কাজ কেন জরুরি by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শার্লক
হোমসের একটি পরিচিত মন্তব্য পড়লাম সেদিন একটি প্রবন্ধে। মনে হলো পুরনো
বন্ধুর সঙ্গে দেখা। খুব ভালো লাগল। শার্লক হোমসকে তার সেই বিখ্যাত ও
অত্যন্ত অনুগত এবং কিছুটা বোকা বোকা বন্ধু ডা. ওয়াটসন জিজ্ঞেস করছেন, ‘এখন
তোমার হাতে কী কাজ?’ জবাবে শার্লক হোমস বলছেন, ‘না, কোনো কাজ নেই, দেখছ না
সে জন্য কোকেনের ইনজেকশন নিচ্ছি।’ খুবই নাড়া দেয় এ কথাটা আমাকে, যখনই ভাবি। মানুষকে বলা হয়েছে চিন্তাশীল প্রাণী। গ্রিক দার্শনিকরাই বলেছেন প্রথমে।
কথাটা অবশ্য সত্য, কিন্তু আরো বেশি সত্য বোধহয় এই কথাটা যে, মানুষ একটি
কর্মপ্রিয় প্রাণী। হ্যাঁ, কাজ ইতর প্রাণীও করে বটে, কিন্তু সেসব কাজ থেকে
মানুষের কাজ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কেননা মানুষের সব কাজের পেছনেই চিন্তা
থাকে, এমনকি বোকামির কাজগুলোতেও থাকে সৃষ্টিশীলতা। মানুষের কাজ সৃষ্টিশীল।
পশুর কাজ নয়। ওদিকে চিন্তা মাত্রেই কাজ বটে। অলস চিন্তাও কাজের মধ্যেই পড়ে।
শুয়ে-বসে দিন কাটাই এ কথা বলেন যিনি, এমনকি যদি প্রচণ্ড আত্মসুখের সঙ্গে
বলেন, তবুও নিশ্চিতে বলা যায় যে, তিনি কেবল শোন আর বসেন না। আরো অনেক কিছু
করেন এবং শোয়া-বসাতে এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যখন কাজ পায় না, মানুষ তখন
অকাজ করে। যেমন শার্লক হোমসের মতো জগদ্বিখ্যাত ডিটেকটিভও করেন, কোকেনের
সেবা করেন, কর্মহীন অবস্থায় তিনি আর অতিবুদ্ধিমান মানুষটি থাকেন না।
অতিসামান্য মাদকাসক্ততে পরিণত হয়ে যান, রাস্তাঘাটের যুবকদের মতো।
হোমস আরো বলেছেন ওই সংলাপে, ‘কাজ না থাকলে বেঁচে থাকার কী থাকে। ক্ষমতা থেকে লাভ কী, ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র যদি না পাওয়া যায়।’ খুবই সত্য কথা। মনে কি পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কচের প্রতি দেবযানীর সেই বিখ্যাত অভিশাপ, ‘পারিবে না করিতে প্রয়োগ।’ এ বড়ই নিষ্ঠুর পরিস্থিতি; ক্ষমতা আছে জানি, টেরও পাই, কিন্তু প্রয়োগ করতে পারি না। এর নাম বেকার থাকা। বেগার খাটা তবু সহ্য হয়, কিন্তু বেকার থাকা? একদিন, দু’দিন, দশ দিন, বিশ দিন চলে, কিন্তু যদি হয় অন্তহীন থাকা, তবে? না, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না। তার কর্মপ্রিয়তা এবং সৃষ্টিশীলতা ভেতর থেকে ঠেলাঠেলি করে একটা প্রলয়কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়ে। হয়তো সে কোকেন, হেরোইন এসব ধরে, ঝিমোয়, নয়তো মস্তানি করে। কর্মহীনতা তার মনুষ্যত্বকেই মাটি করে দিতে চায়, একেবারে।
বাংলাদেশে এখন আমরা ওই দশাতেই পড়েছি। ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কর্মশালা’ এ বক্তব্য আমাদের ক্ষেত্রে খুবই সত্য। কিন্তু সেটা কিছুই নয় শার্লক হোমসের পাশে। ‘কাজ না থাকলে কী থাকে ওয়াটসন। বেঁচে থাকার কি অর্থ থাকে?’ শয়তানের কায়কারবার বেশ অশরীরী, সে তুলনায় কোকেনের ইনজেকশন নিজেই নিজের ধমনীতে প্রবেশ করানো অনেক বেশি বাস্তবিক, খুব স্থূলরূপেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। বেকারত্ব মানুষকে আত্মমর্যাদাহীন করে তোলে। আর সৃষ্টিশীলতা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে এবং সেই স্তূপের বোঝা বহন করে সে ক্লান্ত হয়। কেবলই ক্লান্ত হয়। আত্মবিশ্বাস যায় হারিয়ে। পরনির্ভরশীলতা হয়ে পড়ে মজ্জাগত। আর ওই যে দুই বড় বিপদ, মস্তানির ও মাদকাসক্তি তারা তো আছেই রয়েই গেছে।
