নূর হোসেনে আটকে আছে সাত খুনের বিচার! by সোহরাব হাসান
তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু মাত্র এক বছর। একবিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু যে আরও কম, তা উপলব্ধি করলাম গত শনিবার নারায়ণগঞ্জে গিয়ে। গত এপ্রিলের শেষ দিনে যখন নারায়ণগঞ্জে যাই, সর্বত্র ছিল শোকের আবহ। সাত খুনের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ তো বটেই, গোটা দেশ তোলপাড়। বিচারের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ মিছিল-সমাবেশ-মানববন্ধন করছেন। স্লোগান দিচ্ছেন, ঘাতকদের ফাঁসি চাই। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা ছুটে যাচ্ছেন শোকসন্তপ্ত স্বজনদের কাছে। গণমাধ্যমের কর্মীরা ভিড় করছেন ডিসি-এসপির অফিসে, আদালত চত্বরে—যদি নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায়। ছয় মাস পর যেন সবকিছু স্তিমিত হয়ে আসছে। সময় ও জীবনের দাবি শোককে ভুলিয়ে দিয়েছে। সাইনবোর্ড মোড় থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ সড়কের দুপাশে টানানো ব্যানারগুলো মলিন। পোস্টারগুলো বিবর্ণ। শনিবার বিকেলে প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি আসিফ হোসেনকে নিয়ে আমরা যখন মিজমিজি উচ্চবিদ্যালয়ে পৌঁছাই, সবকিছু স্বাভাবিক লক্ষ করি। স্কুলের গেটে কাউন্সিলর নজরুল হত্যার বিচারের দাবি–সংবলিত একটি ব্যানার ঝুলছে। ভেতরে ভোটার আইডি কার্ড তৈরি ও নবায়নের কাজ চলছে। কিছুক্ষণ পর নজরুলের স্ত্রী কাউন্সিলর সেলিনা ইসলাম এলেন। সালোয়ার–কামিজের ওপর কালো বোরকা পরা ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হলো, তিনি একাই স্বামীর শোক ধারণ করে আছেন। সাত খুনের বিচারের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী, জানতে চাইলে তিনি কিছুটা হতাশার সুরে বললেন, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আগে তদন্ত কর্মকর্তারা বলতেন, শিগগিরই নিয়ে আসা হবে। এখন বলছেন, আনার চেষ্টা হচ্ছে। তাঁকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত বিচার হবে না বলে মনে করেন তিনি। সেখানে উপস্থিত নজরুলের অনুসারী আওয়ামী লীগের একাধিক কর্মী জানালেন, র্যাবের সদস্যদের বাইরে কোনো আসামিকে ধরার চেষ্টা করছে না পুলিশ। এমনকি আসামিদের বাড়িতে কোনো অভিযানও চালানো হয়নি। পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ ঈদের সময় আত্মীয়স্বজন এলাকায় এসে আসামিদের নামে কোরবানি দিয়ে চলে গেছেন। নজরুলের অনুসারীদের ধারণা, আসামিরা আশপাশে কিংবা ঢাকার কোথাও আত্মগোপন করে আছে।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালত ভবন থেকে বাড়ি ফেরার পথে র্যাব পরিচয়ে কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। সেদিনই নূর হোসেন, ইয়াসিন, হাসমত আসমত আলী, আমিনুল ইসলাম, ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেনকে আসামি করে মামলা করেন নজরুলের স্ত্রী। এজাহারে তিনি র্যাবের পরিচয়ে তাঁদের অপহরণ করা হয়েছে বললেও পরে প্রমাণিত হয় যে নূর হোসেনের প্ররোচনায় র্যাব-১১–এর সদস্যরাই তাঁদের অপহরণ ও হত্যা করেন। আলাপকালে সেলিনা আরও বললেন, আসামিদের অনুসারীরা মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। নূর হোসেনের অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য যারা দেখত, তারা ফের এলাকায় ফিরে আসছে। এ অবস্থায় তিনিও ভয়ে আছেন। আমরা যখন স্কুলের একটি কক্ষে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখনো মামলার দুই নম্বর আসামি ইয়াসিনের লোক মাঠে ঘেরাফেরা করছিল, জানালেন আওয়ামী লীগেরই স্থানীয় এক কর্মী।
