জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ বিএনপির পক্ষে সহজ নয় by ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
বিভিন্ন মহল থেকে সম্প্রতি একটি কথা বলা
হচ্ছে, বিএনপি যেন জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে। তা হলে, কী হবে? তাদের
ধারণা, বিএনপি একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়ে যাবে, বিএনপি একটি
গণতান্ত্রিক দল হয়ে যাবে, বিএনপিকে তখন আওয়ামী লীগের বিকল্প দল হিসেবে ধরে
নেয়া যাবে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্ভর করার একটি শক্তি পাওয়া যাবে। এমন
সহজ, সরল ধারণা আমাদের দেশের বেশিরভাগ ছোট, মাঝারি, বড় দলের অনেক নেতার এবং
বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে রয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি এবং টিভি
টকশোর বিভিন্ন আলোচক ও লেখকের মধ্যে এমন ধারণা আছে বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান
হচ্ছে। এই যদি হয় এদেশের রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকা কিংবা রাজনীতি
সম্পর্কে যাদের জ্ঞান রয়েছে বলে দাবি করা হয়ে থাকে তাদের তাহলে এদেশের
সাধারণ মানুষের পর্যায়ে রাজনীতি বোঝা এবং দেশে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আলহকিকত সম্পর্কে ধারণা বা অনুমান করার বাস্তবতা কোথায়
তা সহজেই বোধগম্য হওয়া উচিত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক আলোচনা-পর্যালোচনা,
সমালোচনা আসলে খুব বেশি জ্ঞান বা বাস্তবতা নির্ভর নয় বরং তা থেকে যোজন যোজন
দূরের বিষয় তা এমন কথাবার্তা শোনার পর খুব বেশি ভুল বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি একটি বইয়ের আলোচনা সভায় অধ্যাপক ডা. বি চৌধুরী ও বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অবশ্য বি চৌধুরী যখন বিএনপিতে ছিলেন এবং ৪ দলীয় জোটের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতি হন তখন জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ছিল জামায়াত। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আগাগোড়াই রাজনীতি করেছে। তখন তিনি বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার কোনো পরামর্শ দিয়েছেন বলে শুনিনি। তিনি বিএনপি ছাড়ার পেছনে জামায়াত নির্ভর বিএনপি হয়ে যাওয়া কোনো কারণ ছিল বলে শুনিনি কিংবা তেমন কোনো প্রতিবাদ করে তিনি বা তার পুত্র বিএনপি ছাড়েননি। তারা স্বেচ্ছায় বিএনপি ত্যাগ করেননি। বিএনপি থেকে তাদের কিভাবে তাড়ানো হয়েছিল এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তা লিপিবদ্ধ আছে। তবে এই বি চৌধুরী এবং তার পুত্র মাহী বি চৌধুরী ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের আগে ‘সাবাস বাংলাদেশ’ নামক একটি অনুষ্ঠান যা নির্বাচনী প্রচারণামূলক ফিল্ম তৈরি করেছিলেন যা উৎকট সাম্প্রদায়িকতায় ভরপুর বললেও কম বলা হবে। বলা হয়ে থাকে মাহীর সম্পাদনায় এবং বি চৌধুরীর উপস্থাপনায় প্রচারিত ওই ভিডিওতে এক হাতে গীতা অন্য হাতে কোরান দেখিয়ে ভোটারদের বলা হয়েছিল নৌকায় ভোট দিলে গীতায়, ধানের শীষে দিলে কোরানে ভোট পড়বে। এভাবে যে পিতা-পুত্র একটি নির্বাচনের আয়োজনকে চিহ্নিত করতে পারেন তিনি জামায়াতের চেয়ে উত্তম তা কী করে দাবি করা যায়? সম্প্রতি ডা. বি চৌধুরীর বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে জিয়ার আদর্শে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দেয়ার পর ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব এবং কাদের সিদ্দিকীর দল নিয়ে নতুনভাবে বিএনপিকে নিয়ে একটি রাজনীতির মেরুকরণ ঘটানোর সম্ভাবনার খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হয়েছে। যদিও এসব খবর নিজস্ব আশঙ্কার বিষয়, কতটা বিএনপিসহ উল্লিখিত দলগুলোর ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয় তা পরিষ্কার নয়। তবে কাদের সিদ্দিকীসহ অন্য নেতৃবৃন্দের কথায় যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কিছু একটা হলে দেশের কিছু একটা ঘটে যাবে এমন ধারণাই তাদের ভাষায় স্পষ্ট বোঝা যায়।