এসব কথা থাক। মূল কথায় ফেরত যাই। না, আমাদের বড় রাজনৈতিক দল দুটি যে দুর্বৃত্তদের আশকারা দিচ্ছে, সেটা যে শুধু আমি দেখছি না তা নয়। চাওয়ামাত্রই তারা যে মস্তান পেয়ে যায় এবং রাজধানী থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিল, পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত সর্বত্র তাদের কাজে লাগাতে পারে এর কারণ কী সেটা নিয়েই একটু চিন্তিত ছিলাম, এই যা। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের প্রথম দিকেও দেখেছি সরকারি দল (তাদের হাতেই যখন টাকা ছিল) বস্তি থেকে লোক ভাড়া করে এনে মিটিং-মিছিল করত। এখন আর বস্তিতে যেতে হয় না। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব এত বেড়েছে যে এখন মস্তান মাশআল্লাহ যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়। ওই যে যুব কমান্ডের নাম শোনা গিয়েছিল ও শ্রীমানেরা হঠাৎ এলো কোত্থেকে? সন্দেহ নেই এদের অনেকেই এরশাদের আমলে যুব সংহতি করত। কেন করত? না, দরিদ্র ও বেকার বলে। যেদিন জেনারেল (অব.) এরশাদের মুক্তির দাবিতে জাতীয় পার্টি স্বেচ্ছাকারাবরণ কর্মসূচি পালন করেছিল। তাদের কেউ কারাগারে যায়নি, পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেফতার করেনি। তবে হ্যাঁ, বায়তুল মোকাররমে তাদের দলের যুবকরা লুটপাট করেছিল। আসলে এরশাদপ্রীতি নয়, সত্য হলো লুটপাটপ্রীতি। এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা। বেকার যুবক আছে বলেই সন্ত্রাসে লাগানো যাচ্ছে। না থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো হাজার চেষ্টা করলেও তাদের কোথায় পেত?
রাজনৈতিক দল তো বিলেত-আমেরিকাতেও আছে, কই সেখানে তো তারা সন্ত্রাসী যুবকদের এমনভাবে কাজে লাগাতে পারে না অথবা ধরা যাক না কেন, আমাদের বড় দুই দলের নেতারা জাপানে গেলেন চলে (এশিয়ার দেশ বলে)। আইন তো তাদের হাতেই, তাই সেদিক থেকে অসুবিধা থাকবে না, টাকাও থাকবে হাতে (এখন যেমন রয়েছে), তবু কি তারা মস্তান ভাড়া করতে পারবে রাজনীতি করার জন্য? কল্পনা করা যায়? না, পারবে না। পারবে না এই সহজ কারণে যে, কোনো জাপানি যুবকই রাজি হবে না ওইভাবে খুন-জখম হয়ে শেষ হতে। সেখানে এখানকার মতো দারিদ্র্য নেই, এত বেকারও নেই, সেখানে ভাড়া খাটা মস্তান পাওয়া বড়ই কঠিন। সে জন্যই বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, আসল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। অন্য কারণ যে নেই তা নয়, তবে তা প্রধান নয়।
কাজের ব্যাপারটাকে আমরা আমাদের সংস্কৃতিতে তেমন গুরুত্ব দেইনি। ‘কাজের লোক’ বলতে ভৃত্যদের বোঝানো হয়েছে, কাজ তারাই করবে, অন্যরা করবে ভোগ ও উপভোগ। গৌরবের দাবি বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এক সময়ে হতো, মেয়েদের বিয়ের কথাবার্তার ক্ষেত্রে। কাজ জানে না অর্থ কাজ জানার প্রয়োজন পড়েনি। কাজকর্ম যা করার দাস-দাসীরাই করেছে। ভাবটা ছিল এই রকমের। সর্বত্র এতটা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ না পেলেও মনোভাবটা বহু ক্ষেত্রেই বিদ্যমান থাকত। অযোগ্যতা নিয়ে বড়াই চলত, আলস্য আদর্শায়িত হতো। কত কম শ্রমে কত বেশি সাফল্য লাভ হয়েছে এটা হতো গর্ব করার বিষয়। আর মেয়েদের তেমন কোনো কাজই দেয়া সম্ভব হতো না। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ ছিল বিয়ে করা এবং তারপর তথাকথিত ঘরকন্না করা। অত্যন্ত উচ্চমূল্য দেয়া হতো তাদের মাতৃত্বকে। এখনো যে এসব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে তা মোটেই নয়। এখনো মেয়েদের আমরা কাজের মতো কাজ দিতে পারি না। বিপুলসংখ্যক মানুষকে এভাবে কর্মহীন করে রাখা হয়েছে এবং বেকারত্বের যে অভিশাপ তা তাদের এবং তার ফলে গোটা সমাজকে জর্জরিত করছে। মেয়েদের জন্য কাজ যে কত প্রয়োজনীয় গার্মেন্টস শ্রমিকদের দিকে তাকালে তা বোঝা যায়। যে পরিশ্রম তাদের করতে হয় যে কোনো বিচারেই তা অমানবিক। আলোকিত শহরে অন্ধকার চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেন শ্রমিকদের জন্য। কিন্তু তবু গার্মেন্টসের যে কোনো নারী শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করুন, বলবে অতি সামান্য বেতনে এই অমানবিক শ্রম, তবু ভালো গৃহের অভ্যন্তরে দাসিত্বের তুলনায়; কেননা এ কাজ তাকে চলাফেরার কিছুটা হলেও স্বাধীনতা দিয়েছে, সামান্য হলেও কিছু আয় করে নিজের ও অপরের কাছে মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ সে পেয়েছে, অপরের সঙ্গে মেলামেশার একটা ক্ষেত্রও সে লাভ করেছে।
আসলে কাজ খুবই দরকার। কাজ যারা পেয়েছে তারাও অনেকেই পুরোপুরি পায়নি। অর্থাৎ এমন কাজ পায়নি, যা তাদের পূর্ণ সময় ও মনোযোগ দাবি করতে পারে। ওদিকে লাখ লাখ মানুষ দেশে বেকার, যাদের কাজ দেয়া যাচ্ছে না এবং এই বেকারদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, তাদের জন্য নতুন কোনো কাজ তৈরি হচ্ছে না। এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন, বাংলার অর্থনীতিই হচ্ছে বাংলার রাজনীতি। বড়ই সত্য কথা। অর্থনীতি রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয় এবং তাকে এদিকে ঘোরায়, ওদিকে ঘোরায়, দুমড়ে দেয়, মুচড়ে দেয়। অর্থনীতিতে মন্দা ভাব। শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে না। না ওঠার কারণ পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে বাইরে। আরো একটি কারণ দেশীয় পণ্য বাজার পাচ্ছে না। বৈধ পথে কিছুটা, অবৈধ পথে অধিক পরিমাণে বিদেশি পণ্য এসে দেশি পণ্যের বাজার তছনছ করে দিচ্ছে। তদুপরি মানুষের নেই ক্রয়ক্ষমতা।
মূল সমস্যাটা অর্থনৈতিক বটে, কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতিও জড়িত, ওতপ্রোতভাবেই। রাজনীতিকে কেবল অর্থনীতির প্রতিফল ভাবলে ভুল করা হবে। কেননা রাজনীতিও যে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে না, তা নয়। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও নীতি অর্থনীতির ক্ষেত্রে খুবই জরুরি বটে। এই প্রসঙ্গটা সংবেদনশীল একজন পাঠকের চিঠিতেও আছে। তা সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কথা। লিখেছেন, ‘এই বিপর্যয়ে যতটা অপমানিত ও মর্মাহত হয়েছি নৈর্ব্যক্তিক কারণে, এতটা অন্য কোনো কারণে খুব কমই হয়েছি। তবু ভালো, কিছুটা লেখাপড়া ছিল বলে যুক্তি দিয়ে সামলে নিলেও অপমানটা বিঁধছে।’ এখন চতুর্দিকে ওই প্রচণ্ড আওয়াজ সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাই কি? বিপ্লবের আগে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের অবস্থার সঙ্গে পরের অবস্থার তুলনা করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন সমাজতন্ত্র মানুষকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে আর যাই থাক বেকারত্ব ছিল না, ছিল না মুদ্রাস্ফীতি, যে দুই দানব আমাদের মতো গরিব দেশকে আজ উত্ত্যক্ত করে রাখছে। আর কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে তো নয়, পুঁজিবাদী দুনিয়াতেও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ শ্রমজীবী মানুষের জন্য যে ছাড় আদায় করে নিয়েছে তা উপেক্ষা করার বিষয় নয়।
শ্রমিকবহুল পরিবহন ব্যবস্থায় কাজ করেন এমন আমার একজন আত্মীয় সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিল; সমাজতন্ত্র তখন পড়ো পড়ো। তিনি পুঁজিবাদী বিশ্বের শ্রমিক নিয়োগনীতি দেখেছেন, ওখানেও দেখলেন। দেখেন রেলওয়েতে যত লোক লাগে তার চেয়ে বেশি লাগানো রয়েছে। ‘এত লোক কি লাগে?’ জিজ্ঞেস করায় রুশ কর্মকর্তা যে জবাব দিয়েছিলেন সেটা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরের কথা। না, লাগে না। তাহলে রেখেছেন কেন? রেখেছি সামাজিক প্রয়োজনে। এদের ছাঁটাই করে দিলে এরা যাবে কোথায়? খাবে কী? কোথায় দাঁড়াবে ওদের পরিবার? আসল ব্যবধানটা এখানেই। পুঁজিবাদ মুনাফা দেখে, সমাজতন্ত্র দেখে উপকার। দুই দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর ব্যবধান সামান্য নয়, ব্যবধান রাত ও দিনের। রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন আমরা মুনাফার লাইনে চলছি। বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দেয় এই এই খাতে লোক ছাঁটাই কর, তাহলে তোমাদের উন্নতি হবে। কার উন্নতি? কিসের উন্নতি? উন্নতি যা হচ্ছে তা তো দেখতে পাচ্ছি, উন্নতির ধাক্কায় যে যেভাবে পারে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। কর্ম সৃষ্টি না করে উল্টো বেকার সৃষ্টির চেয়ে বড় আত্মঘাতী পদক্ষেপ আবিষ্কার করা আমাদের পক্ষেও কঠিন হবে বৈকি! যেসব প্রশ্নে সরকারের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়ার অধিকার থাকা উচিত আমাদের তার মধ্যে অবশ্যই থাকা দরকার কর্ম সৃষ্টির এই জিজ্ঞাসাটা। এটি প্রধান বিবেচনাগুলোর একটি হওয়া আবশ্যক। যোগ্যতার বিচার কথায় নয় কাজে চাই এবং একটা বড় কাজ হচ্ছে দেশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান করা। সাফল্য ও ব্যর্থতা বিচারের এই নিরিখটাকে উচ্চে তুলে ধরা চাই, বলা চাই, কাজ দিতে হবে; বেকার রাখা চলবে না। একটা কথা বলে শেষ করি, ধর্মঘট ও হরতালকে একমাত্র রাজনৈতিক অস্ত্র করা আর উচিত নয়। নতুন উদ্ভাবন দরকার। কাজ ও চলাচল থামিয়ে রেখে আমরা এগোতে পারব না। পারছিও না।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
