খুলনার তিন উপজেলা- পানির জন্য ছুটছে প্রাণ by উত্তম মণ্ডল
খুলনার পাইকগাছা পৌরসভা এলাকায় একটি বেসরকারি সংস্থার নির্মিত ‘আর্সেনিক আয়রন রিমুভাল প্লান্ট’ থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করছেন এলাকাবাসী। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো |
‘সব
কষ্ট সইহ্য হয়, কিন্তু পানির কষ্ট সইহ্য হয় না। বাড়িতে অসুস্থ মাইয়ে
রাইখে গাং পার হইয়ে পথ পানি নিতি আসলাম। মানুষ তো পানি কিনে খাচ্ছে। আমরা
তাও পারতিছিনে। গরিব মানুষের জ্বালা খুব।’
রেনু ফকির কথাগুলো শেষ করতে না-করতেই মাথার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেই আবার সেই বহুকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি উধাও। চোখে-মুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব নিয়ে এই গৃহবধূ বলেন, ‘আল্লার কাছে এত কচ্ছি তবু বৃষ্টি দেচ্ছে না। এ রকম আর কদিন চললি পানি না খাইয়ে মুরে যাতিবে (মারা যেতে হবে)।’
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা ইউনিয়নের বেতবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা রেনু ফকির। মিনেজ নদী পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে গড়ইখালী গ্রামের আলমশাহী ইনস্টিটিউটের পুকুরে এসেছেন পানি নিতে। সেখানে তাঁরই মতো পানি নিতে এসেছেন আরও কয়েক শ নারী ও পুরুষ। সবার হাতেই কলস বা ড্রাম।
পুকুরপাড়ে ১৫-২০টি নছিমন। পাইকগাছা ছাড়াও পাশের কয়রা ও দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসব যানে করেই পানি নিতে এসেছেন লোকজন। পুকুরে সামান্য পানি। কলস বা ড্রাম ডোবানোর অবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে অনেকে বাটিতে করেই পানি তুলছেন।
ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক মধুসূদন সরকার জানান, প্রতিদিন কয়েক শ লোক এখান থেকে পানি নেন। এই একটা পুকুরের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন তিন উপজেলার লোকজন।
দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা—খুলনার এই তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে এবং ভুক্তভোগী লোকজন, জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পানি নিয়ে দুর্ভোগের এই চিত্র পাওয়া যায়।
বিশুদ্ধ পানির অভাবে তিন উপজেলার ছয় লাখ অধিবাসী দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। সমুদ্র উপকূলে প্রায় সারা বছরই লোনা পানির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হয় তাঁদের। অগভীর বা গভীর নলকূপ অকার্যকর। বৃষ্টি ও পুকুরের পানিই ভরসা। আর যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন।
বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরাসরি বৃষ্টির পানি পান করেন এখানকার মানুষ। পৌষের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি দিয়ে। সারা বছরই পানির সংকট থাকলেও পৌষের মাঝ থেকে বৈশাখের মাঝ পর্যন্ত চলে তীব্র সংকট।
পাইকগাছার ছয়টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে শুধু পানি আর পানি। কিন্তু অফুরন্ত এই জলরাশির মধ্যেও খাওয়ার পানির জন্য ছুটতে হয় ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে। তারপরও মিলছে না বিশুদ্ধ পানি। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে পানির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম। মাইলের পর মাইল হেঁটে বা নসিমন, ট্রলার ও নৌকায় করে দূরে গিয়ে পুকুর থেকে পানি আনতে হয়। তবে গোসল, থালাবাসন ও কাপড় ধোয়ার কাজ চলে লোনা পানি দিয়েই।
ঘুরে ঘুরে দেখা গেল, অধিকাংশ পুকুর শুকিয়ে আছে। শুকিয়ে যাওয়া এবং অনেক পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় সরকারি-বেসরকারিভাবে নির্মিত পিএসএফ (পন্ডস অ্যান্ড স্যান্ড ফিল্টার) কাজে আসছে না। এ ব্যবস্থায় চাপকল দিয়ে পুকুরের পানি একটি বালুভর্তি বিশাল ফিল্টারে ফেলা হয়। সেই বালুর ভেতর দিয়ে গিয়ে পানি কিছুটা পরিশোধিত হয়ে নল দিয়ে বের হয়ে আসে।
