছাড়াও বহুবার মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভের ব্যাগ তল্লাশি করে ঢামেকের জন্য ব্যবহৃত সরকারি ওষুধ উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ওষুধগুলো বাইরে বিক্রির জন্য পাচার করা হচ্ছিল। ওষুধ চুরির সঙ্গে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা জড়িত। হাসপাতালের ওষুধসহ নানা জিনিসপত্র চুরির সঙ্গে ওষুধ চোরদের সিন্ডিকেট রয়েছে হাসপাতালের স্টোর ইনচার্জ মুজিবুর রহমান খান, প্রধান ওষুধ স্টোরের ফার্মাসিস্ট শ্রী বিমল চন্দ্র, ডিএমসির কর্মচারী মো. শাহীন ও মোহাম্মদ জুয়েল, মোহাম্মদ শাহজাহানসহ সাব-ওষুধ স্টোরের দুই ফার্মাসিস্ট, ২১০ নম্বর ওয়ার্ডের বয় নাসির উদ্দিন, ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডের বয় মো. আবদুল হালিম, ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের বয় আবুল হাশেম। ইতিপূর্বে সাজা পাওয়া ঢামেকের কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান খান, শাহীন ও মোজাহার হোসেন মোল্লা সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। এদের ইন্ধনে সিন্ডিকেটটি সক্রিয়। ডিএমসির ব্যারেজ শপের ইনচার্জ মো. মোজাহার হোসেন মোল্লাকে চুরির ঘটনায় পঙ্গু হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সিন্ডিকেট সদস্যরা নানা কৌশলে ওষুধ চুরি করে থাকে। এর মধ্যে হিসাব বিবরণীতে গরমিল একটি অন্যতম কৌশল। চোর সিন্ডিকেটের সদস্য ফার্মাসিস্টরা ওষুধের হিসাব বিবরণীতে ইচ্ছাকৃতভাবে গরমিল করে থাকে। হিসেবে গরমিল দেখিয়ে ওষুধ চুরি করে। চুরি করা ওষুধগুলো সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে থাকা ওয়ার্ড বয়দের কাছে পৌঁছে দেয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেবিন ব্লক ছাড়াও ৭০টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত ওষুধ উত্তোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই জড়িত। প্রয়োজনের তুলনায় উত্তোলন করা অতিরিক্ত ওষুধ ওয়ার্ড বয়দের মাধ্যমে হাসপাতালের বাইরে বিক্রি করে থাকে সিন্ডিকেট সদস্যরা। ওয়ার্ড বয় ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মেডিক্যাল প্রতিনিধি ও আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমেও হাসপাতাল থেকে ওষুধ বাইরে পাচার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া চোর সিন্ডিকেটের সদস্য ফার্মাসিস্টরা স্টোর হতে চাহিদাপত্রের বিপরীতে ওষুধ সরবরাহকালে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। ওয়ার্ডগুলোতে থাকা চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা স্বল্পমেয়াদের ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলো রেখে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধগুলো বাইরে বিক্রি করে থাকে। এতে নতুন করে হাসপাতাল থেকে ওষুধ উত্তোলনের সুযোগ থাকে। এর ফলে প্রায়ই বিভিন্ন ওয়ার্ডে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধরা পড়ে। শুধু ওষুধ নয়, হাসপাতাল থেকে মূল্যবান সামগ্রীও চুরি হয়ে যায়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহির্বিভাগের একজন কর্মচারী অভিযোগ করেন, হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগে একজন করে নার্স ইনচার্জ থাকেন। সাধারণত তারাই ওয়ার্ডে ভর্তি করা রোগীর সংখ্যা বেশি দেখিয়ে কমিশনের বিনিময়ে চোর সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। এভাবেই প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার ওষুধ বাইরে পাচার হয়ে যায়। তিনি জানান, ওষুধ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডের বয় মো. শাহীনকে শাস্তি স্বরূপ অন্য ওয়ার্ডে বদলি করা হয়। কিন্তু ওয়ার্ড মাস্টারকে ‘ম্যানেজ’ করে আবারও ওই ওয়ার্ডে ফিরে যান তিনি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ২১০ নম্বর ওয়ার্ডের বয় মামা নাসিরকে প্রায় ২০ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের ওষুধসহ হাতেনাতে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন আনসার সদস্যরা। সেসময় তাকে হাসপাতাল থেকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু মুক্তি পেয়ে আবারও আগের কাজ শুরু করেছেন নাসির।
ওষুধ চুরির অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢামেকের পরিচালক ব্রি. জে. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এখন ওষুধ চুরি নাই বললেই চলে। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। হাসপাতালের সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছি এবং কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি আনুমানিক ১৫ হাজার টাকার ওষুধসহ মো. জসিম, ফার্মাসিস্ট মো. সাগরসহ বহিরাগত মো. রফিককে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। আটক এই তিনজন হাসপাতালের কেউ না হলেও এরা নিয়মিতই ডাক্তারদের ‘বিশেষ কর্মচারী’ হিসেবে কাজ করতো। ডাক্তাররা ছোটখাটো কাজ এদের দিয়েই করাতেন। এর বিনিময়ে তারা ডাক্তারদের মাধ্যমে হাসপাতাল থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিতো। এদের বড় একটি চক্র গড়ে উঠেছে হাসপাতালে।
ডাক্তারদের কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র লিখিয়ে নিয়ে ওষুধের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। এটি সবার চোখের সামনেই ঘটছে। প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এই চক্রটি বিভিন্ন ডাক্তারদের কাছ থেকে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখিয়ে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ওষুধ তুলে বিক্রি করে। এটা ডাক্তারের সঙ্গে যাদের ভাল সম্পর্ক তারা এই কাজ করেন। ডাক্তারদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০টি ওষুধের লিস্ট নিয়ে হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ তুলে বাইরে বিক্রি করে এ চক্রটি। ডাক্তারদের আশ্রয়-প্রশ্র্রয়ে তারা ওষুধর চুরির ঘটনা ঘটায় হাসপাতালে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন স্টোরের প্রধান ডা. মশিউর রহমান জানান, বছরে ২৪ কোটি টাকার ওষুধ ক্রয় করা হয় হাসপাতালে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে কোন ওষুধ উদ্বৃত্ত ছিল না। বরং সরকারি ওষুধ কোম্পানি এসেনসিয়াল ড্রাগসের কাছে ৫৮ হাজার টাকা দেনা রয়েছে হাসপাতালটি।
No comments