হোমস আরো বলেছেন ওই সংলাপে, ‘কাজ না থাকলে বেঁচে থাকার কী থাকে। ক্ষমতা থেকে লাভ কী, ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র যদি না পাওয়া যায়।’ খুবই সত্য কথা। মনে কি পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কচের প্রতি দেবযানীর সেই বিখ্যাত অভিশাপ, ‘পারিবে না করিতে প্রয়োগ।’ এ বড়ই নিষ্ঠুর পরিস্থিতি; ক্ষমতা আছে জানি, টেরও পাই, কিন্তু প্রয়োগ করতে পারি না। এর নাম বেকার থাকা। বেগার খাটা তবু সহ্য হয়, কিন্তু বেকার থাকা? একদিন, দু’দিন, দশ দিন, বিশ দিন চলে, কিন্তু যদি হয় অন্তহীন থাকা, তবে? না, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না। তার কর্মপ্রিয়তা এবং সৃষ্টিশীলতা ভেতর থেকে ঠেলাঠেলি করে একটা প্রলয়কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়ে। হয়তো সে কোকেন, হেরোইন এসব ধরে, ঝিমোয়, নয়তো মস্তানি করে। কর্মহীনতা তার মনুষ্যত্বকেই মাটি করে দিতে চায়, একেবারে।
বাংলাদেশে এখন আমরা ওই দশাতেই পড়েছি। ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কর্মশালা’ এ বক্তব্য আমাদের ক্ষেত্রে খুবই সত্য। কিন্তু সেটা কিছুই নয় শার্লক হোমসের পাশে। ‘কাজ না থাকলে কী থাকে ওয়াটসন। বেঁচে থাকার কি অর্থ থাকে?’ শয়তানের কায়কারবার বেশ অশরীরী, সে তুলনায় কোকেনের ইনজেকশন নিজেই নিজের ধমনীতে প্রবেশ করানো অনেক বেশি বাস্তবিক, খুব স্থূলরূপেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। বেকারত্ব মানুষকে আত্মমর্যাদাহীন করে তোলে। আর সৃষ্টিশীলতা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে এবং সেই স্তূপের বোঝা বহন করে সে ক্লান্ত হয়। কেবলই ক্লান্ত হয়। আত্মবিশ্বাস যায় হারিয়ে। পরনির্ভরশীলতা হয়ে পড়ে মজ্জাগত। আর ওই যে দুই বড় বিপদ, মস্তানির ও মাদকাসক্তি তারা তো আছেই রয়েই গেছে।
এসব কথা থাক। মূল কথায় ফেরত যাই। না, আমাদের বড় রাজনৈতিক দল দুটি যে দুর্বৃত্তদের আশকারা দিচ্ছে, সেটা যে শুধু আমি দেখছি না তা নয়। চাওয়ামাত্রই তারা যে মস্তান পেয়ে যায় এবং রাজধানী থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিল, পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত সর্বত্র তাদের কাজে লাগাতে পারে এর কারণ কী সেটা নিয়েই একটু চিন্তিত ছিলাম, এই যা। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের প্রথম দিকেও দেখেছি সরকারি দল (তাদের হাতেই যখন টাকা ছিল) বস্তি থেকে লোক ভাড়া করে এনে মিটিং-মিছিল করত। এখন আর বস্তিতে যেতে হয় না। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব এত বেড়েছে যে এখন মস্তান মাশআল্লাহ যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়। ওই যে যুব কমান্ডের নাম শোনা গিয়েছিল ও শ্রীমানেরা হঠাৎ এলো কোত্থেকে? সন্দেহ নেই এদের অনেকেই এরশাদের আমলে যুব সংহতি করত। কেন করত? না, দরিদ্র ও বেকার বলে। যেদিন জেনারেল (অব.) এরশাদের মুক্তির দাবিতে জাতীয় পার্টি স্বেচ্ছাকারাবরণ কর্মসূচি পালন করেছিল। তাদের কেউ কারাগারে যায়নি, পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেফতার করেনি। তবে হ্যাঁ, বায়তুল মোকাররমে তাদের দলের যুবকরা লুটপাট করেছিল। আসলে এরশাদপ্রীতি নয়, সত্য হলো লুটপাটপ্রীতি। এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা। বেকার যুবক আছে বলেই সন্ত্রাসে লাগানো যাচ্ছে। না থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো হাজার চেষ্টা করলেও তাদের কোথায় পেত?