কোনো মৃত্যুই জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারে না। সেলিনা ইসলামের জীবনও থেমে নেই। নজরুলের শূন্য পদে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় ঢাকার একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে। চন্দন সরকারের পরিবারের বিষয়টি নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা নিজেদের বিষয় হিসেবে নিয়েছেন। জানতে চাই, অপর পাঁচ পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন। জবাবে সেলিনা বললেন, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের পরিবার। জাহাঙ্গীর মারা যাওয়ার পর ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী নিরুপায়। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে গেছেন। একইভাবে বিপদাপন্ন আওয়ামী লীগের কর্মী স্বপনের পরিবারও। এখন পর্যন্ত সরকার বা কোনো সংগঠন তাদের কোনো সহায়তা করেনি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু সহায্য দিয়েছেন।
ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নিজে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। বিএনপির নেত্রী পাশে থাকার কথা বলেছেন। তার পরও সেলিনা বিচারের ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারছেন না। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, বাংলাদেশে কয়টা হত্যার বিচার হয়? এ প্রশ্ন শুধু নজরুলের স্ত্রীর নয়, এ প্রশ্ন প্রতিটি স্বজনহারার। ছয় মাস আগে যখন সাত হত্যার ঘটনা ঘটে, তখন পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। এর পরও নানা অঘটন ঘটেছে। সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন যাঁর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছেন, সেই নাসিম ওসমান মারা গেছেন গত এপ্রিলে। তাঁর শূন্য আসনে নির্বাচিত হয়েছেন ছোট ভাই সেলিম ওসমান। সেই নির্বাচনেও চলেছে অপতৎপরতা। সেলিম ওসমানের পক্ষে আবদুস সালাম নামে একজন ইউপি চেয়ারম্যান বন্দর থানার মদনপুরের একটি কেন্দ্র দখল করতে গেলে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা এএসপি মোহাম্মদ বশিরউদ্দিন বাধা দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাংসদ শামীম ওসমান তাঁকে গালাগাল করেন, যা টিভি-পত্রিকার কল্যাণে সবাই দেখেছেন ও শুনেছেন। সেই পুলিশ কর্মকর্তাই সাত খুনের ঘটনার পর নগর ভবনের সামনে থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উঠিয়ে দিয়ে প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাঁচ মাস সেটি ধরে রাখতে পারলেও সম্প্রতি আবার সেখানে ট্রাকস্ট্যান্ড বসিয়ে চাঁদাবাজি চলছে। এখানে দিনে কমপক্ষে তিন লাখ টাকার চাঁদা তোলা হয়।
এ কথা ঠিক, সাত হত্যার পর নারায়ণগঞ্জে মোটামুটি শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়, এমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু মানুষের মনের শঙ্কা যায় না, ভয় কাটে না। যে অপরাজনীতি নূর হোসেনের মতো দানব গড়ে তোলেন, যে অপরাজনীতি সাতটি মানুষকে দিনে দুপুরে হত্যা করে, সেই অপরাজনীতি পুরোপুরিই বহাল আছে। আছে চাঁদাবাজি, দখলবাজিও। সাত খুনের আগে নূর হোসেন সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথের (সওজ) জায়গা দখল করে চাঁদাবাজি করছিলেন, এখন অন্যরা একই কাজ করছেন। আর গডফাদারদের দৌরাত্ম্যও বেড়েছে, বৈ কমেনি। নারায়ণগঞ্জের একজন স্থানীয় সাংবাদিক বললেন, আগের সংঘটিত হত্যাগুলো বন্ধ করতে পারলে হয়তো ২০১৩ সালের ত্বকী হত্যার ঘটনা ঘটত না। আবার ত্বকী হত্যার বিচার হলে হয়তো সাত খুনের ঘটনা এড়ানো যেত। একটি হত্যা আরেকটি হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে। আবার একটি হত্যার অপরাধীদের আড়াল করতে আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, যাতে আগেরটির কথা মানুষ ভুলে যায়। সাত খুনের ঘটনা কিসের ইঙ্গিত দেয়?
