উপেক্ষিত যুব সম্প্রদায় by মুনির হাসান
বাংলাদেশের তরুণদের নতুন একটি ছবি ইদানীং বিশ্বব্যাপী আলোচিত। এটি হলো ভাগ্যান্বেষণে আমাদের যুবাদের সমুদ্রে ভেসে থাকা কিংবা ত্রাণশিবিরে আহাজারি করার চিত্র। যে সময়ে এমন অনেক ছবি বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়া প্রকাশ করেছে, ঠিক তখনই জাতীয় সংসদে নতুন বাজেট পেশ করেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। বড় আকারের, উচ্চাভিলাষী ও বিশাল আশ্বাসের বাজেট। সামগ্রিকভাবে বাজেটে অনেক আশার কথা আছে, আছে উন্নয়নের ফিরিস্তিও। তবে সামগ্রিক বাজেটের ভালো-মন্দ বিবেচনা এই লেখার বিষয় নয়। কর্মসূত্রে ও প্যাশনসূত্রে আমাকে তরুণ-যুবাদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটাতে হয়। তাদের অনেক স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের অংশীদারও হতে হয়। তাই আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি অর্থমন্ত্রী আমাদের যুবাদের জন্য এই বাজেটে কী রেখেছেন।
ধরা যাক শিক্ষার কথা। একুশ শতকের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য নিজেকে তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মের মনের গভীরে স্থায়ী আসন নিয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। নিয়েছে বলে তারা রাস্তায় নেমে শিক্ষার অধিকার আদায়ে মিছিল-মিটিংয়ের পরিবর্তে নিজেরাই নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্র যেহেতু তাদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারছে না, তারা তাই রাষ্ট্রকে এ কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ফলে, দুই দশক আগে যে পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিত কিন্তু অনেকখানি বদলে গেছে। একসময় ধরা হতো কেবল ধনীর দুলালই সেখানকার শিক্ষার্থী।
এখন কিন্তু তা নয়। বরং ছবিটা উল্টো। প্রধানত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতা এত তীব্র যে গরিব, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে সেখানে সুযোগ পাওয়া এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। যারা এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে, তাদের অনেককেই বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ে ভর্তি হতে হয় এবং কোচিং না করলে ভর্তি হওয়া কঠিন। এমনকি এইচএসসি পরীক্ষার অন্তত চার-ছয় মাস আগে থেকে কোচিং সেন্টারে আগাম টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়! যারা কোচিংয়ের সুবিধা পাচ্ছে না এবং যারা প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসছে, তাদের পক্ষে তাই কম টাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধরাই থেকে যাচ্ছে। বাবা-ভাইয়ের কষ্টের টাকা দিয়ে তাকে এসে ভর্তি হতে হচ্ছে বেশি খরচের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন-সুবিধা নেই। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো শায়েস্তা খাঁর আমলের খরচে সে থাকার সুবিধাও পাচ্ছে না। অথচ অর্থমন্ত্রী এবার তার পড়ালেখার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছেন শতকরা ১০ ভাগ!
অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর নতুন ১৩ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। কিন্তু তিনি প্রতিবছর কতজন কর্মপ্রত্যাশী কর্মবাজারে যোগ দিচ্ছে, সেই সংখ্যাটি বলেননি। প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ২২ লাখ ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে প্রবেশ করছে এবং এটি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে যেখানে বিএমইটির হিসাবে বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছে ৮ লাখ ৭৫ হাজার জন, সেখানে ২০১৪ সালে একই উদ্দেশ্যে গিয়েছে মাত্র ৪ লাখ ২৫ হাজার। অথচ বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান বাড়ছে ভয়াবহভাবে। দুই বছর আগে দেশে কর্মরত বিদেশিরা ৩১৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স তাদের দেশে পাঠিয়েছে। আর বাজেট বক্তৃতার কয়েক দিন আগে অর্থমন্ত্রী নিজেই সেটি ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন। এদের একটি বড় অংশ কাজ করছে গার্মেন্টস এবং কয়েকটি বিশেষায়িত সেক্টরে। বলা হয়, দক্ষতার অভাবে আমাদের কর্মীরা এগিয়ে যেতে পারছে না। তাই যদি হবে, আমাদের কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য চলতি বাজেটে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কেন আলাদা করে মাত্র ১০০ কোটি টাকাও রাখা হলো না!