রাজনীতিবিদদের বাইরে মিডিয়ার অনেকেই বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। খুবই ভালো কথা। বিএনপি কতটা জামায়াতকে ছাড়বে তা কেবল ভবিষ্যতেই বলতে পারবে। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও নাকি বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছে। জামায়াত উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং জঙ্গিবাদী সংগঠনে পরিণত হওয়ার বিষয়টি এতদিনে তারা উপলব্ধি করেছেন বলে কোনো কোনো মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীর তরফে বলা হচ্ছে। অথচ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে দেশে যখন জঙ্গিবাদের চরম আস্ফালন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, জঙ্গিদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের কথা মিডিয়ায় প্রচারিত-প্রকাশিত হচ্ছিল, তাদের আড়াল করছিল তখন কোনো কোনো আন্তর্জাতিক মহল জামায়াতকে ‘মডারেট মুসলিম দল’ বলে সার্টিফিকেট প্রদান করেছিল। এখন তারা জামায়াতকে কতটা জঙ্গিবাদী, কতটা ‘মডারেট’ বলে মনে করে তার কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য শোনা যাচ্ছে না । শোনা গেলে ভালো হতো। কিন্তু তেমন কিছু যেহেতু জানা যায়নি তাই জামায়াত সম্পর্কে বিদেশিদের এখনকার মনোভাব আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ বিএনপির পক্ষে সহজ নয়যে বিষয়টি নিয়ে চারদিকে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে তা হলে অনেকের আকাক্সক্ষা মতো বিএনপি আদতেই কি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে? এটি বড় প্রশ্ন। এর উত্তর বিএনপি থেকে কেউ স্পষ্ট করছেন না। কোনো কোনো নেতা এ প্রসঙ্গে তেমন কিছু কথা বলছেন যা নিয়ে কেউ আশাবাদী হন, কেউ আবার তেমন কোনো আশার আলোই দেখছেন না। বিষয়টি এতটাই জটিল এবং গভীর যে এর উত্তর আসলে বিএনপির চেয়ারপার্সন বা তারেক রহমান ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে আশা করার কিছু নেই। তবে বিএনপির মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক অবস্থার গভীরের বিষয়টি যারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তারা বিএনপির এ্যানাটমি এবং কেমিস্ট্রিতে জামায়তের একাকার হয়ে যাওয়ার বিষয়টিতে বিস্মিত না হয়ে পারছেন না। দুটো দলই আদর্শগতভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র দর্শনকে গ্রহণ করেছে। জামায়াত ডানপন্থার চরম ভাবাপন্ন অবস্থানে রয়েছে, বিএনপি এর কাছাকাছি বা কিছুটা মধ্যম জায়গায় অবস্থান করছে মাত্র। জামায়াত তাদের উগ্র আদর্শে প্রশিক্ষিত দল। জামায়াত সেভাবে গড়ে তোলা, রাষ্ট্রবিপ্লব সংগঠনে দীক্ষিত করে তোলা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে গভীরভাবে চুক্ত একটি দল। বিএনপি এ ধরনের কোনো সুশৃঙ্খল নেতাকর্মীর দল নয়, বরং বহত্তর সমাজের অভ্যন্তরে বসবাসকারী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠিত, অপ্রতিষ্ঠিত নানা গোষ্ঠীর একটি প্লাটফর্ম যা শেষ পর্যন্ত ডানপন্থার ভাবাদর্শে জনগণের একটি বড় অংশকে ধরে রাখার ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে করে থাকে। রাজনীতির এ শক্তিকে মতাদর্শগতভাবে মধ্য ডানপন্থী বলা হলেও শিক্ষাদীক্ষার অভাব মানহীনতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবের কারণে এ ধরনের রাজনৈতিক বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে শেষ পর্যন্ত লাভবান হয় জামায়াতের মতো সংগঠিত উগ্রবাদ, রাজনৈতিক দলই যারা এর ভেতরে প্রভাব বিস্তার করার মাধ্যমে সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিএনপির অভ্যন্তরে জামায়াত ভাবাপন্ন শক্তির অবস্থান বেশ শক্তিশালী। তারা বিএনপিকে আগাগোড়াই নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন। এটি এমনি এমনি হয়নি। জামায়াত গোড়া