সাত খুনের কারণ, পটভূমি এবং এর সামনের ও নেপথ্যের হোতাদের নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এখন বড় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, এই বিচার হবে কি না। অপরাধীরা শাস্তি পাবে কি না। সাত খুনের ঘটনায় যেভাবে আবেগ ও আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তাতে অনেকের মনে আশা জেগেছিল, হত্যার বিচার হবে। কিন্তু বিচারের প্রক্রিয়া প্রথমেই হোঁচট খেল এফআইআর ও এক নম্বর তালিকাভুক্ত আসামি নূর হোসেনের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায়। সাত হত্যার ঘটনা ঘটে ২৭ এপ্রিল অপরাহ্ণ আড়াইটা-তিনটার মধ্যে। এরপর তিন দিন পুলিশ পুরোপুরি নীরব ছিল। যেদিন তারা নূর হোসেনের বাড়িতে তল্লাশি চালায়, তার আগেই তিনি ভারতে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে তিনি যে নারায়ণগঞ্জ-৪-এর সাংসদ শামীম ওসমানের আশীর্বাদ ও পরামর্শ নিয়ে গেছেন, সেই খবরও সবার জানা। তবে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের কর্মকর্তারা মনে করেন, নূর হোসেন পালিয়ে গেলেও মামলা সঠিক খাতেই প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁদের আশা, সাত হত্যার বিচার হবে এবং অপরাধীরাও শাস্তি পাবে। কীভাবে এতটা নিশ্চিত হলেন? এ প্রশ্নের জবাবে একজন কর্মকর্তা বললেন, যেখানে ১২ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন; তাঁদের বাইরেও অনেকের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, সেখানে অপরাধীদের রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, তদন্তের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। এমনকি আভাসে-ইঙ্গিতেও কেউ কিছু তাঁদের বলেননি।
সাত খুনের মামলার তদন্ত তদারকের দায়িত্বে যিনি আছেন; তিনিই নরসিংদীর লোকমান হত্যা মামলার তদন্তকাজেরও তদারকের দায়িেত্ব ছিলেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদন নির্ভুল বলেই দাবি করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তাই আশা করা যায়, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনারও ঠিকঠাক তদন্ত হবে। তবে তদন্ত সঠিক হলেই যে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে, তা হলফ করে বলা যায় না। এর পর আছে সাক্ষ্য, সওয়াল–জওয়াব, আপিল ইত্যাদি। তাই, নীতিনির্ধারকদের অভয়বাণী কিংবা পুলিশের কর্মকর্তাদের আশ্বাস সত্ত্বেও নিহতদের পরিবার তথা নারায়ণগঞ্জবাসী পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না। তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের এক কর্মকর্তা জানালেন, সাত খুনের ঘটনা তাঁদের কাছে যেমন নতুন অভিজ্ঞতা, তেমনি চ্যালেঞ্জও। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তঁারা প্রস্তুত আছেন। তবে পুলিশের কর্মকর্তারা যা-ই বলুন না কেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করে, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার ওপরই এ মামলার চূড়ান্ত পরিণতি নির্ভর করছে। সরকার প্রথম দিকে নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যত তৎপর ছিল, এখন মনে হচ্ছে তাতে ভাটা পড়েছে। নানা ধরনের গুজব শোনা যাচ্ছে। প্রভাবশালী মহলের কেউ কেউ নূর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে সাত খুনের মামলাও ঝুলে থাকবে। অপরাধীরা শাস্তি পাবে না। সরকার চাইলেই তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি হয় ২০১২ সালে। চুক্তির আগেই যদি অরবিন্দ বাজখোয়াসহ দুর্ধর্ষ উলফা নেতাদের বাংলাদেশ ভারতের হাতে তুলে দিতে পারে, পুঁচকে নূর হোসেনকে কেন ভারত বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে পারবে না? ভারত সরকার চেয়েছিল বলেই বাজখোয়াকে সে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নূর হোসেনকে বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে আনতে চায় কি না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালত ভবন থেকে বাড়ি ফেরার পথে র্যাব পরিচয়ে কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। সেদিনই নূর হোসেন, ইয়াসিন, হাসমত আসমত আলী, আমিনুল ইসলাম, ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেনকে আসামি করে মামলা করেন নজরুলের স্ত্রী। এজাহারে তিনি র্যাবের পরিচয়ে তাঁদের অপহরণ করা হয়েছে বললেও পরে প্রমাণিত হয় যে নূর হোসেনের প্ররোচনায় র্যাব-১১–এর সদস্যরাই তাঁদের অপহরণ ও হত্যা করেন। আলাপকালে সেলিনা আরও বললেন, আসামিদের অনুসারীরা মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। নূর হোসেনের অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য যারা দেখত, তারা ফের এলাকায় ফিরে আসছে। এ অবস্থায় তিনিও ভয়ে আছেন। আমরা যখন স্কুলের একটি কক্ষে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখনো মামলার দুই নম্বর আসামি ইয়াসিনের লোক মাঠে ঘেরাফেরা করছিল, জানালেন আওয়ামী লীগেরই স্থানীয় এক কর্মী।