আমাদের যুবারা তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য অধিক হারে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অথচ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুখবর এই বাজেটে দেখা যায়নি। প্রায় গণদাবিতে পরিণত হওয়া দাবিকে কলা দেখিয়ে ইন্টারনেটের ওপর সকল পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বহাল রাখা হয়েছে। ভ্যাটের মূল ধারণাই হলো উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সব মিলিয়ে ভ্যাটের পরিমাণ হবে ১৫ শতাংশ। কিন্তু ইন্টারনেটের বেলায় সেটি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কাছ থেকে আমি যে হিসাবটি পেয়েছি, সেটি খুবই ভয়াবহ।
একটি সহজ হিসাব দেখা যাক। সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি বা অনুরূপ কোম্পানিগুলো নিজেদের ১০ শতাংশ লাভ ধরে ১০০ টাকার ব্যান্ডউইডথ বিক্রি করতে পারে ১১০ টাকায়। তার ওপর তাকে ১ শতাংশ রাজস্ব সরকারকে দিতে হয়। বাড়তি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে সেটির বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১২৭ দশমিক ৭৭ টাকা। এই টাকায় ব্যান্ডউইডথ কিনতে পারে কেব্ল ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজি। এখানে ১০ শতাংশ লাভে তাদের মূল্য দাঁড়ায় ১৪০ দশমিক ৫৫ টাকা। আইআইজিকে রাজস্বের ১০ শতাংশ সরকারকে দিয়ে দিতে হয়। সেটি এবং এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে ওই ১০০ টাকার ব্যান্ডউইডথের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১৭৭ দশমিক ৮১ টাকা। এই টাকায় ব্যান্ডউইডথ কেনে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আইএসপি), যারা আপনার-আমার কাছে ইন্টারনেটকে নিয়ে যাচ্ছে। আইএসপি-ওয়ালারাও যদি ১০ শতাংশ লাভ আর ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে, তাহলে ভোক্তা পর্যায়ে ১০০ টাকার ব্যান্ডউইডথের দাম পড়ে যাচ্ছে মাত্র ২২৪ দশমিক ৯৪! অবশ্য আইআইজি এবং আইএসপিগুলো তাদের ভ্যাটের রিবেট পায়, যা একুনে ৩৪ দশমিক ৬৯ টাকা। এই রিবেট বাদ দিলে ২২৪ দশমিক ৯৪ টাকার মধ্যে সরকারের হিস্যা দাঁড়াচ্ছে মোট ৭৬ দশমিক ৩৬ টাকা, যা কিনা ৩৪ শতাংশ। অন্য কথায় বলা যায়, আমাদের যুবাটি ইন্টারনেটের জন্য অহেতুক দ্বিগুণ দামে ইন্টারনেট কিনছে। ১০০০ টাকার ইন্টারনেট বিলের ৩৪০ টাকাই সরকার নিয়ে যাচ্ছে। এবার অর্থমন্ত্রী এই খরচ আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৯০ শতাংশই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সুবিধার আওতায় আছে। মোবাইল-সেবার ওপর ৫ শতাংশ অতিরিক্ত এরই মধ্যে আরোপ হতে শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে একদল যুবা নিজেরাই একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। ফেসবুকে নিজের নেটওয়ার্ক তৈরি করছে ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ নামে, চেষ্টা করছে আত্মকর্মসংস্থানের। কয়েক বছরে এদেরই বিরাট একটা অংশ দেশে চালু করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। ফলে চট্টগ্রামে বসে এখন খুব সহজে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম খাওয়া যাচ্ছে, ঢাকায় বসে পাওয়া যাচ্ছে মংলার গলদা চিংড়ি। কষ্ট করে কেবল একটি ফোন বা একটা ক্লিক করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য সেই খাতে প্রচুর প্রণোদনা দেওয়া হয়। কিন্তু এবারের বাজেটে ই-কমার্সের সব সেবার ওপর ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এখন আপনি যদি বাটার কোনো দোকান থেকে এক জোড়া জুতা কেনেন, তাহলে যত টাকায় সেটা কিনতে পারবেন, ই-কমার্স স্টোর থেকে কিনলে দাম দিতে হবে বেশি!