পাইকগাছা সদরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে চারটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে নসিমনে করে পানি নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, ১০ লিটার পানির একটি ড্রাম এখান থেকে তিন-চার টাকায় কিনে দূরত্ব অনুসারে সাত থেকে ৩০ টাকা করে বিক্রি করেন। প্রতিদিন ২০ হাজার লিটারের বেশি পানি কেনেন তাঁরা।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল কার্যালয় সূত্র জানায়, লতা, দেলুটি, সোলাদানা, লস্কর, চাঁদখালী ও গড়ইখালী ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। হরিঢালী, কপিলমুনি, রাড়ুলি ও গদাইপুর ইউনিয়নের পানি তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে এ বছর সেখানেও অধিকাংশ পুকুর শুকিয়ে গেছে।
পানির সংকট নিরসনে ১০টি ইউনিয়নে বড় পুকুর পুনঃখনন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী। তিনি বলেন, ‘দুই লাখ ৪৭ হাজার মানুষের এ উপজেলায় পানির সংকটকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কপোতাক্ষ শুকিয়ে যাওয়ায় এই সংকট দিন দিন আরও বাড়ছে।’
দাকোপেও পাইকগাছার মতো পরিস্থিতি। কোনো ইউনিয়নের নলকূপই কার্যকর নয়। পুকুরের পানি ও বৃষ্টিই এক লাখ ৫২ হাজার মানুষের ভরসা। কিছু এনজিও এখানে রিজার্ভ ট্যাংক সরবরাহ, পুকুর খনন ও পিএসএফ নির্মাণ করেছে। আছে ৪৫৮টি পিএসএফ, ৩৬৬টি নলকূপ ও সাতটি পুকুর। কিন্তু সবই প্রয়োজনের তুলনায় কম। তা ছাড়া দীর্ঘ খরার কারণে সেগুলোর পানিও শেষ হয়ে গেছে।
চালনা পৌরসভায় পানির সংকট মারাত্মক। সেখানকার মানুষ উপজেলা পরিষদের পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করেন। দু-একটি পিএসএফ থাকলেও সেগুলোর অবস্থা ভালো না। বিত্তশালীরা খুলনা ও বটিয়াঘাটা থেকে পানি কিনে আনেন।
পৌর মেয়র অচিন্ত্য কুমার মণ্ডল জানান, এনজিওর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পানির সংকট নিরসনে কাজ চলছে। এখান থেকে চার হাজার লোক উপকৃত হবেন। তাঁর অভিযোগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে সিডিএমপি প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি পয়েন্টে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান প্রকল্প প্রধানকে বাস্তবায়ন করতে নিষেধ করায় সেটি আটকে আছে।
তবে উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মো. আবুল হোসেন এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে বলেন, পৌর মেয়রের সদিচ্ছার অভাবে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
উপজেলার সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়ন আইলায় প্লাবিত হওয়ার পর থেকে পানির সংকটে ভুগছে। সুতারখালীর কালাবগী, গুনারী, নলিয়ান গ্রামের লোকজন গড়ইখালী পুকুর থেকে পানি কিনে পান করেন।
মাথায় কলস ও কোলে শিশুসন্তান নিয়ে কামারখোলার কালীনগর বাজারের ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তপতী রানী। তিনি জানান, বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি আনেন। কিন্তু পাঁচজনের সংসারে এক কলস পানিতে হয় না।
উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মো. আবুল হোসেন জানান, সংকট সমাধানে বর্তমানে উপজেলা গভর্ন্যান্স প্রকল্পের আওতায় এবং এনজিওর মাধ্যমে ১৪টি পুকুরের খননকাজ চলছে। কিছু পুকুর খননও করা হয়েছে। পানির ট্যাঙ্ক দেওয়া হয়েছে কিছু। কিন্তু এর সবই প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশীর পানি কিছুটা ভালো। তবে মহেশ্বরীপুর, বাগালি ও আমাদি ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। সেখানকার কোনো নলকূপই কার্যকর নেই। একই অবস্থা মহারাজপুর ও সদরের কিছু অংশেও।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয় সূত্র জানায়, এই উপজেলায় এক লাখ ৯৪ হাজার মানুষের বসবাস। এদের ৬০ শতাংশই আছে পানির সংকটে। সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ৭৬টি পিএসএফ থাকলেও ৫২টি অচল। লবণাক্ত পানি শোধনের নয়টি ডি-স্যালাইনেশন প্ল্যান্টের সাতটি সচল আছে। এসব প্ল্যান্ট থেকে ৫০ পয়সা দরে পানি বিক্রি হলেও চাহিদার তুলনায় পানির সরবরাহ অপ্রতুল।
দীর্ঘ খরায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় কয়রার মহেশ্বরীপুর ও বাগালি ইউনিয়নে নলকূপ থেকে পানি ওঠানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বহু গ্রামের লোকজন পাশের মহারাজপুরের গভীর নলকূপ থেকে পানি কিনে খান। প্রতি ৩০ লিটার পানি কিনতে তাঁরা খরচ করেন ২০ টাকা।