কোনো মৃত্যুই জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারে না। সেলিনা ইসলামের জীবনও থেমে নেই। নজরুলের শূন্য পদে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় ঢাকার একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে। চন্দন সরকারের পরিবারের বিষয়টি নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা নিজেদের বিষয় হিসেবে নিয়েছেন। জানতে চাই, অপর পাঁচ পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন। জবাবে সেলিনা বললেন, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের পরিবার। জাহাঙ্গীর মারা যাওয়ার পর ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী নিরুপায়। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে গেছেন। একইভাবে বিপদাপন্ন আওয়ামী লীগের কর্মী স্বপনের পরিবারও। এখন পর্যন্ত সরকার বা কোনো সংগঠন তাদের কোনো সহায়তা করেনি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু সহায্য দিয়েছেন।
ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নিজে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। বিএনপির নেত্রী পাশে থাকার কথা বলেছেন। তার পরও সেলিনা বিচারের ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারছেন না। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, বাংলাদেশে কয়টা হত্যার বিচার হয়? এ প্রশ্ন শুধু নজরুলের স্ত্রীর নয়, এ প্রশ্ন প্রতিটি স্বজনহারার। ছয় মাস আগে যখন সাত হত্যার ঘটনা ঘটে, তখন পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। এর পরও নানা অঘটন ঘটেছে। সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন যাঁর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছেন, সেই নাসিম ওসমান মারা গেছেন গত এপ্রিলে। তাঁর শূন্য আসনে নির্বাচিত হয়েছেন ছোট ভাই সেলিম ওসমান। সেই নির্বাচনেও চলেছে অপতৎপরতা। সেলিম ওসমানের পক্ষে আবদুস সালাম নামে একজন ইউপি চেয়ারম্যান বন্দর থানার মদনপুরের একটি কেন্দ্র দখল করতে গেলে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা এএসপি মোহাম্মদ বশিরউদ্দিন বাধা দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাংসদ শামীম ওসমান তাঁকে গালাগাল করেন, যা টিভি-পত্রিকার কল্যাণে সবাই দেখেছেন ও শুনেছেন। সেই পুলিশ কর্মকর্তাই সাত খুনের ঘটনার পর নগর ভবনের সামনে থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উঠিয়ে দিয়ে প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাঁচ মাস সেটি ধরে রাখতে পারলেও সম্প্রতি আবার সেখানে ট্রাকস্ট্যান্ড বসিয়ে চাঁদাবাজি চলছে। এখানে দিনে কমপক্ষে তিন লাখ টাকার চাঁদা তোলা হয়।
এ কথা ঠিক, সাত হত্যার পর নারায়ণগঞ্জে মোটামুটি শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়, এমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু মানুষের মনের শঙ্কা যায় না, ভয় কাটে না। যে অপরাজনীতি নূর হোসেনের মতো দানব গড়ে তোলেন, যে অপরাজনীতি সাতটি মানুষকে দিনে দুপুরে হত্যা করে, সেই অপরাজনীতি পুরোপুরিই বহাল আছে। আছে চাঁদাবাজি, দখলবাজিও। সাত খুনের আগে নূর হোসেন সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথের (সওজ) জায়গা দখল করে চাঁদাবাজি করছিলেন, এখন অন্যরা একই কাজ করছেন। আর গডফাদারদের দৌরাত্ম্যও বেড়েছে, বৈ কমেনি। নারায়ণগঞ্জের একজন স্থানীয় সাংবাদিক বললেন, আগের সংঘটিত হত্যাগুলো বন্ধ করতে পারলে হয়তো ২০১৩ সালের ত্বকী হত্যার ঘটনা ঘটত না। আবার ত্বকী হত্যার বিচার হলে হয়তো সাত খুনের ঘটনা এড়ানো যেত। একটি হত্যা আরেকটি হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে। আবার একটি হত্যার অপরাধীদের আড়াল করতে আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, যাতে আগেরটির কথা মানুষ ভুলে যায়। সাত খুনের ঘটনা কিসের ইঙ্গিত দেয়?