এই তালিকা আর বাড়াতে চাই না। আমার মনে হয়েছে, আমরা কথায় কথায় আমাদের যুব সম্প্রদায়কে যেভাবে আগামী দিনের মূল চালিকাশক্তি, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রসৈনিক বলি, আদতে সেটা মোটেই বিশ্বাস করি না।
না হলে কথায় আর কাজে এত অমিল কেমনে থাকে?
মুনির হাসান : যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক, প্রথম আলো।
ধরা যাক শিক্ষার কথা। একুশ শতকের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য নিজেকে তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মের মনের গভীরে স্থায়ী আসন নিয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। নিয়েছে বলে তারা রাস্তায় নেমে শিক্ষার অধিকার আদায়ে মিছিল-মিটিংয়ের পরিবর্তে নিজেরাই নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্র যেহেতু তাদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারছে না, তারা তাই রাষ্ট্রকে এ কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ফলে, দুই দশক আগে যে পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিত কিন্তু অনেকখানি বদলে গেছে। একসময় ধরা হতো কেবল ধনীর দুলালই সেখানকার শিক্ষার্থী।
এখন কিন্তু তা নয়। বরং ছবিটা উল্টো। প্রধানত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতা এত তীব্র যে গরিব, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে সেখানে সুযোগ পাওয়া এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। যারা এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে, তাদের অনেককেই বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ে ভর্তি হতে হয় এবং কোচিং না করলে ভর্তি হওয়া কঠিন। এমনকি এইচএসসি পরীক্ষার অন্তত চার-ছয় মাস আগে থেকে কোচিং সেন্টারে আগাম টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়! যারা কোচিংয়ের সুবিধা পাচ্ছে না এবং যারা প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসছে, তাদের পক্ষে তাই কম টাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধরাই থেকে যাচ্ছে। বাবা-ভাইয়ের কষ্টের টাকা দিয়ে তাকে এসে ভর্তি হতে হচ্ছে বেশি খরচের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন-সুবিধা নেই। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো শায়েস্তা খাঁর আমলের খরচে সে থাকার সুবিধাও পাচ্ছে না। অথচ অর্থমন্ত্রী এবার তার পড়ালেখার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছেন শতকরা ১০ ভাগ!
অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর নতুন ১৩ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। কিন্তু তিনি প্রতিবছর কতজন কর্মপ্রত্যাশী কর্মবাজারে যোগ দিচ্ছে, সেই সংখ্যাটি বলেননি। প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ২২ লাখ ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে প্রবেশ করছে এবং এটি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে যেখানে বিএমইটির হিসাবে বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছে ৮ লাখ ৭৫ হাজার জন, সেখানে ২০১৪ সালে একই উদ্দেশ্যে গিয়েছে মাত্র ৪ লাখ ২৫ হাজার। অথচ বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান বাড়ছে ভয়াবহভাবে। দুই বছর আগে দেশে কর্মরত বিদেশিরা ৩১৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স তাদের দেশে পাঠিয়েছে। আর বাজেট বক্তৃতার কয়েক দিন আগে অর্থমন্ত্রী নিজেই সেটি ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন। এদের একটি বড় অংশ কাজ করছে গার্মেন্টস এবং কয়েকটি বিশেষায়িত সেক্টরে। বলা হয়, দক্ষতার অভাবে আমাদের কর্মীরা এগিয়ে যেতে পারছে না। তাই যদি হবে, আমাদের কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য চলতি বাজেটে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কেন আলাদা করে মাত্র ১০০ কোটি টাকাও রাখা হলো না!