থেকেই পরিকল্পিতভাবে বিএনপির অভ্যন্তরে এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার মতো ব্যবস্থা করে রেখেছে। জামায়াতের যেহেতু বিপুল অর্থবিত্ত এবং ক্যাডারবাহী রয়েছে তাই বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়া, থাকা এবং রাজনীতিতে শক্তির উৎস হিসেবে জামায়াতের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতি ও শিক্ষাদীক্ষায় পরিচালিত কোনো দলের পক্ষে এভাবে রাজনীতি করার চিন্তা একেবারেই অকল্পনীয়। বিএনপির জন্মই হয়েছে আওয়ামীবিরোধী ভাবাদর্শকে সম্বল করে। দলের সর্বত্র তখন যাতের স্থান করে দেয়া হয়েছিল তারা আওয়ামীবিরোধী সাম্প্রদায়িক এবং অতবিপ্লবী গোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অনেকে বিভ্রান্তবাদী, হঠকারী চিন্তাধারায় নিমজ্জিত। একটি জাতীয়তাবাদী আদর্শের উদারবাদী চিন্তা ধারার আন্দোলনে এরা কেউ যুক্ত ছিলেন না, সেটিকে তারা সমর্থনও করেননি। মুক্তিযুদ্ধের তাদের কারো ভাষায় ‘ভারতের নির্দেশিত’, ‘কারো ভাষায় দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে চিত্রিত! দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, এদের নিয়েই জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে যে রাজনীতির মাঠ প্রশস্ত করেছিলেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল, নেতাকর্মীরা ছিল অবাঞ্ছিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত। অন্যদিকে যারা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন— তারাই হলেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার মূল শক্তি। ফলে বাংলাদেশে জামায়াত এবং তাদের ভাবাদর্শের-শক্তির আবির্ভাব ঘটার সুযোগ ঘটে। জিয়াউর রহমান সেই সুযোগ নিজের দলে এবং দলের বাইরে পরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত করে ছিলেন। একজন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শবাদিতার শক্তিকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন। রেখে গেলেন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যারা প্রায় দুই দশক দাপটের সঙ্গে রাষ্ট্র রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করা, দুর্বল এবং বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তাদের সহযোগিতায়, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত অপপ্রচার, বিভ্রান্তি, ঘৃণা এবং অজ্ঞতা সমাজ জীবনকে এই দীর্ঘ সময়ে গ্রাস করেছে। বাংলাদেশের সমাজ জীবনে অসাম্প্রদায়িকতাকে এতটাই দুর্বল, ভঙ্গুর এবং নড়বড়ে করে ফেলা হয় যে, এর মানে বাংলাদেশ আসলেই কেমন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গ্রহণ করবে তা অসাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহণ করবে নাকি ধর্ম রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শে পরিচালিত হবে এ নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো সম্ভব হয়েছে তাতে লাভবান হয়েছে প্রধানত জামায়াত এবং অংশত বিএনপি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার পরিবেশে। বাংলাদেশে এখন সাম্প্রদায়িতকতা কতখানি বিস্তৃত এবং গভীরে নিহিত তা যে কোনো ধরনের নির্বাচনে এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে লক্ষণীয় বিষয়। একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রক্তস্নাত বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নীতি-নৈতিকতার আদর্শে কতখানি এগুতে পেরেছে তা অনেক ক্ষেত্রেই বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখা হচ্ছে না। যদি এভাবে দেখা হয় তাহলে আশাবাদী হওয়ার চাইতে হতাশ হওয়ার বাস্তবতাই অনেক বেশি বিদ্যমান। বাংলাদেশে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্ম জামায়াত শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতিকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার বড় কারণ পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির মাঠ গঠন যেখানে জামায়াত-বিএনপি একসঙ্গে পথ চলেছে, রাজনীতির জায়গা তৈরি করেছে, নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শকে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করেছে সেখানেও বাংলাদেশের সমাজ জীবনে এখন এমন বিশ্বাসী মানুষের অবস্থান বেশ শক্তিশালী যারা যে কোনো মূল্যে আওয়ামী ঠৈকাওয়ের অবস্থান নিতে বড় দল হিসেবে প্রথমে বিএনপিকে বাছাই করবে তারপর জামায়াত এবং জঙ্গিবাদী সকল শক্তির যে কোনো উত্থান, হঠকারী অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিতে প্রস্তুত। বিষয়টি এখন দুই পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের লড়াইতে পরিণত হয়েছে। সেই লড়াই অসাম্প্রদায়িক শক্তি বিভক্ত ও বিভ্রান্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি ভেতরে ভেতরে এক ও অভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। এরা যুগ যুুগ ধরে বিএনপির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে এবং বিএনপিকে তারা ছাড়া সংগঠনে পরিণত করেছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের কারণে রাজনীতির এই চাল ধরতে বা বুঝতে পারছে না। একটি বিরাট অংশ তাতে অংশ নিচ্ছে, শক্তি জোগাচ্ছে। বিএনপি এমন এক বাস্তবতায় শ্যাম রাখি নাকি কুল রাখি, নাকি সব কিছু হারাই এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। কেননা আন্তর্জাতিক মহলও বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরের এই দুর্বলতা বুঝে ফেলেছে। বিত্রনপির ভূমিকাও বুঝে ফেলেছে। তারা জামায়াত-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উত্থান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অচিরেই বিপজ্জনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার কথা বলছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা কতটা কঠিন তা বিএনপির মানস সম্পর্কে যারা সচেতন তারাই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
এতদিনকার-রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দীক্ষার সঙ্গে বড় সংখ্যা নেতাকর্মীর যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তা আসলে বিএনপি কিভাবে সামাল দেবে সেটি বড় প্রশ্ন। একটি দলের নেতাকর্মীদের দীর্ঘদিন যে ভাবাদর্শে গড়ে তোলা হয়েছে তা থেকে চট করে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন । বিএনপির পক্ষে তাদের কর্মীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নতুন করে গড়ে তোলা, গণতন্ত্রের উদারবাদী ভাবাদর্শের রাজনীতির পাঠ নতুন করে দেয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ধারণ এবং জানার কথা বলা, আধুনিক অগ্রসর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে রাজনীতিকে আত্মস্থ করে রাজনীতির পাঠ নেয়ার কথা বলা মোটেও সহজ কাজ নয়। তাতে কতটা সফল হবে বিএনপি তা নিয়ে বিএনপির মধ্যেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রের মতাদর্শ সব সময়ই অসাম্প্রদায়িক। কোনো দল সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করলে সম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিলে সেই দল কোনো কালেই গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। বিএনপি জন্ম থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করছে। তাদের নেতাকর্মী-সমর্থকরাও তাতে বিশ্ববাসী এবং তেমন রাষ্ট্রের ধারণাই নেতাকর্মীরা পোষণ-করেছেন। বিএনপি ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো ইশতেহার দেয়নি। আওয়ামীবিরোধী, ভারতবিরোধী ধর্ম চলে যাবে এসব সস্তা স্লোগান প্রচার-প্রচারণায় সব চেয়ে নির্ভরশীল ছিল এবং এখনো আছে। ভোটের রাজনীতিতে এ ধরনের বিজয় লাভ করে বার বার ক্ষমতায় এসে বিএনপি আরো বেশি সাম্প্রদায়িকতানির্ভর হয়ে উঠেছে। কিন্তু এভাবে কোনো দল রাজনৈতিকভাবে গণত্রান্ত্রিক রাষ্ট্রে অগ্রসর হতে পারে না। বিএনপির তাদের কোনো শাসনামলেই এমন কোনো উন্নয়ন বা রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মডেল তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ শত প্রশ্নের পরও পেরেছে কিছুটা হলেও। আওয়ামী লীগের এই সক্ষমতা দেশ ও বিদেশে যে বার্তা দিয়েছে তাতে বিএনপির সাম্প্রদায়িকতানির্ভর রাজনীতি মস্তবড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এখন যত কষ্টই হোক না কেন বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দলটি গণতন্ত্রের মৌল আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতি করবে, নেতাকর্মীদের মনোজগত তৈরি করবে নাকি জামায়াতের সঙ্গে এতদিনের চর্চা করা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালিয়ে যাবে। এসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া বিএনপির কাছ থেকে সহজ নয়।
লেখক : ইতিহাসতত্ত্ব ও শিক্ষাবিদ
সম্প্রতি একটি বইয়ের আলোচনা সভায় অধ্যাপক ডা. বি চৌধুরী ও বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অবশ্য বি চৌধুরী যখন বিএনপিতে ছিলেন এবং ৪ দলীয় জোটের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতি হন তখন জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ছিল জামায়াত। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আগাগোড়াই রাজনীতি করেছে। তখন তিনি বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার কোনো পরামর্শ দিয়েছেন বলে শুনিনি। তিনি বিএনপি ছাড়ার পেছনে জামায়াত নির্ভর বিএনপি হয়ে যাওয়া কোনো কারণ ছিল বলে শুনিনি কিংবা তেমন কোনো প্রতিবাদ করে তিনি বা তার পুত্র বিএনপি ছাড়েননি। তারা স্বেচ্ছায় বিএনপি ত্যাগ করেননি। বিএনপি থেকে তাদের কিভাবে তাড়ানো হয়েছিল এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তা লিপিবদ্ধ আছে। তবে এই বি চৌধুরী এবং তার পুত্র মাহী বি চৌধুরী ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের আগে ‘সাবাস বাংলাদেশ’ নামক একটি অনুষ্ঠান যা নির্বাচনী প্রচারণামূলক ফিল্ম তৈরি করেছিলেন যা উৎকট সাম্প্রদায়িকতায় ভরপুর বললেও কম বলা হবে। বলা হয়ে থাকে মাহীর সম্পাদনায় এবং বি চৌধুরীর উপস্থাপনায় প্রচারিত ওই ভিডিওতে এক হাতে গীতা অন্য হাতে কোরান দেখিয়ে ভোটারদের বলা হয়েছিল নৌকায় ভোট দিলে গীতায়, ধানের শীষে দিলে কোরানে ভোট পড়বে। এভাবে যে পিতা-পুত্র একটি নির্বাচনের আয়োজনকে চিহ্নিত করতে পারেন তিনি জামায়াতের চেয়ে উত্তম তা কী করে দাবি করা যায়? সম্প্রতি ডা. বি চৌধুরীর বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে জিয়ার আদর্শে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দেয়ার পর ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব এবং কাদের সিদ্দিকীর দল নিয়ে নতুনভাবে বিএনপিকে নিয়ে একটি রাজনীতির মেরুকরণ ঘটানোর সম্ভাবনার খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হয়েছে। যদিও এসব খবর নিজস্ব আশঙ্কার বিষয়, কতটা বিএনপিসহ উল্লিখিত দলগুলোর ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয় তা পরিষ্কার নয়। তবে কাদের সিদ্দিকীসহ অন্য নেতৃবৃন্দের কথায় যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কিছু একটা হলে দেশের কিছু একটা ঘটে যাবে এমন ধারণাই তাদের ভাষায় স্পষ্ট বোঝা যায়।
রাজনীতিবিদদের বাইরে মিডিয়ার অনেকেই বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। খুবই ভালো কথা। বিএনপি কতটা জামায়াতকে ছাড়বে তা কেবল ভবিষ্যতেই বলতে পারবে। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও নাকি বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছে। জামায়াত উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং জঙ্গিবাদী সংগঠনে পরিণত হওয়ার বিষয়টি এতদিনে তারা উপলব্ধি করেছেন বলে কোনো কোনো মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীর তরফে বলা হচ্ছে। অথচ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে দেশে যখন জঙ্গিবাদের চরম আস্ফালন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, জঙ্গিদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের কথা মিডিয়ায় প্রচারিত-প্রকাশিত হচ্ছিল, তাদের আড়াল করছিল তখন কোনো কোনো আন্তর্জাতিক মহল জামায়াতকে ‘মডারেট মুসলিম দল’ বলে সার্টিফিকেট প্রদান করেছিল। এখন তারা জামায়াতকে কতটা জঙ্গিবাদী, কতটা ‘মডারেট’ বলে মনে করে তার কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য শোনা যাচ্ছে না । শোনা গেলে ভালো হতো। কিন্তু তেমন কিছু যেহেতু জানা যায়নি তাই জামায়াত সম্পর্কে বিদেশিদের এখনকার মনোভাব আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ বিএনপির পক্ষে সহজ নয়যে বিষয়টি নিয়ে চারদিকে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে তা হলে অনেকের আকাক্সক্ষা মতো বিএনপি আদতেই কি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে? এটি বড় প্রশ্ন। এর উত্তর বিএনপি থেকে কেউ স্পষ্ট করছেন না। কোনো কোনো নেতা এ প্রসঙ্গে তেমন কিছু কথা বলছেন যা নিয়ে কেউ আশাবাদী হন, কেউ আবার তেমন কোনো আশার আলোই দেখছেন না। বিষয়টি এতটাই জটিল এবং গভীর যে এর উত্তর আসলে বিএনপির চেয়ারপার্সন বা তারেক রহমান ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে আশা করার কিছু নেই। তবে বিএনপির মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক অবস্থার গভীরের বিষয়টি যারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তারা বিএনপির এ্যানাটমি এবং কেমিস্ট্রিতে জামায়তের একাকার হয়ে যাওয়ার বিষয়টিতে বিস্মিত না হয়ে পারছেন না। দুটো দলই আদর্শগতভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র দর্শনকে গ্রহণ করেছে। জামায়াত ডানপন্থার চরম ভাবাপন্ন অবস্থানে রয়েছে, বিএনপি এর কাছাকাছি বা কিছুটা মধ্যম জায়গায় অবস্থান করছে মাত্র। জামায়াত তাদের উগ্র আদর্শে প্রশিক্ষিত দল। জামায়াত সেভাবে গড়ে তোলা, রাষ্ট্রবিপ্লব সংগঠনে দীক্ষিত করে তোলা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে গভীরভাবে চুক্ত একটি দল। বিএনপি এ ধরনের কোনো সুশৃঙ্খল নেতাকর্মীর দল নয়, বরং বহত্তর সমাজের অভ্যন্তরে বসবাসকারী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠিত, অপ্রতিষ্ঠিত নানা গোষ্ঠীর একটি প্লাটফর্ম যা শেষ পর্যন্ত ডানপন্থার ভাবাদর্শে জনগণের একটি বড় অংশকে ধরে রাখার ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে করে থাকে। রাজনীতির এ শক্তিকে মতাদর্শগতভাবে মধ্য ডানপন্থী বলা হলেও শিক্ষাদীক্ষার অভাব মানহীনতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবের কারণে এ ধরনের রাজনৈতিক বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে শেষ পর্যন্ত লাভবান হয় জামায়াতের মতো সংগঠিত উগ্রবাদ, রাজনৈতিক দলই যারা এর ভেতরে প্রভাব বিস্তার করার মাধ্যমে সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিএনপির অভ্যন্তরে জামায়াত ভাবাপন্ন শক্তির অবস্থান বেশ শক্তিশালী। তারা বিএনপিকে আগাগোড়াই নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন। এটি এমনি এমনি হয়নি। জামায়াত গোড়া থেকেই পরিকল্পিতভাবে বিএনপির অভ্যন্তরে এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার মতো ব্যবস্থা করে রেখেছে। জামায়াতের যেহেতু বিপুল অর্থবিত্ত এবং ক্যাডারবাহী রয়েছে তাই বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়া, থাকা এবং রাজনীতিতে শক্তির উৎস হিসেবে জামায়াতের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতি ও শিক্ষাদীক্ষায় পরিচালিত কোনো দলের পক্ষে এভাবে রাজনীতি করার চিন্তা একেবারেই অকল্পনীয়। বিএনপির জন্মই হয়েছে আওয়ামীবিরোধী ভাবাদর্শকে সম্বল করে। দলের সর্বত্র তখন যাতের স্থান করে দেয়া হয়েছিল তারা আওয়ামীবিরোধী সাম্প্রদায়িক এবং অতবিপ্লবী গোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অনেকে বিভ্রান্তবাদী, হঠকারী চিন্তাধারায় নিমজ্জিত। একটি জাতীয়তাবাদী আদর্শের উদারবাদী চিন্তা ধারার আন্দোলনে এরা কেউ যুক্ত ছিলেন না, সেটিকে তারা সমর্থনও করেননি। মুক্তিযুদ্ধের তাদের কারো ভাষায় ‘ভারতের নির্দেশিত’, ‘কারো ভাষায় দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে চিত্রিত! দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, এদের নিয়েই জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে যে রাজনীতির মাঠ প্রশস্ত করেছিলেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল, নেতাকর্মীরা ছিল অবাঞ্ছিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত। অন্যদিকে যারা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন— তারাই হলেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার মূল শক্তি। ফলে বাংলাদেশে জামায়াত এবং তাদের ভাবাদর্শের-শক্তির আবির্ভাব ঘটার সুযোগ ঘটে। জিয়াউর রহমান সেই সুযোগ নিজের দলে এবং দলের বাইরে পরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত করে ছিলেন। একজন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শবাদিতার শক্তিকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন। রেখে গেলেন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যারা প্রায় দুই দশক দাপটের সঙ্গে রাষ্ট্র রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করা, দুর্বল এবং বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তাদের সহযোগিতায়, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত অপপ্রচার, বিভ্রান্তি, ঘৃণা এবং অজ্ঞতা সমাজ জীবনকে এই দীর্ঘ সময়ে গ্রাস করেছে। বাংলাদেশের সমাজ জীবনে অসাম্প্রদায়িকতাকে এতটাই দুর্বল, ভঙ্গুর এবং নড়বড়ে করে ফেলা হয় যে, এর মানে বাংলাদেশ আসলেই কেমন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গ্রহণ করবে তা অসাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহণ করবে নাকি ধর্ম রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শে পরিচালিত হবে এ নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো সম্ভব হয়েছে তাতে লাভবান হয়েছে প্রধানত জামায়াত এবং অংশত বিএনপি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার পরিবেশে। বাংলাদেশে এখন সাম্প্রদায়িতকতা কতখানি বিস্তৃত এবং গভীরে নিহিত তা যে কোনো ধরনের নির্বাচনে এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে লক্ষণীয় বিষয়। একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রক্তস্নাত বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নীতি-নৈতিকতার আদর্শে কতখানি এগুতে পেরেছে তা অনেক ক্ষেত্রেই বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখা হচ্ছে না। যদি এভাবে দেখা হয় তাহলে আশাবাদী হওয়ার চাইতে হতাশ হওয়ার বাস্তবতাই অনেক বেশি বিদ্যমান। বাংলাদেশে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্ম জামায়াত শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতিকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার বড় কারণ পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির মাঠ গঠন যেখানে জামায়াত-বিএনপি একসঙ্গে পথ চলেছে, রাজনীতির জায়গা তৈরি করেছে, নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শকে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করেছে সেখানেও বাংলাদেশের সমাজ জীবনে এখন এমন বিশ্বাসী মানুষের অবস্থান বেশ শক্তিশালী যারা যে কোনো মূল্যে আওয়ামী ঠৈকাওয়ের অবস্থান নিতে বড় দল হিসেবে প্রথমে বিএনপিকে বাছাই করবে তারপর জামায়াত এবং জঙ্গিবাদী সকল শক্তির যে কোনো উত্থান, হঠকারী অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিতে প্রস্তুত। বিষয়টি এখন দুই পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের লড়াইতে পরিণত হয়েছে। সেই লড়াই অসাম্প্রদায়িক শক্তি বিভক্ত ও বিভ্রান্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি ভেতরে ভেতরে এক ও অভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। এরা যুগ যুুগ ধরে বিএনপির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে এবং বিএনপিকে তারা ছাড়া সংগঠনে পরিণত করেছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের কারণে রাজনীতির এই চাল ধরতে বা বুঝতে পারছে না। একটি বিরাট অংশ তাতে অংশ নিচ্ছে, শক্তি জোগাচ্ছে। বিএনপি এমন এক বাস্তবতায় শ্যাম রাখি নাকি কুল রাখি, নাকি সব কিছু হারাই এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। কেননা আন্তর্জাতিক মহলও বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরের এই দুর্বলতা বুঝে ফেলেছে। বিত্রনপির ভূমিকাও বুঝে ফেলেছে। তারা জামায়াত-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উত্থান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অচিরেই বিপজ্জনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার কথা বলছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা কতটা কঠিন তা বিএনপির মানস সম্পর্কে যারা সচেতন তারাই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
এতদিনকার-রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দীক্ষার সঙ্গে বড় সংখ্যা নেতাকর্মীর যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তা আসলে বিএনপি কিভাবে সামাল দেবে সেটি বড় প্রশ্ন। একটি দলের নেতাকর্মীদের দীর্ঘদিন যে ভাবাদর্শে গড়ে তোলা হয়েছে তা থেকে চট করে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন । বিএনপির পক্ষে তাদের কর্মীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নতুন করে গড়ে তোলা, গণতন্ত্রের উদারবাদী ভাবাদর্শের রাজনীতির পাঠ নতুন করে দেয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ধারণ এবং জানার কথা বলা, আধুনিক অগ্রসর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে রাজনীতিকে আত্মস্থ করে রাজনীতির পাঠ নেয়ার কথা বলা মোটেও সহজ কাজ নয়। তাতে কতটা সফল হবে বিএনপি তা নিয়ে বিএনপির মধ্যেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রের মতাদর্শ সব সময়ই অসাম্প্রদায়িক। কোনো দল সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করলে সম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিলে সেই দল কোনো কালেই গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। বিএনপি জন্ম থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করছে। তাদের নেতাকর্মী-সমর্থকরাও তাতে বিশ্ববাসী এবং তেমন রাষ্ট্রের ধারণাই নেতাকর্মীরা পোষণ-করেছেন। বিএনপি ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো ইশতেহার দেয়নি। আওয়ামীবিরোধী, ভারতবিরোধী ধর্ম চলে যাবে এসব সস্তা স্লোগান প্রচার-প্রচারণায় সব চেয়ে নির্ভরশীল ছিল এবং এখনো আছে। ভোটের রাজনীতিতে এ ধরনের বিজয় লাভ করে বার বার ক্ষমতায় এসে বিএনপি আরো বেশি সাম্প্রদায়িকতানির্ভর হয়ে উঠেছে। কিন্তু এভাবে কোনো দল রাজনৈতিকভাবে গণত্রান্ত্রিক রাষ্ট্রে অগ্রসর হতে পারে না। বিএনপির তাদের কোনো শাসনামলেই এমন কোনো উন্নয়ন বা রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মডেল তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ শত প্রশ্নের পরও পেরেছে কিছুটা হলেও। আওয়ামী লীগের এই সক্ষমতা দেশ ও বিদেশে যে বার্তা দিয়েছে তাতে বিএনপির সাম্প্রদায়িকতানির্ভর রাজনীতি মস্তবড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এখন যত কষ্টই হোক না কেন বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দলটি গণতন্ত্রের মৌল আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতি করবে, নেতাকর্মীদের মনোজগত তৈরি করবে নাকি জামায়াতের সঙ্গে এতদিনের চর্চা করা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালিয়ে যাবে। এসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া বিএনপির কাছ থেকে সহজ নয়।
লেখক : ইতিহাসতত্ত্ব ও শিক্ষাবিদ
No comments