সাত খুনের কারণ, পটভূমি এবং এর সামনের ও নেপথ্যের হোতাদের নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এখন বড় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, এই বিচার হবে কি না। অপরাধীরা শাস্তি পাবে কি না। সাত খুনের ঘটনায় যেভাবে আবেগ ও আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তাতে অনেকের মনে আশা জেগেছিল, হত্যার বিচার হবে। কিন্তু বিচারের প্রক্রিয়া প্রথমেই হোঁচট খেল এফআইআর ও এক নম্বর তালিকাভুক্ত আসামি নূর হোসেনের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায়। সাত হত্যার ঘটনা ঘটে ২৭ এপ্রিল অপরাহ্ণ আড়াইটা-তিনটার মধ্যে। এরপর তিন দিন পুলিশ পুরোপুরি নীরব ছিল। যেদিন তারা নূর হোসেনের বাড়িতে তল্লাশি চালায়, তার আগেই তিনি ভারতে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে তিনি যে নারায়ণগঞ্জ-৪-এর সাংসদ শামীম ওসমানের আশীর্বাদ ও পরামর্শ নিয়ে গেছেন, সেই খবরও সবার জানা। তবে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের কর্মকর্তারা মনে করেন, নূর হোসেন পালিয়ে গেলেও মামলা সঠিক খাতেই প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁদের আশা, সাত হত্যার বিচার হবে এবং অপরাধীরাও শাস্তি পাবে। কীভাবে এতটা নিশ্চিত হলেন? এ প্রশ্নের জবাবে একজন কর্মকর্তা বললেন, যেখানে ১২ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন; তাঁদের বাইরেও অনেকের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, সেখানে অপরাধীদের রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, তদন্তের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। এমনকি আভাসে-ইঙ্গিতেও কেউ কিছু তাঁদের বলেননি।
সাত খুনের মামলার তদন্ত তদারকের দায়িত্বে যিনি আছেন; তিনিই নরসিংদীর লোকমান হত্যা মামলার তদন্তকাজেরও তদারকের দায়িেত্ব ছিলেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদন নির্ভুল বলেই দাবি করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তাই আশা করা যায়, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনারও ঠিকঠাক তদন্ত হবে। তবে তদন্ত সঠিক হলেই যে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে, তা হলফ করে বলা যায় না। এর পর আছে সাক্ষ্য, সওয়াল–জওয়াব, আপিল ইত্যাদি। তাই, নীতিনির্ধারকদের অভয়বাণী কিংবা পুলিশের কর্মকর্তাদের আশ্বাস সত্ত্বেও নিহতদের পরিবার তথা নারায়ণগঞ্জবাসী পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না। তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের এক কর্মকর্তা জানালেন, সাত খুনের ঘটনা তাঁদের কাছে যেমন নতুন অভিজ্ঞতা, তেমনি চ্যালেঞ্জও। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তঁারা প্রস্তুত আছেন। তবে পুলিশের কর্মকর্তারা যা-ই বলুন না কেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করে, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার ওপরই এ মামলার চূড়ান্ত পরিণতি নির্ভর করছে। সরকার প্রথম দিকে নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যত তৎপর ছিল, এখন মনে হচ্ছে তাতে ভাটা পড়েছে। নানা ধরনের গুজব শোনা যাচ্ছে। প্রভাবশালী মহলের কেউ কেউ নূর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে সাত খুনের মামলাও ঝুলে থাকবে। অপরাধীরা শাস্তি পাবে না। সরকার চাইলেই তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি হয় ২০১২ সালে। চুক্তির আগেই যদি অরবিন্দ বাজখোয়াসহ দুর্ধর্ষ উলফা নেতাদের বাংলাদেশ ভারতের হাতে তুলে দিতে পারে, পুঁচকে নূর হোসেনকে কেন ভারত বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে পারবে না? ভারত সরকার চেয়েছিল বলেই বাজখোয়াকে সে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নূর হোসেনকে বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে আনতে চায় কি না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
No comments