খুলনা জেলার মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় ৭৬ হাজার ৬১৩ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৭৪ হাজার ৯০ হেক্টর জমিতেই ব্যাপক মাত্রার লবণের উপস্থিতি। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের ফলে মাটি সারা বছরই লবণাক্ত পানিতে ডুবে থাকে। পরিকল্পিত উপায়ে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি লবণসহিষ্ণু জাতের ধান চাষ করা গেলে লবণাক্ততার মাত্রা কমবে বলে মনে করেন তিনি।
রেনু ফকির কথাগুলো শেষ করতে না-করতেই মাথার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেই আবার সেই বহুকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি উধাও। চোখে-মুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব নিয়ে এই গৃহবধূ বলেন, ‘আল্লার কাছে এত কচ্ছি তবু বৃষ্টি দেচ্ছে না। এ রকম আর কদিন চললি পানি না খাইয়ে মুরে যাতিবে (মারা যেতে হবে)।’
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা ইউনিয়নের বেতবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা রেনু ফকির। মিনেজ নদী পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে গড়ইখালী গ্রামের আলমশাহী ইনস্টিটিউটের পুকুরে এসেছেন পানি নিতে। সেখানে তাঁরই মতো পানি নিতে এসেছেন আরও কয়েক শ নারী ও পুরুষ। সবার হাতেই কলস বা ড্রাম।
পুকুরপাড়ে ১৫-২০টি নছিমন। পাইকগাছা ছাড়াও পাশের কয়রা ও দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসব যানে করেই পানি নিতে এসেছেন লোকজন। পুকুরে সামান্য পানি। কলস বা ড্রাম ডোবানোর অবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে অনেকে বাটিতে করেই পানি তুলছেন।
ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক মধুসূদন সরকার জানান, প্রতিদিন কয়েক শ লোক এখান থেকে পানি নেন। এই একটা পুকুরের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন তিন উপজেলার লোকজন।
দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা—খুলনার এই তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে এবং ভুক্তভোগী লোকজন, জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পানি নিয়ে দুর্ভোগের এই চিত্র পাওয়া যায়।
বিশুদ্ধ পানির অভাবে তিন উপজেলার ছয় লাখ অধিবাসী দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। সমুদ্র উপকূলে প্রায় সারা বছরই লোনা পানির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হয় তাঁদের। অগভীর বা গভীর নলকূপ অকার্যকর। বৃষ্টি ও পুকুরের পানিই ভরসা। আর যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন।
বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরাসরি বৃষ্টির পানি পান করেন এখানকার মানুষ। পৌষের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি দিয়ে। সারা বছরই পানির সংকট থাকলেও পৌষের মাঝ থেকে বৈশাখের মাঝ পর্যন্ত চলে তীব্র সংকট।
পাইকগাছার ছয়টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে শুধু পানি আর পানি। কিন্তু অফুরন্ত এই জলরাশির মধ্যেও খাওয়ার পানির জন্য ছুটতে হয় ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে। তারপরও মিলছে না বিশুদ্ধ পানি। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে পানির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম। মাইলের পর মাইল হেঁটে বা নসিমন, ট্রলার ও নৌকায় করে দূরে গিয়ে পুকুর থেকে পানি আনতে হয়। তবে গোসল, থালাবাসন ও কাপড় ধোয়ার কাজ চলে লোনা পানি দিয়েই।
ঘুরে ঘুরে দেখা গেল, অধিকাংশ পুকুর শুকিয়ে আছে। শুকিয়ে যাওয়া এবং অনেক পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় সরকারি-বেসরকারিভাবে নির্মিত পিএসএফ (পন্ডস অ্যান্ড স্যান্ড ফিল্টার) কাজে আসছে না। এ ব্যবস্থায় চাপকল দিয়ে পুকুরের পানি একটি বালুভর্তি বিশাল ফিল্টারে ফেলা হয়। সেই বালুর ভেতর দিয়ে গিয়ে পানি কিছুটা পরিশোধিত হয়ে নল দিয়ে বের হয়ে আসে।
পাইকগাছা সদরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে চারটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে নসিমনে করে পানি নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, ১০ লিটার পানির একটি ড্রাম এখান থেকে তিন-চার টাকায় কিনে দূরত্ব অনুসারে সাত থেকে ৩০ টাকা করে বিক্রি করেন। প্রতিদিন ২০ হাজার লিটারের বেশি পানি কেনেন তাঁরা।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল কার্যালয় সূত্র জানায়, লতা, দেলুটি, সোলাদানা, লস্কর, চাঁদখালী ও গড়ইখালী ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। হরিঢালী, কপিলমুনি, রাড়ুলি ও গদাইপুর ইউনিয়নের পানি তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে এ বছর সেখানেও অধিকাংশ পুকুর শুকিয়ে গেছে।