রাজনৈতিক দল তো বিলেত-আমেরিকাতেও আছে, কই সেখানে তো তারা সন্ত্রাসী যুবকদের এমনভাবে কাজে লাগাতে পারে না অথবা ধরা যাক না কেন, আমাদের বড় দুই দলের নেতারা জাপানে গেলেন চলে (এশিয়ার দেশ বলে)। আইন তো তাদের হাতেই, তাই সেদিক থেকে অসুবিধা থাকবে না, টাকাও থাকবে হাতে (এখন যেমন রয়েছে), তবু কি তারা মস্তান ভাড়া করতে পারবে রাজনীতি করার জন্য? কল্পনা করা যায়? না, পারবে না। পারবে না এই সহজ কারণে যে, কোনো জাপানি যুবকই রাজি হবে না ওইভাবে খুন-জখম হয়ে শেষ হতে। সেখানে এখানকার মতো দারিদ্র্য নেই, এত বেকারও নেই, সেখানে ভাড়া খাটা মস্তান পাওয়া বড়ই কঠিন। সে জন্যই বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, আসল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। অন্য কারণ যে নেই তা নয়, তবে তা প্রধান নয়।
কাজের ব্যাপারটাকে আমরা আমাদের সংস্কৃতিতে তেমন গুরুত্ব দেইনি। ‘কাজের লোক’ বলতে ভৃত্যদের বোঝানো হয়েছে, কাজ তারাই করবে, অন্যরা করবে ভোগ ও উপভোগ। গৌরবের দাবি বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এক সময়ে হতো, মেয়েদের বিয়ের কথাবার্তার ক্ষেত্রে। কাজ জানে না অর্থ কাজ জানার প্রয়োজন পড়েনি। কাজকর্ম যা করার দাস-দাসীরাই করেছে। ভাবটা ছিল এই রকমের। সর্বত্র এতটা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ না পেলেও মনোভাবটা বহু ক্ষেত্রেই বিদ্যমান থাকত। অযোগ্যতা নিয়ে বড়াই চলত, আলস্য আদর্শায়িত হতো। কত কম শ্রমে কত বেশি সাফল্য লাভ হয়েছে এটা হতো গর্ব করার বিষয়। আর মেয়েদের তেমন কোনো কাজই দেয়া সম্ভব হতো না। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ ছিল বিয়ে করা এবং তারপর তথাকথিত ঘরকন্না করা। অত্যন্ত উচ্চমূল্য দেয়া হতো তাদের মাতৃত্বকে। এখনো যে এসব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে তা মোটেই নয়। এখনো মেয়েদের আমরা কাজের মতো কাজ দিতে পারি না। বিপুলসংখ্যক মানুষকে এভাবে কর্মহীন করে রাখা হয়েছে এবং বেকারত্বের যে অভিশাপ তা তাদের এবং তার ফলে গোটা সমাজকে জর্জরিত করছে। মেয়েদের জন্য কাজ যে কত প্রয়োজনীয় গার্মেন্টস শ্রমিকদের দিকে তাকালে তা বোঝা যায়। যে পরিশ্রম তাদের করতে হয় যে কোনো বিচারেই তা অমানবিক। আলোকিত শহরে অন্ধকার চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেন শ্রমিকদের জন্য। কিন্তু তবু গার্মেন্টসের যে কোনো নারী শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করুন, বলবে অতি সামান্য বেতনে এই অমানবিক শ্রম, তবু ভালো গৃহের অভ্যন্তরে দাসিত্বের তুলনায়; কেননা এ কাজ তাকে চলাফেরার কিছুটা হলেও স্বাধীনতা দিয়েছে, সামান্য হলেও কিছু আয় করে নিজের ও অপরের কাছে মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ সে পেয়েছে, অপরের সঙ্গে মেলামেশার একটা ক্ষেত্রও সে লাভ করেছে।
আসলে কাজ খুবই দরকার। কাজ যারা পেয়েছে তারাও অনেকেই পুরোপুরি পায়নি। অর্থাৎ এমন কাজ পায়নি, যা তাদের পূর্ণ সময় ও মনোযোগ দাবি করতে পারে। ওদিকে লাখ লাখ মানুষ দেশে বেকার, যাদের কাজ দেয়া যাচ্ছে না এবং এই বেকারদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, তাদের জন্য নতুন কোনো কাজ তৈরি হচ্ছে না। এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন, বাংলার অর্থনীতিই হচ্ছে বাংলার রাজনীতি। বড়ই সত্য কথা। অর্থনীতি রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয় এবং তাকে এদিকে ঘোরায়, ওদিকে ঘোরায়, দুমড়ে দেয়, মুচড়ে দেয়। অর্থনীতিতে মন্দা ভাব। শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে না। না ওঠার কারণ পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে বাইরে। আরো একটি কারণ দেশীয় পণ্য বাজার পাচ্ছে না। বৈধ পথে কিছুটা, অবৈধ পথে অধিক পরিমাণে বিদেশি পণ্য এসে দেশি পণ্যের বাজার তছনছ করে দিচ্ছে। তদুপরি মানুষের নেই ক্রয়ক্ষমতা।