আমাদের যুবারা তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য অধিক হারে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অথচ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুখবর এই বাজেটে দেখা যায়নি। প্রায় গণদাবিতে পরিণত হওয়া দাবিকে কলা দেখিয়ে ইন্টারনেটের ওপর সকল পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বহাল রাখা হয়েছে। ভ্যাটের মূল ধারণাই হলো উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সব মিলিয়ে ভ্যাটের পরিমাণ হবে ১৫ শতাংশ। কিন্তু ইন্টারনেটের বেলায় সেটি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কাছ থেকে আমি যে হিসাবটি পেয়েছি, সেটি খুবই ভয়াবহ।
একটি সহজ হিসাব দেখা যাক। সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি বা অনুরূপ কোম্পানিগুলো নিজেদের ১০ শতাংশ লাভ ধরে ১০০ টাকার ব্যান্ডউইডথ বিক্রি করতে পারে ১১০ টাকায়। তার ওপর তাকে ১ শতাংশ রাজস্ব সরকারকে দিতে হয়। বাড়তি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে সেটির বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১২৭ দশমিক ৭৭ টাকা। এই টাকায় ব্যান্ডউইডথ কিনতে পারে কেব্ল ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজি। এখানে ১০ শতাংশ লাভে তাদের মূল্য দাঁড়ায় ১৪০ দশমিক ৫৫ টাকা। আইআইজিকে রাজস্বের ১০ শতাংশ সরকারকে দিয়ে দিতে হয়। সেটি এবং এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে ওই ১০০ টাকার ব্যান্ডউইডথের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১৭৭ দশমিক ৮১ টাকা। এই টাকায় ব্যান্ডউইডথ কেনে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আইএসপি), যারা আপনার-আমার কাছে ইন্টারনেটকে নিয়ে যাচ্ছে। আইএসপি-ওয়ালারাও যদি ১০ শতাংশ লাভ আর ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে, তাহলে ভোক্তা পর্যায়ে ১০০ টাকার ব্যান্ডউইডথের দাম পড়ে যাচ্ছে মাত্র ২২৪ দশমিক ৯৪! অবশ্য আইআইজি এবং আইএসপিগুলো তাদের ভ্যাটের রিবেট পায়, যা একুনে ৩৪ দশমিক ৬৯ টাকা। এই রিবেট বাদ দিলে ২২৪ দশমিক ৯৪ টাকার মধ্যে সরকারের হিস্যা দাঁড়াচ্ছে মোট ৭৬ দশমিক ৩৬ টাকা, যা কিনা ৩৪ শতাংশ। অন্য কথায় বলা যায়, আমাদের যুবাটি ইন্টারনেটের জন্য অহেতুক দ্বিগুণ দামে ইন্টারনেট কিনছে। ১০০০ টাকার ইন্টারনেট বিলের ৩৪০ টাকাই সরকার নিয়ে যাচ্ছে। এবার অর্থমন্ত্রী এই খরচ আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৯০ শতাংশই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সুবিধার আওতায় আছে। মোবাইল-সেবার ওপর ৫ শতাংশ অতিরিক্ত এরই মধ্যে আরোপ হতে শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে একদল যুবা নিজেরাই একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। ফেসবুকে নিজের নেটওয়ার্ক তৈরি করছে ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ নামে, চেষ্টা করছে আত্মকর্মসংস্থানের। কয়েক বছরে এদেরই বিরাট একটা অংশ দেশে চালু করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। ফলে চট্টগ্রামে বসে এখন খুব সহজে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম খাওয়া যাচ্ছে, ঢাকায় বসে পাওয়া যাচ্ছে মংলার গলদা চিংড়ি। কষ্ট করে কেবল একটি ফোন বা একটা ক্লিক করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য সেই খাতে প্রচুর প্রণোদনা দেওয়া হয়। কিন্তু এবারের বাজেটে ই-কমার্সের সব সেবার ওপর ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এখন আপনি যদি বাটার কোনো দোকান থেকে এক জোড়া জুতা কেনেন, তাহলে যত টাকায় সেটা কিনতে পারবেন, ই-কমার্স স্টোর থেকে কিনলে দাম দিতে হবে বেশি!
এই তালিকা আর বাড়াতে চাই না। আমার মনে হয়েছে, আমরা কথায় কথায় আমাদের যুব সম্প্রদায়কে যেভাবে আগামী দিনের মূল চালিকাশক্তি, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রসৈনিক বলি, আদতে সেটা মোটেই বিশ্বাস করি না।
না হলে কথায় আর কাজে এত অমিল কেমনে থাকে?
মুনির হাসান : যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক, প্রথম আলো।
No comments