পানির সংকট নিরসনে ১০টি ইউনিয়নে বড় পুকুর পুনঃখনন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী। তিনি বলেন, ‘দুই লাখ ৪৭ হাজার মানুষের এ উপজেলায় পানির সংকটকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কপোতাক্ষ শুকিয়ে যাওয়ায় এই সংকট দিন দিন আরও বাড়ছে।’
দাকোপেও পাইকগাছার মতো পরিস্থিতি। কোনো ইউনিয়নের নলকূপই কার্যকর নয়। পুকুরের পানি ও বৃষ্টিই এক লাখ ৫২ হাজার মানুষের ভরসা। কিছু এনজিও এখানে রিজার্ভ ট্যাংক সরবরাহ, পুকুর খনন ও পিএসএফ নির্মাণ করেছে। আছে ৪৫৮টি পিএসএফ, ৩৬৬টি নলকূপ ও সাতটি পুকুর। কিন্তু সবই প্রয়োজনের তুলনায় কম। তা ছাড়া দীর্ঘ খরার কারণে সেগুলোর পানিও শেষ হয়ে গেছে।
চালনা পৌরসভায় পানির সংকট মারাত্মক। সেখানকার মানুষ উপজেলা পরিষদের পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করেন। দু-একটি পিএসএফ থাকলেও সেগুলোর অবস্থা ভালো না। বিত্তশালীরা খুলনা ও বটিয়াঘাটা থেকে পানি কিনে আনেন।
পৌর মেয়র অচিন্ত্য কুমার মণ্ডল জানান, এনজিওর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পানির সংকট নিরসনে কাজ চলছে। এখান থেকে চার হাজার লোক উপকৃত হবেন। তাঁর অভিযোগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে সিডিএমপি প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি পয়েন্টে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান প্রকল্প প্রধানকে বাস্তবায়ন করতে নিষেধ করায় সেটি আটকে আছে।
তবে উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মো. আবুল হোসেন এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে বলেন, পৌর মেয়রের সদিচ্ছার অভাবে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
উপজেলার সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়ন আইলায় প্লাবিত হওয়ার পর থেকে পানির সংকটে ভুগছে। সুতারখালীর কালাবগী, গুনারী, নলিয়ান গ্রামের লোকজন গড়ইখালী পুকুর থেকে পানি কিনে পান করেন।
মাথায় কলস ও কোলে শিশুসন্তান নিয়ে কামারখোলার কালীনগর বাজারের ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তপতী রানী। তিনি জানান, বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি আনেন। কিন্তু পাঁচজনের সংসারে এক কলস পানিতে হয় না।
উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মো. আবুল হোসেন জানান, সংকট সমাধানে বর্তমানে উপজেলা গভর্ন্যান্স প্রকল্পের আওতায় এবং এনজিওর মাধ্যমে ১৪টি পুকুরের খননকাজ চলছে। কিছু পুকুর খননও করা হয়েছে। পানির ট্যাঙ্ক দেওয়া হয়েছে কিছু। কিন্তু এর সবই প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশীর পানি কিছুটা ভালো। তবে মহেশ্বরীপুর, বাগালি ও আমাদি ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। সেখানকার কোনো নলকূপই কার্যকর নেই। একই অবস্থা মহারাজপুর ও সদরের কিছু অংশেও।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয় সূত্র জানায়, এই উপজেলায় এক লাখ ৯৪ হাজার মানুষের বসবাস। এদের ৬০ শতাংশই আছে পানির সংকটে। সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ৭৬টি পিএসএফ থাকলেও ৫২টি অচল। লবণাক্ত পানি শোধনের নয়টি ডি-স্যালাইনেশন প্ল্যান্টের সাতটি সচল আছে। এসব প্ল্যান্ট থেকে ৫০ পয়সা দরে পানি বিক্রি হলেও চাহিদার তুলনায় পানির সরবরাহ অপ্রতুল।
দীর্ঘ খরায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় কয়রার মহেশ্বরীপুর ও বাগালি ইউনিয়নে নলকূপ থেকে পানি ওঠানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বহু গ্রামের লোকজন পাশের মহারাজপুরের গভীর নলকূপ থেকে পানি কিনে খান। প্রতি ৩০ লিটার পানি কিনতে তাঁরা খরচ করেন ২০ টাকা।
খুলনা জেলার মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় ৭৬ হাজার ৬১৩ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৭৪ হাজার ৯০ হেক্টর জমিতেই ব্যাপক মাত্রার লবণের উপস্থিতি। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের ফলে মাটি সারা বছরই লবণাক্ত পানিতে ডুবে থাকে। পরিকল্পিত উপায়ে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি লবণসহিষ্ণু জাতের ধান চাষ করা গেলে লবণাক্ততার মাত্রা কমবে বলে মনে করেন তিনি।
No comments