মূল সমস্যাটা অর্থনৈতিক বটে, কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতিও জড়িত, ওতপ্রোতভাবেই। রাজনীতিকে কেবল অর্থনীতির প্রতিফল ভাবলে ভুল করা হবে। কেননা রাজনীতিও যে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে না, তা নয়। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও নীতি অর্থনীতির ক্ষেত্রে খুবই জরুরি বটে। এই প্রসঙ্গটা সংবেদনশীল একজন পাঠকের চিঠিতেও আছে। তা সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কথা। লিখেছেন, ‘এই বিপর্যয়ে যতটা অপমানিত ও মর্মাহত হয়েছি নৈর্ব্যক্তিক কারণে, এতটা অন্য কোনো কারণে খুব কমই হয়েছি। তবু ভালো, কিছুটা লেখাপড়া ছিল বলে যুক্তি দিয়ে সামলে নিলেও অপমানটা বিঁধছে।’ এখন চতুর্দিকে ওই প্রচণ্ড আওয়াজ সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাই কি? বিপ্লবের আগে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের অবস্থার সঙ্গে পরের অবস্থার তুলনা করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন সমাজতন্ত্র মানুষকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে আর যাই থাক বেকারত্ব ছিল না, ছিল না মুদ্রাস্ফীতি, যে দুই দানব আমাদের মতো গরিব দেশকে আজ উত্ত্যক্ত করে রাখছে। আর কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে তো নয়, পুঁজিবাদী দুনিয়াতেও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ শ্রমজীবী মানুষের জন্য যে ছাড় আদায় করে নিয়েছে তা উপেক্ষা করার বিষয় নয়।
শ্রমিকবহুল পরিবহন ব্যবস্থায় কাজ করেন এমন আমার একজন আত্মীয় সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিল; সমাজতন্ত্র তখন পড়ো পড়ো। তিনি পুঁজিবাদী বিশ্বের শ্রমিক নিয়োগনীতি দেখেছেন, ওখানেও দেখলেন। দেখেন রেলওয়েতে যত লোক লাগে তার চেয়ে বেশি লাগানো রয়েছে। ‘এত লোক কি লাগে?’ জিজ্ঞেস করায় রুশ কর্মকর্তা যে জবাব দিয়েছিলেন সেটা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরের কথা। না, লাগে না। তাহলে রেখেছেন কেন? রেখেছি সামাজিক প্রয়োজনে। এদের ছাঁটাই করে দিলে এরা যাবে কোথায়? খাবে কী? কোথায় দাঁড়াবে ওদের পরিবার? আসল ব্যবধানটা এখানেই। পুঁজিবাদ মুনাফা দেখে, সমাজতন্ত্র দেখে উপকার। দুই দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর ব্যবধান সামান্য নয়, ব্যবধান রাত ও দিনের। রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন আমরা মুনাফার লাইনে চলছি। বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দেয় এই এই খাতে লোক ছাঁটাই কর, তাহলে তোমাদের উন্নতি হবে। কার উন্নতি? কিসের উন্নতি? উন্নতি যা হচ্ছে তা তো দেখতে পাচ্ছি, উন্নতির ধাক্কায় যে যেভাবে পারে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। কর্ম সৃষ্টি না করে উল্টো বেকার সৃষ্টির চেয়ে বড় আত্মঘাতী পদক্ষেপ আবিষ্কার করা আমাদের পক্ষেও কঠিন হবে বৈকি! যেসব প্রশ্নে সরকারের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়ার অধিকার থাকা উচিত আমাদের তার মধ্যে অবশ্যই থাকা দরকার কর্ম সৃষ্টির এই জিজ্ঞাসাটা। এটি প্রধান বিবেচনাগুলোর একটি হওয়া আবশ্যক। যোগ্যতার বিচার কথায় নয় কাজে চাই এবং একটা বড় কাজ হচ্ছে দেশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান করা। সাফল্য ও ব্যর্থতা বিচারের এই নিরিখটাকে উচ্চে তুলে ধরা চাই, বলা চাই, কাজ দিতে হবে; বেকার রাখা চলবে না। একটা কথা বলে শেষ করি, ধর্মঘট ও হরতালকে একমাত্র রাজনৈতিক অস্ত্র করা আর উচিত নয়। নতুন উদ্ভাবন দরকার। কাজ ও চলাচল থামিয়ে রেখে আমরা এগোতে পারব না। পারছিও না।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments